#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৪২]

ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালো জায়িদ। গাড়ি থেকে নেমে জড়ো হওয়া লোকজনকে বলল
‘ কি হয়েছে এখানে।
লোকগুলো সব খুলে বলল। জায়িদ বলল
‘ ওদের স্বামী স্ত্রীর ছবি আছে?
ভীড়ের মাঝে এক মহিলা ছুটে আসল। বলল
‘ স্যার ছেলেটার ওয়ালেট থেকে এই মেয়েটার ছবিটা পড়ে গিয়েছে।
জায়িদ ছবিটা হাতে নিয়ে তব্দা মেরে রইল। এ তো জুননুর ছবি। জুননুর হাত বাঁধা থাকবে কেন? সাহিল তাকে দৌঁড়াবে কেন? এ লোকগুলোর কোথাও ভুল হচ্ছে। বিরাট ভুল হচ্ছে। তারা তো একসাথে নেই। কোথায় তারা? লোকগুলো কি কি বলে মাথা নষ্ট করে দিল। জায়িদ গাড়ি নিয়ে ফিরতি পথে চলে গেল। ব্যাপারটা ভালো ভাবে দেখা দরকার।

ডক্টর মুখার্জি আর ডক্টর হোসেন এসে স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেল সাহিলকে। জিনিয়া স্তব্ধ। এরা ও যুক্ত এসবের সাথে। ছিঃ।
তাননা মুননা জিনিয়ার কাছাকাছি এসে বসল। সাহিলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল
‘ আম্মা আব্বা ঘুম কেন? উঠেনা কেন? আব্বা বিথা পাছে। আব্বা কান্না কচচে। লততো পচচে।
জিনিয়া বসে থাকল তব্দা মেরে। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাহিল সুস্থ হয়ে উঠার আগেই তাকে পালাতে হবে। শীঘ্রই তার বাচ্চাদের নিয়ে সরে পড়তে হবে। উঠে দাঁড়ালো জিনিয়া। হাতদুটো বন্ধ। রশির দাগ পড়ে গেছে। শাড়িটা ছিঁড়তে চেয়েও পারলনা সে। তাননা মুননাকে আদর করে বলল
‘ আছে তোমাদের আব্বা। কিচ্ছু হয়নি। তাননা মুননা শান্ত হলোনা। মুখে রক্ত লেগে আছে তাদের। জিনিয়া শাড়ি দিয়ে মুছে দিল সেই রক্ত। গালে চুমু খেয়ে বলল
‘ আম্মা যেটা বলব,সেটা শুনবে কেমন?
তাননা মুননা মাথা নাড়ালো। বলল
‘ খিদে পাছে আম্মা। খাবো।
জিনিয়া এদিকওদিক তাকালো। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের অনুরোধ করে বলল
‘ আমার বাচ্চাদের একটু খেতে দিন। ওদের খুব কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কখনো বলেনা।
লোকগুলোর মধ্যে ভাবান্তর দেখা গেলনা। জিনিয়া পায়ে কোনোমতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তাননা মুননাকে বলল
‘ আমার পিছু পিছু আসো।
তাননা মুননা গেল। জিনিয়া বাড়ির ভেতর ডুকে পড়ে রান্নাঘর খুঁজল। এরিজমা দৌড়ে এল।
‘ কি চাইছ তুমি? পালাতে পারোনি?
জিনিয়া বলল
‘ আমার বাচ্চাদের খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দিন ওদের।
এরিজমা তাকালো তাননা মুননার দিকে। বলল
‘ খাবার নেই।
জিনিয়া বলল
‘ ওরা মাসুম বাচ্চা। ওদের সাথে এমন করবেন না। আমাকে শাস্তি দিন,কিন্তু আমার বাচ্চাদের না। ওরা কখনো নিজ থেকে খেতে বলেনা, আজ বলল। একটু খেতে দিন।
এরিজমা গেলনা। মুহূর্তেই জিনিয়ার অগ্নিরূপ প্রকাশ পেল।
‘ ওদের খেতে দিন নইলে ওনি উঠলে সব বলে দেব। ওনি ওনার বাচ্চাদের ব্যাপারে কিছু শুনলে লাশ ফেলবেন।
এরিজমা কানে না তুলতে চাইলে ও তুলল। জিনিয়া ভুল কিছু বলেনি। সাহিলের রাগ সম্পর্কে তার জানা আছে। দুইটা আপেল এনে ছুঁড়ে মারলো সে।
মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল তাননা মুননা। জিনিয়া ডাক দিল
‘ আব্বা আম্মা গালে দিওনা। আম্মার শাড়িতে মুছে নাও আগে।
তাননা মুননা জিনিয়ার শাড়িতে মুছে নিল আপেল। কামড়ে খেতে খেতে মুননা বলল
‘ আম্মা ইগুলা মুজা নাই৷ মিততি নাই।
জিনিয়া বলল
‘ বাসায় গেলে মিষ্টি মিষ্টি খাওয়াবো কেমন?
মাথা নাড়ালো মুননা। এরিজমা তাকিয়ে থাকল জিনিয়ার দিকে। তার তুলনায় মেয়েটার কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না৷ সে এই মেয়ের তুলনায় হাজারগুণে সুন্দরী। কিন্তু সাহিল কি পায় এই মেয়ের কাছে। হঠাৎ হঠাৎ এই মেয়ের কাছে যাওয়ার নেশা উঠে কেন তার? জিনিয়া এরিজমাকে দেখে বলল
‘ ওনাকে কোথায় নেওয়া হয়েছে?
এরিজমা বলল
‘ জানিনা।
