#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[২৭]
রাতের নৈঃশব্দ্যে ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজ ভেসে আসছে জানালা দিয়ে। নিশাচর পাখিদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। নেড়ি কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট দেখা মিটিমিটি করে জ্বলছে। তাননা মুননা গোল খাটে ঘুমিয়ে পড়েছে বকবক করতে করতে। এত বকবক করে দুজন!
জেগে থাকলে মাথা খেয়ে ফেলবে আবার ঘুমিয়ে পড়লে পুরো বাড়িটাকেই শব্দহীন ভূতের বাড়ি মনে হয়। বাড়িটার প্রাণ বাচ্চাগুলো। দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে গালে চুমু খায় জিনিয়া। দুজনেই ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমায়। তাননা গুছিয়ে ঘুমায়, মুননা এলোমেলো। ঘুমের মাঝেও একে অপরের হাত ধরে রেখেছে। একেই কি বলে ভাইবোনের বন্ধন?
জিনিয়া দুজনের গায়ের উপর পাতলা হাতের নকশা করা কাঁথা জড়িয়ে দেয়। কাথাটির উপর তাননা মুননার নাম লেখা। হাতের কাজ করতে ভীষণ ভালোলাগে তার।
জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আলমারি খুলল জিনিয়া। কালো ব্যাগটা বের করে হাতে নিল একটি রুমাল। রুমালটিতে সে তার আর সাহিলের নামের মাঝখানে তাননা মুননার নাম লিখেছে। একটি সুন্দর পরিবারের নকশা। সাহিলকে দেবে দেবে করে দেওয়া হয়নি। আজ একদম দিয়ে দেবে। এত রাত হয়েছে তারপরও এখনো বাড়িতে ফেরার নাম নেই লোকটার । এত কাজের চাপ। ব্যবসা ও মানুষ করে? চাকরিবাকরি করলে সময়ে সময়ে বাড়ি ফিরত। এখন কোনো টাইমটেবিল নেই।
খিদে পেয়েছে জিনিয়ার। লোকটাকে ছাড়া খেতে ও ইচ্ছে করেনা। লোকটা একা একা খেতে ও চায়না।
সাহিল ফোন করে জিনিয়াকে খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে বলল, সে আসলে ফোন দিয়ে দরজা খুলে দিতে বলবে। কিন্তু জিনিয়া ঘুমালো না। তাননা মুননা গোল খাটটাতে এমনভাবে শুয়েছে বসার ও জো রাখেনি। কেউ বসতে ও পারেনা তাদের খাটে। ঠোঁট টেনে টেনে বলে,
‘ আমাদেল খাত। তুননুল মুননুল।
জিনিয়া হেসে দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। দুজনের উপর মশারী টাঙিয়ে দিল। নিজে এসে খাটে শুয়ে পড়ল। সাহিল আসলে নিয়ে আসবে। গোল খাটটা ছাড়া ঘুমাতে চায়না দুজনই।
জিনিয়ার চোখে ঘুম নেমে আসতেই ফোন বাজল।
” আসছি ” বলেই ঘুমঘুম চোখে জিনিয়া নেমে গেল নিচে। দরজা খুলে দিতেই সাহিল জিনিয়াকে দেখে হাসল। জিনিয়া হাসল না। মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ আজকে ও দেরি?
সাহিল এক হাতে কান ধরল। বলল,
‘ আজকের মতো সরি।
জিনিয়া সাহিলের বাচ্চামো দেখে হাসল। বলল,
‘ হয়েছে।
সাহিল বাড়িতে পা রাখল। এদিকওদিক তাকিয়ে জিনিয়াকে টেনে এনে বাহুবন্ধনে বন্দী করল। জিনিয়া নড়াচড়া করতে করতে হাল ছেড়ে দিল। বলল,
‘ কেউ যদি চলে আসে? এখন ছাড়ুন।
সাহিল ছাড়ল না। বলল,
‘ এখন ছেড়ে দেব কিন্তু আবার ধরব। ঠিক আছে?
