#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৩)
মাহদী ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। নিহিতা আবার বলল,
” আপুকে ভালো রাখতে পেরেছিলেন? সুখী করতে পেরেছিলেন? ”
মাহদী বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিল। অন্ধকারে ডুবে থাকা উঠোনের দিকে চেয়ে থেকে নিজের ছেলেকে ডেকে আনল। আদেশের মতো বলল,
” মন, তোর নানিকে ডেকে নিয়ে আয়। ”
মন নানিকে ডাকতে দৌড় দিলে নিহিতা শঙ্কিত স্বরে বলল,
” আম্মুকে ডাকছেন কেন? আম্মুকে দিয়ে কী হবে? ”
মাহদী কাঠ গলায় বলল,
” অপেক্ষা করো। ”
মাহদীর নীরস কণ্ঠ স্বরে নিভে গেল নিহিতা। মায়ের আসার অপেক্ষা করতে করতে মনে পড়ল, মা বলেছিল এখানে আসতে হবে না। রিন্টুর মায়ের হাতে চা পাঠাতে। সে তা করেনি। তার উপর সন্ধ্যে থেকে এ রুমে পড়েছিল। মা কি এসেই খুব বকবে? নিহিতা ভেতরে ভেতরে ভয় পেল। মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে। যদিও মা-বাবার বকুনির কবলে খুব একটা পড়েনি সে। নিহিতা অসহায় চোখে তাকাল মাহদীর দিকে। সে কি রেগে গেছে? রাগ থেকে নালিশ করবে? তারপর কী হবে? নালিশ শোনার পর নিশ্চয় কোনো মা সন্তানকে আদর করে না!
নিহিতার ইচ্ছে হলো মাহদীকে দুঃখিত বলতে। পর মুহূর্তে ভাবল, কী এমন বলেছে যে দুঃখিত বলতে হবে? অন্যায় কিছুই নয়। নায়রা আপুর বোন হয়ে এটুকু জানার অধিকার কি থাকতে নেই? সীমা লঙ্ঘন করার মতো কিছু নিশ্চয় বলেনি। নিহিতা অসহায় ভাব দূর করতে চাইল। ভয়টুকু কাটাতে চাইল। খুব একটা সফল হলো না। মাহদীকে খুব একটা না জানলেও তার রাগ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে। খুব ছোট ব্যাপার নিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে। নিহিতার চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই আসমা রহমান এগিয়ে এলেন। মাহদী মনকে ভেতরে পাঠিয়ে দরজা ভিজিয়ে দিল। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” নায়রা আপনাকে দৈনিক কল করত? ”
হঠাৎ নায়রার প্রসঙ্গ আসায় আসমা রহমান অপ্রস্তুত হলেন। চোখেমুখে দুঃখী ভাব চলে এসেছে। ভার স্বরে জানতে চাইল,
” হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন? ”
মাহদী আড়চোখে নিহিতাকে দেখতে গিয়েও থেমে গেল। অনুরোধ করে বলল,
” দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, মা। ”
এতক্ষণে মেয়েকে লক্ষ্য করলেন আসমা রহমান। কিছু একটা আঁচ করতে পারলেন বোধ হয়। নিহিতার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন,
” হ্যাঁ করত। ”
মাহদী চট করে পরের প্রশ্নটা করল,
” কত বার? ”
এবার মেয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরালেন আসমা রহমান। মাহদীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আমি তো গুণে রাখিনি কখনও। তবে নিয়ম করে তিনবেলা করত। ”
মাহদীর মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হলো। পরের প্রশ্ন-উত্তর গুলো চলল দ্রুত।
” এখানে বেড়াতে আসত? ”
” হ্যাঁ। ”
” কত দিন পর পর? ”
” সেভাবে তো মনে রাখিনি। কিন্তু খুব ঘুন ঘন আসত দেখে আমি মাঝে মাঝেই বকাঝকা করতাম। ”
” কেন? নায়রা কি আমার সাথে ঝগড়া করে আসত? ”
” না, না তা হবে কেন? এমন ঘন ঘন বাপের বাড়ি আসা খারাপ দেখায় তাই বলতাম। তোমার সাথে ঝগড়া হত নাকি? নায়রা তো কখনও বলেনি! ”
” বলতে হবে কেন? আপনি তো মা। মেয়ের মুখ দেখে কখনও মনে হয়নি সে অখুশি? স্বামীর উপর বিরক্ত, শ্বশুর-শাশুড়ির জ্বালায় অতিষ্ঠ? এই বিয়ে থেকে মুক্তি চাচ্ছে! ”
আসমা রহমানের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছটা! মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে বহু বছরের পুরোনো কোনো সত্য উদ্ঘাটন হচ্ছে। আসলেই কি সত্য?