জিনিয়া গেল হেঁটে হেঁটে। ইয়ামিন বন্দী করল তাকে। জিনিয়া হাতে থুতু মারতেই কষে চড় মারল ইয়ামিন। জিনিয়া আর্তনাদ করে উঠল। আবার ও থুতু মারল সে। ইয়ামিন কিছু করার আগেই তাননা পেছন থেকে কি দিয়ে যেন আঘাত করল তাকে। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে পড়ল শক্ত হয়ে। মাথার পেছনে হাত দিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল সে। জিনিয়া দেখল লোহার রড মুননার হাতে। আঁতকে উঠল জিনিয়া।
‘ না আব্বা তুমি তোমার আব্বার মতো হবেনা। নাহ ।
মুননা আরেকটা আঘাত করতে যাচ্ছিল। জিনিয়া ডাক দিল
‘ না আব্বা। মুননা!
ইয়ামিন এরিজমাকে ডাকল। সে দৌড়ে এসে ইয়ামিনকে এই অবস্থায় দেখে মাথায় হাত দিল। বলল
‘ তুমি এখানে কেন এলে আবার?
ইয়ামিন যেতে যেতে বলল
‘ এদের বন্দী কর। তাড়াতাড়ি। বাচ্চাগুলোর হাত বেঁধে দে। এরিজমা তাই করল। তাননা মুননা হাতে রশি বেঁধে দেওয়ায় কাঁদল। বলল
‘ আম্মা বিথা কলে। বিশিবিশি বিথা কলে। আমি মেলে ফেলব ইদের।
জিনিয়া বলল
‘ এটা কি করেছ তুমি? এমনটা করেনা আব্বা।
মুননা বলল
‘ আব্বা মালে ইভাবে। আমিও মাববো।
তাদের সবাইকে রুমে বন্দী করে চলে যায় ইয়ামিন। আপেলটা খেতে ও পারলনা ভালো করে। জিনিয়া বলল
‘ তোমাদের আব্বা আসুক। রশি খুলে দেবে। কাঁদেনা আমার বাবুরা।
তাননা বলল
‘ আম্মা ও ইভাবে বিথা পায়। আব্বা আম্মাকে বিথা দেয় কিনো?
জিনিয়া চুপ হয়ে চেয়ে রইল। মেয়েকে কি উত্তর দেবে সে? তাকে শক্ত হতে হবে। এই পরিস্থিতিতে তাকে দুর্বল হলে চলবেনা। দরজা খুলল প্রায় দুই তিন ঘন্টা পরে। তাননা মুননা ঘুমিয়ে পড়েছে৷ জিনিয়া দেখল পেট লেগে আছে দুজনের। বিষাদে তিতিয়ে উঠল। সে ছাড়বেনা কাউকে৷ কাউকে না। দরজায় চাবি লাগানোর শব্দ হলো। জিনিয়া ব্যাগ থেকে ধারালো ছুরিটা বের আড়াল করে দাঁড়ালো। ভেতরে ডুকে পড়া লোকটার হাতের বাহুতে মেরে দিল প্যাঁচ। শার্ট ছিঁড়ে রক্তে তড়বড় হলো। চিৎকার করে উঠল জিনিয়া লোকটার ধাক্কায়। পড়ে গিয়ে কপালে আঘাত পেল। সাহিলের হাতে খাবার। এগুলো তো এখন পড়ে যাচ্ছিল। আক্রমণ করার আর সময় পায়নি মেয়েটা ।
জিনিয়া উঠে দাঁড়ালো। দেখল সাহিল খাবার নিয়ে এসেছে। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জিনিয়া। সাহিল খাবার রাখতে রাখতে জবাব দিল
‘ পালিয়ে কোনো লাভ নেই।
জিনিয়া নরম পায়ে হেঁটে তাননা মুননার পাশে এসে বসল। সাহিল তাদের ডেকে তুলল। সাদা বিরিয়ানি প্লেটে ঢেলে চামচে করে খাইয়ে দেওয়ার আগে তাননা মুননা আবার কেঁদে উঠল।
‘ আব্বার হাতে লততো। আম্মা আব্বার হাতে লততো৷
জিনিয়ার ভাবান্তর নেই। সে ভাবতে লাগল বাড়ি কি করবে সে? কি পরিকল্পনা এদের? কি করবে সে?
সাহিল বলল
‘ এগুলো রং বাবা। খেয়ে নাও এখন। ইয়ামিনকে মেরেছ?
মুননা বলল
‘ হ্যা মাচচি। আম্মাকে মালে কিনো?
সাহিল সাথেসাথে তাকালো জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিল ঘৃণা সহিত। সাহিল খাইয়ে দিল তাননা মুননাকে। জিনিয়ারগুলো তাননা মুননার হাতে দিয়ে বলল
‘ ইগুলো তোমাদের আম্মাকে খাইয়ে দাও।
মুননা বলল
‘ তুমি খাবায় দাও। আমলা পালিনা। পলে যায়।
সাহিল বলল
‘ নোংরা হাতে খেলে তোমাদের আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়বে।
মুননা বলল
‘ আমলা খাছি।
সাহিল তার মুখে আদর করে বলল
‘ তোমরা আমার বাচ্চা।
সাহিল চলে যেতেই তাননা খাইয়ে দিল জিনিয়াকে। খাবার গালে চিবোতে কষ্ট হলো জিনিয়ার। পারল না খেতে। এগুলো বিষফল। বিষ।
প্লেট গুছিয়ে রেখে কেটে যাওয়া অংশে হাত চেপে বসে পড়ল সাহিল। এ আঘাত কেন সয়না? এমন আঘাত সে হাঁটতে বসতে পায়।
এরিজমা দৌড়ে আসলো। সাহিলকে ও-ই অবস্থায় দেখে বলল
‘ তুমি কি কাজ মাঝঅবস্থায় থামিয়ে রাখবে নাকি৷ কি শুরু করেছ?
সাহিল বলল
‘ কাজ চলছে। কালই ডেলিভারি৷
এরিজমা তাকালো সাহিলের রক্তপড়া হাতের দিকে।
‘ বউয়ের কাছ থেকে এত আঘাত পাও, তারপরও আঘাত করোনা কেন?
‘ আঘাত করিনি? ওকে যতটা আঘাত করেছি তোমাকে ও ততটা করিনি। মাথা খারাপ করবেনা একদম। ধুর হও।
এরিজমা মুখ ভেঙে চলে যায়। সাহিল শার্ট পাল্টায়। নিজে নিজে ব্যান্ডেজ করে হাতে। কিছু পেটে পড়েনি। দুই তিন চামচ খেতেই আর গেল না পেটে। তাননা মুননার কাছে যেতেই দেখতে পেল জিনিয়া খায়নি বেশিরভাগ। নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। সাহিল এলেও কোনো ভাবান্তর নেই। সাহিল প্লেট নিতেই তাননা মুননা বলল
