#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||৮ম পর্ব ||
শীতকালের শেষ সময় বসন্তের শুরু। গাছে গাছে ফুলের আগমন ঘটছে। পুরো ক্যাম্পাস ফুলের বাগান হয়ে আছে। সকাল সকাল শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে ফুলের সুবাস উপভোগ করে। ক্যাম্পাসের মাঠে সকলে যে যার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে দৌঁড়ে জারিফের বন্ধু শিহাব এসে বলে।
– ব্রেকিং নিউজ, আমাদের ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মিলিকে কে বা কারা যেন দুদিন আগে ভার্সিটি ছুটির পর কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। কাল রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটার দিকে মিলিদের বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। আশ্চর্যজনকহলেও এটা সত্যি যে কিডন্যাপাররা মিলির কোন ক্ষতি করেনি মানে রেপ আর কি কিন্তু এর চেয়েও ভয়ানক কাজ করেছে।
সকলেই নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে এতক্ষণ মনোযোগ সহকারে শিহাবের কথা শুনছিল।
মাঝপথে শিহাবের চুপ হয়ে যাওয়ায় মোনালিসা বিরক্ত হয়।
– আরে শিহাইব্বা চুপ হয়ে গেলি কেন, তারপর কি হলো বল?
শিহাব এবার শুকনো ঢুক গিলে বলতে শুরু করে।
– মিলির অবস্থা খুবই ভয়াবহ। কিডন্যাপাররা মিলির দুই হাত ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে ছিঁড়ে ফেলেছে। মিলির ঠোঁটখানা কুঁচিকুঁচি করে কেঁটেছে যেন পরবর্তীতে ঐ ঠোঁটের সাহায্যে কথা বলতে না পারে। এছাড়াও মুখে হাজারো থাপ্পড়ের চিন্হ আছেই। মিলির বাবা মা নাকি রাতেই মিলিকে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।
উৎসুক সকলের মাঝে হালকা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সকলের মাঝে রাতুল বলে উঠলো যে কিনা জারিফের বিরোধীপক্ষ। জারিফকে কখনোই সহ্য করতে পারে না। ক্যাম্পাসে জারিফের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র করেছে। তাই এই সুযোগটা হাত ছাড়া করল না। একটু ব্যাঙ্গ সুরে বলা শুরু করল,
– দুইদিন আগে না মিলিকে জারিফ শাসাচ্ছিল তাকে প্রোপজ করেছিল বলে দেখ গিয়ে জারিফই কিছু একটা করেছে মিলির সাথে।
রাতুলের কথায় ওর সহযোগি কয়েকজন সায় দিচ্ছে।
– স্টপ গাইজ, আমার সাথে শেষ কথা হয়েছে বলে এই না যে আমিই কিছু করেছি। সেদিন আমি লাইব্রেরিতে ছিলাম বিকেল পর্যন্ত যার প্রমাণ লাইব্রেরির শরিফ স্যার। আর রাতুল তোকে শেষবারের মতো ওয়ার্নিং দিচ্ছি কারোর সম্পর্কে কিছু না জেনে কখনোই মিথ্যা অপবাদ দিবি না।
ক্ষিপ্তভাবে কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে গেল জারিফ।
——-
– কি প্রেমিক পুরুষ, রেগে আছেন কেন?
জারিফের রাগ অনেক। শান্তশিষ্ট ছেলে যখন রেগে যায় তখন আশেপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হয়। জারিফের অবস্থা কিছুটা এমন। আয়না স্টিলের স্কেলের সাহায্য নিজের হাতের নখে আঁচড় কাঁটছিল। নখে আস্তে করে ফুঁ দিয়ে আবারও প্রশ্ন করল।
– কি হলো সিনিয়ার ভাইয়া।
– আমার সাথে একজায়গায় যাবে? ভয় নেই আমি মেয়েদের অনেক সম্মান করি, তোমার কোন ক্ষতি হতে দিব না।
জারিফের কথায় আয়না হাসতে লাগল। কোনরকম হাসি থামিয়ে বলল।
– ভয় পাবো, তাও আপনার মতো আলুকে?