জিনিয়া না হেসে পারল না। হেসে বলল,
‘ আচ্ছা পরে দেখা যাবে।
সাহিল জিনিয়ার কপালের পাশে দীর্ঘ চুম্বন বসালো। কানের পাশে নেমে আসতেই জিনিয়া তাড়াতাড়ি সরে এল। বলল,
‘ আপনি একদম বেসামাল।
সাহিল হাসল গলা একপাশে কাত করে। বলল,
‘ আর ও বাকি আছে।
জিনিয়া বলল,
‘ ধুর যান তো। মুখ হাত ধুঁয়ে আসুন, খাবার দিচ্ছি।
সাহিল হাসতে হাসতে চলেই যাচ্ছিল। আবার ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। ডাকল,
‘ এই মেয়ে ?
জিনিয়া ফিরে চাইল।
‘ কি?
‘ আমি তোমাকে একটু ও ভালোটালো বাসিনা কিন্তু। ভাব নেবেনা একদম।
জিনিয়া নতজানু হয়ে হাসল। মাথা তুলে বলল,
‘ এরকম বলতে থাকুন। কিন্তু যেদিন বলতে চাইবেন সেদিন আমি শুনব না। হুমম।
জিনিয়া চলে গেল হেসে। স্বাভাবিকভাবে বলা কথাটা সাহিল সহজে নিতে পারল না। সাহিল মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকল। জিনিয়ার গলা ভেসে আসল
‘ যান না। মুখ হাত ধুঁয়ে আসুন। খেতে দিচ্ছি।
সাহিল চলে গেল। রাগ করল জিনিয়ার সাথে। রুমে গিয়ে মুখ হাত ধুঁয়ে বাচ্চাদের মুখে কপালে আদর দিল। তারপর খাটে এসে শুয়ে পড়ল। খাবেনা সে।
জিনিয়া টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসেই রয়েছে। লোকটা আসছেনা। এত ধীরগতির হলে হয়? আশ্চর্য লোক!
জিনিয়া রুমে গেল। চোখ কপালে উঠল তার। সাহিলকে ডেকে বলল,
‘ কি হয়েছে আপনার? আসুন না। খাবেন না? শুনছেন? এই গুড্ডু সাহেব?
সাহিল বলল,
‘ খাবনা আমি। তুমি খেয়ে নাও।
বুক ভার হলো জিনিয়ার। থমথমে মুখে সে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। সে ও খাবেনা।
অনেক সময় পার হওয়ার পর ও জিনিয়াকে আসতে না দেখে সাহিল নিচে নামল। কি সমস্যা এই মেয়ের?
জিনিয়াকে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখা গেল। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল সাহিল। কি করা যায় এই মেয়েকে? এটুকুনি একটা মেয়ে এত রাগ কিসের? মাইর দিতে হবে।
সাহিলকে আসতে দেখে ওড়না টেনে মুখের উপর রাখল জিনিয়া। চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখল। সাহিল তার ওড়না ধরে টান দিল।
‘ উঠো। এই মেয়ে? মাইর খেতে না চাইলে উঠো। খেয়ে নাও। এই মেয়ে? জিনি?
জিনিয়া উঠল না। পিঠের নিচে হাত গলিয়ে জিনিয়াকে কোলে তুলে নিল সাহিল। মুখ নামিয়ে এনে বলল,
‘ কি সমস্যা?
জিনিয়া অভিমানী সুরে বলল,
‘ নামান আমাকে। ধরবেন না আমায়। ছুঁবেন না আমায়।
আওয়াজ করে হেসে দিল সাহিল।
‘ ও আল্লাহ এই মেয়ে রাগ ও করতে জানে? রাগ করা কখন শিখে ফেলেছ জিনি?
জিনিয়া সাহিলের বুকে গুঁজে গিয়ে বলল,
‘ আপনার কাছ থেকে শিখেছি। আপনি শিখিয়েছেন। রাগ কি শুধু আপনি করতে জানেন? আমি জানিনা?
সাহিল হেসে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিল। বলল,
‘ খাইয়ে ও দিতে হবে?
জিনিয়া হাসল।
‘ আজ!
