#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১০)
নিহিতা কান্না প্রায় গলায় বলল,
” সেতুকে খুঁজে পাচ্ছি না! ”
মাহদী সাথে সাথে কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। এক পলকে সবার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বলল,
” খুঁজে পাচ্ছ না বলতে? সে কি বাচ্চা? ”
নিহিতা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসল। দিশাহারা ভঙ্গিতে বলল,
” না। সেতু আমাদের বন্ধু। ভেতরের রুমে আড্ডা দিচ্ছিল। তারপর…”
নিহিতা চুপ হয়ে গেলে মাহদী জিজ্ঞেস করল,
” তারপর? ”
নিহিতার মনে পড়ল সানোয়ারকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সকলেই ব্যস্ত ছিল। সেই ফাঁকে কি সেতুর সাথে কিছু হলো? ”
” নিহিতা? ”
নিহিতা ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলল,
” তারপর আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ”
মাহদী ব্যাপারটাকে সাধারণভাবে নিয়ে বলল,
” হয়তো কোথাও বেরিয়েছে। ”
নিহিতা মনে করিয়ে দিল,
” না। দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল। আপনি যখন আসলেন তখন খুলেছি। ”
এবার মাহদীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট! গুরুতর চিন্তায় পড়তে টনক পড়ল। সহসা বলল,
” মেয়েটি কি কালো রঙের কিছু পরেছিল? ”
নিহিতা আরেকপা এগিয়ে আসল মাহদীর দিকে। দ্রুত মাথা নেড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
” হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন? ”
” আমি যখন দরজায় কড়া নাড়ছিলাম তখন একটা মেয়ের গলা পেয়েছিলাম। পেছন ঘুরে দেখি একজন মাঝ বয়সী লোকের কাঁধে মাথা ফেলে উঠোন পার হয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। ”
সুমি জায়গায় দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল,
” এটা কী করে হতে পারে? ”
পেছন থেকে সানোয়ার জিজ্ঞেস করল,
” কী বলতে চাচ্ছিস? ”
” সেতু বাইরে গেল কী করে? যদি দরজা খুলে যায় তাহলে ভেতর থেকে আটকাল কে? ”
সকলের চোখ গিয়ে পড়ল নাঈমের উপর। সে ভয় পেয়ে গেল। শরীর থেকে ঘাম ছোটার পূর্বে মিনমিনে বলল,
” আমি লাগাইনি। ”
সানোয়ার বন্ধুর কাছে গিয়ে বলল,
” তাহলে কে আটকাল? ”
নাঈম সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলল,
” রান্নাঘর দিয়ে বেরিয়েছে মনে হয়। ওখানে আরেকটা দরজা আছে। ব্যবহার করা হয় না। ”
সুমি সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখল,
” সামনে দরজা থাকতে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বের হলো কেন? ”
” ও বের হয়নি। কেউ বের করেছে। ”
নিহিতার কথা শুনে সকলে চমকে তাকাল। সচকিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সুমি,
” কে? ”
নিহিতা নাঈমের দিকে তাকাল। পরক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে দুর্বল স্বরে বলল,
” নাঈমের চাচা। ”
সানোয়ার এগিয়ে এসে বলল,
” নাঈমের চাচা বললেই ও যাবে কেন? ”
এবার মুখ খুলল মাহদী। রুষ্ট স্বরে বলল,
” বোধ শক্তি হারিয়েছে বলে। সেতু এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল। মদ খেয়েছিল নাকি? ”
কেউ উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে ফেলল সকলে। এতে মাহদীর রাগ আকাশ ছুঁলো। রাম ধমক দিয়ে বলল,
” এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সেতুকে খুঁজে বের করো গাধার দল। কী ঘটতে যাচ্ছে তোমরা ভাবতেও পারছ না! ”
মাহদী আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে চলে আসল। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব। তখন যদি একটু ভালো করে খেয়াল করত তাহলে ব্যাপারটা এত দূর গড়াত না!