‘ আমলা খাবো।
সে কথা শুনে জিনিয়ার চোখের জল গড়াতেই মুছে ফেলল জিনিয়া। সাহিল হেসে বলল
‘ খাবেন? আর ও এনে দেই?
তাননা মাথা নাড়ালো।
সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকাতেই হাসি বন্ধ হয়ে যায়। সাহিল আর ও এক প্লেট এনে দেয় তাননা মুননাকে। যতগুলো না খাচ্ছে, ততগুলো নিচে ফেলছে। কখনো খায়নি নিজ হাতে। জিনিয়া বের হয়ে গেল রুম থেকে। সাহিল তার পিছু পিছু গেল। আটকালো না। জিনিয়া সবখানে গেল। এরিজমার রুমে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। এরিজমা নেই। জিনিয়া রুমে ডুকে পড়ল। কি সুন্দর গোছানো রুমটা। সাহিলের বেশ কাপড় চোপড় রাখা আছে এরিজমার শাড়ির পাশে। নিজের অন্তর্বাসগুলো ও ঢেকে রাখার প্রয়োজন মনে করেনা এরিজমা। সেগুলো একদম চোখে পড়ার মতো করে রেখেছে। জিনিয়া বলল
‘ ছয় বছর আগে আপনি বিয়ে করেছেন?
সাহিল উত্তর দিল।
‘ হ্যা।
কতদিন থেকেছিলেন ওনার সাথে?
‘ দেড়বছর।
‘ আপনাদের সন্তান?
‘ দরকার ছিলনা।
ঢোক গিলে নিল জিনিয়া।
‘ সীমান্তকে বিয়ে করে নিলে আজ আমার এই দশা হতোনা।
‘ সেটা এখন ভেবেও কাজ নেই।
জিনিয়া রুম থেকে বের হলো। ও টি নামক রুমটাতে গিয়ে দেখল সবকিছু। সাহিল তার পেছনে দাঁড়িয়ে। আশেপাশে থাকা লোকগুলো চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকলো। জিনিয়া অপারেশন রুমে ডুকে হাঁটল। দশটা লাশ রাখা আছে। জিনিয়া সাদা কাপড় সরিয়ে সরিয়ে মুখ দেখল। চারজনের বেলায় গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল জিনিয়া। এই মহিলা তো সেই যিনি তাকে চাবি দেখে এই বাড়ির সন্ধান দিয়েছিল। ঘৃণা নিয়ে তাকালো জিনিয়া। সাহিল বলল,
‘ কিছুক্ষণ আগেই মারা গিয়েছে।
জিনিয়া বলল
‘ নাকি জীবিত মানুষটাকেই মেরে ফেললেন?
সাহিল চুপ হয়ে গেল। জিনিয়া অপারেশনের সিজার দেখতে পেল। নিয়ে ছুঁড়ে মারল সাহিলের দিকে৷ সাহিলের কপালের কোণায় এসে লাগলো। সাহিল দাঁড়িয়ে রইল।
‘ সব দেখা হয়েছে?
জিনিয়া শক্ত কন্ঠে বলল
‘ নাহ।
ও টি নামক রুম থেকে বের হয়ে জিনিয়া অস্ত্র রাখা রুমটাতে গেল। পিস্তল আর ধারালো অস্ত্রের বাহার। জিনিয়া এগিয়ে গেল। খুব চকচকে কালো একটা পিস্তল নিয়ে নিল। সাথেসাথে ফিরল সাহিলের দিকে। তার বাচ্চাগুলো যদি না থাকতো এখানে, মেরে ফেলতো সেই এই অমানুষকে। জিনিয়া উচ্চারণ করল
‘ অমানুষ, পশু।
সাহিল তারপরে ও নিশ্চুপ। জিনিয়া পিস্তল নিল, ধারালো একটি অস্ত্র নিল। সাহিল নীরব চোখে তা দেখল। জিনিয়া বের হয়ে গেল রুম থেকে। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো দৌড়ে গিয়ে রেখে এল নিজের ব্যাগে। সাহিল তাকিয়ে দেখল৷ জিনিয়া আবার বের হয়ে এল। দৌড়ে গেল অন্য রুমে। দেখল ইয়ামিনের রুম। সারাঘরে টাঙানো তার ছবি। আর ও কিছুদূর এগোতেই সাহিলের কয়েকটা ছবি দেখা গেল। ইয়াজিদ সাহেবের সাথে। অস্ট্রেলিয়ায় থাকার সময় ছবি। পিস্তল নিয়ে নানা ভঙ্গিতে তোলা ছবি। জিনিয়া পিছু হাঁটল। সাহিলের সামনে দৌড়ে এসে বলল
‘ কখন থেকে এসব করছেন আপনি?
‘ আমাদের এনিভার্সারির দিন বিশ বছর পূর্ণ হলো। জিনিয়া চেয়ে রইল। বলল
‘ আপনার আমার দেখা কুক্ষণে ঘটেছিল। আমার জীবনে আপনি বিশাল আকারের কালো মেঘ। সেই মেঘ অভিশাপ আমার জীবনে। আপনি এসেছিলেন ভয়ংকর রূপে কিন্তু নিজেকে ঢেকে রেখেছিলেন। আপনি ঠিকই মেঘের বেশে এসেছিলেন। আমিই আপনাকে ঝলমলে রোদ ধরে নিয়েছিলাম। সেদিন আমি আপনাকে সিগারেট ফুঁকতে ঠিকই দেখেছি। সীমান্তর সাথে বিয়ের বাজার করতে গিয়ে আপনার অন্যরূপ দেখেছি। আপনি বীভৎস ভাবে মেরেছেন একজনকে আমার চোখের সামনে। আঘাত সেদিন আমি ও পেয়েছি। আপনার বীভৎস রূপ আমি আবার ও পেয়েছি সীমান্তকে খুন করেছেন শুনে। কিন্তু দেখেও আমি আপনাকে আগলে রেখেছিলাম। কি অন্ধ ছিলাম আমি?
সাহিল বলল
‘ ইয়ামিনকে দিয়ে বলেছিলাম আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে। থাকোনি কেন? সীমান্তরটা যখন সত্যি হয়েছে তোমার ভেবে নেওয়া উচিত ছিল আমারটা ও সত্যি।
হাসল জিনিয়া। অদ্ভুত সেই হাসি। কি লুকোনো আছে এই হাসির। এত তোলপাড় হয় কেন চারপাশে? যেন কোনো মহাদানবী হাসছে!

