যখন এসেছিলে অন্ধকারে
৪।
বাসায় পৌঁছেই ইমরানের খুব অস্থির লাগতে লাগল। কী যেন একটা খুব ভুল হয়ে গেছে। স্কুলে পড়ার সময় পরীক্ষার আগে কলম নেওয়া হয়নি নইলে এডমিট কার্ড ভুলে বাসায় রেখে গেলে যেরকম ছটফট করত মন সেরকমটা লাগছে। সারা বাসায় মানুষ গিজগিজ করছে, কিন্তু ইমরানের ঘরে ইমরান একা। ওকে বিরক্ত করায় বারণ আছে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ কোলের উপরে রেখে কাজ করছিল, উঠে বসে মাথাটা ডানেবাঁয়ে ঝাঁকাতে শুরু করল। ঠোঁটদুটো টিপে ধরে নিজের মনেই খানিক বিড়বিড় করল ‘খুব ভুল হচ্ছে।’ কিন্তু কী ভুল হচ্ছে মনে পড়ল না। উঠে গিয়ে সব পেপারস চেক করল, লাগেজে নেওয়া জিনিসপত্রের লিস্ট ধরে ধরে রিচেক করল, কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফেলে যাচ্ছে কীনা! চিন্তামুক্ত হলেও ছটফটানিটা কমল না। ওর ঘরের সাথে এক টুকরো বারান্দা। বারান্দাওয়ালা ঘর ইমরানের পছন্দ না। দরজা খুলে রাখলে বাতাস এসে সব কাগজ, নোটশীট এলোমেলো করে দিয়ে যায়।
ঘরটা ইমার।
মেয়ে হওয়ার সুবাদে ইমা আলাদা একটা ঘর পেয়েছিল নিজের ভাগে। টিপটপ করে সাজিয়ে রাখত ঘরটা। ইকরামের সাথে রুমশেয়ার করতে হতো ইমরানের।
ইকরাম নাকি লাউডসাউন্ডে গান শোনে, গেম খেলার সময় হাত পা ঝাঁকায়, ইমার বিয়ের পরে ঘরটা খালি হলে, এই অজুহাতে একদিন নিজের বইখাতা নিয়ে মেয়েলি আলমারি, ড্রেসিং টেবিলে সাজানো ঘরটার দখল নিয়েছে ও।
ইমা শশুরবাড়ি থেকে এসে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল কিন্তু ইমরান বা বাবা-মা কারো কাছেই পাত্তা পায়নি।
ইমরানের চোখ চলে গেল ড্রেসিং টেবিলের দিকে – একগাদা কাচের চুড়ি খুলে রাখা, চুলের ক্লিপ, একটা খোলা সেফটিপিন, একপাশে দলা করে রাখা ব্যবহৃত কাপড়, ফাঁক দিয়ে অন্তর্বাস বেরিয়ে আছে, একপাশে পাট করে গুছিয়ে রাখা শাড়ির বান্ডিল, তার উপর অবহেলায় সোনার কাঁকন পড়ে আছে। প্যারাসুট নারিকেল তেলের নীল রঙের বোতল, পেন্সিল কাজল, চিরুণির দাঁতে লম্বা লম্বা চুল পেঁচানো – একটা রাতের ভেতর ঘরটা আবার মেয়েলি আগ্রাসনের শিকার!
সেসব দেখে মুখ দিয়ে ‘চ্যু’ করে একটা শব্দ করল ইমরান আর তখনই ওর অস্থিরতা কমে এলো। কোথায় ভুল হয়েছে বুঝতে পারল আর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে!