নিহিতা, সুমি, সানোয়ার এমনকি নাঈমও সেতুর অনুসন্ধানে নেমে পড়ছে। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছুটাছুটি করছে বাড়ির ভেতর ও বাহিরে। নিহিতা বাড়ির মধ্যেই খুঁজছিল। আশেপাশের পুরো জায়গাটা চষে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল দেয়ালের কাছের পেয়ারা গাছটির নিচে। চিন্তা আর অস্থিরতায় শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে তার। দুর্বল শরীরে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টসাধ্য। বড় নিশ্বাস টেনে ডানে তাকাল। সাথে সাথে চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল বাড়ি ও দেয়ালের মধ্যের সরু জায়গায়টায়। অন্ধকারে পুরুষের ছায়া নড়ছে। নিহিতা উদ্বেগ নিয়ে একটু এগিয়ে গেল। ছায়াটি দৃষ্টি সীমায় আসতেই নিহিতা ভয়ে জমে গেল। হা-পা কাঁপছে! কাঁপুনি নিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে নাঈমের চাচার দিকে। শরীরের উপরের ভাগে কাপড় নেই। অঙ্গপ্রতঙ্গে পাগলের মতো অস্থিরতা। সে অবস্থায় সেতুর কালো জামাটি ছিঁড়ে ফেলার তুমুল প্রচেষ্টা!
নিহিতার জমে যাওয়া শরীরটি আরও এক বার কেঁপে উঠল মাহদীর কণ্ঠ স্বরে। নাঈমের চাচার গলা চেপে ধরে চিৎকার করছে। চোখে-মুখে উগ্র ভাব। ভয়াবহ কিছু করে ফেলার মতো অবস্থা। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। নিহিতা ভয় ফেলে ছুটে এসে মাহদীকে সাবধান করল,
” উনি মারা যাবেন তো! ছাড়ুন। ”
ততক্ষণে সুমি, সানোয়ার, নাঈমও চলে এসেছে। নিহিতার মতো সাহস করে উঠতে পারল না কেউ। এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সবটা। নিহিতার কথায় হোক অথবা অন্য কিছু মাহদী লোকটাকে ছেড়ে দিল। লোকটা দেয়ালের সাথে লেগেই মাটিতে বসে পড়ল। কাঁশি থামছেই না!
নিহিতা ছুটে যায় সেতুর কাছে। সে অজ্ঞান হয়ে গেছে! সুমি একটু সাহস সঞ্চয় করে নিহিতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সেতুকে ধরে রাখতে সাহায্য করছে। সেই ফাঁকে মাহদীকে দেখছে বার বার। রাগে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। কণ্ঠ হার বের হয়ে যাওয়ার যোগাড়! তপ্ত নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পায়চারি করছে। কয়েক বার এপার থেকে ওপার ঘুরে অকস্মাৎ ভারী ইট তুলে নিল হাতে। তীর বেগে ছুটে এসে লোকটির মাথায় বাড়ি দিতে গিয়েও থেমে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
” নায়রার জন্য বেঁচে গেলি! ”
তারপরেই নিহিতার উদ্দেশ্যে বলল,
” এর কী শাস্তি হওয়া উচিত বলো। তুমি যা বলবে তাই করব। ”
নিহিতা লোকটার দিকে তাকাল। ঘৃণায় ভেতরটা তেতো হয়ে আসলে চোখ ফিরিয়ে নিল। বলল,
” মৃত্যু ব্যতীত যা ইচ্ছে হয়। ”
মাহদী নির্দয় দৃষ্টিতে তাকাল। ইচ্ছে হচ্ছে ইট দিয়ে বিকৃত মস্তিষ্কটা ছেঁচে দিতে! পারছে না বলে রাগটা কমছে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তোমরা গেইটের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, আমি আসছি। ”
সেতুকে নিয়ে নিহিতা আর সুমি সাবধানে হাঁটা ধরে। সানোয়ার আর নাঈম পেছন ধরলে মাহদী বলল,
” নাঈম, তুমি এখানেই থাকো। ”
নাঈমের পা আটকে গেল। ভীত চোখে মাহদীর দিকে তাকালে সে বলল,
” বাসায় দড়ি আছে? মোটা দড়ি? ”
নাঈম মাথা নাড়লে মাহদী বলল,
” নিয়ে আসো। জলদি। ”
নাঈম বাসার ভেতর ঢুকে গেল। দড়ি নিয়ে যখন ফিরল তখন লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার চাচার শরীরে সুতো বলতে কিছু নেই!
