#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||৭ম পর্ব ||

নির্জন রাস্তা। পেটের দায়ে হাতেগোনা কয়েকটা রিকশা চলাচল করছে রাস্তায়। রাত এখন মোটামুটি গভীর। চারজোড়া পা এই রাতে হেঁটে চলছে অজানা গন্তব্যে। ঘুমন্ত শহরে সবকিছুই ঘুমন্ত। রাস্তার পাশে ছোট টোকাইরা প্লাস্টিকের বস্তার সাহায্যে নিজেদের ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। এক একটা বড় বাস আসা যাওয়ায় যে বাতাস সৃষ্টি হচ্ছে সেই বাতাস এসে গা থেকে আবরণকৃত বস্তাকে সরিয়ে নিচ্ছে।
আয়না অনেকক্ষণ যাবত পথশিশুদের লক্ষ্য করছে। আয়নার দুলাভাই ইমরান পেছনে ফিরে আয়নার দৃষ্টি অনুসরণ করে পথশিশুদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। যার অর্থ, আজ এই পথশিশুরা আপন নিবাস পাবে যা তিনি আয়নার মুখশ্রী অবলোকন করে বুঝতে পেরেছেন।
– আয়ু, মন যা বলছে করে ফেল। ভুলে যাবি না তোর এই ভাইয়ু আছে সবসময় তোর পাশে। আমি ফারিয়াকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছি। তোর উপর আমার আস্থা আছে। নিজের খেয়াল রাখবি।
আয়না প্রশান্তির হাসি হেসে মাথা নতজানু করে সায় দিলো যার অর্থ সে নিজের খেয়াল রাখতে পারবে সাথে আশেপাশের দশজনের খেয়ালও রাখতে পারবে।

– দর্পণ, যাবি আমার সাথে?

দর্পণ ছেলেটা দারুন মেধাবী। উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা প্রখর কিন্তু শক্তিতে আনাড়ি। আয়নার এক বাক্যে বুঝে যায় তার আপাই এখন কি কাজ করতে উদ্যত নিচ্ছে। হাতের মুঠোফোন পকেটে ঢুকিয়ে আয়নাকে সাহায্য করতে চলে গেল।

———

বাদলে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। সাদা আকাশে মেঘের ভেলা কখনও ছাই রং ধারণ করছে তো কখনও সাদা।
ভার্সিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানের পর পুরো ভার্সিটি এখন রমরমা পরিবেশ। নবীনদের মনে এখনও অনুষ্ঠানের রেশ রয়ে গিয়েছে। ভার্সিটির ক্লাস আরম্ভ হতে এখনও অনেক সময় বাকী। জারিফ আজ অনেক সকালেই ভার্সিটিতে এসেছে। মাঠের একপাশে সোনাপাতি ফুলের গাছের নিচে বসে কিছু একটা লিখছে। সোনাপাতি ফুলগুলো হলুদ রঙের হয় এই ফুলগুলোর এক ডালে অনেকগুলো একসাথে হয়। জারিফ একদম সোনাপাতি গাছটার নিচে বসে বিধায় হলুদ ফুলগুলো আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

ভার্সিটিতি পৌঁছুতেই আয়নার হাতে একটা ছোট বাচ্চা কাগজের ছোট্ট একটি টুকরো ধরিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। খুব দ্রুত এসব হওয়ায় আয়নার বুঝতে দেরি হয় যে কি হলো এখন। হাতের মুঠোয় অবস্থিত চিরকুটখানা খুলে দেখে তাতে লেখা আছে,

” অপেক্ষা করছি তোমারি আশায় , হলুদ ফুলে সিজিয়ে দেবো তোমার ঐ গলায়। অপেক্ষা করছি প্রিয়, হলদে ফুলের বিস্তৃত এলাকায়।

চিরকুটখানা পড়ে আয়না হতভম্ব হয়ে যায়। আধুনিক যুগে চিরকুটের ব্যপারটা আয়নার হজম হচ্ছে না তাও আবার আয়নাকে চিরকুট দিচ্ছে! আয়না রেগে ভার্সিটির শেষ প্রান্তে সোনাপাতি গাছের দিকে অগ্রসর হলো।

– আমি তোমাকে ভালোবাসি বোম্বাইমরিচ। জীবনের শেষ সময়ে পানপাতা খাবার সঙ্গী হিসেবে তোমাকে চাই। গভীর সমুদ্রে ঢেউয়ের রাজ্যে তোমার সাথে পাড় করতে চাই। সবসময় এই গুন্ডি মেয়েটাকে আমার পাশে চাই। হবে কি আমার বোম্বাইমরিচ?

