যখন এসেছিলে অন্ধকারে
৬।
অনি কী করবে বুঝতে পারছে না। ইমরানের যা যা করেছে ওর সাথে, তাতে ও বিব্রত হয়েছে, দেরিতে হলেও অপমানিত বোধ করছে এখন।
আর ইমরানও ভয়ে ভয়ে আছে, কোনোভাবে ওর সংকল্প না টলে যায়। ও ভেবে দেখেছে, ইমা যা বলেছে তাই সঠিক।
আসলেই অনির কাছে মন আটকে গেছে ওর। গতদুইদিন সারারাত জেগে ও অনির নিঃশ্বাস গুণেছে।
মাঝে মাঝেই খেয়াল জেগেছে, সব বাদ দিয়ে অনির হৃদয়ের স্পন্দন গুণতে, মিনিটে কতগুলো বিট পড়ে নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে।
প্রাণপণে নিজেকে আটকেছে সেইসব ভয়ংকর ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার থেকে।
সাইদা চলে যাওয়ার পরে ইমরান তাই তাকালো না অনির চোখে আর অনিও এড়িয়ে গেল ওকে।
আর তো কয়েকটা ঘন্টা মাত্র। দুজনের মনের ভেতরেই কয়েকটা ঘন্টার অপেক্ষা এখন। ইমরান অপেক্ষা করছে, কখন এই টেনে নেওয়া চোরাবালি থেকে দূরে সরবে ও আর অনি অপেক্ষা করে আছে নিজের মুক্ত হওয়ার গল্পটা সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য।
*****
শেষ কয়েকটা দিন ছেলের কাছাকাছি থাকার ইচ্ছে থাকলেও নিজের অদম্য স্নেহকে দমিয়ে রেখেছিলেন সাইদা, ইমরান আর অনিকে একান্ত সান্নিধ্যে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতে। তা যে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে সেই সংবাদ ভদ্রমহিলা না পেলেও শেষ কয়েকটা ঘন্টা পুত্রের কাছ থেকে নড়লেন না।
অজস্র চুমু দিয়ে ইমরানকে বিব্রত করলেন, এয়ারপোর্টে গিয়েও কেঁদেকেঁদে কয়েকবার মুর্ছা গেলেন। বারবার কথা আদায় করে নিলেন, খুব তাড়াতাড়ি যেন ফিরে আসে।
সুমনাও ইমরানকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু সুযোগ পেলেন না। পরশ এগিয়ে গিয়ে আলিঙ্গন করল ইমরানের সাথে। কাছাকাছি বয়স দুজনের। প্রথমদিন হাল্কা কথাবার্তা হলেও সংকোচে দুজন দুজনের সাথে আর মেলামেশা হয়নি।
ইমরানকে তো একেবারেই বোবাদের দলেই ফেলে দেওয়া যায়। আর ইমরানের চোখে বিয়েবিতৃষ্ণাটা যেন পরিস্কার দেখতে পেত পরশ।
আবার আত্মিয়বাড়ি, এখানে ভগ্নীজামাতা নিজে এগিয়ে না এলে তার সাথে যেচে কথা বলাটা যথেষ্ট সংকোচের।
সেই দিক থেকে ইকরামের সাথে একটা দারুণ সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে পরশের। বেয়াই-বেয়াই ঠাট্টা-তামাশা থেকে হৃদ্যতায় গড়িয়েছে। আব্দুল মজিদ সাহেবও খুব সুহৃদ আর আন্তরিক। আর ইমা, দুদিনেই ওর পছন্দের মানুষের তালিকায় ঢুকে গেছে। মেহমানদারিতে এতটা আন্তরিক, পরশ যে অনির ভাই, সেটা যেন বোঝায় যায় না ইমার আচরণে। ইমরান বা ইকরামের মতো পরশও যেন এই ঘরেরই ছেলে, ইমার আরেকটা ভাই।
এই পরিবারটাকেও দারুণ লাগলেও সাইদা আর ইমরানকেই কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না পরশ। সাইদাকে ওর ভীষণ স্বার্থপর আর দাম্ভিক মনে হয় আর ইমরানকে দেখলেই অস্বস্তি হয়।
আজকে ঠিক যাওয়ার আগমূহুর্তে ও সব সংকোচ দূরে রেখে এগিয়ে গেল।
বোনের ভাই হওয়াটা সবচেয়ে কষ্টের, অপছন্দের মানুষটাকেও ভালোবাসতে হয়, নিদেনপক্ষে ভালোবাসার অভিনয় করতে হয়। আলিঙ্গনে বেঁধে পরশ ইমরানকে বলল ‘ভাই, অনি কোনো ভুলভ্রান্তি করলে মাফ করে দিয়েন, মনে কষ্ট রাখবেন না।’
ইমরান শুধু আস্তে করে বলল ‘না, না, না। অনি কোনো দোষ করেনি তো! মাফ করার প্রসঙ্গ কেন আসছে?’