সাহিল খাইয়ে দিল। নিজে খেল। জিনিয়া খেতে খেতে বলল,
‘ আমি কেস জিতেছি কিন্তু আপনি আমাকে কোনো ট্রিট দেননি। আপনার খুশি হওয়ার কথা না? রাগ করেছি।
সাহিল ভাত মাখায় মনোযোগ দিয়ে বলল,
‘ আমি নিজেই একটা ক্রিমিনাল।
আঁতকে উঠল জিনি। খাবার আর গলা দিয়ে নামল না। সাহিল ভ্রু উঁচাল। বলল,
‘ খাওয়া কেন থামিয়েছ? ভুল কিছু বলেছি? সীমান্তকে আমি খুন করেছি, সেই সুবাদে আমি ও ক্রিমিনাল না?
জিনিয়ার চেহারায় অন্ধকার নামল। ঢকঢক করে পানি খেয়ে সে বলল,
‘ আপনি ক্রিমিনাল কেন হবেন? সে অপরাধী তাই আপনি তাকে শাস্তি দিয়েছেন। প্রত্যেকটা অপরাধীকে যদি এমন শাস্তি দেওয়া হতো তাহলে অন্যায় কমে যেত। আপনি ক্রিমিনাল না।
‘ আমি তোমার স্বামী তাই এমনটা বলছ। অন্যকেউ হলে অন্যকিছু বলতে।
জিনিয়া আর খেলনা। মুখ ফিরিয়ে রাখল। সাহিল হেসে দিল। বলল,
‘ ঠিক আছে। আর কখনো এসব বলব না। প্রমিজ।
জিনিয়া তারপর খেল। বলল,
‘ মৃত বাবলুর হত্যাকারী অন্যকেউ। মতিন মিয়াকে তো নির্দোষ প্রমাণ করেছি কিন্তু অপরাধীকে কিভাবে ধরব?
সাহিল বলল,
‘ সমস্যা নেই। জায়িদ আছে না? ধরতে পারবে। চিন্তা করোনা। এখন নাও পানি খাও।
জিনিয়া পানি খেল। বলল,
‘ আপনার বন্ধু ইয়ামিন মানে আপনার বাবার বন্ধু ইয়াজিদ মজুমদারের ছেলে ও তো লয়ার। আপনি আমাকে বলেননি কেন?
সাহিল বলল,
‘ হ্যা। তেমন বিশেষ কিছু নয় তাই বলিনি। কেন বলছ?
জিনিয়া বলল,
‘ না এমনি। অনেক সিনিয়র আমার। ওনাকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল আমি পারব না।
সাহিল বলল,
‘ ভয় পেলে সেটা দেখাতে নেই।
জিনিয়া আবার ও পানি খেয়ে বলল,
‘ আমি কি দেখিয়েছি? তাছাড়া আমি তো জানতামই খুনটা মতিন মিয়া করেনি। কাল ওই দোকানটাতে যেতে হবে, মতিন মিয়ার কাছে ও যেতে হবে। ওনার দোকানে রাত দশটার আগে কিংবা পরে কে কে এসেছিল সবার খোঁজ নিতে হবে। মোটকথা অনেক কাজ।
সাহিল বলল,
‘ এখন ঘুমানোর সময়। অনেক সময় আছে। বেশি প্রেশার নিওনা।
জিনিয়া বলল,
‘ আচ্ছা গুড্ডুসাহেব ।
সাহিল হেসে উঠল।
_______
মতিন মিয়ার সাথে দেখা করার কথা ছিল জিনিয়ার। কিন্তু মতিন মিয়ার বাড়ি পৌঁছাতেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে তার মেয়ের। লোকজনের সমাগম। জিনিয়া আর জায়িদ ভীড় ঠেলে ডুকে পড়ে মতিন মিয়ার ঘরে। নিথর দেহ পড়ে রয়েছে মতিন মিয়ার। কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ এসেই গেরুয়া করল। ডক্টর এসেই জানাল মতিন মিয়ার শরীরে এক ধরণের বিষ ইনজেকশন দ্বারা পুশ করা হয়েছে। যার কারণে ওনার হৃদস্পনন্দন বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটেছে। ইন্ডাইরেক্টলি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করেছেন। জিনিয়ার বুক কাঁপল ধড়ফড়িয়ে। মানুষটাকে সে পরশু সুস্থ দেখেছে একদম। কে এতবড় অমানুষ? মতিন মিয়ার যুবতী মেয়ের বিলাপ ভেসে আসছে। জিনিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। জায়িদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার কাজে। ফোন পকেটে ডুকিয়ে বেরিয়ে আসতেই জিনিয়াকে দেখে সে ডাক দিল,
‘ জুননু তোর এখন কোনো কাজ নেই। তুই চলে যা বাসায়। একা যেতে পারবি?