জিনিয়া বলল
‘ আপনাকে আমি অন্য কারো সাথে তুলনা করতে পারিনি এটা আমার বোকামো। এটাই আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল। তার চাইতে বড় ভুল আমি বিশ্বাস করেছি আপনাকে, ভালোবেসেছি।
সাহিল চোখ সরিয়ে নিল।
‘ আপনি তো বাসেননি। তাহলে কোথাও খুন করে গুম করে রাখতেন। কেউ দেখতনা। কেন করেননি? কি কারণ?
ঠিকই তো কি কারণ! সাহিল কেন তাকে মেরে ফেলেনি?
সাহিল বলল
‘ কারণটা জানা নেই।
আবার ও হাসল জিনিয়া।
‘ কাঁদার বদলে এখন হাসছ?
‘ কাঁদলে খুশি হবেন? বিরক্ত হচ্ছেন তাই কাঁদা বন্ধ করে দিয়েছি। আপনাকে বিরক্ত হতে দিই কি করে?
সাহিল পকেটে হাত গুঁজল। কি করতে চাইছ এখন?
আবার ও হাসল জিনিয়া।
‘ আপনি যদি বলেন আমিও বলব।
সাহিল বলল
‘ আমি কি বলব? আমি যা করার তা করে নিয়েছি। কালকের মধ্যে সব অস্ত্র আর কিডনি অস্ট্রেলিয়ায় পাচার হবে। ব্যস। তারপরে মিশন শুরু আগামী মাসে। হয়ত তারমধ্য অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে।
চোখজোড়া দপদপ করে উঠল জিনিয়ার।
‘ আমি এগুলো পাঠাতে দেবনা।
‘ ঠিক আছে। আটকে দেখাও।
‘ জানোয়ার!
‘ এককথা কতবার বলবে?
‘ মরার আগ পর্যন্ত।
সাহিল ঘুরে দাঁড়ালো।
‘ চলে এসো।
জিনিয়া গেলনা। থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বলল
‘ এরকম হওয়ার কথা ছিলনা?
সাহিল ফিরল না তবে দাঁড়িয়ে রইল। বলল
‘ হতে দিলে কেন? ভালো ছিলে।
জিনিয়া কিছু বলতে চেয়ে ও পারলনা। সাহিল চলে গেল। জিনিয়া তার পিছু গেল। পেছনে ফিরে দেখল কতগুলো লোক। তার পিছু নিয়েছে লোকগুলো। কোথাও পালানোর সুযোগ নেই।
সাহিলের পিছু পিছু জিনিয়া ডুকে পড়ল ঘরে। মুননা গায়ের শার্ট খুলে বলল
‘ আব্বা গায়ে চুলুচুলি কলে।
সাহিল বলল
‘ চুলকায়?
মুননা মাথা নাড়ালো।
সাহিল বলল
‘ আসুন, দুজনকে গোসল করিয়ে দিই।
জিনিয়া চিৎকার করল।
‘ আপনি ওদের ছুঁচ্ছেন কেন? কেন? বারণ করেছিলাম।
সাহিল কিছু বলল না। দুজন গোসল করে এসে বলল
‘ আম্মা এখুন ভালুলাগে।
জিনিয়া ঠোঁট বিস্তৃত করল সামান্য। সাহিল বেরিয়ে আসতেই তাননা ঝাঁপিয়ে ধরল তাকে। কোলে উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আব্বা কুলে। কুলে।
সাহিল কোলে তুলে নিতে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেল। আহঃ বলে উচ্চারণ করল। তাননা ব্যান্ডেজের উপর হাত বুলিয়ে বলল
‘ বিথা দিচে?
সাহিল মেয়ের মুখের দিকে তাকালো।
‘ কে বিথা দিচে? আম্মা?
সাহিল তাকালো জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া বলল
‘ চুপ করে আছেন কেন? বলুন না। কে কাকে ব্যাথা দিয়েছে। বলুন। নিজের পরিচয় একটু বলুন না। যে হাতে মানুষ খুন করেন সেই হাত দিয়ে ছেলেমেয়েকে ছুঁতে লজ্জা করেনা? নিজের প্রতি ঘৃণা লাগেনা? লাগেনা?
সাহিল সাথেসাথে জবাব দিল।
‘ জানোয়ারদের এসব অনুভব হয়না জিনিয়া।
মুখ ফিরিয়ে নিল জিনিয়া। সাহিল মেয়ের মাথা চেপে লাগালো তারমুখে। কোল থেকে নামিয়ে দিল।
মুননা বলল,
‘ গুড্ডু জাননো, আননা ফিপিল বেবি আচবে। সুলা ফিপিল বাবুল মুতো। আমলা মিততি খাছি।
‘ তাই! জানিতো।
তাননা বলল
‘ হ্যা। আলেকটা বাবু আচবে। আমলা আদোল কববো। মিততি খাবো। চুড়ুই চুড়ুই খিলবো।
সাহিল আদর করল দুজনকে। বলল
‘ আচ্ছা।
জিনিয়া বলল
‘ ছেলেমেয়েদের সাথে ও ভালো অভিনয় করতে জানেন। অনেক শেখার আছে আপনার কাছ থেকে।
‘ সবসময় খোঁচাতে ভালোলাগে তোমার? কথায় কথায় ওদের টানো কেন?
ঘৃণা লাগলো আবার ও। মুখ ফিরিয়ে নিল জিনিয়া।
‘ আপনাকে দেখতে ও ঘৃণা লাগছে আমার। বমি পাচ্ছে।
সাহিল দাঁড়ালো না আর। বের হয়ে গেল রুম থেকে।
চারপাশ এত তিক্ত কেন? নীল নীল বিষের ছড়াছড়ি কেন? বিশ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠা এই পশুত্ব হৃদয়ে আজ ফাটল কেন? এমন হওয়ার কথা ছিলনা। অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলেই তো হৃদয় খানখান হয়। ব্যাথা হয়। যন্ত্রণা হয়। রক্তক্ষরণ হয়। মুখের কথায় তো নয়? মুখের কথায় কেন সারাঅঙ্গ ব্যাথায় নীল হয়?
জিনিয়া মহাখুশি আঘাত করতে পারল বলে।
মহাখুশি সাহিলের চোখে ব্যাথা দেখল বলে। যে চোখে সে আগে ভালোবাসা খুঁজত এখন সে চোখে ব্যাথা খুঁজে বেড়ায়। অসহায়ত্ব, দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়। যাকে নিয়ে জিতের বাজি ধরত আজ তারই হার চায় সে। যাকে নিয়ে সে ভালোবাসার প্রাসাদ গড়ে তুলেছিল আজ তাকেই ভেঙেচুরে দিতে চায় সে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!
যে আকাশের চাঁদ তাদের প্রেমের সাক্ষী ছিল, সে চাঁদ কি তাহলে মিথ্যে ছিল? সবকিছু মিথ্যে ছিল? এই যে সারাক্ষণ ভালো বাসিনা ভালোবাসিনা বলা, সেসব কি সত্যি ছিল? শুধু জিনিয়া বুঝতে পারেনি? কি বোকা সে?

