#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
|| ৯ম পর্ব ||

ওগো অপরূপা, হেরি তব রূপ ক্ষণে ক্ষণে
কি ভাব তুমি আপন মনে ?
কি ছিলে, কি আছ বা কি হইবে , রাখি হাত ভবিষ্যতের অতলান্ত গহ্বরে !
রূপ লাগি রূপ রহে অরূপের মাঝে।
তুমি কি তাহারে খুঁজিছ দিনে কিম্বা সাঁঝে ?

প্রকৃতির সাথে মিশে আয়নার রুপ যেনো বেড়েই চলছে জারিফের আঁখিযুগলে। জারিফ মনে মনে ভাবছে, আয়না কি কোন মায়া জানে? আয়নার কথার আওয়াজ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই আলাদা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। মাত্র কয়েকঘন্টার ব্যবধানে জারিফকে নিজের প্রতিবিম্বে বন্দি করে ফেলছে। জারিফ নিজের মনকে কঠিন একটা গালি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল যেখানে আয়না সহ আরো কিছু বাচ্চারা রান্না করছে।

– কি ব্যাপার বোম্বাইমরিচ, আজ অনেক আনন্দিত মনে হচ্ছে তোমাকে?

আয়না উৎফুল্ল মেজাজে বাচ্চাদের সাথে রান্না করছিল। আয়না বাচ্চাদের কাছে এসে একদম বাচ্চা বনে গিয়েছিল। সে ভুলে গিয়েছিল যে, তার ভেতরে অন্য একটা সত্তার অবস্থান। জারিফের কথা শুনে নিজেকে আগের মতো কঠিন বানিয়ে ফেলল যা জারিফের চোখে এড়ায়নি। আয়না নিজের অবস্থান থেকে উঠে জারিফের উদ্দেশ্যে বলল,

– চলুন মাছ ধরতে যাই। কি দিয়ে মাছ ধরতে ইচ্ছে পোষণ করছেন? বড়শি নাকি মাছ ধরার জাল?

– বড়শিতে মাছ ধরার মজাই আলাদা। তুমি বরঞ্চ দুটো বড়শির ব্যবস্থা করো।

আয়না প্রায় সময় এখানে আসে মনকে ভালো করার জন্য। তাই এখানের অনেকেই আয়নাকে চেনে। ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে এখানে এসে শতবার বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছে আয়না কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম করতে চাচ্ছে।

কিছু কিছু সময় আছে যেখানে চাইলেও বিজয়ী হওয়া যায়না ইচ্ছে করে হারতে হয়। আয়নার আজও ব্যতিক্রম কিছু করছে না।

আয়না অনেক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করছে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে। বড়শিতে মাছ আটকে যায় ঠিকই কিন্তু পানি থেকে পাড়ে উঠালেই খালি বড়শি চলে আসে। জারিফ আয়নার এই অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে পাগলপ্রায়, কোনরকম হাসি থামিয়ে আয়নার উদ্দেশ্যে বলল,

– বোম্বাইমরিচ, তুমি দেখতে যেমনটা ঝাল কাজে কিন্তু ততটাই ঢেঁড়স। এখন বোম্বাই মরিচ আর ঢেড়স একত্রিত হয়ে ঝাল ঢেড়স ফ্রাই-ই হবে যা খেতে একদম জঘন্য হবে। আসো তোমাকে শিখিয়ে দেই কিভাবে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে হয়।

তো দেখো বড়শি দিয়ে কিভাবে মাছ ধরতে হয়। প্রথমে বড়শিতে কিছু খাবার আটকে দেবে তারপর এভাবে ছেড়ে দেবে যখন দেখবে ওইযে ভাসমান পাতাটি একটু নড়ে উঠেছে তখন-ই শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ছিপে টান দিবে দেখবে মাছ উঠে গিয়েছে।