মাহদী বস্ত্রহীন লোকটিকে পেয়ারা গাছের সাথে বেঁধে নাঈমের উদ্দেশ্যে বলল,
” আজ রাতটা তুমি আমার সাথে ঘুমাবে। চলো। ”
_________________
সে রাতে সেতু আর সুমি নিহিতাদের বাড়িতেই ছিল। শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিল বিধায় সুমির ঘুম ভাঙল দেরিতে। সেতু তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নিহিতা নেই। তাকে খোঁজার আগ্রহ দেখা গেল না সুমির মধ্যে। সে অগোছাল ভাবে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। উঠোনের দক্ষিণ পাশে নজর পড়তে তার ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল। ফোলা চোখ দুটিতে মুগ্ধতা ভর করল। ঘোর লাগা সেই দৃষ্টি আটকাল মাহদীর উপর। একটা বাচ্চা ছেলের সাথে দুষ্টুমিতে নেমে কী সুন্দর হাসছে!
” এখানে কী করছিস? চল নাস্তা করবি। ”
নিহিতার দিকে ফিরেও তাকাল না সুমি। বিমুগ্ধ চোখ জোড়া তখনও মাহদীর সুশ্রী মুখখানায়! নিহিতা সুমির চুলগুলো খোঁপা করে দিল। গলায় পড়ে থাকা ওড়নাটা মেলে মাথাসহ বাহু ঢেকে বলল,
” বাবা বাইরে বের হবেন। ভেতরে চল। ”
নিহিতার কথা উপেক্ষা করে সুমি ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
” এই মানুষটাকে পাওয়ার জন্য শুধু বাবার অবাধ্য কেন পুরো পৃথিবীও ছাড়া যায়। নায়রা আপুর পছন্দ নেশা ধরানোর মতো! ”
নিহিতা ভ্রু বাঁকাল। সুমিকে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” কী বিড়বিড় করছিস? ”
সুমি আপ্লুত কণ্ঠে বলল,
” আপুর লাভ স্টোরি শোনা হলো না। ”
” কোন আপুর? ”
” নায়রা আপুর। আজ শুনাবি? ”
নিহিতা বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” নায়রা আপুর লাভ স্টোরি থাকলে তো শোনাব। ”
সুমি অবাক হয়ে বলল,
” লাভ স্টোরি নেই? কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম নায়রা আপু ভালোবেসে মাহদী ভাইয়াকে বিয়ে করেছিল।
” না। ”
” তাহলে? ”
” তাহলে কী? ”
” তাহলে বিয়ে করেছিল কেন? ”
নিহিতা উত্তর দিল না। তার হঠাৎ মনে হলো সে নিজেও জানে না তার আপু কেন বিয়ে করেছিল।
নিহিতার চুপ থাকার মধ্যেই সুমি আরেক বার মাহদীর দিকে তাকাল। বলল,
” উনার হাসিটা দেখেছিস? মনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো। ”
সুমিকে অনুসরণ করে নিহিতাও তাকাল মাহদীর দিকে। নিমিষেই নিহিতার বিস্ময়াভিভূত চোখ জোড়া চুম্বকের মতো আটকে গেল মাহদীর মুচকি হাসি টানা ঠোঁট জোড়ায়।
চলবে