‘ছোটোমানুষ তো? সবকিছু বুঝতে পারে না। আস্তে আস্তে বুদ্ধিসুদ্ধি হয়ে যাবে।’
‘ছোটোমানুষ জানেন যখন বিয়ে দিলেন কেন?’
বোনের জন্য স্নেহ আছে সীমানা ছাড়িয়ে কিন্তু অভিভাবকসুলভ অভিজ্ঞতাতে একেবারেই আনাড়ি পরশ। হঠাৎ করে বুঝতে পারল না, ইমরান অভিযোগ করল নাকি শ্লেষ!
প্রসঙ্গ পালটে তাড়াতাড়ি বলল ‘সাবধানে যাবেন ভাই। আল্লাহ ভরসা।’
‘আচ্ছা, দোয়া করবেন আমার জন্য।’ ইমরানও এড়িয়ে গেল পরশকে।
সাইদা আবার চোখ মুছতে মুছতে ইমরানকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘আব্বা, আল্লাহ হাজির নাজির। আল্লাহর নামে সঁপে দিলাম। আব্বা, প্রতিদিন একবার ফোন কোরো কিন্তু।’
‘প্রতিদিন কি ফোন দেওয়া যায়?’
‘খাবার নিয়ে বসবা যখন, তখন ভিডিও কল দিও৷ কথা বলতে হবে না, শুধু দেখব তোমাকে।’
‘আচ্ছা আম্মু।’
‘আব্বা, বছর শেষেই একবার আসবা কিন্তু। কথা দিয়েছ তুমি আমাকে।’
ইমরান স্মিত হাসল। ও জানে পড়াশোনার চাপে ঘাড় ঘোরানোর সময় পাবে না।
ইকরাম আর ইমাও কেঁদে ফেলে বড়ভাইকে জড়িয়ে ধরল। নিষ্ঠুর, নিরাসক্ত, আবেগহীন ইমরানের চোখের কোণেও যেন জলবিন্দু চিকচিক করে উঠল!
ইমিগ্রেশনে ঢুকে যেতে যেতে যতক্ষণ ওকে দেখা গেল সাইদা চোখ পেতে থাকলেন, আর ইমরান অদৃশ্য হতেই আবার সেন্সলেস হয়ে দড়াম দিয়ে পড়ে গেলেন এয়ারপোর্টের শক্ত ফ্লোরে!
*****
বাসায় ফিরেই বোমটা ফাটালো অনি।
সাইদার শরীর আর মন দুটোই ক্লান্ত খুব। অন্যরা যখন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে তখন তিনি রেগে ক্ষেপে উঠলেন একেবারে। তীব্র কন্ঠে অনির কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী? ইমরান কী করেছে? আবার বলো?’
‘তালাক দিয়া গেছে আমারে।’
‘চোপ অশিক্ষিত, মূর্খ মেয়ে একটা।’ সাইদার রোখ চেপে গেছে। আব্দুল মজিদ সাহেব তাড়াতাড়ি এসে স্ত্রীকে ধরলেন ‘আহা কী করছ কী? শুনতে দাও সবটা।’
‘কী শুনব সব? কী শুনব? ফাজিল মেয়ে! কী না জানি করেছে আমার ছেলেটার সাথে, ছেলেটা রেগে মুখে মুখে তালাক বলেছে। এখন এই মেয়ে বড়গলা করে বলে বেড়াচ্ছে আবার! ঘেন্নাও নেই? দুটো দিন মোটে – ছেলেটাকে খুশী রাখতে পারলি না!’
