#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৬

ড্রয়িংরুমে সোফার এক কোণে বসে আছে ইসরা। তাকে বাইরে নেওয়ার অপরাধে বকা খাচ্ছে নিরপরাধ মনিরা।

মনিরা তুমি কার কথায় ওকে বাইরে নিয়ে গেছো ?

মাইয়াডার কথা শুনে না করতে পারি নাই। আসছে পর থেইকা একটা ঘরে বন্দী থাকে। তার একটু তো ইচ্ছা করে বাইরে যাইতে।

নিহানের মা রেগে বললো, যা বলবে তাই করতে হবে তোমার ? বেতন কী ওর থেকে নাও, নাকি আমার থেকে ?

মনিরা মাথা নিচু করে বললো, ভুল হইয়া গেছে আর হইবো না।

যাও নিজের কাজে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

মনিরা নিজের কাজে চলে গেলো আর নিহানের মা এবার ইসরার দিকে তাকালো আর বললো, আর কতো হাসির খোরাক করবে আমাদের ? তোমার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে পারি না আমরা। আমাদের পরিবারের কাউকে দেখলে মানুষ হাসাহাসি করে, নানা কথা বলে। আমার ছেলেটা বন্ধুদের সাথে মিশতে পারে না তোমার জন্য। সবাই ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। এসব জানার পরও সকালবেলা নিজের এই কুৎসিত চেহারাটা পুরো মহল্লার মানুষকে না দেখালে চলছিলো না তোমার ?

ইসরার চোখ দুটো টলমল করছে পানিতে, বুক ফেটে কান্না আসছে। নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগছে। এতোকিছুর পরও সে কী করে বাইরে গেলো ? তার বুঝা উচিত ছিলো সে মানুষ খুনের চাইতেও বড় অপরাধ করে, শাস্তি ভোগ করতে এসেছে এই সুন্দর বাড়ি নামক কারাগারে। আর অপরাধীরা কখনো বুক ভড়ে নিশ্বাস নেওয়ার অধিকার রাখে না। ইসরা নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে চায় না কারো কাছে। তাই আড়ালে চোখের পানি মুছে, বুক ফাঁটা কান্নাও গিলে নিলো।

উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললো, দুঃখিত এই ভুল আর কখনো হবে না।

ইসরা আর না দাঁড়িয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো৷ নিহানের মা সোফায় বসে পড়লেন ধপ করে। রোজকার এই ড্রামা তারও ভালো লাগছে না আর। মেয়েটার সাথে আজ বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে ভেবে এখন আবার অনুশোচনা হচ্ছে তার। সেও ক্লান্ত হয়ে গেছে নতুন নতুন সব ঝামেলায়।

ইসরা সারাদিন আর রুম থেকে বের হয়নি। তার খাবার বরাবরের মতো রুমে দিয়ে যাওয়া হয়েছে আর সে খেয়েও নিয়েছে। প্রত্যেকবার রেজাল্টের আগে ইসরার প্রচন্ড ভয় হতো, যদিও সে ভালো এক্সাম দিয়েছে তবু। তবে আজ রেজাল্টের জন্য টেনশন হচ্ছে না, অথচ আজকের রেজাল্টের উপর তার পরবর্তী জীবন নির্ভর করছে। ইসরা বেলকনির ফ্লোরে বসে আছে চুপচাপ। হেলে পরা সূর্যের খানিকটা কিরণ ইসরার কালো পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার দুলতে থাকা গাছের পাতা সেই সূর্য কিরণ আড়াল করার চেষ্টা করছে৷ ইসরা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সেই লুকোচুরি খেলা, দেখতে মন্দ লাগছে না তার। হঠাৎ বিকট আওয়াজে ফোনটা বেজে উঠলে ইসরার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। তবু অলস ভঙ্গিতে সেখানেই বসে রইলো। বেশ কয়েকবার ফোনটা বেজে কেটে গেলো। আবারও বেজে উঠলে ইসরা বিরক্ত হয়ে উঠে রুমে চলে এলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তার মায়ের নাম্বার।

গম্ভীর গলায় বললো, আসসালামু আলাইকুম মা।

মলিন গলায় পারভীন বেগমের উত্তর, ওয়ালাইকুম আসসালাম।

তারপর আবার বেশ কিছুটা সময় নিরবতা। মা মেয়ে দুজনেই যেনো আজ চুপ থাকার শপথ নিয়েছে।

শেষে পারভীন বেগমই নিরবতা ভেঙে বললো, কেমন আছিস মা ?

ইসরার কাঠ কাঠ উত্তর, মিস্টার ইখতিয়ার আহমেদ যেমনটা দেখতে চেয়েছিলেন তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো ?