সোনাপাতি গাছটার নিকট এসে জারিফকে দেখে কিছুটা না অনেকটাই অবাক হয়ে যায়। জারিফের নিকট যেতেই আয়নার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে যায় জারিফ। মুচকি হেসে আগে থেকে তৈরি করা সোনাপাতি হলদে ফুলের মালা দিয়ে প্রপোজ করে আয়নাকে। জারিফের এহেন কাজে আয়নার স্মৃতিশক্তি লোপ পাবার উপক্রম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আয়নার মতো সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের পানে। কিছু মানুষজন তো উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়নার উওরের আশায়।
আয়না জারিফের প্রপোজ করা দেখে হাতে তালির আওয়াজ করে অট্টহাসিতে হাসলে লাগল। এতক্ষণ উৎসুক সকলে এখন গাঢ় দৃষ্টি অবলোকন করল।

– বাহ্,বাহ্! ভার্সিটির চকলেট বয় তাযিন জারিফ আমাকে প্রপোজ করছে। তাও আবার খোলা আকাশের নিচে? অমি কি স্বপ্ন দেখছি? যেই ছেলেটা কয়েকদিন আগেও আমাকে হেনস্তা করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে সেই ছেলে নাকি আজ আমাকে প্রপোজ করছে। তা মিস্টার তাযিন জারিফ আবার কি চলছে আপনার মাথায়?

জারিফ এবার মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে যায় আয়নার বরাবর। আয়নার একদম কাছাকাছি এসে হাতের সোনাপাতি হলদে ফুলের মালা পরিয়ে দেয় আয়নার গলায়। আরো কিছুটা কাছে এসে বলে,
– তোমাকে ভালোবাসি বলেছি কোন পাপ করেছি বলিনি। আর মানুষের মন সবসময় একইরকম থাকে না। ভালোবাসতে হাজার সালের প্রয়োজন পড়ে না ঐটা খানিক সময়ই যথেষ্ট। আমি তোমাকে ভালোবাসি এটাই সত্য।
জারিফের এত কাছে আসায় আয়নার অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়ায় তা জারিফকে বুঝতে না দিয়ে আয়না দূরে সরে যায়।

– আপনার এখন ভালোমানুষ সাজতে হবে না। আমি জানি আপনি শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে এমন করছেন ।

– আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।
– কবে থেকে। আর প্রমাণ কি?

আয়নার প্রশ্নে জারিফ চুপ হয়ে যায়। তা দেখে আয়না নিজের গলার হলদে মালা জারিফের হাতে ধরিয়ে হাসতে হাসতে ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে। যাওয়ার আগে জারিফের উদ্দেশ্যে বলে যায়।

– ভালোবাসা, কয়েকটা শব্দ নিয়ে গঠিত একটা বাক্য কিন্তু এর গভীরতা অনেক। আগে মন থেকে ভালোবাসতে শিখুন তখন মন যা বলবে তাই করবেন।

আয়না যেতেই উৎসুক সকলে হাসতে শুরু করল। কেউ কেউ রসিকতা করে বলতে শুরু করল,
– জারিফ দা চকলেট বয় যে কি না কোন মেয়েকে পাত্তা দিতো না আ তে ব্যর্থ প্রমিক উপাধি পেল হা হা হা।
– যাই বলিস, আজ জারিফের ভালোই অপমান হয়েছে সবার সামনে।

একেকজনের এমন কথায় জারিফ নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। আজ আয়নাকে প্রপোজ করা ডেয়ার ছিলো কিন্তু আয়নার করা আজকের ব্যবহারে নিজের মধ্যে জিদ চেপে যায় আয়নাকে নিজের প্রেমে আবদ্ধ করতে।
জারিফের শত ভাবনার মাঝে মিলি নামের একটা মেয়ে এসে বলে,

– জারিফ বেবি, ঐ আয়না ময়লা তোমার ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তো কি হয়েছে! আমি আছি তো আমার জারিফ বেবির জন্য। একবার আমার ডাকে সাড়া দিয়ে দেখো। মন প্রাণ উজাড় করে তোমাকে ভালোবাসবো।

মিলি নামের ন্যাকামো কথা শুনে জারিফ রক্তিম রুপ ধারণ করে। হাত উঠিয়ে চড় দিতে নিয়েও থেমে যায় মেয়ে বলে। হাতের হলদে ফুলের মালা জমিনে নিক্ষেপ করে ব্যাগ কাঁধে ফেলে চলে যায়।

দূর থেকে কেউ মিলি নামক মেয়েটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয় যেন পরবর্তীতে চিনতে ভুল না হয়।
——-
বদ্ধ ঘরে দুহাত পেছনে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মিলি। মুখে অতিরিক্ত আঘাতের কারণে ঠোঁটে কোনে কেঁটে রক্ত বয়ে ঝরছে। চোখে কালো কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখায় কিছুই দেখতে পারছে না। অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছে মিলি কিন্তু তার চিৎকারের আওয়াজ বাহিরের কেউ শুনতে পারছে না। এক পর্যায়ে মিলি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। উঁচু হিল পরিহিত রমণী এসে মিলির পাশে বসে চিবুকে হাত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুরু করে,