মাহদী শাশুড়ির দিকে মাথা এগিয়ে বলল,
” মা, নায়রা কি আপনার সাথে ডিভোর্স কিংবা তালাক নিয়ে আলোচনা করেছিল? ”
আসমা রহমান কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসল। যেন চৈতন্য হারিয়েছেন। কিংবা অলৌকিক কিছু শুনছেন! মাহদী খানিকটা মজা করেই বলল,
” আপনি কি ভয় পাচ্ছেন আমাকে? একটুও ভয় পাবেন না, মা। আমি আপনাকে অনুমতি দিচ্ছি, সব সত্য বলুন। নিহিতা জানুক তার বোন কত অসুখী ছিল। কী পরিণাম অত্যাচার সহ্য করেছে। নায়রা বলত, সে এখানে আসলে রাতে আপনার সাথে ঘুমাত। সে হিসেবে নায়রার শরীরে আমার করা আঘাতের চিহ্নও আপনার দেখার কথা। কখন কখন হাত তুলেছি। কোথায় মেরে দাগ বসিয়েছি সব বলবেন নিহিতাকে। সে এখন ছোট নেই। এসব কথা তাকে বলাই যায়। সব শোনার পর যদি আমার নামে মামলা করতে চায়, আমাকে জানাবেন। আমি নিজে নিহিতাকে থানায় নিয়ে যাব। ”
মাহদী কথা শেষে রুমে ঢুকে গেল।
__________________
মনের শরীরে পাতলা চাদর দিয়ে আলো নিভিয়ে আসল মাহদী। ছেলের পাশে শুতেই সে প্রশ্ন করে বসল,
” বাবা, আম্মু কি তোমার সামনেও বোরকা পরে আসত? ”
চাদরের এক প্রান্ত নিজের শরীরে টেনে নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। ”
মন বাবার দিকে চেপে আসল। কৌতুহূলপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
” তার মানে তুমিও আম্মুকে দেখনি? ”
” দেখেছি। ”
” কিভাবে? খালামনি যে বলল, বোরকা পরলে ছেলেরা মুখ দেখতে পারে না। ”
ভার্সিটির মধ্যে অসাবধানে নায়রার হিজাব খুলে যাওয়ার দৃশ্যটি মাহদীর চোখে ভেসে উঠল। সেটা লুকিয়ে বলল,
” বিয়ে করলে দেখা যায়। ”
” বিয়ে কী বাবা? ”
মাহদী ছেলের কৌতুহলপনা মুখখানায় চুমু খেল। দ্রুত কিছু চিন্তা করে বলল,
” বিয়ে হলো, একটা মেয়েকে পরিপূর্ণ দেখার বৈধ অধিকার। বুকের মধ্যে জমে থাকা ভালোবাসা তার সাথে বিনিময়ের বৈধ সুযোগ। তাকে খুশি রাখার দায়িত্ব নেওয়া। ”
মন চুপ করে থাকলে মাহদী হতাশ হলো। বুঝতে পারল সহজ করে বলতে গিয়ে কঠিন ও খাপছাড়া উত্তর দিয়েছে। নিজেই লজ্জিত হলো। ছেলে বুঝবে এমন একটা উত্তর খুঁজতে মস্তিষ্ক হাতড়ে বেড়াল। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
” বিয়ে হলো, বিশ্বাস। ”
” বিশ্বাস? ”
” হ্যাঁ। বিয়ে করলে ছেলে-মেয়ে থাকে না, স্বামী-স্ত্রী হয়ে যায়। স্ত্রীর নিকট স্বামী খুব বিশ্বস্তবান। সেজন্য স্ত্রীর মুখ দেখার অনুমতি পায় স্বামী। ”
মন আবার চুপ হয়ে গেল। মাহদীও সন্দেহে পড়ল। নিজের দেওয়া উত্তরটা মনে মনে কয়েক বার উচ্চারণ করে বুঝার চেষ্টা করছে ছেলে বুঝতে পারবে নাকি। সেই সময় মন আগ্রহ নিয়ে বলল,
” তাহলে কি আমি সবাইকে বিয়ে করেছি? ”
ছেলের কথা শুনে মাহদীর চোখ কপালে। বিস্ময় নিয়ে সুধাল,
” এমন মনে হলো কেন? ”
” আমি তো সব মেয়েকেই দেখতে পারি, বাবা। সবাই আমাকে মুখ দেখায়। ”
মাহদী কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে ফেলে। ছেলেকে ঝাপটে ধরে আদর করে। তারপর বলল,
” না, বাবা। তুমি যে ছোট তাই দেখতে পাও। বড় হলে দেখতে পারবে না। ”
” কেন? এখন আমি ছেলে নই? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে? ”
মাহদী কী উত্তর দিবে বুঝতে পারল না। একটা বুঝাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তার মধ্যে আরেকটা! আর ভাবনাতে না গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাল,
” তোমার আম্মু কিন্তু মাঝে মাঝে আমাকে মুখ দেখতে দিত না। ”
মায়ের কথা আসায় মন পূর্বের প্রশ্ন ভুলে গেল। নতুন করে কৌতুহল জাগল মুখমণ্ডলে। মাহদী গল্পের মতো করে বলল,
