#আমরা_দুজন
#পর্ব_২
[ written_by_sumaiya_karim ]

কিঞ্চিত অজানা এক আশঙ্কায় শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে বারংবার। উদয় কে এখানে দেখার জন্য সে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে ছিলো কিন্তু সূর্যর জন্য প্রস্তুত ছিলো না একটু ও। কেমন যেনো একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। নার্ভাস থাকলে শুভ্রতা হাতের তালুতে আঙ্গুল ঘষতে থাকে। আজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। নিচে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ রত হয়ে লাগাতার হাতের আঙ্গুলের উপর এক প্রকার জবরদস্তি করে অত্যাচার চালাচ্ছে শুভ্রতা। সেই অসহায় হাত দুটো ও বলছে,

–‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি!’

কিন্তু তাদের এতো রিকোয়েস্ট এও যেনো শুভ্রতা হাল ছাড়ছে না। চুপচাপ ছোট্ট গোলগাল একটা রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে অস্বস্তি কমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সে।

সূর্য এটা নিশ্চুপে অবলোকন করলো। তবে এমন টা করার কারণ প্রথমে ধরতে পারলো না। যখনি দেখলো শুভ্রতার কপাল দিয়ে চিকন পাতলা সিড়সিড়ে ঘাম আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তখন সে বুঝলো ব্যাপার টা। মৃদু হাসলো সে। যেই হাসির কোনো শব্দ নেই। জিহ্বা দিয়ে নিজের কিউট লাল ঠোঁট দুটো কে ভিজিয়ে নিয়ে সূর্য শুভ্রতার অস্বস্তি কাটানোর জন্য বললো,

–‘আচ্ছা আপনার পছন্দের ফুল কি বেলি?’

সূর্য দেখতে আসা পাত্রী কে সাধারণত যেসব প্রশ্ন করা হয় তার বিপরীতে সে এই প্রশ্ন করতে কেন জানিনা বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করলো। শুভ্রতা প্রশ্ন শুনে ভিমড়ি খেয়ে গেলো।

–‘জ…জ্…!’

অস্ফুট স্বরে আধো বলা কথাটায় বুঝিয়ে দিতে সক্ষম যে সামনের মানুষটি তার প্রশ্নের জন্য কোনো রকম প্রস্তুত ছিলো না। তাই সূর্য তার আশানুরূপ উত্তর পেলো না। কিছু টা আফসোস হলো কিন্তু কিছু সেকেন্ড ব্যবধানে তা উবে যায়। সে ফের বললো,

–‘আমি যদি ভুল না বলে থাকি আপনার বেলকনিতে নিশ্চয়ই বেলি ফুলের গাছ রয়েছে। যার সদ্য ফোটা ফুল থেকে দারুন সুগন্ধি ছড়াচ্ছে!’

–‘আ…আস..লে..

শুভ্রতার মুখে স্পষ্ট জড়তা রয়েছে। সূর্য থামলো না শুভ্রতা কে অভয় দিয়ে বললো,

–‘হাত দুটো কে মুক্ত করে দিন। অপরাধীন থেকে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে নিশ্চয়ই। অত্যাচার তো আর কম হলো না তাই না?’

শুভ্রতা কথাটার যথার্থ বুঝতে পেরেছে হাত তড়িৎ গতিতে ছেড়ে দিলো। প্রচুর ঘামতে লাগলো। যেনো কোনো ভয়ংকর কিছুর থাবায় পড়েছে সে। যে কোনো ভাবে বেঁচে পালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত।

–‘আপনার এতো আন-ইজি ফিল করার কোনো শক্তপোক্ত কারণ নেই। আমি বাঘ ও নই আমার ভাল্লুক ও নই। আপনার মতোই একটা মানুষ মাত্র তাই…!’

সূর্যের কথা বুঝতে পেরে শুভ্রতা এবার কিছুটা স্বাভাবিক হলো। সূর্য তার পুরো রুম পায়চারী করে এটা সেটা জিঙ্গেস করছে আর শুভ্রতা হা, হু, জ্বি এসব ছোট্ট কথায় উত্তর দিচ্ছে। মিনিট চারেক গেলে সূর্য এবার শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলে,

–‘আপনার নিজস্ব কোনো পছন্দ আছে?’