‘আহ! ইমরানের মা। মেহমানরা বাসায়। মেয়েটা কী বলছে, শুনতে দাও সব।’
অনি কেঁদে ফেলেছে। পরশ স্তব্ধ। অনির বড়চাচি এসে ওর হাত ধরল ‘কী হইছে অনি? কী করছ মা? ঠিক কইরা কও তো?’
‘আমি কিছছু করিনাই চাচি। আমার কোনো দোষ নেই।’ কান্নার দমকে অনির গলা দিয়ে আর কথা বেরোয় না।
‘অনি কান্না থামা। ঠিক কইরা ক, কী হইছে।’ সুমনা অস্থির হতে হতে বলে ওঠেন।
‘আমার কোনো দোষ নাই মা। আমারে নিয়া গেল না সেইদিন? নিয়া গেছে বিয়া পড়ানির অফিসে। সেইখানে নিয়া গিয়া কয়, তোরে আমি তালাক দিলাম। তারপর কাগজ দিলো। আমারে বলল সই দিতে।’ ফোঁপাতে ফোপাঁতে অনি যা বলল তাতে সবাই এতটুকুই বুঝল।
সাইদা হতভম্ব। বললেন ‘আর তুমি সই করে দিলে?’
অনি ভয় পেয়ে যাচ্ছে সবার চোখমুখ দেখে। আবার আরো খানিকক্ষণ কাঁদল। কেঁদেকেঁদেই বলল, ‘সবাই যে বলে দেলো, স্বামীর কথা সব মান্য করতে হয়।’
‘এসব তুমি আগে কেন বলোনি?’
‘সে তো বলেই দেছিলো, সে গেলে তারপর যেন কই?’
ইমা এসে অনির হাত ধরে টেনে নিয়ে আড়ালে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল ‘ইমরানের তোমার সাথে থাকেনাই একসাথে?’
অনি ঠিকঠাক বুঝল না প্রশ্নটা। ভুল উত্তর দিলো। ‘একখাটেই তো ঘুমাইছি।’
‘ইমরান আদর করেছে?’ মরিয়া হলো ইমা।
উত্তরে ডানেবামে জোরে জোরে মাথা নাড়ল অনি।
সাইদার সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনে ইমা ইশারায় মাথা নাড়ল। সবার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। ইমরান ধোঁকা দিয়েছে। মায়ের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি!
সুমনা মুখে কাপড়চাপা দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। পরশ যেন এইমাত্রই বুঝল সবটা। ক্রুদ্ধ হলো মায়ের উপর ‘বুঝছ মা, লোভ। লোভ সব শেষ করে দেয়। বড়লোক জামাই, বিদ্বান জামাই, বিদেশি জামাই – লোভটা ছাড়তেই পারলে না। আমার বোনটার জীবন শেষ করে দিলে?’
‘আমার ভাগ্যই হলো আমার মেয়েটার। সাইদা আপা, আমার কপালপোড়া আপনি জানেন। অনির বাবা বিদেশ গিয়েই আমার কপাল পুড়ল। আমি কত অসহায় আপনি জানেন। আমি বললাম, আপা, বিদেশ যাবে ছেলে, শুনলে আমার ভয় করে। আপনি বললেন, ভয় নাই। ছেলে আপনার খুব ভালো। আপা, এই আপনার ভালো ছেলে? আপনার ভালো ছেলে দিয়ে আপনি আমার এমন সর্বনাশটা করালেন আমার?’
তলে তলে যে এতটা ভেবে রেখেছে ইমরান, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি সাইদা। তার ছেলে, তার পেটের ছেলে, মা বাবার উপর এমন প্রতিশোধ নিলো? সাইদা আর ভাবতে পারছেন না। কাকে কী বলবেন? অনির উপর রাগ হলো।
অনিকে রাক্ষসী, সর্বখাকী বলে মনে মনেই গাল দিলেন কিছুক্ষণ।
এত ছোটো মেয়ে বউ করে আনা উচিত হয়নি একেবারেই। আরেকটু বয়স্কা মেয়ে হলে, নিজেরটা ঠিকই আদায় করে নিতে পারত। অনির জন্যই তার এমন সর্বনাশটা হলো!
