#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[২৩]
মাঝরাত। নেড়ি কুকুরের আর্তনাদ ভেসে আসছে। মাথার উপর নিশাচর পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। নেড়ি কুকুরগুলো রক্তাত্ত মাংস খাওয়ার জন্য সাহিলের পিছু নিয়েছে। জঙ্গলের পাশে সাহিল। সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। সীমান্তর লাশ তিন টুকরো করেছে সে। তড়পাতে তড়পাতে শান্ত হয়ে গেল সীমান্তর দেহের তিনখন্ড তার চোখের সামনে।
সাহিলের মুখে ও ফোঁটা ফোঁটা ও রক্ত। পুরো গায়ে রক্ত। সীমান্তর লাশ বস্তাবন্দি করে হসপিটাল থেকে দূরের জঙ্গলে ফেলে দিল সাহিল। কুকুরগুলো ও ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই লাশের উপর। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেল।
তার থেকে দূরে বড় ছুরিটা গেঁথে ফেলল মাটির নিচে। সব প্রমাণ লুটপাট করে বাড়ি ফিরল সাহিল। এই সীমান্তই সিফাত। জেনে গিয়েছে সাহিল। আনহার খোঁজ পেলনা সে এখনো। মারা গিয়েছে তার বোন। আজ তার নিখোঁজ হওয়ার সপ্তম দিন। সেই মৃত আনহাকে কোথায় রেখেছে তা না বলায় সীমান্তকে তিন টুকরো করেছে সে। বোন হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে নিল সে। নিল।
সীমান্তর দেওয়া বোনের ছবিগুলো আগুনে পুড়ল। নেড়ি কুকুরগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে হিংস্র মানবটিকে একবার দেখল।
সোফায় কোনোমতে শুয়ে থাকা জিনিয়ার অপেক্ষা পুরোলো না। কখন ফিরবে সাহিল? জিনিয়ার ভীষণ ভয় হয় লোকটাকে নিয়ে।
ইদানীং আনমনা থাকে লোকটা। আনহার শোকে আবার পাগলের মতো ব্যবহার করছে সালেহা বেগম। সাগর সাহেব হয়ে পড়লেন দিশেহারা। মেয়েকে কাছে পেতে না পেতেই আবার হারিয়ে ফেলল। সালেহা বেগমকে কোনোমতেই সামলানো যাচ্ছেনা। আনহার কাপড় চোপড় হাত থেকে ফেলছেনা। বুকের সাথে জড়িয়ে আনু আনু ডেকে যাচ্ছে।
দরজায় খটখট খটখট শব্দ হলো। জিনিয়া ধড়ফড়িয়ে উঠল। দরজা খুলে দিতেই সাহিল ডুকে এল ঘরে। পুরো ভিজে গায়ে। যেন গোসল করে এসেছে কোথাথেকে। জিনিয়া ওভাবে তাকাতে দেখে ভড়কে গেল সাহিল।
সাদা ধবধবে শার্টের রঙটা কেমন পাল্টে গেছে। জিনিয়াকে কথা বলতে দিলনা সাহিল। দরজা বন্ধ করে কোলে তুলে নিল জিনিয়াকে। নরম গালে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল,
‘ সিঁড়ি দিয়ে বারবার উঠানামা করতে বারণ করেছি।
জিনিয়ার মুখ দিয়ে কথা বের হলোনা। লোকটা পাগল হয়ে গেছে বোনের শোকে। কোথা থেকে ভিজে এল তাও জিজ্ঞেস করল না জিনিয়া। বিছানায় শুয়ে দিয়ে জিনিয়ার গালে দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে ছাড়ল সাহিল। ওয়াশরুমে গিয়ে পাল্টে এল কাপড়। রক্তের দাগগুলো সাদা শার্ট থেকে ভালোভাবে যাওয়ার জন্য ওয়াশিং পাউডারের পানিতে ডুবিয়ে রাখল।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে জিনিয়াকে একইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখল সাহিল। মাথা মুছে গামছাটা দূরে ফেলে দিয়ে জিনিয়ার কাছে গিয়ে বসল। জিনিয়াকে তুলে বসিয়ে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। শান্তস্বরে বলল,
‘ তোমার ইজ্জত হরণের চেষ্টা আর আমার বোনের খুনীকে আমি জবাই করেছি জিনি। তিন টুকরো করেছি। তারপর কুকুরকে খেতে দিয়েছি।
জিনিয়া প্রশ্ন করতে পারল না। তরতর করে কাঁপতে থাকল। সাহিল তার ঠোঁট নেড়ে কথা বলতে দিলনা। খানিকটা উঁচু হওয়া পেটে হাত বুলিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। জিনিয়ার চোখের কোটের জমা জল গাল ভিজিয়ে দিল। সাহিল ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল শক্ত করে। তারপর বাচ্চাদের মতো মিনমিন করে বলল,
‘ জিনি সীমান্তকে খুন করে কি পেলাম আমি? আমার বোনকে তো পেলাম না জিনি। তিনমাসের জন্য এসে মায়া লাগিয়ে আবার কেন চলে গেল সে?
