#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৬)
“নিহি, পালা। ”
সুমির আতঙ্কিত কণ্ঠ স্বরে খানিকটা ছিটকে উঠল নিহিতা। তাৎক্ষণিক চোখ গেল দরজার দিকে। দরজার পাল্লা ধরে হাঁপাচ্ছে সে। চোখে-মুখে নিদারুন ভয়! ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে এমন অবস্থা।
নিহিতা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বেঞ্চ ছেড়ে সুমির দিকে এগুল। সে পৌঁছানোর পূর্বে সুমি দৌড়ে এলো। বাইরে পড়ে থাকা খাতা, কলম, বই ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিহিতার হাতে দিয়ে বলল,
” আর দাঁড়িয়ে থাকিস না। জলদি বের হ। ”
এতক্ষণে মুখ খুলল নিহিতা,
” বের হব মানে? ক্লাস করব না? ”
” না। ”
” কেন? ”
সুমি বিরক্ত হলো। পর মুহূর্তে অসহায় মুখ বানিয়ে বলল,
” একটা ভুল হয়ে গেছে। ”
” ভুল? কিসের ভুল? ”
ততক্ষণে নিহিতার অন্যান্য বন্ধুরাও চলে এসেছে। তাদের মধ্য থেকে সেতু মুখ এগিয়ে বলল,
” আহাদ ভাই জেনে গেছে চিঠি আমরা দিয়েছি। ”
নিহিতা কিছুই বুঝছে না। অবোধ গলায় প্রশ্ন করল,
” চিঠি? কিসের চিঠি? ”
সেতু কপালে হাত রাখল। সেই সময় নিহিতা পরের প্রশ্ন করল,
” আহাদ ভাইটা কে? আমি কি চিনি? ”
এ প্রশ্নের উত্তর দিল সানোয়ার,
” তুই চিনবি কী করে? তুই তো আমাকেই চিনিস না। তাহলে সিনিয়র ভাইদের কিভাবে চিনবি? ”
নিহিতা স্পষ্ট বুঝতে পারল সানোয়ার তাকে অপমান করছে। রাগও হতে পারে। অথবা অভিমান! নিহিতা চুপ হয়ে গেলে সেতু বলল,
” আহাদ ভাই চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। দেখতে বেশ! সুমি অনেক দিন ধরে তার প্রেমে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। ”
নিহিতা চোখ তুলে তাকাল। সুমিকে কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল। মনে পড়ল ঊর্মির কথা। সেই যে রাতে বেরিয়ে গিয়েছিল এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। নিহিতা অনেক বার কল করেছে। ধরেনি। বাসায়ও গিয়েছিল দেখা করেনি। আজ ক্যাম্পাসে আসেনি পর্যন্ত!
সে চোখ ফিরিয়ে নিতে সুমি আবারও তাড়া দিল,
” এখনও দাঁড়িয়ে কেন? আহাদ আসল বলে। পালা! ”
নিহিতা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পালানোর জন্য পা ফেলল। দুই কদম এগিয়ে পেছন ঘুরে বলল,
” প্রেমের জল খাচ্ছে সুমি। আমি কেন পালাচ্ছি? ”
সেতু দৌড়ে এসে বলল,
” কারণ, আহাদ ভাই ভাবছে চিঠি তুই দিয়েছিস। ”
নিহিতা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চোখের দৃষ্টি সকলের দিক থেকে ঘুরিয়ে এনে বলল,
” আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ঠিক করে বলবি আসলে কী হয়েছে? ”
এবার সুমিও নিহিতার কাছে এসে দাঁড়াল। ব্যস্ত স্বরে বলল,
” সেদিন ম্যামের জন্মদিনে যে লাভ লেটার লিখছিলাম? ওটা আহাদের জন্যই ছিল। ভেবেছিলাম চিঠি লিখে তার মতিগতি বুঝব। তারপর সামনাসামনি প্রেমের প্রস্তাব দিব। কিন্তু…”
” কিন্তু? ”