____________

সবকিছু গোছগাছ করে সন্ধ্যার দিকে আসলো সাহিল। জিনিয়াকে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলল। শর্ত দিল, শফিক সাহেবকে সে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনবে। তারজন্য জিনিয়াকে ও তার শর্তে রাজি হতে হবে। বাড়ির কাউকে কিছু বলা যাবেনা। বাড়ির বাইরে পা রাখা যাবেনা। বাড়িতে ক্যামরা লাগানো থাকবে। জিনিয়া বলল
‘ আমার বাচ্চাদের ছাড়া আমি যাবনা।
সাহিল বলল
‘ তাহলে। থাকো। যাওয়ার দরকার নেই। আমি কাজ শেষ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেব।
‘ কিসের সিদ্ধান্ত?
সাহিল বলল
‘ সব তোমাকে বলতে পারবনা।
জিনিয়া চুপ মেরে রইল।

সাহিল হেঁটে গিয়ে নিজের চোখের লেন্স খুলে নিল। অপারেশন করানোর সময় দরকার পড়ে। ছোট্ট একটা বক্সে লেন্সগুলো রেখে দিল। বড় ওয়ারড্রবটি চাবি দিয়ে খুলল। কিসব যেন কাগজপত্র নড়াচড়া করল। চোখ বুলাতে বুলাতে সে হাঁটল। জিনিয়ার চোখ কাগজগুলোতে। কি আছে কাগজগুলোতে?