জিনিয়া থেমে থেমে বলল,
‘ হ্যা পারব। কিন্তু,
জায়িদ ব্যস্ত জবাব দিল।
‘ তোর সব কথা শুনব আমি। এখন বাসায় যাহ।
জিনিয়া থামিয়ে দিল জায়িদকে।
‘ লেন্সটা যে পেয়েছিলাম। ওইটার ডিএনএ টেস্ট করেছ?
জায়িদ থেমে গেল। আমাকে তো দিসনি জুননু। তোর কাছেই ছিল সেটি। আমি পরে নেব বলেছিলাম। জিনিয়া চিন্তায় পড়ল।
‘ বাসায় রেখেছি বোধহয় কোথাও। আচ্ছা খুঁজে দেখতে হবে। সাবধানে থেকো ভাইয়া।
জায়িদ মাথা নাড়াল।
‘ তুই সাবধানে যাস। তাননা মুননাকে দেখিস।
জিনিয়া চলে গেল। বাসায় পৌঁছাতেই তাননা মুননা দৌড়ে এল। জিনিয়ার দুইহাতের আঙুল ধরল দুইজনে। মুননা বলল,
‘ জুননু বচো। বচো। আদোল কলি। বচো।
জিনিয়া একটু নিচু হয়ে বসল। তাননা বলল,
‘ আম্মা মুননু জুননু ডাকি কিনো? আল্লাহ মাববে না?
জিনিয়া হাসল। বলল,
‘ মাববে মাববে।
দুইজন দুগাল ভিজিয়ে দিল জিনিয়ার। জিনিয়া ও দু-জনের গালে গাঢ় চুম্বন বসিয়ে বলল,
‘ তুননু মুননু খেয়েছে? কি খেয়েছে আমার বাচ্চারা?
মুননা বলল,
‘ খাছি। পুঁতা দাদুমুণি ঝান ঝান ভাতু দিছে। খাছি। মুজা নাই। বিশিবিশি ঝান। মিততি নাই।
জিনিয়া তার গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘ বাপের মতো সবকিছুতে মিষ্টি খোঁজেন? পঁচা ছেলে। ঝাল খাওয়ার অভ্যাস করেন।
মুননা জিনিয়ার গাল ধরে টেনে দিল। বলল,
‘ গান তানো কিনো? তুমাকে ও তেনে দিবো। বিথা পাছি না?
জিনিয়া হেসে ফেলল।
তাননা হাততালি দিয়ে বলল,
‘ মুননুল গাল তেনে দিছে আম্মা। ওহ ওহ মুননু দুক্কু পাছে।
বলেই তাননা দৌড় লাগাল। মুননা তার পেছন পেছন দৌড় লাগিয়ে বলল,
‘ তুমাকে মেলে দিব। তুননু তুমাকে আমি খিয়ে ফিলব আছ। মেলে ফেলব।
জিনিয়া বলল,
‘ পড়ে যাবে তো। মুননা বোন পড়ে ব্যাথা পাবে আব্বু। আর দৌড়াইও না। মুননা? এই পঁচা ছেলে?