জিনিয়া খেয়াল করল সাহিল কাঁদছে। জিনিয়া পরে রইল তার বুকে। শক্ত করে সাহিলের পড়নের শার্ট খামচে ধরে রাখল। আবার মুখ তুলে দেখল সাহিলকে দেখল। সাহিলের হাত দুটো ছুঁয়ে দেখল। এ হাতে খুন করেছেন? এই হাতে?
সাহিল হাতের কব্জি দিয়ে মুখ মুছে নিল ভালোকরে। জিনিয়ার মুখের কাছে গিয়ে বলল,
‘ পুলিশে দেবে এখন আমায়? জায়িদকে বলে দেবে আমি খুনী? আমার বোনের খুনীর খুনী?
জিনিয়া না না করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
‘ না, আমি আপনাকে ছাড়া কি করে থাকব? আমাদের এখনো আর ও পথ যাওয়া বাকি।
জিনিয়া আবার পড়ে রইল সাহিলের বুকে। বলল,
‘ আমি বলব না কাউকে। বলব না।
সাহিল মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
_________
চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসে থাকা জায়িদের কাছে খবর নিয়ে আসল কনস্টেবল।
‘ স্যার সীমান্তকে নাকি কে কুপিয়ে হত্যা করেছে। জঙ্গলের পাশে তার শরীরের অংশ পাওয়া গেছে। কুকুরে ছিঁড়ে খেয়েছে।
জায়িদ দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘ সীমান্ত?
‘ জ্বি স্যার।
জায়িদ বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে। সীমান্তর লাশ দেখে নিজের চোখ জুড়াল।
সীমান্ত গেল এবার সিফাতের পালা। কোথায় সিফাত? আর কোথায় আনহা?
গোয়েন্দা বিভাগ লেগে পড়ল সীমান্তর হত্যাকারীর খোঁজে।
সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরল জায়িদ। মাথার ক্যাপটা খুলে নিয়ে গেইট খুলে বাড়িতে ডুকে পড়ল। ওই বাড়ির ছাদের দিকে তাকাতেই বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস।
দীর্ঘ সময় শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এল জায়িদ। ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল এককোণে। জাহেদা এল তার পিছু পিছু। সদ্য ধোঁয়া উঠা গরম চা নিয়ে।
জায়িদকে ঘাড় ধরে ডাকল। চা নিল জায়িদ।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জাহেদা জিজ্ঞেস করে,
‘ তোর কি মন খারাপ আব্বা?