” কিন্তু লুকিয়ে চিঠি পাঠানোর পরও কিভাবে জানি ধরে ফেলেছে আমরাই দিয়েছি। আমরা যখন ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন হুট করে উনি আসলেন। চোখ গরম করে জানতে চাইলেন এই চিঠি কে লিখেছে। আমি তো ভয়ে শেষ! কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘ আমি জানি না। ‘ ”
নিহিতা পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
” কিন্তু চিঠি তো তুই লিখেছিস, সুমি। সেদিন আমি দেখেছিলাম। ”
সুমি প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ, আমি লিখেছি। ”
” তাহলে মিথ্যে বললি কেন? ”
” তো বলব না? যদি আমাকে চড় মেরে বসতেন? ক্যান্টিনে তখন জুনিয়ররাও ছিল। জুনিয়রদের সামনে চড় খেলে আমার সম্মান থাকত? ”
নিহিতা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,
” আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না। এর জন্য আমি কেন পালাব? ”
” পরেরটুকু শুনলেই বুঝবি। ”
” বল। ”
” আমি জানি না বলতে আহাদ আরও বেশি রেগে গেল। তার বিশ্বাস আমি জেনেও বলছি না। খুব শাসাচ্ছিল! শেষে বাধ্য হয়ে মিথ্যে ঘটনা সাজালাম। ”
” কী ঘটনা? ”
” ছুটির পর আমরা যখন বের হচ্ছিলাম তখন একটা মেয়ে এলো রিক্সা করে। আমার হাতে চিঠি দিয়ে বলল, আপনাকে দিতে। ঐ সময় আপনি ছিলেন না বলে আপনার বন্ধুর হাতে করে পাঠিয়েছিলাম। এই ঘটনা শুনে আহাদের রাগ কিছুটা কমল। তারপরেই বলল,’ তার মানে তুমি মেয়েটাকে দেখেছ? ‘ ব্যস, আমি আবারও বিপদে! কী বলব কিছু খুঁজে না পেয়ে বললাম, ‘দেখিনি। কারণ, সে মেয়েটি বোরকা পরে ছিল। ‘ এবার তার রাগ এক দম পানি। সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘ সেই মেয়েটি কি তোমাদের ডিপার্টমেন্টের? ‘ আমি তার হাত থেকে মুক্তি পেতে ভুল করে হ্যাঁ বলে ফেললাম। ”
সুমি থেমে গেলে। নিহিতা পরিষ্কার গলায় বলল,
” আমাদের ডিপার্টমেন্টে শুধু আমি বোরকা পরি না, ঊর্মিও পরে। ”
” কিন্তু সেদিন ঊর্মি বোরকা পরেনি। শাড়ি পরেছিল। ”
” ম্যামের জন্মদিনে চিঠি দিয়েছিলি? ”
সেতু নিহিতার হাত ধরে সামনে টেনে নিতে নিতে বলল,
” হ্যাঁ, সেজন্যই তো বলছি পালা। সুমির চড়টা তোর গালে পড়ার আগে পালা। শোন, আগামী এক সপ্তাহ তুই ক্যাম্পাসে আসবি না। তোর নোটের ব্যবস্থা আমরা করে দিব। ”
নিহিতাকে নিয়ে সেতু বেরিয়ে যেতে রাসেল বলল,
” আমার মনে হচ্ছে, আহাদ ভাই নিহিতাকে চড় দিবে না। ”
সুমি জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” আমার মনে হয়, আহাদ ভাই নিহিতাকে পছন্দ করে। ”
সুমির মুখ হাঁ হয়ে গেল। সানোয়ার বেশ আগ্রহ চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” এমন মনে হওয়ার কারণ? ”
রাসেল সাথে সাথে কিছু বলল না। মনে মনে অংক কষে বলল,
” কারণ, সুমি যখন বলল মেয়েটা বোরকা পরে তখনই আহাদের রাগ উধাও। কোনো কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করছিল মেয়েটা আমাদের ডিপার্টমেন্টে পড়ে নাকি। অথচ সুমি বলেছিল মেয়েটি রিক্সা করে এসেছিল। যার মানে দাঁড়ায়, মেয়েটি বাইরে থেকে এসেছে। হতে পারত সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই না। কিন্তু আহাদ ভাই সে রকম কিছু না ভেবে নিজের ভাবনাকেই বাস্তবে প্রকাশ করেছে। এছাড়াও..”