_____________
বাতাসে বাতাসে তখন তুমুল যুদ্ধ। তীব্র সংঘর্ষ। যার ফলে উৎপত্তি শাঁ শাঁ শব্দ। উলটপালট হচ্ছে গাছের পাতা। ভেঙ্গে পড়ছে গাছ।
কিছুক্ষণের মধ্যে তান্ডব থেমে গিয়ে নামল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। প্লাবিত হলো শহর। শান্ত, স্নিগ্ধ, মনোরোম হলো পরিবেশ।
ছাদের এককোণায় দাঁড়ানো ভেজা নাহিলের কাছে দৌড়ে এল নাতাশা। তখন ও বৃষ্টি থামার নাম নেই। পড়েই যাচ্ছে। নাতাশা ছেলের চুল মুছে দিচ্ছে আবার ভিজে যাচ্ছে। আর না পারতে তিনি বলে উঠেন
‘ এভাবে কেন ভিজছিস নাহিল?
সাথেসাথে নাহিল ফিরে তাকাল মায়ের দিকে। বেশখানিক্ষণ মায়ের শুকিয়ে যাওয়া মুখ দেখে অন্তর কেঁপে উঠল নাহিলের। সে ভালো নেই, তার সাথে মায়ের ভালোথাকাটা ও কেড়ে নিয়েছে। যা হয়েছে মায়ের তো কোনো দোষ নেই, আসলে পরিস্থিতিই সবকিছুর মূল। নাহিল শান্ত স্বরে বলে উঠল,
‘ কেমন আছ মা?
নাতাশার গাল বেয়ে গড়াল অশ্রুজল। বৃষ্টিজলে তা দেখা গেলনা। নাহিল জড়িয়ে ধরল মাকে। নাতাশা কেঁদে দিলেন আওয়াজ করে। কতদিন ছেলের মুখে মা ডাক শোনেনা। কতদিন!
নাহিল ঝুঁকে পড়ে রইল মায়ের কাঁধে।
শুকিয়ে উঠা ক্ষতের ভেতর থেকে আবার কেন ব্যাথা হয়? ক্ষত তাহলে উপরে শুকোনো আর ভেতরে এখনো কাঁচা আছে? পুরোপুরি শুকোয়নি?
হাতের কব্জিতে পড়া কালো ঝকঝকে ঘড়িটার উপর ও বৃষ্টি জমেছে। ঘড়িটা নষ্ট হয়ে যাবে শীঘ্রই। হয়ত পড়ে রইবে ঘরের কোনো এককোণে অবহেলিত হয়ে। হয়ত অনাদর অবহেলায় মরিচীকায় রূপ নেবে। ঠিক নাহিলের মতোই। নাতাশা বেগমকে ছেড়ে নাহিল চলে গেল। একমুহূর্ত ও দাঁড়াল না। মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করেনা আর সেই তিক্ত অতীতের। মা সোরা নামক মেয়েটির নাম নিশ্চয়ই ধরত। আবার, আবার ও তীব্র ব্যাথায় যন্ত্রণায় ছেয়ে যেত শরীর। মন। নাহিল এখন একটু ভালো থাকতে চাই। তার ভালো থাকার ভীষণ প্রয়োজন। ভীষণ।
________
তাননা আর মুননাকে নিয়ে নাহিল বেরোলো পার্কের উদ্দেশ্যে। দুজনের বকবকানি শুনে নাহিল হাসি থামাতে পারছেনা। ভাইয়ের এই দুটো পাগল কোথাথেকে হলো?
আইসক্রিম ওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুননা। বলল,
‘ মুন্টু আচকিলিম কিনি দিউ। আচকিলিম খাবো।
নাহিল হাসল। বলল,
‘ জ্বর ঠান্ডা লাগলে আমার দোষ নেই।
তাননা বলল,
‘ চাচচুল দুষ নাই। আমাদেল দুষ। তুননুল আল মুননুল দুষ।
নাহিল হেসে দুজনের গালে চুমু বসিয়ে বলল,
‘ পাকা বুড়োবুড়ি।
মুননা ফোকলা হাসি দিল। বলল,
‘ বুলোবুলো তুলোতুলি মুলোমুলি চুলোচুলি।
নাহিল বলল,
‘ হয়েছে হয়েছে আর কিছুনা।
দুজনকে দুহাতে আইসক্রিম দিল নাহিল। চামচ দিয়ে খেতে দিয়ে গালে মুখে নাকে লাগিয়ে দুজনের বেহাল অবস্থা। নাহিল দুজনকে পার্কের একটি বেঞ্চে বসালো। বলল,
‘ দুইজন এখানে একদম চুপচাপ বসো। আমি পানি বোতল নিয়ে আসি। ওকে?