জায়িদ মায়ের দিকে শান্ত, অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,
‘ যেদিন আমি পুলিশের চাকরিতে ডুকি। সেদিন শপথ নিয়েছিলাম অন্যায় দমন করার জন্য নিজের প্রাণ দিতে হলেও পিছপা হবোনা। কিন্তু দেখো অন্যায় না দমন করতে পারছি না অন্যায়ের সাথে লড়তে পাচ্ছি। দিনশেষে আমি ব্যর্থ আম্মা । ওই পোশাকটার মর্যাদা আমি দিতে পারিনি। ওই পোশাকটা গায়ে জড়াতেই লজ্জা হয় আমার।
জাহেদা চুপ করে থাকেন। অনেকক্ষণ পর বলেন,
‘ নিজেকে দোষ দিসনা আব্বা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বলছিলাম কি, নোরার সাথে কি কথাবার্তা আগাব?
রাগে দপদপ করে উঠে জায়িদের চোয়াল।
‘ কি শুরু করেছ আম্মা? বিয়ে আমি কখনোই করব না। কাউকেই করব না। ওই বাড়িটা দেখছ, ওই পরিবারটা আমাদের পরিবারের ও একটা অংশ আম্মা । তাদের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। আর তুমি পড়েছ বিয়ে নিয়ে। রিডিকিউলাস আম্মা। আনহার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি আম্মা। সে নিখোঁজ।
‘ তার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তুই শুনিসনি বোধহয়। সিফাত নামের ছেলেটা সাহিলের ফোনে বিয়ের ছবি পাঠিয়েছে। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন দেওয়ার ছবি।
জায়িদ বলল,
‘ তাতে কি আম্মা? সিফাত নামের জানোয়ার ওসব জোর করে করেছে। নিজেকে তো সামনে আনেনি। ছবিগুলো আমাদের ডিপার্টমেন্টে দেওয়া হয়েছে আম্মা। যে জায়গায়টা ওখানে দেখা গেছে সেখানেও গিয়েছি আমরা। আনহাকে ওখানে পাওয়া যায়নি। ওই বিয়ে বিয়ে নয় আম্মা। ধোঁকা, প্রতারণা। জানোয়ারদের কাছে খেলামাত্র। ওই বিয়ে মানিনা আমি।
‘ আশ্চর্য! কথাবার্তা বলছিস জায়িদ। ওই মেয়ের পাপের ফল ও পেয়েছে। নষ্ট ওই মেয়ে। যার হয়ে তোকে মারতে চেয়েছিল, সে ওকে নষ্ট করেছে। পাপ কখনো তার বাপকে ছাড়েনা। যতই আমরা ক্ষমা করি, উপরওয়ালা ওকে ক্ষমা করেনি। তাই তো এতবড় শাস্তি দিয়েছে।
‘ দোহাই লাগে আম্মা। আমার ভালো লাগছেনা কিছু। আমার সামনে এসব বলোনা। আনহা বেঁচে আছে কিনা সেটা ও জানিনা আমরা। সিফাত জানোয়ারটা আনহারকে,
‘ কি করেছে?
‘ ওর পিঠে ব্লেড দিয়ে নিজের নাম লিখেছে। সেই ছবি ও পাঠিয়েছে।
আঁতকে উঠে জাহেদা।
‘ এ কি করে হয় জায়িদ? এমন করল কেন? আমি তো ভেবেছি বিয়ে করে ও সুখী আছে।
‘ সুখী? সুখী কার সাথে হয় আম্মা?
‘ যাকে ভালোবাসে তার সাথে হয়।
‘ আনহা ওই জানোয়ারকে ভালোবাসেনা আম্মা। এদের ভালোবাসা যায় আম্মা?
‘ তো কাকে ভালোবাসে? কাকে?