জারিফ এতক্ষণ প্র্যাকটিক্যালভাবে আয়নাকে মাছ ধরা শিখাচ্ছিল। আয়নাও খুব মনোযোগ সহকারে মাছধরা দেখছে যেন সে একজন ছাত্রী আর জারিফ তাঁর শিক্ষক। এবার আয়না বড়শি ফেলল পানিতে। একবার, দুইবার, তিনবার কোনোবার মাছ ধরতে সক্ষম হল না। আয়না অসহায় চাহনিতে জারিফের পানে তাকালো। জারিফ নিছের কপাল চাপড়ে আয়নার সম্মুখে এসে পেছন থেকে আয়নাকে জড়িয়ে ধরল। বড়শি পানিতে ফেলে আয়নার হাতের উপর নিজের হাত রাখল। আয়না কোঁনাচোখে জারিফকে একবার দেখে নিল। মাছ বড়শিতে আটকে গেছে তখনই টেনে পাড়ে নিয়ে আসল জারিফ।

পাশের বাচ্চারা আনন্দে নাচতে শুরু করল বড়শিতে একসাথে দুটো মাছ ওঠায় । আয়না জারিফকে এঅবস্হায় দেখে বাচ্চাদের করতালি আরো তিনগুন বেড়ে গেল। জারিফ আবেগের বসে এতক্ষণ কি করছিল তা ভেবে আয়নার থেকে দূরে চলে যায়। এদিকে আয়না জারিফের কান্ড দেখে বাঁকা হাসে।

বাচ্চাদের থেকে বিদায় নিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আসার সময় প্রথমে জারিফের বাসা পড়ে তারপর আয়নার। এত রাতে একজন মেয়েকে নিয়ে বাইকে চড়া সুবিধাজনক না মানুষ নানা কথা বলতে পারে এবং অন্য কিছু ভাবতে পারে তাই জারিফ ঠিক করল বাসায় গিয়ে বাইক রেখে গাড়ি নিয়ে আয়নাকে পৌঁছে দিবে।

জারিফের বাসায় আসতে আসতে রাত হয়ে যায়। আয়নাকে বাগানে বসতে বলে জারিফ বাড়িতে ঢুকে গাড়ির চাবি আনার জন্য।

– আপনি কি আমার ভাবি হবে?

আকস্মিক কারোর চাঁপা কন্ঠস্বর শুনে আয়না আঁখি জোড়া খুঁজে চলছে শব্দের উৎস।

– আমি এখানে উপরে বারান্দায়।

বারান্দায় কারোর কথা কানে আসায় আয়না উপরে তাকায়। একটা মেয়ে হাতে একটা টেডিবিয়ার নিয়ে গোল গোল চশমাযুক্ত চোখে আয়নাকে দেখছে।

– উত্তর দিলেন না আপনি কি আমার ভাবি হবেন?

আয়না ভালো করে দেখলো পিচ্চি মেয়েটা দর্পণের থেকে দুই এক বছরের ছোট হবে কিন্তু দেখতে মাশাআল্লাহ, পুরাই জারিফের কার্বনকপি। গোল গোল চশমা পড়ে সুন্দর ভাবে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। আয়নায় নিজ অবস্থান থেকে উঠে বারান্দার কিছুটা কাছে এসে বলল।

– না আমি তোমার ভাবি হবো না কিন্তু তুমি যদি চাও তাহলে হবো।

সাজিয়া এবার খুশি হয়ে যায়। আস্তে করে বলে,

– আমার নাম সাজিয়া। আপনার নাম কি?

– আমি আয়না।

– আমিতো চাই এমন সুন্দর পরীর মত আমার ভাবি হোক। কিন্তু আপনি নিচে বসে আছেন কেন? ভেতরে আসুন আমার সাথে দেখা করুন। ভাইয়া কি আপনাকে এখানে বসিয়ে রেখেছে?