সাহিলের চোখ হঠাৎ থেমে গেল এক জায়গায় এসে। সব লাশের ডিটেইলস এখানে। গত দশমাসের ডিটেইলস। একটি লাশের বিবরণ। নাম রাতুল খন্দকার। রূপসা গ্রাম। ফাইলটি তাড়াতাড়ি ওয়্যারড্রবের উপর রেখে বেরিয়ে গেল সাহিল। জিনিয়া দেখল ফাইলটি। খোলা অবস্থায় আছে। রাতুলের নাম দেখে থমকে গেল জিনিয়া। রাতুল? সোরার মাষ্টার? ছিহঃ এই লোকটা ওই মানুষটাকে ও ছাড়ল না? ছিহঃ।
জিনিয়া দৌড় দিল সাহিলের পিছু পিছু। তাননা মুননা খাটের উপর খেলছে। সাহিল লম্বা লম্বা পা ফেলে ছাদের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরল। তিন তলা এখনো তৈরি হয়নি। ইট সিমেন্টের ছড়াছড়ি সেখানে। জিনিয়া দৌড়ে দৌড়ে সাহিলের পিছু পিছু উঠল। মদের আসর বসেছে। ইয়ামিন, ইয়াজিদ সাহেব, আর ও লোকজন। সাহিল যেতে না যেতেই লাতি বসালো ইয়ামিনের পিঠে। উল্টে পড়ে গেল ইয়ামিন। মদের বোতল হাতে। সাহিল বোতল কেড়ে নিয়ে উরুধুরা পিঠিয়ে বলল
‘ আমার গ্রামে কেন গিয়েছিলি? কেন? ওখানে কেন শিকার করতে গিয়েছিলি? কেন গিয়েছিলি?
সবাই এসে ধরল সাহিলকে। সাহিল পা দিয়ে ঠেলে দিল ইয়ামিনকে। মদের নেশায় বুদ সবাই। গন্ধ আসছে। সাহিল সবার পায়ে লাতি বসাতেই ধপ ধপ করে পড়ে গেল সবাই। ইয়ামিনের গলা চেপে ধরল। ইয়ামিন কাশতে কাশতে বলল
‘ আমি নই। বাবা বলেছে। বাবা।
সাহিল তাকালো ইয়াজিদের দিকে। মদের বোতল ছুঁড়ে মেরে বলল
‘ কুত্তার বাচ্চা ওইখানে নজর দিতে বারণ করেছিলাম।
ইয়াজিদের মাথায় গিয়ে পড়ল বোতল। ব্যাথা লাগলো। ইয়াজিদ আঙুল দেখিয়ে বলল
‘ বাড়াবাড়ি করছ সাহিল। সাহিল দৌড়ে গিয়ে গলা চেপে ধরল ইয়াজিদের। ফেলে দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরল। ইয়ামিন উঠে দাঁড়ালো। ইট হাতে নিল। বাকি লোকগুলো মদের নেশায় ঢলতে থাকলো। ইয়ামিন ইট হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল সাহিলের দিকে। ইয়াজিদের চোখ উল্টে আসতে শুরু করল। সাহিলের মাথায় মারতেই দৌড়ে গেল জিনিয়া। সাহিলের মাথায় পড়ার আগে পড়ে গেল জিনিয়ার মাথায়। গগন ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল জিনিয়া। সাহিলের পিঠের উপর ঢলে পড়ল সে। হয়ত সে আওয়াজ পৌঁছালো ছোট্ট ছোট্ট দুটো বাচ্চার কানে। কোথায় তাদের মা?
সাহিল ধাক্কা মারল ইয়ামিনকে। ইয়ামিন গিয়ে পড়ল আর ও একটা ইটের উপর। লোকগুলোকে চিল্লিয়ে বলতেই লোকগুলো ইয়ামিনকে ঘিরে রাখল। এরিজমা এসে দেখল রক্তাক্ত জিনিয়া। সাহিল বিধ্বস্ত। জিনিয়া নিজের বুক চেপে ধরে বিড়বিড় করল
‘ আমার বাচ্চা, আমার সংসার।
সাহিল কোলে তুলে নিল তাকে। সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল
‘ জিনি আমি এখন ঠিক করে দেব। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সাহিল নিয়ে গেল তাকে অপারেশন রুমে। বেডে শুইয়ে দিয়ে তাননা মুননাকে এনে দরজা বন্ধ করে দিল। তাননা মুননা মায়ের এই অবস্থা দেখে শান্ত হয়ে গেল। কান্না এলনা বুক ফাটিয়ে। বুক খামচে ধরে দুজনই বসে রইল দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে। সাহিল রক্তপ্রবাহ বন্ধ করার চেষ্টায় রত। রক্ত দিতে হবে জিনিকে। রক্ত কোথায় পাবে সে ? জিনিয়ার মুখে অক্সিজেন লাগালো সে। রক্ত বন্ধ করে স্যালাইন লাগালো। রক্ত না দিতে পারলে সব শেষ হয়ে যাবে। সব। ডক্টর মুখার্জিকে ফোন করল সাহিল। শীঘ্রই এ পজিটিভ রক্ত নিয়ে আসতে বলল। ডক্টর মুখার্জি রক্ত নিয়ে এল ঘন্টাখানেক পর। তিনব্যাগ রক্ত দিতে হলো জিনিয়াকে। সামান্য ফোলা পা দুটো তরতর করে ফুলে উঠে টুইটুম্বুর হলো। মিঃ মুখার্জিকে সরিষা তেল গরম করে আনতে বলল সাহিল। মিঃ মুখার্জি এরিজমার রুমে গিয়ে গ্যাসে তেল গরম করে আনলো। সাহিল মুখার্জিকে চলে যেতে বলল।
গরম তেল হাতে লাগিয়ে জিনিয়ার দু পায়ে মালিশ করল সে। তেলগুলোতে পড়ল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিজলও। তাননা মুননা দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। জিনিয়ার চিকিৎসা শেষে সাহিল বসে পড়ল তাননা মুননার পাশে। হাত পায়ের আঙুল মোঁচড়ালো। মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন আওড়ালো। রক্তবর্ণ চোখদুটো দিয়ে রক্ত গড়ালো যেন। ওই বেডে নিথর হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির শ্বাস উঠানামা করছে। দেয়ালে মাথা ঠুকল সাহিল। তার এই পাপের জন্য সে হারিয়ে ফেলল স্ত্রী সন্তান, পরিবার, ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা। সে অপরাধী প্রিয়তমার চোখে, পরিবারের চোখে, সমাজের চোখে, কিন্তু সন্তানদের চোখে হতে পারবেনা। কি জবাব দেবে সে? তাননা মুননাকে কি বলবে সে?
মুননা জেগে উঠল। সাহিল তাকালো ছেলের দিকে। মুননা বসে থাকল। জিনিয়ার কাছে গিয়ে জিনিয়ার মুখ ছোঁয়ার জন্য চেয়ার টেনে নিল। চেয়ারে দাঁড়িয়ে জিনিয়ার মুখে আলতোকরে আদর করে ঠোঁট টেনে ডাকল
‘ জুননু! আমাল আম্মা।
সাহিল উঠে দাঁড়ালো তার পিছু। মুননাকে ছুঁতেই চেঁচালো মুননা।
‘ জুননুকে মাচচো তুমি। মারি ফিলবো তুমাকে। আল্লাহ মাববে তুমাকে। আমাল জুননুকে মাচচো। আল্লাহ মাববে। আল্লাহ তুমি মারো দুষ্টু আব্বাকে।
সাহিল তাকিয়ে থাকল নিজের হাতের দিকে। মুননা জিনিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে ডাকল
‘ আম্মা আমলা চলি যাবো আব্বাকে ছেলে। আব্বার সাথি থাকবুনা। আব্বা পুঁচা হয়ে গিছে। আব্বা মালে তুমাকে।
মুননার কান্নার আওয়াজে উঠে যায় তাননা।
সাহিল তাকে ছুঁতে যায়। তাননা দৌড়ে চলে যায়।
‘ আমি বিথা পাবো। আমাকে মাববে?
সাহিল বলল
‘ না। আব্বা কি তোমাকে মারতে পারি?
তাননা বলে
‘ আম্মাকে মাচচো। আম্মার লততো পচচে।
সাহিল বলল
‘ না আমি মারিনি।
তাননা চেঁচালো।
‘ তুমি মাচচো। আব্বা মিছি কথা বুলে।
সাহিল বলল
‘ না। আমি মারিনি। আমি মারিনি। আমি ওকে মারতে পারিনা। আমি তো ওকে ভালো রাখতে চেয়েছি।
তাননা কেঁদে কেঁদে বলে
‘ আল্লাহ মাববে তুমাকে। মাববে। বিশিবিশি মাববে।
সাহিল কপালের কাছে হাতদেয়। ফাটা অংশে জ্বলছে।
কি করবে সে এখন? জিনিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। সোরা আর মা তার সেবা করতে পারবে। সাহিলের ছোঁয়ায় যদি আবার অসুস্থ হয়? কিন্তু তাননা মুননা? কি করবে সে? দিশেহারা সাহিল। জিনিয়ার অবস্থা বেগতিক।