– আলু মানে?
– দেখতে তো আপনাকে আলুর মতোই লাগে।শরীরে সামান্য শক্তি আছে কি না সন্দেহ।
আয়নার কথা শুনে জারিফের রাগ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আয়নার কাছে এসে আয়নায হাত পেছনে মুড়ে এবার প্রশ্ন করল।
– এবার বলেন মিস বোম্বাইমরিচ, আমি আলু না লোহা? ছেলেদের শক্তি সম্পর্কে আপনার কোন ধারনা নেই মিস বোম্বাইমরিচ।
এত দ্রুত জারিফ এমন একটা কাজ করবে তা আয়না ভাবতে পারেনি। আয়নার নিঃশ্বাস দ্রুত চলছে, শরীরের বল হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। জারিফ এবার আগের ন্যায় আরো শক্ত করে আয়নার হাতদুটো আকড়ে ধরল। আয়নার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল।
– কি মিস বোম্বাইমরিচ, আপনার মুখের তোতাপাখির আওয়াজ আর আসছে না কেন? সব কথা শেষ?
জারিফের আস্তে কথায় আয়না কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে বলল
– এতদিন জানতাম তাযিন জারাফ দা চকলেট বয় মেয়েদের পাত্তা দেয় না কিন্তু আজ দেখছি তাযিন জারিফ মেয়েদের সাথে লেপ্টে থাকতে পছন্দ করে। কিছুক্ষণ আগেই না বললেন আপনি মেয়েদের সম্মান করেন এই তাঁর নমুনা!
আয়নার কথায় জারিফ আস্তে করে আয়নার হাত ছেড়ে দেয়। আয়না নিজের দুহাত সামনে এনে দেখে অনেকক্ষণ শক্তভাবে ধরে রাখায় হাত নীলচে রঙ ধারণ করছে। তা দেখে খানিকটা মুচকি হেসে জারিফের দিকে তাকিয়ে দেখে কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে তাঁর মাঝে। আয়না জারিফকে স্বাভাবিক করতে বলে।
– তা আমায় কোথায় নিয়ে যাবেন?
– আমার পছন্দের জায়গায়।
– বাইক আছে তো?
– হ্যাঁ।
– তো দেরি কিসের আমি রেডি চলুন।
আয়নার কথায় জারিফ অবাক হয়ে যায়। আয়না একদম নরমালভাবে আছে এখন। পরনে সবসময়ের মতো আকাশি রঙের থ্রি-পিস ওরনা পেছন থেকে সামনে ঝুলানো, মাথার চুলগুলো এলোমেলো, কানে ঝুমকো। জারিফ আয়নার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল,
– সিরিয়াসলি তুমি এভাবে যাবে? মানে আমার দেখা অনুযায়ী মেয়েরা কোথাও গেলে আচ্ছামতো আটা ময়দা মেখে বের হয় তাই বললাম।
জারিফের কথায় আয়না মন খুলে হাসে, হাসতে হাসতে একপর্যায়ে বলে।
– কোন গ্রন্থে লেখা আছে যে মেয়েরা বাহিরে বের হলে সেজেই বের হতে হবে? আপনার যদি আমার এই অবস্থাতে খুবই সমস্যা হয় তো দাঁড়ান একনই পরিবর্তন করছি।
কথাগুলো বলে এবার আয়না চুলগুলোকে হাতের সাহায্যে মাঝসিঁথি করে খোপা করে নেয় আর ঝুলন্ত ওরনাখানা সুন্দর করে মাথায় পেঁচিয়ে ঘোমটা আকারে নিয়ে নেয় ব্যস আয়না রেডি।