*****
অনি চপল কিশোরী। বাড়ন্ত শরীরে যৌবন এসে গেলেও মনের দিক থেকে অস্থির, দুরন্ত, চঞ্চল শিশু। এই একদিন আগে পর্যন্তও বিয়ে ব্যাপারটা ধরতে পারছিল না। বিয়ে মানে ওর কাছে বউ সাজা আর বরের আদর। ইমরান ওর বর কিন্তু আদর করেনি একবারও। গতকাল সারারাত ধরে বকেছে আর আজকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার বাহানায় তালাক দিয়ে এনেছে। এইযে বিয়ে বুঝে ওঠার আগেই তালাক যেন ঘুমন্ত রাজকুমারীকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলো। ইমরান কাউকে বলতে নিষেধ করে দিয়েছে, বাধ্য মেয়ের মতো ও কাউকে কিছু বলল না কিন্তু নিজের মনের সাথে যে যুদ্ধটা সেটা ওকে নতুন করে নিজেকে চিনিয়ে দিলো। প্রথমে অভিমান হলো খানিক, ভয় করল তারপরে জেদ হলো আর চুপ করে গেল৷
বাসায় এসে থেকে ইমার ঘরে বসে আছে, সুমনা কয়েকবার ডেকে গেছে ও কথা শোনেনি। ইমরান ওকে গেঁয়ো বলেছে, অযোগ্য বলেছে এসবই নাড়াচাড়া করতে লাগল মনের ভিতর।
সাইদা রাতের খাবারের আয়োজন করছিলেন। সেসবের ফাঁকে একবার এলেন অনির সাথে কথা বলতে। ইমরান কাউকে কিছু না বলেই বাইরে গিয়েছে, অনির কাছে জানতে হবে কেন গেছে, অনির কোনো দরকারে গেছে কীনা!
‘বৌমা?’ অনিকে সবসময় নাম ধরে ডেকে আসলেও রাতারাতি নিজেকে শুধরে নিয়েছেন সাইদা। যত তাড়াতাড়ি অনি নিজেকে ইমরানের বউ মনে করবে, শশুরবাড়ির সবাইকে নিজের করে নেবে ততই ইমরানের মনের কাছাকাছি পৌঁছাতে চেষ্টা করবে। আর একবার ইমরানের মনে জায়গা করে নিতে পারলেই, ইমরান ঠিক ফিরে আসবে দেশে। সাইদার ডাক শুনেও অনি সাড়া দিলো না, মাথাটা উঁচু করে চোখ মেলে তাকালো শুধু।
সাইদা অনির পাশে বসলেন। ওর হাতের উপর আলগোছে হাতটা রেখে বললেন ‘ইমরানএখন বাইরে কেন গেল, বৌমা?’
‘আমি তো জানিনে।’
‘তুমি কিছু আনতে বলেছ?’
‘না,না,না!’ ভয়ার্ত ভঙ্গি করে দুই হাত নেড়ে বলল অনি। ওর চোখেমুখেও আতঙ্ক। না জানি সাইদা বুঝি ওকে বকে দেয় আরও।
সাইদা বুঝলেন ওর মনের অবস্থা। আস্তে করে বললেন ‘ইমরান বুঝি তোমাকে বকেছে?’
অনি চট করে বুঝে উঠল না, ওর কিছু বলা উচিত হবে কীনা! তাকিয়ে রইল শূন্য চোখে। সাইদা সেই চোখের ভাষা বুঝলেন না। তার খুব ইচ্ছে করল ইমরান-অনির দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কীনা জিজ্ঞাসা করার। কিন্তু তিনি ভালো করে জানেন পুত্রবধূকে এই প্রশ্নটা করা চরমতম অশালীনতা। তাই সেই অশালীন প্রশ্নটাকে চাদর পরিয়ে জানতে চাইলেন ‘ইমরান ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল?’
অনি মাথাটা উপরনিচ করল।
‘কোথায় নিয়ে গেল?’
‘কোথাও না। শুধু রিকশায় ঘুরলাম। রাস্তায়।’
সাইদা বুঝলেন বিষয়টা অনির মনোঃপুত হয়নি। তাড়াতাড়ি করে বললেন ‘এই করে এরা। শহরের সব ছেলেমেয়েরাই, রিকশা ভাড়া করে অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ায়, বৃষ্টিতে ভেজে। কীযে এরা করে! কই একটু পার্কে যাবি, না সিনেমা দেখবি তা না রোদে পুড়ে রিকশায় ঘোরাঘুরি!’