_________

শফিক সাহেবকে রিমান্ডে রাখা হলো। জায়িদ কোথায় যেন চলে গেল। জায়িদের জুনিয়র গিয়াশ অনেক চেষ্টা করল সত্যিটা বলিয়ে নেওয়ার। পারলনা। শফিক সাহেব বলল
‘ মিঃ মুখার্জির সাথে আমার কথা আছে। ওনার সাথে কথা বলতে দিন। আলাদা করে কথা বলে আমি সত্যিটা বলে দেব।
রিমান্ড তুলে নেওয়া হলো। শফিক সাহেবকে সুযোগ দেওয়া হলো। মিঃ মুখার্জিকে নিয়ে আসার আদেশ দেওয়া হলো। মিঃ মুখার্জি নিখোঁজ। তাকে পাওয়া গেলনা।
শফিক সাহেব সবার সম্মুখে কেঁদে উঠে বললেন
‘ এখন কি হবে? কি হবে আমার মায়ের? কি হবে?

__________

ইয়াজিদ,ইয়ামিন আর এরিজমার বৈঠক বসল ছাদে। জিনিয়াকে আর তার দুই বাচ্চাকে মেরে ফেললে সব ঠিক হয়ে যাবে। সাহিল হয়ত কিছুদিন পাগলামি করবে কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে। ইয়ামিন বলল
‘ এখনো ওই সাহিলকে বিশ্বাস করো তুমি?
ইয়াজিদ বলল
‘ সবকিছু ওর হাতের মুঠোয়। আমার হাতে কিছু নেই। ওকে হাতের মুঠোয় রাখতে হবে।
ইয়ামিন পা দিয়ে লাতি বসালো সিমেন্টের বস্তায়।
ইয়াজিদ বলল
‘ এরিজমা ওই মেয়েকে মারতে পারবে?
এরিজমা চমকালো।
‘ নাহ। সাহিল যদি,
ইয়াজিদ বলল
‘ কৌশলে মারতে হবে। যাতে সাহিল বুঝে ওই মেয়েকে আমরা মারিনি, ওরজন্যই মারা গিয়েছে। কিংবা এক্সিডেন্ট।
ইয়ামিন বলল
‘ মাকে মারতে পারলে, বাচ্চা দুটোকে মারতে সময় লাগবেনা।
ইয়াজিদ বলল
‘ রাতে মারতে হবে। ওই মেয়েকে পালাতে সাহায্য করতে হবে মানে পথ খোলা রাখতে হবে। তারপর যখন ও বের হয়ে যাবে তখন মাঝরাস্তায় গিয়ে ঢলে দিয়ে আসবে গাড়ি দিয়ে। সাহিল আর কিছু বলার সাহস পাবেনা।
ইয়ামিন বলল, ওহ বাবা দারুণ বলেছ। এরিজমা বলল, তাহলে কাজে লেগে পড়ি। কি বলো?
ইয়াজিদ সায় দিল। হ্যা সাবধানে। যাতে ঘূর্ণাক্ষরেও সাহিল টের না পায়।