জারিফ সূক্ষ্মভাবে আয়নাকে পর্যবেক্ষণ করছে। চুল খোপা আকারে বাঁধার কারণে সামনে ছোট কিছু চুল এসে পড়েছে। মাথায় ঘোমটা দেওয়ায় গুন্ডি রুপ পরিবর্তিত হয়ে লাজুক রুপ ধারণ করেছে। জারিফ তো এবার সত্যি সত্যিই এই বোম্বাইমরিচ মরিচের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। জারিফ এবার নিজের মনকে কয়েকটা কঠিন বকা দিয়ে দিল। জারিফ কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিল যে তার সামনে বোম্বাইমরিচ দাঁড়িয়ে আছে। জারিফের এমন হাজারো চিন্তা চেতনার মাঝে আয়না হাতের তুড়ি বাজায়।
– আপনি মাঝে মাঝে কোন দুনিয়ায় চলে যান? দেখেন আজই আপনার সাথে কোথাও যাওয়া শুরু এবং শেষদিন। আপনার সাথে প্রেম পিরিত করলে জমবে না। আপনার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে ঝগড়া মানায়।
আয়নার এমন কঠিন সহজ কথা শুনে জারিফ মুচকি হাসে। জারিফের এখন মন ভালো হয়ে গিয়েছে আয়নার সঙ্গ পেয়ে। চোখে সানগ্লাস পড়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
– সেটা সময় বলে দিবে বোম্বাইমরিচ।
———
শো শো বাতাস বইছে চারপাশে। মোটরবাইক চলছে অচেনা রাস্তায়। বর্তমানে মোটরবাইকের গতি একদম নিম্ন তাঁর কারন হলো আয়নার ঘুম। জারিফের কাঁধে হেলে আরামে ঘুম দিচ্ছে সে যেন শত বছরের ঘুম আজ ঘুমাচ্ছে। প্রথমে আয়নার এমন কাছে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু এখন সয়ে গিয়েছে তাইতো আস্তে আস্তে বাইক চালাচ্ছে।
হঠাৎ ব্রেক হওয়ায় আয়নার ঘুম ভেঙ্গে যায় ফলস্বরূপ আয়না নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে সরে আসে।
– এসে পড়েছি? চলুন সামনে হাঁটি।
জারিফ মোটরবাইক লক করতে করতে উওর দেয়।
– তোমার কথায় আমার পছন্দের জায়গায় না গিয়ে এখানে আসলাম। মন ভালো না হলে হলে জরিমানা দিতে হবে।
– কিসের জরিমানা?
– সময়ের।
– আচ্ছা দেখা যাবে চলুন।
আয়নারা এক বাজারে প্রবেশ করেছে। বাজারটায় বট গাছে ভরপুর। হাজার হাজার বছর আগের বট গাছ এগুলো। বট গাছের এক একটা শেকড় থেকে আরো গাছের জন্ম হয়েছে এখানে । বাজারের দিন না থাকলে জায়গাটাকে কেমন ভুতুড়ে দেখায়।
– মামা দু কাপ মালাই চা দাও তো?
ছোট্ট একটা টিনের ছাউনি দোকানের টুলে বসে যায় আয়না। জারিফ তখনও দাঁড়িয়ে। চিন্তা করছে আয়নার কথা। জারিফ যতটুকু শুনেছে আয়নারা অনেক বড়লোক কিন্তু ভার্সিটিতে আয়না একদম সাদামাটা আসে। আয়নার ইশারা বুঝতে পেরে টুলে বসে যায়।
গরম গযম মালা চা নিয়ে হাজির হয় দোকানের মামা। চায়ের উপরিভাগের অংশে মালাইয়ে ভরপুর আর নিচের অংশে চা। এক একটা চুমুকে তৃপ্তি পায় জারিফ । চা শেষ করে আয়না জারিফের উদ্দেশ্যে বলে,
– মাছ ধরতে জানেন?
– না।
– চলেন আজ আপনাকে মাছ ধরা শেখাবো।
আয়নার প্রতিটা কাজে জারিফ অবাক হচ্ছে। এই মেয়েটার মাথায় কি খেলছে কে জানে । আজ জারিফকে কাঠের পুতুল মনে হচ্ছে। আয়নার প্রতিটা কথা শুনতে ইচ্ছে করছে। চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে।
– ও বোম্বাইমরিচ কি আমাকে তোমার ঐ মাথাতে?
চলবে…….