তাননা মুননা খেতে খেতে ঠোঁট গোল করে বলল,
‘ উকে।
নাহিল রাস্তার পাশে দোকানের কাছে গেল। দোকানদারকে ডেকে বলল,
‘ মামা একটা পানির বোতল দেন তো।
দোকানদার পানির বোতল দিল। নাহিল টাকা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। রাস্তায় শাঁ শাঁ গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। হঠাৎ পড়ল রেড সিগনাল। থামতে লাগল সব গাড়ি একে একে। নাহিল বোতলের ছিপি খুলে এগোতে গেল, হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত কিছু দেখার কৌতূহলে পিছু ফিরল।
বিবর্ণ, পাংশুটে, মলিন চেহারার সাদা শাড়ি পরিহিত মেয়েটি গাড়ির কাচের উপর ভাঁজ করা হাতের কব্জির উপর মুখ রেখেছে। চোখের দৃষ্টি নিরুদ্দেশে। কোনদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বলা মুশকিল। উদাস হাওয়ায় উড়ছে মেয়েটির সামনের কয়েক গাছি চুল।
খুব খুব চেনা, তারপরেও অচেনা মেয়েটি নাহিলের কাছে। এত এত পরিবর্তনের মাঝে নাহিলের চোখ চিনল হয়ত। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই গ্রিন সিগনাল জ্বলে উঠল। গাড়ি সব চলতে শুরু করল। এক নিমেষে গাড়িটা চোখের আড়াল হলো। নাহিল তার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল শক্ত করে। কোথাও একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। নাহিলের হাত আপনাআপনি গিয়ে ঠেকল বুকের বা পাশে।
মিঃ চ্যাটার্জি হসপিটালের এই ওই কেবিনে উঁকি দিতেই নার্স এসেই জিজ্ঞেস করল,
‘ কাউকে খুঁজছেন স্যার?
মিঃ চ্যাটার্জি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘ জ্বি, পূজারিনী চ্যাটার্জির বাবা আমি। ওকে কোন কেবিনে রেখেছেন?
কপালের পাশে সেলাই খুলে গিয়েছিল তাই এনেছিলাম। মাথা সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো ছিল। দেখেছেন?
নার্স বলল,
‘ পূজারিণী চ্যাটার্জি তো কিছু আগেই বাইরে গিয়েছিল। বলল ওনার মা নাকি ওখানে ছিলেন।
মিঃ চ্যাটার্জি কপালের ঘাম মুছে বলল,
‘ হ্যা। আপনারা ওকে একা ছাড়লেন কি করে?
নার্স বলল,
‘ সরি স্যার। আমরা ছাড়ার কে? পেশেন্টকে তো এডমিট করায়নি যে চোখেচোখে রাখব। ওনার ট্রিটমেন্ট শেষ,ওনাকে আপনারা অভিভাবকরা নিয়ে যাবেন। ব্যস। তাছাড়া পে ও করে দিয়েছেন।
মিঃ চ্যাটার্জি বললেন,
‘ কোথায় গেল মেয়েটা? কিছু জানেনা। কিছু চেনেনা।
মিঃ চ্যাটার্জি বের হয়ে গেলেন হসপিটাল থেকে। পূজার খোঁজে।
ফোনে চেঁচাল জাহেদা জায়িদের সাথে। সকালে ও তেমন কিছু খাসনি। তাড়াতাড়ি করে বের হয়েছিস। টিফিন ও নিসনি। তুই না খেয়েটেয়ে শুধু কাজ নিয়ে থাকবি জায়িদ? অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই মাকে দেখতে হবে। বউ বাচ্চা তো নেই যে সেবা করবে।
জায়িদ বিরক্ত হলো। আবার মায়ের কথায় হাসি ও পেল। সবকিছুর শুরুতে মা বিয়ে বিয়ে করে। এই বিয়ে সংসার এসব ছাড়া আর কোনোকিছু নেই মানুষের জীবনে। আশ্চর্য!