প্রশ্ন শুনে শুভ্রতার বুক টা ধ্বক করে উঠলো। কিছু টা সময় চুপ থেকে জবাব দিলো,

–‘না!’

সূর্য কে সেইম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না। বা বিন্দু পরিমান প্রয়োজন থাকলে ও সাহস করলো না। সূর্য নিজের উত্তর টা পেয়ে এবার ডিরেক্টলি বললো,

–‘এই বিয়ে তে কি আপনার মতামত আছে? জড়তা ছেড়ে উত্তর টা দিন। মোস্ট ইমফর্টেন্ট এই আনসার টা জানা। আপনার আর আমার জীবনের ব্যপার!’

শুভ্রতা কে এবার নার্ভাস দেখাচ্ছিলো। বিপরীত জন প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় ব্যস্ত।

–‘আমার বাবা মার পছন্দ ই আমার পছন্দ। উনারা যা করবেন আমার ভালোর জন্য ই করবেন এটা আমার বিশ্বাস। কারণ কোনো বাবা মা সন্তানের অমঙ্গল চায় না!’

শুভ্রতার উত্তর টা জম্পেশ ছিলো। যেহুতু তার কোনো পছন্দ ও নেই সেহুতু সূর্যের এই জবাব টা খুব মনে ধরলো।

.
উদয় উশখুশ করতে থাকলো কি হবে এখন? এদিকে মনে চেপে রাখা কথা প্রকাশ করতে পেরে পেট ফুলে ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তার উপর তার অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে শুভ্রতার বাবা মা বললেন,

–‘নাহ তো। ছোট বাচ্চা কি করে আসবে?’

উর্মি দাঁত কটমট করতে করতে বললো,

–‘ওহহো এই উদয় ভাইয়ের মাথা টা আজ গেছে!’

উদয় নিজেই নিজেকে লুকানোর জন্য বললো,

–‘নাহ..ওই আসলে…

উদয় তার পুরো কথা শেষ করতে নিবে এমন সময় সূর্য নিচে আসে। মুখে তার মুচকি হাসি। বুঝিয়ে দিচ্ছে ফলাফল পজেটিভ। শুভ্রতার ভাই শুভ পুলিশের চাকরি করে দু দিন পর ই ছুটি পাবেন। ঠিক হলো সে আসলেই বিয়ের কথা পাকা হবে। আজকের মতো হাসি মুখে বিদায় নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। সূর্যের পরিবার।

সূর্য চলে যেতেই যেনো হাঁপিয়ে ছেড়ে বাঁচল শুভ্রতা। হাঁপাতে থাকলো। আর একটু হলেই যেনো দম বন্ধ হয়ে যেতো। উদয় কে তিন বছর পর আজ আবার দেখে পুরোনো ক্ষত তরতাজা হয়ে উঠলো। চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো শুভ্রতা। চোখের কোণ ঘেসে বরফ খন্ড থেকে টুপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই দাঁত কড়মড় করে শান্ত চেহারা রুপ নিলো বাঘিনীর মতো। দাঁতে দাঁত চেপে বেলকনির শক্ত লৌহ দন্ড প্রচন্ড আক্রোশে চেপে ধরলো সে আর মনে মনে আওড়ালো,

–‘তোমার করা অপরাধের শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে! ‌ তিন বছরে আমি জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছি এবার তোমার পালা!’

আচমকা কাঁধে কেউ হাত রাখতেই চমকে উঠলো শুভ্রতা। চোখের পানি দ্রুত মুছে ফেলার চেষ্টা চালালেও সে ব্যর্থ হয়। পেছনে ফিরে দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে পানি তিনি ধরে ফেললেন। ধড়পড় করে উঠে তিনি বললেন,

–‘শুভা কাঁদছিস কেন তুই?’

শুভ্রতা কে আদর করে শুভ আর তার মা শুভা বলে ডাকে। একমাত্র তার বাবা ই পুরো নাম টা ডাকে। শুভ্রতা কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। গোপন করার চেষ্টা ও ব্যর্থ হয়ে গেলো সে। হকচকিয়ে উঠলো যেনো চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে।

–‘আপনাদের ছেড়ে যেতে হবে আমার খুব কষ্ট. মা!’