জায়িদ আর কোনো জবাব দিলনা।
‘ সব প্রশ্নের উত্তর হয়না আম্মা। তুমি নিচে যাও। আমি একটু একা থাকি। প্লিজ আম্মা।
জাহেদা ছেলের দিকে তাকাল।
‘ আচ্ছা থাক। আমি যাই তাহলে। চলে আসিস, বেশিক্ষণ দাঁড়াস না।
______________
সাগর সাহেব ডাকায় জায়িদ গেল আহমেদ বাড়িতে। সালেহা বেগমের অবস্থা বেগতিক। কিছুক্ষণ পরপর কাঁদছে পাগলের মতো। সাগর সাহেব জিজ্ঞেস করল জায়িদকে আনহার কোনো খোঁজ পেল নাকি। জায়িদ জানাল পায়নি। যেখানে পাওয়ার কথা আনহাকে, সেখান থেকে তাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আনহার রক্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে একটা বস্তাতে। আর কিছুই না।
সাহিল নেমে এল নিচে। জিনিয়া তার পিছু পিছু নেমে এল। ভয় কমল না তার। সাহিল এসে সোজাসাপ্টা বলল,
‘ আনহা মৃত। মারা গেছে আনহা।
জায়িদ উঠে দাঁড়াল।
‘ পাগলের মতো কথা বলছিস কেন সাহিল? তোর কি মাথা গেছে? এমন সময় তুই এসব বলছিস?
সাহিল রেগে গেল।
‘ তো কি বলব? যেটা সত্যি সেটাই বলছি। আরেহ তোদের আইন অন্ধ। অন্ধ। কি করেছে তোদের আইন? কিচ্ছু করেনি।
জায়িদ মাথা নামিয়ে রাখল।
সাহিল টাকা ছুড়ে মারল জায়িদের দিকে।
‘ যাহ ঘুষ দিলাম এবার আমার বোনের লাশ এনে দে খুঁজে। যাহ।
জায়িদ তাকাল রক্তবর্ণ চোখে। সাহিলের দিকে তাকাতেই সাহিল ঘুষি বসালো তার নাক বরাবর। দূরে ছিটকে পড়ল জায়িদ।
জিনিয়া চিৎকার দিয়ে উঠল ভাইয়া বলে ?
দৌড়ে গিয়ে ধরল জায়িদকে। জায়িদ চেয়ে রইল সাহিলকে। বসে পড়ল সাহিল মাথায় হাত দিয়ে। জিনিয়ার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। সাহিল গিয়ে ধরল জিনিয়ার হাত। চলো জিনি।
জিনিয়া জায়িদকে জড়িয়ে ধরা। সাহিল জায়িদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল জিনিয়াকে। তোমাকে বারবার নিচে নামতে বারণ করেছি না?
যাও উপরে যাও। যাও।
জিনিয়া গেলনা।
সাগর সাহেব বলল,
‘ তোর কি হয়েছে সাহিল? ওর সাথে কেন এমন করছিস?
সাহিল কোলে তুলল জিনিয়াকে।
‘ খবরদার জিনি। আমার কথার অমান্য করলে ভালো হবেনা একটুও।
এমন ব্যবহার কখনো করেনি সাহিল তার সাথে। জিনিয়া কাঁদল শুধু। জায়িদ মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। সাহিলের জায়গায় সে থাকলে আর ও বেশি পাগলামি করত। যদি এতসব অন্যায় জুননুর সাথে হতো?
জিনিয়াকে খাটে বসালো সাহিল। জিনিয়া ছাড়ল না সাহিলকে। সাহিল বলল,
‘ ছাড়ো জিনি। নিচে যাব আমি।
জিনিয়া কেঁদে কেঁদে মাথা নাড়ল।
‘ ভাইয়াকে মারবেন না। আমাকে মারুন।
সাহিল জিনিয়ার কান্না দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল।
জিনিয়ার মুখ আগলে ধরে বলল,
‘ মারব না কাউকে। তুমি এই ঘর থেকে বের হবেনা। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবে।
তরিনা খাতুন অসুস্থ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে থাকেন। আনহার নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে আবার রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়েছেন। জিনিয়াকে কাজ করতে দিতে বারণ করেছে সাহিল। সালেহা ও সেই অবস্থায় নেই। রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন তিনি।
সাহিল ততক্ষণে রুমের বাইরে এসে দরজা বন্ধ করছে। ভেতর থেকে জিনিয়া দরজা ধাক্কাচ্ছে।
‘ কি করছিস গুড্ডু? ওকে আটকে রাখলি কেন?