– হ্যাঁ বাচ্চা মেয়েটা, তোমার ভাইয়া তো ভীষণ পাজি। আমাকে বাহিরে বসিয়ে রেখে ভেতরে আরাম করছে। আর আমি এখানে বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছি।

আয়না সাজিয়াকে কিছুটা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে বলল। প্রত্যুত্তরে সাজিয়া দ্রুততার সহিত বলল,

– আপু আপু আপনি দাঁড়ান আমি এখনই আসছি, আপনাকে নিয়ে যাব। আর ভাইয়াকে বকা খাওয়াবো মায়ের কাছ থেকে।

আয়না এতক্ষণ মেয়েটার সাথে দুষ্টামি করছিল কিন্তু মেয়েটা যে তার দুষ্টুমি না বুঝে তাঁর মন মত কাজ করবে তা ভাবতে পারেনি।

প্রায় দুই মিনিট পর মেয়েটা এক ভদ্রমহিলা কে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে।

– মা দেখো একটা মিষ্টি আপু বাগানে বসে আছে। ভাইয়া এই আপুটাকে বাহিরে বসিয়ে রেখেছে। এখানে বসে মশার কামড় খাচ্ছে।

জারিফের মা আয়নার দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখল। মেয়েটার মনে কোন ভয় ভীতি নেই। জারিফের মা অত্যন্ত বুদ্ধিমতি মহিলা।ছেলে মেয়ের ব্যাপারে খুবই কঠিন। এজন্যই জারিফ আয়নাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়নি । জারিফ জানে তার মা বাসায় মেয়ে আনা পছন্দ করেন না।

– ভেতরে এসো। রাত অনেক হয়েছে।

———–

সোফায় বসে আয়না বাড়ির চারপাশের পর্যবেক্ষণ করছে। বাড়ির আসবাবপত্র দেখে বোঝাই যাচ্ছে জারিফের মা খুবই সৌখিন মহিলা। ঘরের আনাচে কানাচে কোথাও ময়লার চিহ্ন পাওয়া যাবে না।

-এই তুমি এখানে? তোমাকে না আমি বাহিরে বসিয়ে রেখে এসেছিলাম?

আয়না তাকিয়ে দেখছে জারিফ আগের পোষাকে নেই, হয়তো গোসল করে এসেছে এজন্যই মাথার চুলগুলো ভিজে। আয়না জারিফকে দেখে কেমন যেন লাগতে শুরু করেছে তাই অন্য দিকে ফিরে বলল।

– আপনার মা আমাকে নিয়ে এসেছেন।

জারিফের মা হাতে একটা তোয়ালে নিয়ে আসতে আসতে বলল,

– মেয়েটাকে বাহিরে বসিয়ে রেখে এসেছিলে কেন এত রাতে কি বাইরে রাখা যায়?

– তোমার ভয় আনি নাই যদি উল্টাপাল্টা কোন কিছু মনে করো তাই।

জারিফের মা ছেলের বোকা কথা শুনে জারিফের মাথায় একটা চাটি দিয়ে বলল,

– এখন অনেক কিছু মনে করেছি, যা ভাবার ভেবে নিয়েছি। তুই এখন শত সত্যি কথা মিথ্যা কথা বললেও লাভ হবে না।

– মা, এটা ঠিক না। আমি তোমাকে সত্যি বলছি এই হচ্ছে আমার ভার্সিটির জুনিয়র ছাত্রী রাস্তায় বিপদে পড়েছিল তাই সাথে করে বাসায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাইকে যাওয়াটা রিক্স মনে হচ্ছিল এজন্য বাসায় এসে গাড়ি নিতে চেয়েছিলাম।

– গাড়ি থাকে গ্যারেজে তুই তোর ঘরে কি করিস?

– আরে মা খুব গরম লাগছে ওই জন্য গোসল করে একেবারে নিচে আসছি। আমি কি জানি এতো সময় লাগবে আর তোমরা এই মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসবে?

