–‘আমার ভাই এক বাচ্চার মা কে কি করে বিয়ে করতে পারে বাবা?’

মনে মনে ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলো উদয়। কারো ধাক্কায় তার হুস ফিরে। পাশ থেকে উর্মি কানে কানে ফিসফিস করে বললো,

–‘সূর্য ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছে তোমার জন্য নয়! যেভাবে হা করে আছো মনে হয় শুভ্রতা কে আপু কে দেখে ফিদা হয়ে গেছো। এনারা কেউ সেটা বুঝতে পারলে কিন্তু একেবারে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!’

উদয় উর্মির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। উদয় রা ভাই বোন বলতে ওরা ভাই দুজন ই। তার মধ্যে সূর্য বড়। আর আজ তার জন্য ই মেয়ে দেখতে এসেছে বাসার লোকজন। কিন্তু মেয়ের আসনে উদয় তার প্রেমিকা কে দেখে প্রচন্ড বেগে এক ধাক্কা খেলো যেনো। কারণ শুভ্রতাকে শুধু তার প্রেমিকা বলা চলে না বরং বলা যায় তার প্রাক্তন প্রেমিকা। যার সঙ্গে সে প্রেমের নাটক করেছিলো। এবং কি এই নাটক শুভ্রতা বুঝতে না পেরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলো উদয়ের মাঝে। প্রচন্ড বোকা এই মেয়ে টা। মনে পড়ে গেলো তিন বছর আগের কাহিনী…

শুভ্রতা প্রচন্ড ভয়ে ভীত হয়ে উদয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে কিসের যেনো সব কাগজ পত্র। মুখে মাত্রাতিরিক্ত ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। এই মুহূর্তে শুভ্রতা কে দেখে খুব বিরক্ত হলো উদয়। অবশ্য তার কাজ হাছিল হয়ে যাওয়ার পর থেকে কোনো মেয়ে কেই তার আর ভালো লাগে না। তার কাজ হলো মেয়েদের সাথে প্রেমের নাটক করে রাত কাটানো। ভীষণ কুৎসিত আর বাজে রকমের এই এক নেশা তার। সেদিন শুভ্রতা কেঁদেই দিয়েছিলো আর বলেছিলো,

–‘উদয় আমি প্রেগন্যান্ট!’

–‘হোয়াট? আর ইউ ম্যাড শুভ্রতা? কিসব আজেবাজে কথা বলছো তুমি!’

–‘আমি আজেবাজে বলছি না এই পেপারে দেখো স্পষ্ট লিখা আছে আমি মা হতে চলেছি। আর…

ছোঁ মেরে শুভ্রতার হাত থেকে কাগজ গুলো কেড়ে নিয়ে পড়ে দেখলো সত্যিই শুভ্রতা মা হতে চলেছে। এই চমক টার জন্য উদয় ব্যক্তিগত ভাবে কোনো রকম প্রস্তুত ছিলো না। তবে সে এখন বিরক্তের চরমে পৌঁছে গেলো।

–‘আর কি?’

–‘আর আমার পেটের সন্তানের বাবা হলেন তুমি!’

–‘হাউ ফানি? এই কাগজের কোথায় লেখা আছে এই সন্তানের বাবা আমি?’

চিরচেনা মানুষ টার মুখে এই কথা টা শুনে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে ভারী চমকে গেলো শুভ্রতা। এ যেনো সুর হঠাৎ ই বেতাল হয়ে যাচ্ছে বা তাল হারাচ্ছে। এক আকাশ বিষ্ময় চোখে লালন করে শুভ্রতা বলে,

–‘এই কথাটার মানে কি উদয়?’

–‘মানে টা খুব সোজা আমি মানি না যে তোমার কথা ঠিক। এটা কার না কার বাচ্চা আমি কেন দায়ী হবো!’

–‘মজা করছো আমার সাথে উদয়? দেখো প্লিজ এখন এসবের সময় নয় চলো আমরা বিয়ে করে নিই প্লিজ!’

–‘হাহা বিয়ে তাও তোমার মতো মেয়ে কে?’

উদয় এতো সেনসিটিভ আর সিরিয়াস একটা কথা কে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে দেখে শুভ্রতা চোয়াল শক্ত করে রেগে বললো,

–‘কি বলতে চাও তুমি?’

–‘যেই মেয়ে আমার এক কথায় আমার সাথে বিছানায় যেতে রাজি হয়ে যায় তাকে আমি কি করে বিশ্বাস করবো যে সে আর কখনো কোনো পুরুষের সাথে বিছানায় যায় নি!’

এই মস্ত বড় এক কঠিন কথা শুনে অশ্রুসিক্ত নয়নে শুভ্রতা চেঁচিয়ে উঠলো,

–‘উদয়য়য়..

–‘হুস চেচাবে না একদম!’