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন অনির মুখে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সেইরকমই ম্লান। চিবুকটা ধরে অনির নতমুখটা উঁচু করে ধরলেন ‘তোমাকে কিছু কিনে দেয়নি ইমরান?’
অনি কিছু বলল না। উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আনল। সেটা বিছানার উপর সাইদার সামনে রাখল।
‘কী আছে এতে?’ সাইদা উৎসুক হলেন।
‘চুড়ি। চাইর বারো আটচল্লিশখান।’
‘চার ডজন?’
‘হুম।’ ব্রাউন পেপারে মোড়ানো প্যাকেটটা ছিঁড়ে ফেলল অনি। তারপর বের করে আনল চুড়িগুলো। লাল, কালো, সাদা আর নীল রঙের খুব সাধারণ রেশমি চুড়ি। বিয়ের পর ইমরানের দেওয়া প্রথম উপহার বউকে। এত সামান্য বলেই হয়তো মন খারাপ হয়েছে অনির। এবার সাইদা রেগে গেলেন। যতই সামান্য হোক না কেন, স্বামীর দেওয়া উপহার। এতে তো আনন্দ হওয়া উচিত। দুটো কঠিন কথা শোনাতে গিয়েও থেমে গেলেন। একে মেয়েটার বয়স কম তায় ছেলেটা আছে আর দুটোদিন। এখনই অনিকে কিছু বললে যদি কান্নাকাটি করে আর ইমরানেরও মন খারাপ হয় তো ব্যাপারটা একেবারেই ভালো হবে না। নিজেকে সামলে নিয়ে চুড়িগুলো হাতে উঠিয়ে প্রশংসা করলেন ‘বাহ! সুন্দর রঙ তো। তুমি পছন্দ করে কিনেছ?’
অনি না বোধক মাথা নাড়ল জোরে জোরে। চুড়ি পছন্দ করার মতো ইচ্ছে ছিলো না অনির। ওর খুব ভয় লাগছিল। এখনো লাগছে। কী হবে, কী হবে ভেবে সারা হয়ে আছে এখনো। ইমরানই হুট করে রিকশা নামিয়ে, একটা মার্কেটে ঢুকে ফটাফট কয়েক ডজন কিনে নিলো। অনিকে দুবার জিজ্ঞেস করেছিল ‘এগুলো নেব?’ অনি কোনোরকম ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিয়েছিল।
সাইদার খুব ভালো লাগল। তবে মন আরও কিছু জানতে চাইছে। তিনি আবার জানতে চাইলেন ‘দুজনে মিলে পছন্দ করে কিনেছ তাই না?’
অনি চুপ করে থাকল।
অনিকে আরও খুশি করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে সাইদা বললেন ‘আমার খুব পছন্দ এইরকম সাদা রঙের চুড়ি। ইমাকে কতবার বলেছি এনে দিতে, পায়ই না নাকি! আর ইমার পছন্দ লাল চুড়ি।’
‘আপনি নেবেন?’
‘আমার মোটাহাতে ওই চুড়ি ঢুকবে নাকি?’
‘ইমা আপারে দিমু?’
‘না। স্বামীর দেওয়া উপহার কাউকে দিতে নেই।’
‘আইচ্ছা!’
সাইদা এবার একটু বিরক্তই হলেন অনির কথার আঞ্চলিকতাদোষে। ‘বৌমা, একেবারে ফটফট করে ইংরেজি বলতে বলছি না। এই দিমু, খামু, করমু এসব তো ছাড়তে হবে। যে কয়টা দিন ইমরান আছে সে কয়টা দিন তো একটু সুন্দর করে কথা বলার চেষ্টা করো। নাটক, সিনেমা তো কম দেখো না। ওরা কী সুন্দর করে কথা বলে, সেইরকম করে কথা বলবা, বুঝছ?’