‘ ও বার-বার সিঁড়ি দিয়ে উঠছে আর নামছে। তাই। ওকে ঠিকমতো খেতে বলো গ্রান্ডমা। আজকাল আমার কথা শুনতে চায়না।
তরিনা খাতুন হাত বুলালেন সাহিলের মুখে।
‘ বোনটা শেষমেশ তোর মাথা খারাপ করে চলে গেল গুড্ডু।
সাহিল হাত নামিয়ে দিল তরিনা খাতুনের।
‘ মাথা খারাপ হয়নি গ্রান্ডমা। আমি একদম ঠিক আছি। তুমি জিনির খেয়াল রেখো। ও বেশি শুকিয়ে গেছে।
_________
সাতমাস পার হলো প্রায়। সালেহা বেগম ধীরেধীরে সুস্থ হলেন। কিন্তু মেয়ের কথা মনে পড়লেই উন্মাদের মতো কান্না করেন। মেয়েকে শেষদেখা ও দেখতে পারল না। সবকিছুর জন্য সে আর সাগর সাহেব দায়ী। তারা দায়ী। সাগর সাহেব নিজেকে দায়ী করেন বেশি। সে শুরু থেকে ঠিক থাকলে এতকিছু হতোনা কখনো। কখনোই হতোনা।
দুই জমজ সন্তান জন্ম নিল জিনিয়ার। একটি মেয়ে অপরটি ছেলে। মেয়েটিকে কোল থেকে নামায়না সালেহা। সারাক্ষণ ডাকতে থাকে আনু আনু।
সন্তানদের দেখে একেবারে শান্ত হয়ে যায় সাহিল। সবকিছু ভুলে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। ছেলে মেয়ে দুইটা আলোকিত করে রাখে পুরো বাড়ি। সবাই নতুন সদস্যর আগমনে পুরোনো ব্যাথা ভুলতে শুরু করে ধীরে ধীরে।
ছোট্ট ছোট্ট হাত পা নাড়িয়ে খেলা করা বাচ্চাগুলোকে ভিডিও কলে দেখে নাহিল। জিনিয়াকে বলে,
‘ ভাবি ওদের কি নামে ডাকব ?
জিনিয়া হেসে বলল,
‘ তাদের চাচ্চু বলুক।
নাহিল বলল,।
‘ অন্য নামগুলো তোমরা দিয়ো। আমি ওদের ডাকনামটা দেই। মাকে ডাকব তাননা, বাবাইকে ডাকব মুননা।
খিলখিল করে হেসে উঠল জিনিয়া।
‘ এই তাননা মুননাকে দেখার জন্য তাদের চাচ্চু কি আসবেনা?
নাহিল একদম চুপ মেরে যায়। কোথাথেকে এসে সাহিল ফোন কেড়ে নেয়।
‘ এখানে ফোন দিতে কে বলেছে তোকে? আমরা কে হই তোর? তুই কেউ নস আমাদের। কেউ না।
সাহিল ফোন কেটে দিল। নাহিল ডাকল,
‘ ভাই শোনো।
সাহিল শুনল না।
জিনিয়া বিছানার উপর খেলা করা বাচ্চা দুটোকেই নাক টিপে দিয়ে ডাকল,
‘ তাননা মুননা তোমাদের বাপ মহাশয় এত রাগী কেন?
সাহিল বলল,
‘ না। তোমার ছেলেকে ডাকো। আমার মেয়েকে ওই নামে ডাকবেনা। ডাকব না।
জিনিয়া বলল,
‘ তো?
সাহিল মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়। গালের সাথে লাগিয়ে রেখে বলে,
‘ ও আমার মা। মা ডাকবে। বুঝেছ?
হেসে ফেলল জিনিয়া। ছেলেকে কোলে নিয়ে বলল,
‘ আমার বাবাকে বাবা ডাকবেন তাহলে।
সাহিল বলল,
‘ আমাকে বাবা ডাকবে। ওকে কেন আমি বাপ ডাকব?