” তোমার আম্মু খুব ভালো করেই জানত তার চুল আমার কত প্রিয়! তাই আমার উপর রাগ হলেই আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলত। যতক্ষণ না সেই রাগ পড়ত ততক্ষণ আঁচল সরাত না। আর রাগ যদি একটু বেশি হয়ে যেত তাহলে আঁচল মাথা ঢেকে মুখে পড়ত। আমি ডাকলে সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। যা বলতাম তাই করত কিন্তু মুখ থেকে আঁচল সরাত না। জোর করে যে সরাব সেই উপায় নেই। জোর করলে কথা বলা বন্ধ করে দিত! ”
” তারপর তুমি রাগ ভাঙাতে, বাবা? ”
” না। ”
“কেন? তুমি মুখ না দেখেই থাকতে? ”
” না। দেখতাম। অন্যভাবে। ”
” কিভাবে? ”
মাহদী একটু থামল। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলল,
” চোখ বন্ধ করো। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে কিন্তু। ”
মন চোখ বন্ধ করলে মাহদী বলল,
” যেদিন তোমার আম্মু রাগ করত সেদিন আমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতাম। ময়লা জুতো পরে রুমের ভেতর ঢুকতাম। ঘামে ভেজা কাপড় পরে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়তাম। চোখ বন্ধ করে নিলেই তোমার আম্মু ছুটে আসত। ভাবত আমার শরীর খারাপ করছে। ব্যস! রাগ ভুলে গিয়ে আমার শরীর ঠিক করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত। মাথা থেকে আঁচল কখন পড়ে গেছে খেয়ালই নেই! ”
মন চোখ খুলল। বাবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
” তুমি আম্মুকে ধোঁকা দিতে, বাবা? ”
মাহদী কিছু বলার আগেই মন অন্যদিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করে বলল,
” আমি তখন থাকলে আম্মুকে ধোঁকা খেতে দিতাম না! ”
মাহদী ছেলেকে নিজের দিকে ঘুরাল না। আমনমনে বিড়বিড় করল, ‘ স্ত্রী অভিমান করলে স্বামী শারীরিকভাবে অসুস্থ না হলেও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তুমি বড় হলে ঠিক বুঝবে, আমি তাকে ধোঁকা দিইনি। আমার রাগ ভাঙানোর কায়দাটা ভিন্ন ছিল শুধু। ‘
________________
” তোকে নিষেধ করেছিলাম ও ঘরে যেতে। তাও কেন গেলি? ”
রাতের খাবার শেষে রান্নাঘর গুছানোতে মাকে সাহায্য করতে এসেছিল নিহিতা। মাহদীর ওখান থেকে মায়ের পিছু পিছু নিজেদের ঘরে এসেছিল তখনই। ভেবেছিল, মা বকবে। কিন্তু অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন কিছু বলেনি তখন ভেবেছিল মা হয়তো কিছু বুঝতে পারেনি। তাই একসাথে খাবার খেয়ে রান্নাঘরে আসা। ধোয়া প্লেটগুলো সরিয়ে নিতে গিয়ে মা প্রশ্ন করে বসলেন। নিহিতা থমকে গেলে, আসমা রহমান বললেন,
” গিয়েই গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিলি? মাহদী কতটা কষ্ট পেয়েছে দেখেছিস? চোখ দুটো জলে চিকচিক করছিল। তোর যদি এসব জানারই ছিল আমাকে জিজ্ঞেস করলি না কেন? ”
নিহিতা কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল। মাহদীর জলে চিকচিক করা চোখ দুটো দেখেনি সে। কিন্তু অপমান করার কৌশলটা দেখেছে! তার দিকে না তাকিয়ে কথার তীর না ছুঁড়েও হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে শুধু বয়সে নয় চিন্তা-ভাবনায়ও সে কতটা উচ্চ পর্যায়ে!
মেয়ের হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিলেন আসমা রহমান। রান্নাঘরের আলো নিভিয়ে চলে যাওয়ার পূর্বে বললেন,
” বাবাকে বলে দিস, মাহদীরা সকালের ট্রেনে ঢাকা চলে যাবে। ছয় বছর পর এসে আপ্যায়ন পাবার বদলে অপমানিত হয়ে ফিরে যাচ্ছে। আর কখনও আসবে নাকি কে জানে! টিকেটটা যেন সে কেটে দেয়। ”
চলবে