পারভীন বেগম ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, মানুষটা ভালো নেই রে মা। নিজের হাতে সন্তানের জীবন নষ্ট করার দায় মাথায় নিয়ে কোনো বাবা ভালো থাকতে পারে না। খাওয়া ঘুম যেনো দিনদিন ভুলে যাচ্ছে। মাঝরাতে ডুকরে কেঁদে উঠে বলে আমার কলিজার জীবনটা আমি নিজের হাতে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছি। এই পাপ আমি কী দিয়ে মুছবো পারভীন ? মানুষটার কান্না দেখে পাথরের মুর্তিও কেঁদে দিবে সেখানে তো আমি রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। নিজেও কাঁদি তার সাথে।

বাবার কথা শুনে ইসরার চোখে পানি টলমল করছে। মানুষটা যতোই অন্যায় করুক, ইসরা তাকে খুব ভালোবাসে আর সেও মেয়েটাকে কলিজা মনে করে। কী করে সেই মেয়ের জীবন নিয়ে এতোবড় ভুল সে করলো ইসরা হিসার মেলাতে পারে না।

নিজের অনুভূতি আড়াল করে ইসরা কঠিন গলায় বললো, অন্যকে ধোঁকা দিয়ে কখনো ভালো থাকা যায় না মা।

পারভীন বেগম ভেজা গলায় বললো, উনি তো অন্যকে ঠকাতে গিয়ে নিজে ঠকে গেছে। নিহান ছেলে মানুষ কিছুদিন পর তার গায়ের ডিভোর্সের দাগ মুছে যাবে। কিন্তু তুই মেয়ে মানুষ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোর গায়ের এ দাগ মুছতে দেবে না এই সভ্য সমাজ।

জানো মা, স্কুলে থাকতে আমাদের একটা শিক্ষা দেওয়া হতো। ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। এখন আর ভেবে লাভ নেই। কর্মের ফল সবাইকেই ভুগতে হবে।

তাহলে অন্যের কর্মফল তুই কেনো ভোগ করছিস ? ভুল তোর বাবার ছিলো তোর তো নয়। তাহলে তুই কেনো এতোকিছু সহ্য করছিস তার উত্তর আছে তোর কাছে ?

কখনো কখনো বাবা-মায়ের কর্মফল সন্তানকে ভোগ করতে হয় মা। সেটা ভালো হোক বা খারাপ।

পারভীন বেগম আর কিছু বলতে পারলো না। আর কিছু বলার মতো ভাষায় আর জানা নেই।

ইমন কোথায় মা ?

কোথায় যেনো খেলতে গেলো একটু আগে।

ওহ্।

আবার কিছুটা সময় নিরবতা বিরাজমান।

রাখছি মা ভালো থেকো।

যেটা বলতে চেয়েছি সেটাই তো বলা হলো না।

কী সেটা ?

হাজারটা খারাপ খবরের মাঝে তোর জন্য একটা ভালো খবর পেয়েছি। তুই মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছিস।

ইসরা চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিশ্বাস নিলো। চোখের কোণ বেয়ে একবিন্দু নোনাজল বের হয়ে গেলো। কষ্টের নয় বরং সুখের অশ্রু। ইসরা যেনো ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটা জোনাকির মিটমিটে আলোর সন্ধান খোঁজে পেলো। এটাই হয়তো তাকে আর লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।

ইসরা শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা ?

হ্যাঁ মা শুনতে পেয়েছি।

খবরটা জানার পর তোর বাবা ছটফট করছে কী করে তোকে খবরটা দেবে। তোর সাথে একটু কথা বলার জন্য তড়পাচ্ছে প্রতিদিন। একটু কথা বলবি তোর বাবার সাথে ?

আমি এখন রাখছি মা।

পারভীন বেগম কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। ইসরা কিছুটা সময় চুপ করে থেকে কল কেটে দিলো। বাবার সাথে ইসরার অদৃশ্য একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে। কিছুটা রাগ, অনেকটা অভিমান, চাপা কষ্ট আর অদ্ভুত কিছু অভিযোগ দিয়ে তৈরি এই দেয়াল। ইসরার জানা নেই কতটা সময় লাগবে এই অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে। কিংবা আদৌ কোনোদিন এই দেয়াল ভাঙবে কিনা জানা নেই।

১০.
ইসরার আনন্দটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে যখন জানতে পেরেছে, সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে গেছে। এতো বিষাদের মাঝে এটা ইসরার কাছে মেঘের অন্তরালে উঁকি দেওয়া রৌদ্র কিরণের মতো। হুর মেডিকেলে চান্স পায়নি সেটা নিয়ে কেঁদে ভাসিয়েছে। আল্লাহ সবাইকে সবদিক থেকে দেয় না হুর তার প্রমাণ। মেয়েটা দেখতে অসম্ভব সুন্দরী হলেও পড়াশোনায় ইসরার ধারে কাছেও না। ছোটবেলা থেকে হুরের রোল নাম্বার সবসময় ইসরার পরেই ছিলো৷ তাই পরীক্ষায় সবসময় ইসরার পেছনের সীটেই জায়গা হয়েছে হুরের। ইসরার হেল্প নিয়েই বরাবর ভালো রেজাল্ট করে এসেছে, তবে দুর্ভাগ্যবশত একসাথে সিট না পড়লে হুর হলে বসেই হাত-পা ছড়িয়ে কান্না করতে থাকতো। সেই দুর্ভাগ্যের একটা অংশ হিসাবে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় হুরের সিট আলাদা হলে নয় বরং আলাদা শহরেই পড়েছিলো৷