অনির কতটা ক্ষতি হলো সেটা মাপতে গেলে তিনি ঠাঁই পেতেন না, তাই নিজের কতটা ক্ষতি হলো তাই মাপতে বসলেন।
সব অপরাধের দায় অনির ছোট্ট মাথায় উঠিয়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করলেন আর সিদ্ধান্ত নিলেন, ইমরানকে এসব কিছুই জানাবেন না। কোনো প্রশ্নও করবেন না। একদম স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তিনবছর পরে হলেও ছেলে ফিরবে, কিন্তু এসব নিয়ে অভিযোগ করলে, জবাবদিহি চাইলে, আর ফিরবেই না কোনোদিন, হয়তো আর ফোনও করবে না।
ছেলে হারিয়ে ফেলার দুঃখে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন একেবারে।
অনির চাচারা আর পরশ বেশ হম্বিতম্বি করল কিছুক্ষণ, তারপরে বুঝে গেল কিছুই আসলে করার নেই।
ইমরান দুটো পরিবারকেই ঠকিয়ে গেছে। ইমরানকে পেলেই কিছু করা যেত, তাছাড়া আর কিছুই করার নেই। বোকা অনির উপরেও রেগে গেল পরশ ‘আমাকে অন্তত বলতি।’
‘তুমি এমন করেই চিল্লাতে থাকতা ভাইয়া। আর সেও আমাকে মানা করে দেছিলো।’
‘ওই সে লোকটার কথা আর কখনো মনেও আনবি না তুই।’
বেলায়েত শিকদার বললেন ‘ঠান্ডা মাথায় বস পরশ। কী করব সেটা ভাব। এইভাবে তো গ্রামেও যাওয়া যাবে না এখন। মেয়ের বিয়ে দিতে এসে তালাক নিয়ে যাচ্ছি। মুখ দেখাতে পারব? সীমা, রিমা আর অলিরে ভালোমতো বুঝা, পলাশডাঙা গিয়ে কাউরে যেন কিছু না কয়। আমরা বলব, জামাই বিদেশ গেছে, আমরা মেয়ে নিয়ে আসছি। জামাই ফিরলে ধুমধামে অনুষ্ঠান করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাব। ঠিক আছে?’
‘না বড়চাচা। আমি ভাবছি, আমরা ঢাকাতেই থেকে যাব।’
‘ঢাকা? কেন?’
‘অনিরে আমি যোগ্য বানায়ে ছাড়ব। যে ওরে এত অপমান করল সে একদিন পস্তাবে, সে কী হারাইলো জানবে যেদিন!’
‘এইগুলা ছেলেমানুষী কথা বাবা। এইগুলো সিনেমাতে হয়। বাস্তব কত কঠিন দেখতেছ? তোমার আব্বা হঠাৎ চলে গেলে তোমাদের নিয়ে এমনই অকূল পাথারে পড়েছিলাম। কাটাই উঠছি না? ইনশাআল্লাহ এইটাও কাটায় উঠব, বাবা আমার। মাথা ঠান্ডা করো। তুমি বড় না?’
শেষ পর্যন্ত পরশের জেদের কাছে ওর চাচারা পরাজিত হলেন। ঢাকাতে নিজেদের ঠিকানা বানিয়ে নিলো পরশ আর বোনেদের জীবনটা নতুন করে গড়ে দেওয়ার শপথ নিলো।
সামনে অনির একটা নতুন জীবন…
আর অন্যদিকে জাপানের আকাশে উড়ে যাওয়া প্লেনে বসে অনির কথা মনে আসতেই আতঙ্কিত হলো ইমরান! সত্যিই কি ও অনির খেয়ালে থাকবে সারাক্ষণ? দিনরাত ওকেই ভাববে? ওকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে? তাহলে নিজের আজীবন লালন করা স্বপ্নটার কী হবে? আজ থেকেই অনি চ্যাপ্টার পুরোপুরি ক্লোজড। মুখে তো আনবেই না অনির নাম, মনে না আনারও প্রাণপণ চেষ্টা করে যাবে। সামনে শুধুই ইমরানের স্বপ্নপূরণ…
চলবে..
Afsana Asha