__________

জিনিয়ার ট্রিটমেন্ট চলছে। তাননা মুননা ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি শুরু করেছে। সাহিলকে দেখে আর ও জোরে কাঁদছে। কিছু মুখে নিচ্ছেনা। তখন বেলা এগারোটা হবে। জিনিয়ার জ্ঞান ফিরল। মাথা ভার। চোখের নিচে কালি। পা ফুলে উঠায় নড়াচড়া করতে কষ্ট। জিনিয়ার চোখ বন্ধ। সাহিল তাননা মুননার চিপসের প্যাকেট রাখল, বিস্কিটের প্যাকেট রাখল অনেকগুলো। মিষ্টির প্যাকেট রাখল৷ তাননা মুননা অনেক্ক্ষণ পর খাবার মুখে দিল। সাহিল আড়ালে দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখল। জিনিয়ার পায়ে চোখ পড়তেই সে দেখল পা ফুলে গিয়েছে। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তেল গরম করে আনলো সে। জিনিয়ার পড়নের শাড়ি হাঁটুঅব্দি তুলে ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করল তেল। জিনিয়া আরাম বোধ করায় চোখ বন্ধ করে ঘুমোলো আর ও। সাহিল দেখল জিনিয়ার লম্বা চুল সামনে। বুকে গলায়,মুখের কাছে। এলোমেলো হয়ে আছে। অস্বস্তি হচ্ছে জিনির। এই চুলগুলো সে কতবার আঁচড়ে দিয়েছে। মনে পড়ে সেসব দিনের কথা। যখন তাননা মুননা একদম ছোট্ট। তখন সারাদিন দুই বাচ্চা সামলাতে গিয়ে এই লম্বা চুল আঁচড়ানোর কথা ভুলে যেত জিনি। তখন সেই চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ে দিত সাহিল। অদক্ষ হাতে চুল আঁচড়াতে গিয়ে কত ভয় পেত সে। জিনি যদি কোথাও ব্যাথা পায়?
এমনও হয়েছে চুলে মুখ ডুবিয়ে পার হয়ে গেছে অনেক মুহূর্ত । জিনিয়াকে তুলে বসিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখল সাহিল। চুলগুলো পেছনে নিয়ে গিয়ে কোনোমতে মোঁচড়ে রাখল। উন্মুক্ত হলো ঘাড়। কাঁধ। গলা। এখানে কত আঁকিবুঁকি আঁকত না সে? এই ঘাড়ে,কাঁধে, গলায় নাকমুখ ডুবিয়ে পার করেছে না কতমুহূর্ত! আর এই কপাল,নাক,ঠোঁট, চিবুক! কত ভালোবাসা বিনিময় হতো না এদের সাথে? কত কথা! কত আলাপ! রোজ রোজ ফুটত কত প্রেমের গোলাপ!
কোথায় সেসব দিন! কত সুন্দর, রঙিন ছিল দিনগুলো। পুরোনো দিনগুলো এত সুন্দর হয় কেন? দিনগুলো আবার ফিরে আসেনা কেন? এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় কেন?

সাহিল শুইয়ে দিল জিনিয়াকে। জিনিয়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বহু কৌতূহলী হয়ে বলল,
‘ জিনি আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি না। তোমাকে, তোমার আমার অস্তিত্বগুলোকে ভালোবাসি না। বাসিনা। এটা আমার দোষ নয় জিনি। আমি দোষী নই। তোমাদের ভালোবাসিনা বলেই তো এসব পাপকে ছাড়ার কথা মাথায় আসেনি। ভালোবাসিনা বলেই তো মনে করেছিলাম কোনো পিছুটান নেই। ভালোবাসিনা বলেই তো তোমাদের ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে তা ভাবিনি। তাহলে এখন সব উল্টো মনে হচ্ছে কেন? কেন জিনি?

ঘুমঘুম চোখ খুলতে না খুলতেই জিনিয়া ছুঁড়ে মারল সাহিলের হাত। বহুকষ্টে উঠে নরম গলায় বলল
‘ সোরার স্বামীকে ও ছাড়লেন না?
সাহিলের হুঁশ ফিরল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বলল
‘ সোরার স্বামীর কিডনি আমার অজান্তে নেওয়া হয়েছিল।
‘ ঘেন্না হচ্ছে আপনাকে।
‘ ঘৃণা পাপকে করো, পাপীকে নয়।
চোখ তুলে তাকালো জিনিয়া। সাহিল ও তাকালো। চার চোখ মিলিত হলো। চোখ ফিরিয়ে নিল দুজনই। জিনিয়া বলল
‘ ভালোবাসেননি কাউকে তাই বুঝবেন না ভালোবাসার মানুষকে হারালে কতটা কষ্ট। সোরার কষ্ট আপনি বুঝবেন না। মরা মানুষটাকে ও ছাড়লেন না আপনি। ভালোবাসেননি তো কাউকে। বুঝবেন কি করে? অমানুষরা ভালোবাসা বুঝেনা।
সাহিল বের হয়ে গেল জিনিয়ার কথার আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে। কি বলবে সে?
তাকে তো ভালোবাসা শেখানো হয়নি। দশবছর বয়স থেকে তাকে শেখানো হয়েছে কি করে অস্ত্র চালাতে হয় মানুষের বুকে? তাকে শেখানো হয়েছে কিভাবে পেট কেটে বের করতে হয় কিডনি। তাকে শেখানো হয়েছে মিথ্যে,ছলনা,প্রতারণা,কঠোরতা,বর্বরতা, উগ্রতা। তাকে ভালোবাসা শেখানো হয়নি। ভালোবাসা পায়ও নি সে। পেতে পেতে অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। ততদিনে সে পরিণত হয়েছে অমানুষে । পায়নি তো ভালোবাসা। দেবে কি করে? বুঝবে কি করে? ভালোবাসবে কি করে?
ভালোবাসার জন্য তো শেখা দরকার? নাকি শেখার দরকার পড়েনা। শেখা ছাড়া কি ভালোবাসা যায় না ? যায় কি?

চলবে
গল্প শেষের দিকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here