নাক টেনে হুর বললো, তোর জন্য আমি ডক্টর হতে পারলাম না ইশু।

ইসরা মলিন হেঁসে বললো, ডক্টর হলেও তুই খবু বাজে ডক্টর হতি। তারচেয়ে যেটা ভালো পারিস সেটা কর। যেটা হবি একদম পার্ফেক্ট হবি।

হুর কিছু সময় চিন্তা করে বললো, সত্যি ইয়ার ডক্টর হলে, খুব বাজে ডক্টর হতাম। শেষে দেখা যেতো রোগীর হার্টের অপারেশনের বদলে বেবি সিজারের অপারেশন করে ফেলেছি। না বাবা আমার ডক্টর হয়ে কাজ নেই। কিন্তু আমি কী করবো এখন তাহলে ?

ইসরা আনমনে বললো, বিয়ে করে সংসার কর। এই সমাজ তোদের মতো বউই খোঁজে। এই সমাজ বুঝিয়ে দেয় সংসার করার জন্য তোদের জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষদের সংসার করার স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই ভদ্র সমাজে।

হুরের মাথায় ইসরার আনমনে বলা গম্ভীর কথাগুলো ঢুকলো না। সে সরল ভাষায় বললো, মানে বুঝলাম না।

ঘরটা নাহয় তোরাই সামলা আর বাহিরের দ্বায়িত্বটা নাহয় আমরাই নিলাম। ঘরে যে আমাদের জন্য জায়গা নেই।

তোর মোটা মোটা কথা আমার চিকন মাথায় ঢুকছে না ইশু, একটু বুঝিয়ে বলবি ?

হুরের বিরক্তি মাখা গলা শুনে মুচকি হাঁসলো ইসরা আর বললো, মামার সাথে কথা বলে দেখ কী করতে বলে। এখন রাখছি ভালো থাকিস,,, আল্লাহ হাফেজ।

কলটা কেটে ঘুরে তাকাতেই নিহানকে পেছনে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো ইসরা। হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত এগারোটার বেশি বাজে। হুরের সাথে কথা বলতে বলতে ছাঁদে চলে এসেছে খেয়াল নেই ইসরার। রাতের অন্ধকারে আগে ভয় লাগলেও অন্ধকারকে নিজের সঙ্গী করে নিয়েছে ইসরা তাই এখন আর ভয় হয় না।

নিহান কিছু বলার আগেই ইসরা বললো, আমাকে বলা হয়েছিলো আপনি সকালে ছাঁদে আসেন সেই সময়টাতে যেনো ছাদে না আসি। কিন্তু এই সময়টার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি।

নিহান ইসরার কথা উপেক্ষা করে বললো, আমার জীবনটা শেষ করে দিয়ে বেশ ভালোই আছো দেখছি। বোনের সাথে বেশ হেঁসে হেঁসে কথা হচ্ছিলো।

ইসরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললো, আপনার জীবনটা নষ্টের জন্য আমি দায়ী নই। তার জন্য আমার বাবা দায়ী আর বাকিটা দায়ী আপনার ভাগ্য।

নিহানের ভ্রু কুঁচকে গেলো ইসরার কথা শুনে। ছাঁদের ঝলমলে কৃত্রিম আলোয় সেটা পরখ করতে অসুবিধা হলো না ইসরার।

ইসরা মুচকি হেঁসে চলে যেতে গেলে নিহান বলে উঠলো, অসম্পূর্ণ কথা আমি পছন্দ করি না। আমার ভাগ্য দায়ী মানে কী ?

সেটা বলার সঠিক সময় এখনো আসেনি মিস্টার নিহান রেজওয়ান।

কখন সেই সঠিক সময় ?

আমি চাই না, আমি চলে যাওয়ার পরও আপনার মনে আমার প্রতি কোনো রাগ থাকুক। তাই চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতটা পারেন রাগ ঝেড়ে নিন। সময় শেষে যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেটা দূর করার জন্য কিছু তো প্রয়োজন তাই না। এর মানেটাই সেদিন আপনার অবশিষ্ট রাগ টুকু দূর করার উপায় হবে।

ইসরা পা বাড়ালে নিহান বললো, তোমার হাতে আর দুমাস সময় আছে।

ইসরা ঘুরে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো আর চলে গেলো। নিহান দাঁড়িয়ে রইলো রেলিঙে হেলান দিয়ে। ইসরা মেয়েটাকে তার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয়। তবে ইসরাকে নিয়ে সে কোনো প্রকার বিশ্লেষণ করতে চায় না। নিজের জীবনের একটা সেকেন্ড ব্যয় করতে চায় না তার জন্য। কিন্তু একটা বিষয় নিহান চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে। সে ভেবেছিলো ইসরা এখানে নিজের জায়গা তৈরি করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। কিন্তু ইসরার মধ্যে এমন কিছুই লক্ষ্য করতে পারছে না সে। এদিকে ইসরা রুমে এসে ভাবছে তার আগামীকাল বাইরে যেতে হবে। কিন্তু এই বাড়ি থেকে তার বাইরে যাওয়া নিষেধ তাহলে কীভাবে যাবে সে ?

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here