সুমির দ্রুত প্রশ্ন,
” এছাড়াও? ”
” এছাড়াও আমি বেশ কয়েক বার উনাকে আমাদের ক্লাসে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখেছি। তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছি, উনি সেই দিনই উঁকি মারতেন যে দিন নিহিতা ক্যাম্পাসে আসত না। ”
সুমির মুখের রঙ পালটে গেল। আতঙ্কিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” সর্বনাশ! ”
সানোয়ার, রাসেল কিছু বুঝে উঠার আগেই সুমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।
_____________
ফাঁকা মাঠে শরীরের ভর ছেড়ে বসে আছে মাহদী। হাত দিয়ে ঘাস ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করল। সেই সময় নায়রার মুখটা ভেসে উঠল চোখের পাতায়। তার উপস্থিতি অনুভব করছে। ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। বেশিক্ষণ কল্পনায় থাকতে পারল না। কানের কাছে কে যেন চিৎকার করে ডাকল, ‘ শিহাব? ‘
মাহদীর চোখ খুলে গেল। বুকে ধাক্কা গেল। মনে পড়ল নিজের সেই বন্ধু শিহাবের কথা। যার সাথে ঝগড়া করার সময় নায়রাকে প্রথম দেখেছিল। সাথে এটাও মনে পড়ল, সেদিনের পর শিহাবের সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি মাহদীর। সে যেমন কল দেয়নি, শিহাবও দেয়নি। অথচ এই সেই ছেলে যে কিনা বলেছিল, মাহদী বিয়েতে না আসলে বিয়ে করবে না। মিনিটে মিনিটে কল, সেকেন্ডে সেকেন্ডে মেসেজ পাঠিয়ে মাহদীকে জ্বালিয়ে মারছিল। তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে হয়ে বিয়েতে এসেছিল সে। সেই বন্ধু এতগুলো বছরে একবারও কল দেয়নি? মাহদীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। সে চট করে পকেট থেকে ফোন বের করল। ডায়াল লিস্ট, ম্যাসেজ বক্স, মেসেঞ্জার, ই-মেইল কোথাও শিহাবকে না পেয়ে মনটা ভেঙে গেল। তাহলে কি নায়রাই ঠিক? মাত্রাতিরিক্ত রাগ প্রিয় মানুষগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়?
মাহদী আর স্থির থাকতে পারল না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাঠ ছাড়তে ছাড়তে শিহাবের নাম্বারে কল দিল। তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। অবশ্যই চাইতে হবে। যে মানুষটা কোনো দোষ না করেও হাজার হাজার মানুষের সামনে মার খেয়েছে। একটা প্রতিবাদ করেনি। সে মানুষটা যে তাকে কতটা ভালোবাসে তা কি মাপার প্রয়োজন আছে? ভালোবাসা যত গাঢ়, অভিমান তত প্রগাঢ়।
প্রথম রিংয়েই কল রিসিভ হলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। মাহদী কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
” সরি, শিহাব। ”
শিহাব অভিমান ভেঙে কথা বলল,
” একটা সরি বলতে এত দেরি? ”
মাহদী কিছু বলতে পারল না। তার চোখ দুটো অশ্রুতে টলমল! ধরা গলায় বলল,
” কেমন আছিস? ”
তাদের ফোনালাপ চলল অনেক্ষণ। মাহদী দিনাজপুর আছে শুনে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল শিহাব। কল কাটার আগে বলল,
” তুই ওখানে থাক। আমি এখনই আসছি। ”
_____________
নিহিতা দোতালা ছেড়ে নিচ তলায় আসতে দেখে একটা ছেলে এদিকে আসছে। সে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করার আগেই ছেলেটি দেখে ফেলল। দূর থেকে বলল,
” নিহিতা, ওখানেই দাঁড়াও। তোমার সাথে কথা আছে। ”
নিহিতা চট করে বুঝে গেল এই ছেলেই আহাদ। তার কথার অবাধ্য হয়ে অন্য দিকে হাঁটা ধরল। দ্রুত পদে বারান্দা পেরিয়ে মাঠে পা রাখল। আরেকটু সামনে এগুলেই বাইরে বেরুনোর গেইট। সে ভেতরে ভেতরে এত ভয় পেল যে ঠিক করে ফেলল, আগামী এক সপ্তাহ কেন এক মাসও ক্যাম্পাসে পা রাখবে না!
নিহিতা ঘন পা ফেলতে ফেলতে বার বার পেছন তাকাচ্ছিল। আহাদের থেকে নিজের দূরত্ব মাপছিল। দূরত্ব মাপতে গিয়েই ঘাসে পা আটকে গেল। হুমড়ি খেয়ে পড়ল কারও উপর। মানুষটির দিকে তাকানোর পূর্বেই কথা বলে উঠল,
” নিহিতা না? ”
নিহিতা তার বাঁধনে থেকেই মুখ তুলে তাকায়। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” আপনি? ”
মাহদী নিহিতাকে ছেড়ে দাঁড়াল। খানিকটা দূরত্ব তৈরি করে বলল,
” হ্যাঁ, তোমার বোনও তো এখানে পড়ত। ”
আহাদ দূর থেকে সব দেখছিল। নিহিতার কাছকাছি এসে শক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” ইনি কে, নিহিতা? ”
নিহিতা উত্তর দেওয়ার আগেই কেউ একজন বলল,
” নিহিতার স্বামী। ”
চলবে