আবার ও হেসে ফেলল জিনিয়া। সাহিল দেখল তার হাসি।
‘ বাচ্চার মা হয়েছ অথচ এখনো হাসো বাচ্চাদের মতো। হাসতে ও শিখলানা মেয়ে।
জিনিয়া বলল,
‘ তো আপনি শিখিয়ে দিন না।
সাহিল বলল,
‘ আমার মেয়ে বড়হোক। শিখিয়ে দিতে বলব। ওর থেকে শিখবে। বুঝেছ?
জিনিয়া মাথা দুলালো।
‘ জ্বি গুড্ডুসাহেব বুঝেছি।
সাহিল তার মাথা দিয়ে দুম করে মারে জিনিয়াকে৷ জিনিয়া মাথা ঢলতে ঢলতে বলে
‘ ব্যাথা পেয়েছি না?
সাহিল বলল,
‘ তো আমি কি করব?
সাহিল খেয়াল করল তার কোলে থাকা মেয়েটি,
‘ ঢোক তুলে তুলে হাসে।
সাহিল বলল,
‘ আরেহ তুমি হাসো কেন মা? কি বুঝেছ?
জিনিয়া বলল,
‘ বুঝে গিয়েছে তাদের বাপ মহাশয় ভারী দুষ্টু।
সাহিল হাসল একগাল। ছেলেটা কেঁদে উঠল জিনিয়ার কোলে৷
‘ ওকে আদর করছেন না কেন? দেখুন কাঁদছে আমার ছেলে৷
সাহিল হেসে ছেলের দিক তাকিয়ে বলল,
‘ হেইই ছেলে শুরু হয়ে গিয়েছে? হিংসুটে ছেলে? যাহ তোকে আদর করব না। আমার মেয়েকে করব।
ছেলেটা খ্যাঁচখ্যাঁচ আওয়াজ করে কেঁদে উঠে।। জিনিয়া বুকের সাথে লেপ্টে রাখলে শান্ত হয়ে যায়। সাহিল এসে কোলে নিয়ে চলে গেল আদর দিতে দিতে । বিছানার উপর রাখা মেয়েটা জিনিয়ার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে জিহ্বা বের করল। দন্তহীন গালে হাসল।
জিনিয়া তার নাকে টুপ করে চুমু খেয়ে বলল,
‘ মা হাসে কেন?
_________
জায়িদ চলে আসে ভাগিনী ভাগিনাকে দেখার জন্য। আসার সময় এটা ওটা আনে। জিনিয়া বকে,
‘ ওরা কি এখনো ওসব খেতে পারে ভাইয়া? কেন যে পাগলামি করো?
‘ মামা কি ওদের দশটা আছে জুননু। আমি একাই দশজনের পাগলামি করব।
মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করে জায়িদ। বলে,
‘ মামা তুমি কি খাবে বলোতো? মায়ের মতো চকলেটখোর হবে?
জিনিয়া হেসে ফেলল। তাননাকে কোলে দিয়ে মুননাকে কোলে নেয় জায়িদ। সাথে সাথে কাম সাড়ে মুননা। জায়িদ চিল্লিয়ে বলে,
‘ এটা কি করলি বাপ? এখন থেকে শুরু করে দিলি আমার সাথে। মামা ভাগিনার তুমুল যুদ্ধ হব্বে।
জিনিয়া হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল বিছানায়। বলল,
‘ মামা কোলে নিয়েছে জেনে গিয়েছে তাই সুসু করে দিয়েছে।
জায়িদ ও হাসল।
মুননা হাসে। জায়িদ বলল,
‘ সুসু করে দিয়ে আবার হাসেন আপনি? সেই লেভেলের ফাজিল হবে এই ছেলে দেখা যাচ্ছে।
মুননা আর ও হাসে। জায়িদ নেমে যায় দোতলা থেকে। সালেহাকে দেখতে যায়। গাল ভেজা।
জায়িদ জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছেন আন্টি?