জায়িদ থেমে থেমে বলল,
‘ আম্মা আমি বাইরে খেয়েছি। আজকে বড়স্যার মিটিংয়ে ডেকেছেন আর লান্চ অফার করেছেন। তোমাকে জানাতেই যাচ্ছিলাম।
জাহেদা বলে উঠল,
‘ কেন বলতে যাবি এই বুড়িকে? বলিস না। দরকার নেই। থাক তুই তোর মতো। তোর কোনোকিছুতে আমি আর মাথা ঘামাব না। তোর বিয়ে নিয়ে ও আর কোনো কথা বলব না।
জায়িদ বলল,
‘ আসল কথায় তাহলে এসেছ আম্মা। তুমি শুধু আমাকে,
জাহেদা ডাকলেন,
‘ জায়িদ? হ্যালো? এই জায়িদ?
‘ কিছুক্ষণ পর ফোন দিচ্ছি আম্মা।
বলেই জায়িদ ফোন পকেটে রাখল। আশ্চর্য মেয়ে মানুষ! রাস্তার মাঝখানে কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে? জায়িদ গাড়ি থামাল। তীব্র বিরক্তি নিয়ে গেল মেয়েটার কাছে। মেয়েটির হাতে আইসক্রিম। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। গোলাপি কাপড়ের সাথে কালো ওড়না। হাতে পড়া একটি ঘড়ি।
জায়িদ মেয়েটির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলল,
‘ কোনো সুস্থ মানুষ এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খায়? আশ্চর্য! এক্সকিউজ মি. ম্যাডাম!
পূজা সামনে ফিরল। আইসক্রিম গালের ভেতর রেখে চুষতে চুষতে চেয়ে রইল জায়িদের দিকে। কমলা রঙের আইসক্রিম খাওয়ায় উপরনিচ ঠোঁটদুটো কমলা রঙ ধারণ করেছে।
জায়িদের চক্ষু স্থির। কন্ঠ শান্ত,গম্ভীর। শান্ত কন্ঠ আর ও শান্ত রাখার চেষ্টা করতে করতে এক ফাঁকা ঢোক নেমে গেল জায়িদের স্বরনালী বেয়ে। জিজ্ঞেস করল সে,
‘ নাম?
পূজা গাল থেকে আইসক্রিম নামিয়ে নিল। ঠোঁটজোড়া নেড়ে শুধালো
‘ পূজা। পূজারিণী চ্যাটার্জি।
জায়িদের কপালের ভাঁজ স্পষ্ট।
পূজা আগাগোড়া দেখল জায়িদকে। ওমা এটা তো পুলিশ? পুলিশের ড্রেস গায়ে?
পূজা কাঁপল তরতর করে। দাঁতে দাঁত চাপাল। চিৎকার করে বলল,
‘ বাবা! পুলিশ। পুলিশ। বাবা? মা? দাভাই?
জায়িদ পূজার আকস্মিক চিৎকারে হতভম্ব। তার পা চলছে না মনে হলো। কোনোমতে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল জায়িদ। গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। পূজা চেঁচাতে চেঁচাতে কাঁদছে। আশেপাশে লোক জড়ো হয়েছে। সেই লোকগুলোকে ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এল মিঃ চ্যাটার্জি। পূজাকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দৌড়ে গেল পূজার কাছে। পূজা তার বাবাকে দেখে ঝাপটে ধরল। একহাতে কপাল চেপে ধরে মূর্ছা গেল৷ জায়িদ গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। অবাক হলো মিঃ চ্যাটার্জি। পুলিশ অফিসার তার মেয়েকে বেহুশ হতে দেখে এগিয়ে না এসে এভাবে চলে যেতে পারল?
চলবে,
সকলের মন্তব্য আশা করছি