– হয়েছে হয়েছে আর বাহানা বানাতে হবে না।

মা ছেলের কথোপকথন এর মাঝেই আয়না বলে উঠল,

– আন্টি, আমার কোনো বিপদ হয়নি আপনার ছেলে আমাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল।

আয়নার মুখে হুটকরে সত্যি কথা বলায় জারিফ হতভম্ব হয়ে যায়। জারিফ ভাবতে পারেনি আয়না এভাবে তাকে কেস খাওয়াবে।

– মিথ্যা কথা মা। এই বোম্বাইমরিচ মিথ্যা কথা বলছে। আমি তো এই মেয়েকে সহ্য-ই করতে পারিনা।

জারিফ দ্রুততার সাথে তার মাকে উওর দিল।

– আন্টি আমি মিথ্যা বলি না। আপনার ছেলের মন খুব খারাপ ছিল তাই আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল এবং এটাও বলেছে আজ আমাকে নিয়ে বের হওয়া শুরু এবং শেষ।

জারিফ পরপর বিষম খাচ্ছে। আয়নার মুখে সত্য কথা শোনার পর।

জারিফের মা আয়নার আর জারিফের কথা কাঁটাকাঁটিতে এবার এদের ধমক দিলো।

– এই তোরা চুপ করবি? আমি ইই মেয়েটার কথাই বিশ্বাস করে নিয়েছি। আমি জানি আমার ছেলে কেমন? একদম দুষ্টের হাড্ডি মিথ্যা বলায় উস্তাদ।আমি তোর চোখ দেখে বুঝতে পেরেছি কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা বলেছিস। আয়না যা মা ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ রাতে এখানেই থাকবি তোর বাসায় বলে দে। কারণ এত রাতে আমি কোন মেয়েকে আমার ছেলের সাথে পাঠাবো না।

জারিফ মায়ের কথায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মা আয়নাকে তুই বলে সম্বোধন করছে। জারিফের মা সচরাচর কাউকে তুই বলে সম্বোধন করে না। যাদের মনে ধরে তাদেরই তুই বলে।

আয়না ছল ছল চোখে কিছুক্ষণ জারিফের মায়ের পানে চেয়ে থাকে তারপর বাধ্য মেয়ের মত গেস্টরুমে চলে গেল কারণ আয়না খুবই ক্লান্ত তার বিশ্রামের প্রয়োজন।
গেস্ট রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে আয়নার শরীর কেমন উসখুস করছে। এখন একটা শাওয়ার নিলে ভালো হতো কিন্তু এখানে তো তাঁর জামাকাপড় নেই।এসব ছোট ছোট ভাবনা ভাবতে ভাবতেই জারিফের মা প্রবেশ করে হাতে শাড়ি নিয়ে।

– আয়না তুই বরং গোসল করে আয়। এই নে শাড়ি এবাড়িতে তো আর আমার কোন বড়ো মেয়ে নেই। আর সাজিয়ার জামা তোর হবে না এজন্য শাড়ি নিয়ে আসলাম। হ্যাঁ রে মা আমি তোকে তুই বলে ডাকাতে রাগ করেছিস?

– না আন্টি রাগ করিনি। খুব ভালো লাগছে আপনার মুখে তুই শুনতে।

– আসলে তোকে দেখে কেমন আপন মনে হচ্ছে তাই তুই বলে সম্বোধন করছি আরো আপন করার জন্য তুই কিছু মনে করিস না।

জারিফের মায়ের মুখে এসব কদা শুনে আয়নি এবার কেঁদে দিলো। আজ কতবছর পর ফারিয়া দর্পণ ছাড়া অন্য কাউকে আপন মনে হলো আয়নার

– আমার মা নেই মায়ের মুখ থেকে তুই তুমি কিছু শুনতে পারিনি। ভালো লাগছে আপনার মুখে তুই ডাক।

– আচ্ছা তুই গোসল করে খেতে আয়। এরপর থেকে যখন মন খারাপ হবে আমার কাছে চলে আসবি অনেক আদর করে দেব।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here