অনি কিছু বলে না। ওর চোখ ছলছল করে ওঠে। তবে সাইদার বকা শুনে না, ওর সবাইকে বলে দিতে ইচ্ছে করছে ইমরান কী কী করেছে ওর সাথে। কিন্তু বলতে মানাও করেছে ইমরান। ও ঠোঁটের কোণা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল।
সাইদা ভাবলেন ওনার কথারই প্রভাব। চিন্তিত হলেন। কেঁদে ফেলবে নাকি? ইমরানের সামনে মুখ ভার করে থাকবে? ভালো করে কথা বলবে না ওর সাথে? বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদবে? গায়েগতরে বড়সড় হলেও মেয়েটা তো বাচ্চাই একেবারে। পরিস্থিতি কি কিছু বুঝবে? জেদ, নখরা এসবের সময় যে এখন না, নারীর ষোলোকলা দেখানোর সময়, সেটা ওকে কে শিখিয়ে দেবে? ইমরানের মা বলে আরেকবার অসহায় মনে করলেন নিজেকে। ভাবি বা সমগোত্রীয় কেউ হলে ভালো হতো। তাড়াতাড়ি করে অনির হাত থেকে চুড়ির ছড়া নিজের হাতে নিয়ে লালরঙের চুড়িগুলো জোড়ায় জোড়ায় পরিয়ে দিতে লাগলেন অনির হাতভরে আর বলতে থাকলেন, ‘বাহ কী সুন্দর মানিয়েছে তোমার হাতে। হবে না? পছন্দ করে সুন্দরী বউ এনেছি আমি, যা পরবে তাতেই মানাবে।’
অনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। বয়সটাইতো প্রশংসায় গলে যাওয়ার। সাইদা আস্তে আস্তে বললেন ‘ইমাকে দিতে চাও? এক ডজন দিও। তোমার যেটা মনে চায় সেই রঙের এক ডজন ওকে দাও। আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।’
ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও আবার কী মনে করে নিজের ঘরে গেলেন। একখানা রতনচূড় আছে তার। বাবা বিয়ের সময় দিয়েছিলেন। নতুন বউ হয়ে কয়েকদিন আর তারপরে বিয়ের প্রথম বছর বিয়েশাদির দাওয়াতে গেলে ওটা পরতেন। তারপর ইমরান পেটে এসে গেলে আর ওভাবে সাজা হয়নি, কখনো ভারী শাড়ি, ভারী গয়না পরাও হয়নি। তোলাই থেকেছে সবসময়। শশুরবাড়িতে অভাব পাননি, তেমনি নতুন গয়নার বিলাসিতাও হয়নি। ওই পুরোনোগুলোই ভেঙে নতুন করে হালকা ডিজাইন দিয়ে বানিয়ে নিয়েছেন। শুধু এই রতনচুড়টাই কখনো নষ্ট করেননি। মাঝেমাঝেই নাড়াচাড়া করে দেখেন।
ইমরানের হুট করে বিয়ে বলে, হীরের আংটি, একটা গলার চেন আর নাকফুল করে দিয়েছেন। ইমরান দেশে ফিরলে ধুমধামে বৌ উঠিয়ে আনবেন যখন তখন সব গয়নাই তো দেবেন।
এখন মনে হচ্ছে আরও কিছু দেওয়া উচিত ছিলো মেয়েটাকে। একটা নতুন গয়না একটা নতুন জীবনের মতো।
নবপরিনীতাকে পরানো জড়োয়া গয়নাতে সে শুধু সুন্দরই হয়ে ওঠে না, গয়না গায়ে ওঠার সাথে সাথেই সে মেয়ে থেকে বধূ হয়ে ওঠে!