– আমার জারিফের দিকে যে তাকাবে তাঁরই এই অবস্থা হবে। জারিফ শুধু আমার আর কারোর না।
আমার ভালোবাসার আশেপাশে যে আসবে তার জন্য আমি হিংস্র। কাল তুই তোর আসল অবস্থানে ফিরে যাবি হা হা হা।
রমণীটি যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেল। রুমে শুধু মিলির জ্ঞানহীন দেহ পরে রইলো।

——-
” আমার কল্পনা জুড়ে
যে গল্পেরা ছিলো
আড়ালে সব লুকোনো
সেই গল্পেরা সব

রঙিন হল পলকে
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন
প্রেম তুমি আসবে এভাবে
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি
আজও আছে সেই পথ শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানী?
অভিমানী…

ভার্সিটির টিচার্সদের জরুরী মিটিংয়ের জন্য আজকের ক্লাস বন্ধ তাই শিক্ষার্থীরা যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছে। রাদিফ আর জিনিয়ার জোরাজুরিতে আয়না গিটার হাতে চোখ বন্ধ করে গানটা গাইলো। আয়নার গান শুনে ভরা মাঠের সকলেই চুপ হয়ে যায়। এত মিষ্টি কন্ঠস্বরে গান শুনে সকলেই আনন্দিত হয়ে যায়। জারিফ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে আয়নার পানে। জারিফ মনে মনে ভাবছে,
– এই মেয়েটা এত রহস্যময়ী কেন? এই মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ভেতরে এক আর বাহিরে আরেক।

জারিফের ভাবনার মাঝে একটা মেয়ে এসে আয়নার মুখশ্রীতে পানি ছুঁড়ে ফেলে। এত মিষ্টি একটা মুহূর্তের মধ্যে বেঘাত ঘটাতে অনেকেই বিরক্তবোধ হয়।
হাতে কাঁচের গ্লাস নিয়ে হেলে দোল খাচ্ছে পানি নিক্ষেপ করা মেয়েটা। আয়না ওড়নার সাহায্যে নিজের মুখশ্রী মুছে মেয়েটার পানে তাকায়।
হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট সাথে লাল রঙের টি- শার্ট পরিহিত মেয়েটি বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে। হাতের গ্লাস পাশের বান্ধবীর হাতে দিয়ে বলতে শুরু করে

– তুমিই সেই মেয়ে, যে কিনা কাল সকলের সামনে ভার্সিটির চকলেট বয় তাযিন জারিফের প্রেম নিবেদন প্রত্যাখান করেছ? সাহস তো তোমার কম না জারিফকে কথা শুনাও। দেখো মেয়ে আজ মুখে পানি ছুঁড়ে মেরেছি কাল যদি আবার শুনি তুমি জারিফের সাথে লাগতে এসেছ তাহলে তোমাকে কেঁটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।

কথাগুলো বলে হেলে দুলে চলে খেল মেয়েটা। আয়না নিজের মুখখানা আরো ভালোভাবে মুছে রাদিফকে প্রশ্ন করল,
– কে মেয়েটি?
– মেয়েটির নাম জারিন। জারিফের মামাতো বোন। এক নাম্বারের ন্যাকা আর ভীষণ ভয়ংকর। বড়লোকের মেয়ে বলে যা ইচ্ছে করে ভার্সিটিতে। আজ চার মাস পর ভার্সিটিতে পা রেখেছে। সারাদিন ঘুরাফেরা আর রাতে ক্লাবে যাওয়া তার দৈনিক রুটিন।
রাদিফের কথা শুনে আয়না মুচকি হাসে। কিছু একটা ভেবে রাদিফ জিনিয়াকে বিদায় দিয়ে চলে যায় ভার্সিটি থেকে।

– আয়না, এই আয়না শুনো।

জারিফের ডাকে আয়না থেমে যায়। তাকিয়ে দেখে জারিফ কয়েকটা পথশিশুদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।

– এদের আপন আবাস্থল নেই। ঐদিন রাতের মতো এদেরও কি আপন নিবাস তৈরি করে দিবে?

জারিফের কথায় আয়না ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলে

– আপনি আমাকে ফলো করেছেন?
আয়নার প্রশ্নে জারিফ মাথা চুলকে বলে

– ইয়ে মানে হ্যাঁ করেছি একটু।

– কেন?

জারিফ আয়নার কাছাকাছি এসে বলে

– কারন তুমি আমার বোম্বাইমরিচ। আর বোম্বাইমরিচ যেখানে আলু-পটল তো সেখানে হবেই।
– এই আলু-পটল কে?

– কেন আমি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here