–‘তুমি যদি আমাকে আমার সন্তান কে মেনে মা নাও তো আমি তোমার পরিবারের কাছে যাবো। আমার সর্বনাশ করে এখন মজা নিচ্ছো তা তো হতে দিবো না আমি। কিছুতেই না!’

–‘আমি কিছু করিনি।’

–‘তুমি ই করেছো সব। আমার জীবনে প্রথম পুরুষ তুমি ছিলে এখনি সব তোমার মুখের এক কথায় মিথ্যা হয়ে যায় না। তুমি অস্বীকার করলেও আমি অস্বীকার করতে পারবো না! আমি এক্ষুনি তোমার বাবা মার কাছে যাচ্ছি!’

–‘ওয়েট ওয়েট এতো তাড়া কিসের। আ’ম ভেরি সরি বাবু। আসলে আমি মজা করছিলাম। আমি ই তোমার পেটের বাবুর বাবা। চলো আমরা বিয়ে করে নেই তাহলে সব সমাধান হয়ে যাবে তাই না। এর জন্য কাঁদতে হয়? ধুর পাগলী চলো তো।’

উদয়ের সম্পূর্ণ পরিবর্তন এই কথা গুলো শুনে শুভ্রতা বিপাকে পড়ে গেলো আসলে উদয়ের কোন রূপ টা এক্সেপ্ট করা তার উচিত। উদয় ১০ সেকেন্ড পর হো হো করে গগন কাঁপিয়ে হেসে বললো,

–‘তোমার কি মনে হয় আমি এসব বলবো? ভুল! তুমি যদি আমার পরিবার কে এসব জানাতে যাও তো ক্ষতি টা তোমার ই বেশি হবে বুঝলে! সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। তাছাড়া আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ও নেই তোমার কাছে সো বুঝতে পেরেছো তো হার টা কার হবে?’

শুভ্রতা যেনো নিজের কান কেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কাকে সে নিজের থেকে ও বেশি ভালোবাসলো বিশ্বাস করলো? সব উজাড় করে যাকে ভালোবাসলো সেই আজ তাকে কথা শুনালো। তার দিকে আঙ্গুল তুললো। অনেক কান্নাকাটি করেছিলো সেদিন শুভ্রতা। তার আহাজারি তে গগন কাঁদলেও উদয় কে একটু ও বিচলিত করতে পারে নি সেই চোখের পানি। বরং সেদিন উদয় বিচিত্র এক আনন্দ অনুভব করেছে। পৈশাচিক এক তৃপ্তির হাসি লেগে ছিলো তার ঠোঁটের কোণে। শেষমেশ শুভ্রতা ই নিজের হার মেনে নেয়। আর অঝোরে কান্না শেষে ক্লান্ত হয়ে বললো,

–‘তোমার অভিনয় টা খুব সুন্দর ছিলো উদয়। আমাকে এভাবে ঠকাবে বুঝতে পারিনি। তবে এটা তো সত্যি এই নিষ্পাপ শিশু টার কোনো দোষ ছিলো না। পাপ আমি একা করিনি। তুমি ও ছিলে অংশীদার। আমার পাপের শাস্তি তো আমি পাবো-ই এন্ড তোমাকে ও পেতে হবে তা আজ হোক বা কাল!’

শুভ্রতার এই কথা টাও হেসে উড়িয়ে দিলো উদয়। যাওয়ার আগে বললো,

–‘আরে যা তো এখান থেকে। আজাইরা প্যাচাল। প্যারা দিস না। যা ভাগ!’

.
উর্মি এবার জোড়েই বললো,

–‘কার ভাবনায় বার বার হারিয়ে যাচ্ছো তুমি উদয় ভাই? প্লিজ বলবে আমাকে?’

ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে উদয়। কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার সামনে সেই পুরোনো চেনা ব্যক্তি টা বসা।

অন্যদিকে শুভ্রতা নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার ফাঁকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে উদয় কে দেখেছিলো। উদয়ের তুলনায় সে একদমি চমকায় নি। বরং তাচ্ছিল্যের এক হাসি আর একটা চাপা কষ্ট বুকে হাতুড়ি পেটায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চোখের পানি গুলো যেনো এক্ষুনি সকল বাঁধা পেরিয়ে সামনে চলে আসবে এমন এক অবস্থা।

.
সূর্য ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুললো। শুভ্রতাকে লাল রঙের জামদানী শাড়ি টায় মারাত্মক সুন্দর লাগছে। তার নজর না লেগে যায় সেই ভয়ে থাকলো সে। ভেবে পায় না এই মেয়ে টা তাকে এতো আকর্ষণ ই বা করে কেন! টানা টানা হরিণীর মতো চোখের এক চাহনি ই যেনো যে কাউকে ঘায়েল করতে সক্ষম। যেমন করে সে ও প্রথম দিন প্রথম দর্শনে হয়েছিলো।