খুব ভুল হয়েছে, জিভ কাটলেন সাইদা। তারপর ভুলশুদ্ধি করতে ওই রতনচূড়টাই হাতে বাধল তার। এক মূহুর্ত দ্বিধাবোধ হলো না, ইমরানের জন্য তিনি তার প্রাণটাও হাতে করে এনে দিতে পারেন।
শুধু কেউ একবার নিশ্চয়তা দিক, কোলের ছেলে তার আবার ঘরে ফিরে আসবে!
*****
ডিভোর্স এপ্লিকেশন এনলিস্টেড হওয়ার আগেই ফেরত নিয়ে আসতে পেরে ইমরান মহাখুশি। কাজিসাহেব একগাদা কথা শুনিয়েছে ওকে।
বিয়ে পড়ানোর সময় অনির বয়স নিয়ে কারিকুরি করতে হয়েছিল। কমিশনারের অনুমতি নিয়েও লাভ হতো না, বয়স তিনবছর বাড়িয়ে কাবিন লিখতে হয়েছে। তাতে জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট অন্য কোথাও অনির বয়সের কোনো প্রমাণপত্র নেই। সেটা যেকোনোসময় বদলে নেওয়া যাবে, একটু ধরাধরি করেই।
বয়স বাড়ানো মোটামুটি একটা জটিল প্রক্রিয়া। স্কুল এডমিশন, এসএসসি রেজিস্ট্রেশনের সময় বয়সটা কাগজেকলমে পাকাপোক্ত হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশ কীনা, অনেক ক্ষেত্রেই ম্যারিজ সার্টিফিকেটটা এতটাই অপ্রয়োজনীয় যে অনেক দম্পতিই হয়তো কখনো কাগজখানা তোলেই না। তাই বয়স নিয়ে ছিনিমিনি খেলার একটা ছোটো সুযোগ থেকে যায়।
সেই বিয়ে এত ঝামেলা করে হলো, আবার তালাক দেওয়ার সময়ও নাবালিকার অভিভাবকের উপস্থিতি থাকা চাই, সেখানেও অসদুপায় নিতে হয়েছে কাজিসাহেবের – ভালোমন্দ কিছু পকেটে ঢুকলেও অন্যায় বিয়ের দায় কাঁধে নেওয়াতে তিনি ক্ষিপ্ত ছিলেন। ইমরান আবার যখন ডিভোর্স এপ্লিকেশন ফেরত আনতে গেল তিনি কয়েকটা কথা শুনিয়েই দিলেন ওকে।
তবু ইমরান মন খারাপ করল না। একবুক আনন্দ নিয়ে বাতিল হওয়া কাগজগুলো ছোটো ছোটো টুকরো করে ছিঁড়ে রাস্তায় ছড়িয়ে বাসায় ঢুকলো যখন, আনন্দে মুখ ঝলমল করছে!
ইমার ছেলের সাথে মামা-ভাগনেটাইপ কোনো আন্তরিকতা নেই ওর, আজকে কাঁধে চড়িয়ে নিলো তিন বছর বয়সের ভাগ্নে ইরাজকে।
যখন নিজের ঘরে ঢুকেছে সেখানে ইমা, অনির ছোটোবোন অলি, অনির দুই চাচতো বোন সীমা আর রিমা সবাই বসে গল্প করছে। ইমরান ঢুকতেই অনি হুট করে দাঁড়িয়ে গেল আর অলি, সীমা, রিমা কোনোরকম বদান্যতা ছাড়াই হুড়মুড় করে ঘর ছেড়ে চলে গেল। ইমা, ইরাজকে ইমরানের কাঁধ থেকে নামাতে নামাতে বলল ‘ভাইয়া, এই দেখ তোর বউ আমাকে চুড়ি গিফট করেছে।’
ইমরান সেদিকে তাকালো। ইমা হাতটা বাড়িয়ে ধরেছে। ওর হাতভরা নীল রঙের কাচের চুড়ি। ইমরান আড়চোখে অনির হাতের দিকেও তাকালো, খালি হাত। সিটিগোল্ডের মোটা বালা দেওয়া হয়েছিল বিয়ের দিনই, সাজতে, অনেকগুলো চিকন চুড়ি মিলিয়ে। সেই মোটাদুটোই দুইহাতে গলানো, চারগাছি করে চিকন চুড়িসহ। ওর মন খারাপ হলো একটু। অনি তো একটু সাজতেও পারত, ওর দেওয়া উপহারে!