ডাহা একটা মিথ্যা কথা বলে দিতে হলো। শুভ্রতার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

–‘পাগলী মেয়ে এই জন্য কাঁদতে হয় নাকি রে? আর এখনো তোর বিয়ে ঠিক হয় নি! তাছাড়া মেয়ে হয়ে জন্মেছিস যখন বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হবে তাই না?’

শুভ্রতার ভয় হতে লাগলো বিয়ে টা যদি উদয় ভেঙ্গে দেয় তাহলে তার কি আর কিছু করার থাকবে? সে কি নিজের লক্ষ্য আদৌ পূরণ করতে পারবে? শেষে কি উদয় এবার ও পার পেয়ে যাবে? প্রশ্নের উত্তর গুলো অজানা। মা কে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শুভ্রতা।

উদয় বাসায় এসে কেমন একটা করতে থাকে। উর্মি এই ব্যাপার টা খেয়াল করলে এসে বলে,

–‘কি হয়েছে টা কি তোমার উদয় ভাই? সূর্যের ভাইয়ের সাথে এখানে গিয়েও ক কান্ড টাই না করলে আর এখন!’

–‘এখন কি?’

–‘অস্বাভাবিক লাগছে তোমাকে। প্লিজ বলবে যে কি আসলে হলো টা কি?’

–‘আমি একদম ঠিক আছি। ফিট এন্ড ফাইন!’

উর্মির কথাটা এড়িয়ে গেলো সে। রাতে সবাই খেতে বসলে উদয়ের পেটে যেনো খাবার যাচ্ছে ই না। মোটকথা গলা দিয়ে নামছে না। সকালের এতো শক টা এখনো তার হজম হয় নি যে। তাই সে বললো,

–‘ভাইয়ার বিয়ে কি ঐ মেয়ে টা কেই করাবে তোমরা?’

ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবার ই উদয়ের কথাটায় কেমন একটা খটকা লাগলো। উর্মির মা বললো,

–‘ঐ মেয়ে বলতে শুভ্রতা কে বলছিস?’

–‘হুম!’

–‘কয়দিন পর তোর ভাবী হয়ে যাচ্ছে আর তুই বলছিস ঐ মেয়ে? এটা কেমন সম্বোধন উদয়?’

–‘এখন তো হয় নি তাই না?’

–‘হয়নি হয়ে কতক্ষণ?’

উর্মি পাল্লা দিয়ে বললো,

–‘হ্যাঁ হ্যাঁ ভাবী বলতে শিখো। এতো বড় হয়েছো রেসপেক্ট করতে জানো না এখনো?’

উদয় উর্মির কথা কে পুরোপুরি এভোয়েড করে গেলো।

–‘মা বাবা বললে না তো কিছু?’

–‘হুম’

–‘কিহহ..!’

–‘এমন আচরণ করছিস যেনো কিছুই বুঝিস না। আমাদের সবার মনে হয়েছে শুভ্রতা ই একমাত্র সূর্যের উপযুক্ত। যেমন রুপ তেমন গুন। এমন লক্ষী একটা মেয়ে কেই আমার সূর্যের জন্য ‌মনে মনে চাইতাম! একবার যখন পেয়ে গেছি আর হাত ছাড়া করবো না! কি বলিস সূর্য?’

সূর্য কিছু বললো না। মিটমিট সবাই হাসলো। শুধু উদয় বাদে।

–‘আর আমার জন্য কেমন চাচ্ছো?’

কথাটা বুঝতে পেরে উর্মি ঝটপট বললো,

–‘তোমার জন্য দজ্জাল একটা চাচ্ছে। তোমার মতো সয়তান কে আপকামিং ভাবীর মতো এতো সহজ সরল মেয়ে দিয়ে হবে না। তোমাকে সোজা করতে কিরণমালা সিরিয়ালের কটকটির মতো বউ লাগবে বুঝেছো? হাহাহা!’

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

কপট রাগ হলো উর্মির কথায়। কিন্তু মূল সাবজেক্ট পাল্টে যাচ্ছে দেখে উদয় প্লেটে শাহাদাত আঙ্গুল টা চারদিকে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,

–‘শুভ্রতার মতো মেয়ে কে ভাইয়া বউ করে ঘরে নিয়ে এসে সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিও না। ও আসলে ভালো না!’

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here