শুভ্রা কে দেখার জন্য সূর্যের বাবা মা চাচি উদয় আর চাচাতো বোন উর্মি এসেছে। মোটামুটি সবার ই খুব পছন্দ হলো শুভ্রতা কে। হবে নাই বা কেন গোলগাল চেহারার ফর্সা মেয়ে টা দেখতে ভারী সুন্দরী। তার উপর কথাবার্তা ও বেশ শান্ত। সহজ সরল শুভ্রতা কেই সূর্যের উপযুক্ত মনে হলো সবার। এক কথায় শুভ্রতা কে উনাদের মনে ধরেছে। তাই সূর্যের বাবা বললেন,

–‘সূর্য তোর কিছু বলার আছে?’

উদয় চট জলদি উঠে বললো,

–‘বাবা আমার বলার আছে!’

সবাই চমকে উঠলো শুধু শুভ্রতা ছাড়া। উদয়ের এই কথা টা কে ভালো ভাবে দেখলো না শুভ্রতার বাবা মা। হঠাৎ ই উদয়ের ফোন টা বেজে উঠে। উর্মি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বলে উঠলো,

–‘এখানে নেটওয়ার্ক নেই ঐ দিক টায় গিয়ে কথা বলো তুমি!’

–‘হুম আচ্ছা!’

উদয় চলে যেতে সূর্যের বাবা বললো,

–‘যা বলছিলাম। সূর্য বল!’

শুভ্রতার বাবা বললেন,

–‘উদয় বাবা কি যেনো বলবে বললো?’

–‘আরে ওর কথা ছাড়ুন। আমার ছোট ছেলের মাথায় কখন কি চলে বোঝা দায়। এই দেখুন না ফোন নিয়ে বিজি হয়ে গেলো। থাক বাদ দিন! মূল কথায় আসা যাক!’

–‘সূর্য তুমি চাইলে শুভ্রতার সঙ্গে আলাদা কথা বলে নিতে পারো!’

সূর্যের মা সহমত পোষণ করে বললেন,

–‘হ্যাঁ সূর্য যা! তোদের বিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে নেওয়া জরুরী!’

শুভ্রতার মা হেসে বলে,

–‘ঠিক বলেছেন শুভ্রতা সূর্য কে তোর রুমে নিয়ে যা!’

শুভ্রতা সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। সূর্য কে নিয়ে তার ঘরে যেতেই সেখানে আসে উদয়। শুভ্রতার বাবা বললো,

–‘তুমি কি যেনো বলতে চেয়েছিলে বাবা?’

–‘আ.ব আস. আসলে ঐ সূর্য ভাইয়ার সাথে কথা ছিলো আর কি!’

–‘ওহ আচ্ছা। আমরা ভাবলাম আরো কি না কি বলবে!’

উর্মি মাঝখান দিয়ে বলে,

–‘উদয় ভাই এমন ই! হাহা!’

সবার সঙ্গে জোড় পূর্বক হাসি উদয় ও। কিন্তু মনে বেগে চলছে এক উত্তাল পাতাল ঝড়। বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পথে। তার তো কিছু একটা কথা উচিত। নাহলে পরিশেষে তার খেয়ে ফেলে দেওয়া জিনিস কে ঘরে তুলতে হবে। যা উদয় ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারে না। তার উপর এই মেয়ে কে ঘরে তোলা মানে বিপদ। মহাবিপদ। যেই মেয়ে কে উদয় গাইয়া ক্ষেত বলে ছেড়েছে তাকে সূর্য বিয়ে করতে পারবে না। তাছাড়া শুভ্রতা তো প্রেগন্যান্ট ছিলো। তিন বছরে তো বাচ্চা টা বড় হওয়ার কথা! সেই বাচ্চা টা ই বা গেলো কোথায়?

উদয় এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলো কোথাও ছোট বাচ্চার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। তাই সে হঠাৎ ই বলে উঠে,

–‘আপনাদের এই বাসা তে কি কোনো ছোট বাবু নেই!’

আকস্মাৎ এই আশ্চর্য রকমের প্রশ্নে সবাই হতভম্ব। প্রশ্ন টা করেও বিপাকে পড়ে গেলো উদয়। ভুলে মুখ ফসকে কি বলতে কি বলে ফেলেছে নিজেও বুঝতে পারে নি।

অথচ এই উদয় জানে ও না তার সেদিনের নাকোচ করে, ভেঙ্গে দেওয়া সেই সম্পর্কের ফল নিষ্পাপ শিশু টাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর আগেই মেরে ফেলেছিলো শুভ্রতা…!

চলবে?

#আমরা_দুজন
#পর্ব_১
[ written_by_sumaiya_karim ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here