সালেহা বেগম বুকের সাথে জড়িয়ে ধরা ছবিটা দেখিয়ে বলে,
‘ ওকে আমার কাছে এনে দাওনা বাবা। বুকটা খালি খালি হয়ে গিয়েছে। জানো? কেউ বকে বকে ঔষধ খাওয়ায় না। মাথায় তেল দিয়ে দেয়না। চুল আঁচড়ে দেয়না। আমি কতদিন ছুঁইনা আমার মেয়েকে। আদর করিনা। কতদিন তার হাসির আওয়াজ শুনিনা।
জায়িদ মাথা নামিয়ে নিল তাড়াতাড়ি।
কিছু মানুষ কি আসলেই অল্প সময়ে মায়া জমিয়ে হুট করে হারিয়ে যেতে আসে? তাদের কেন হুট করে এসে সব লুট করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে? সবকিছু থাকা স্বত্বেও পাওয়া স্বত্বেও কেন মাঝখানে একটি কিছু না থাকার আর না পাওয়ার গল্প থাকে?
এত সুন্দর আর সুখের মাঝে কেন একটি অসুন্দর স্মৃতি জড়ানো। স্মৃতির পাতা চকচকে ঝকঝকে না হয়ে কেন কালো হয়ে থাকে? ডায়রীর ভাঁজে ভাঁজে গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি কেন শুকনো অবস্থায় থাকে?
অদ্ভুত মানবজীবন!
প্রেম প্রণয়ে অবিশ্বাসী বিরক্তিকর মানুষগুলো একসময় এই প্রেমপ্রণয় হারিয়ে যাওয়ার জন্য আর্তনাদ করে । আড়ালে, আবডালে। নীরবে, নিভূতে। প্রশ্ন জাগে জায়িদের?
এই তথাকথিত ভালোবাসা শব্দটা আছে কেন? এটার মাহাত্ম্য কি? এটার মানেই কি না পাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া?
যদি এমন হয় তাহলে এই ভালোবাসা শব্দটা পাল্টে যায়না কেন?
এই তথাকথিত ভালোবাসা শব্দটার আসলেই কোনো নির্দিষ্ট অর্থ নেই। একেক জনের কাছে এর একেক রূপ, একেক বাহার। কারো কাছে এর মানে বিশ্বাস, আশা, ভরসা, নির্ভরতা । আবার কারো কাছে ধোঁকা, প্রতারণা আর বিশ্বাসঘাতকতা। এই শব্দটা কাউকে ভাঙা থেকে গড়ে। আবার শক্তপোক্ত কাউকে ভেঙে তছনছ করে দেয়। এই শব্দটাই মানুষের মনের মতো দামী মূল্যবান জিনিসকে ভেঙ্গে চুরমার করে। অথচ সেই মন ভাঙার শাস্তি দেওয়ার জন্য তখন সেই মন ভাঙা মানুষটাকে ও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। এমনভাবে হারিয়ে যায় তারা যে তাদের অস্তিত্ব আশেপাশেই কিংবা মনগহীনে থেকে যায়। কিন্তু মুছে যায়না। ম্লান হয়না। অবশ্য এই মুছে না যাওয়ার পেছনে ও আর ও একটি গল্প থাকে। মুছে যায়না আর ও একটি মনভাঙার গল্প না হওয়ার জন্য।
জায়িদ ভাবে,
‘ রোজ কত মনভাঙার গল্প লেখা হয় হয় কে জানে?
মনভাঙবে জেনে ও আবার গড়তে যায় কতজনে?
তারপরেই সময় এগিয়ে গেল দ্রুত। প্রায় আড়াই বছর পর।
চলবে,
পেইজের রিচ একদম কমে গেছে। আপনারা বেশি বেশি কমেন্ট করুন। কোনোকিছু বলার না থাকলে স্টিকার কমেন্ট করুন 🙏।