ইমরান ভুলেই গেছে, তালাক বাতিলের খবর অনিকে এখনো জানানো হয়নি। ওদের বিয়ে রদ হয়নি, এখনো অনি ইমরানের বিবাহিতা স্ত্রী। তালাক রেজিস্ট্রি না করা পর্যন্ত যতই তালাকের কাগজে সইসাবুদ করে দেওয়া হোক না কেন, তালাক কার্যকর হয় না, এটা অনিকে বলা হয়নি।
‘কীরে ভাইয়া, এবার?’
ইমরান তাকালো ইমার দিকে। ‘কী এইবার?’
‘ফেঁসে গেলি তো?’
‘কোথায় ফেঁসে গেলাম?’
‘বউয়ের আঁচলের তলায়?’ দুই ভুরু নাচাতে নাচাতে বলল ইমা।
‘কী যা তা বলছিস?’
‘এম, হুম। ইউ ফেল ফর হার! ইজন্ট ইট?’ দুইকান বিস্তৃত হাসি ইমার চোখেমুখে।
‘নো, ওয়ে!’ লজ্জিত হয় ইমরান।
‘ডেফিনেটলি, ইউ ক্র্যাপ! আম্মুর বুদ্ধি কাজে লেগেছে। এবারে তুমি বউয়ের পাল্লুতে ঠিক আটকে গেছ। বছর ঘুরতেই দেশে ফিরতে হবে তোমাকে। দূর, কতদূর, ওই ওশিনের দেশে আর কি মন বসবে?’
‘কী আবোলতাবোল বলছিস ইমা?’
‘ভাইয়া, বছরও তো ঘুরবে না। উঁহু, তোর চোখমুখ যেমন চেরিটাইপ রেডিশ হয়ে উঠেছে তাতে বছরও ঘুরবে না। আই এম শিওর!’ অনেকখানি ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে ইমা।
‘কী বলছিস কী, তুই?’
‘আমার কী মনে হচ্ছে বলি ভাইয়া? না গেলি তুই? দেশে থেকে কি কেউ বড় কিছু হতে পারছে না? দেশের বড় বড় কর্পোরেট হাউজ, মাল্টিন্যাশনালগুলোতে কেউ ক্যারিয়ার তৈরি করছে না? ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোর চাইতে আমাদের দেশের মার্কেটই বরং অনেক ওয়াইড! আর তোর যে ক্যালিবার, নিশ্চয়ই টপ করবি! দেখিস তুই?’
ইমরান চুপচাপ খাটের কোণায় বসে পড়েছে।
ইমা বলে চলেছে ‘অনিকে রেখে যেতে পারবি ভাইয়া? যাস না প্লিজ। মায়ের অনেক কষ্ট হবে। আর অনিও তো ছোটোমানুষ। বল? আমি ঠিক জানি, আর যেতে পারবি না তুই! আটকে গেছিস তুই! মাকে ছেড়ে যাওয়া যায়, বউ রেখে কি যাওয়া যায়? থেকে যা ভাইয়া?’
নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে ইমরানের। মিনিটদুই আগে যে বিয়েটা টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত সবচেয়ে সঠিক মনে হয়েছিল, মিনিটের ব্যবধানে সেই বিয়েটাকে মস্ত ফাঁদ মনে হতে লাগল ওর, আর অনিকে সেই ফাঁদের ফাঁসুড়ি…
চলবে…
Afsana Asha