#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_44
প্রেমালাপে মত্ত দুই হৃদয়। সময় তিনটার কাছাকাছি । অথচ ফোনের দু প্রান্তের মানুষ দুটির চোখে ঘুম নেই। একটু পর পর ই হাসছে দুজনে। ঘড়ির কাঁটা ঢং ঢং করে উঠলো।
অর্থাৎ রাত তিনটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট। দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটে ঝিল। ফোন টা নামিয়ে দেখে 2 ঘন্টার ও বেশি সময় চলছে। ফিচেল হাসিতে মেতে উঠলো। কখনো ভাবা হয় নি এভাবে প্রেম হবে। তা ও আবার স্বামীর সাথে প্রেম।
_ এই শোনো !
_ হুমম বলো।
_ রাত তিনটা বেজে গেছে। এখনো ঘুম আসছে না কেন বলো তো?
_ আহহ তোমার যে স্বামীর সাথে সখ্যতার প্রয়োজন।
_ ধ্যাত।
_ সত্যি বলছি আমার একটা চুমু খেলেই ঘুম চলে আসবে।
_ থামো তো তুমি। এতো প্রেম ভালো না।
_ আসলেই এতো প্রেম ভালো না ?
_ উহহহু। ভালো তো , তবে
_ তবে কি ? ফোনালাপে মন ভরে না ?
_ ধ্যাত।
অভিনব হেসে উঠলো। যেই হাসির শব্দে ঝিলের অন্তর কাঁপে।
_ শোনো মেয়ে , একটু কষ্ট করে ছাঁদে আসো।
_ ছাঁদে আসবো ?
_ হুমম আসো।
_ কেন বলো তো ? আবার ছাঁদে চলে আসলে না তো?
ঝিলের রসিকতায় অভিনব দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
_ উহহহু। তোমার পাপা রা যে সিকিউরিটি দিয়ে রেখেছেন এতে করে একটা মাছি ওহ গলতে পারবে না।
_ তাহলে ছাঁদে কেন আসবো ?
_ আসোই না একবার।
ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালো। এই মধ্য রাতে ছাঁদে কেন যাবে ? অভিনবর খাম খেয়ালি পানায় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। কল হোল্ড করেই পা টিপে হাঁটা লাগালো। ভাগ্যিস ভাইদের ঘুম গভীর। না হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। ঝিল এক পা দু পা করে ছাঁদে চলে আসলো।
ছাঁদ টা ঘুট ঘুটে অন্ধকার। সুইচ চেপে আলো জ্বালিয়ে নিলো। ফিস ফিস করে বলল
_ এসেছি তো !
_ চোখ বন্ধ কর।
_ কেন ?
_ আরে করোই না।
ঝিল আশে পাশে এক বার তাকিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করলো। কানে থাকা ফোন এর মধ্য দিয়ে অভিনবর ঘনঘন শ্বাস শুনতে পাচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন সুখ সুখ অনুভূতি হলো।
অভিনবর বুকে মাথা রাখার জন্য মন টা ছটফট করছে। পাগলামি করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই ফোনের ওপাশ থেকে ধুম করে আওয়াজ হলো । ঝিল চমকে তাকালো, আকাশের দিকে তাকিয়ে হতবাক। ফানুসে ভরপুর পুরো আকাশ। যেদিকে তাকাচ্ছে শুধুই ফানুস। পুরো আকাশ যেন ফানুসের দখলে। ফোন টা কানে নিয়ে বলল
_ তুমি কোথায় বলো তো ?
_ তোমার বাসা থেকে পশ্চিমের যেই দিঘী আছে সেখানে।
_ সত্যি ?
_ হুমম। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম । তবে তোমাদের স্পেশাল পাহাড়াদার আমাকে কামড়াতে এসেছিলো।
অভিনবর কথাতে খিল খিল করে হেসে উঠে ঝিল। বাড়ি তে এতো সিকিউরিটি দেওয়া সত্যি হাস্যকর। ফোস করে দম ফেলে অভিনব। অনুনয়ের সুরে বলে
_ একটু কর্নারে আসো না ঝিল। তোমাকে দেখবো আমি।
ঝিল কর্নারে আসে। লাল আলো তে ঝিল কে দেখতে পায় অভিনব। প্রান যেন ফিরে এলো। একটু করে হাসে ছেলেটা। অভিনব ঝিল কে দেখতে পেলে ওহ ঝিল দেখতে পায় না।
প্রচুর মন খারাপ হয়। পরক্ষনেই হাসি মুখে বলে
_ এই তুমি দাঁড়াও আমি আসছি ।
অভিনব কে কিছু বলার সুযোগ দেয় না তাঁর আগেই ছুট লাগায়। বাসা থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়। হঠাৎ কানে ভেসে আসে খটখট আওয়াজ। ঝিলের অন্তকর্নে পানি শূন্য অনুভব হয়। এই প্রথম পাপা আর ভাই দের ভয় হচ্ছে। ঝিল একটু ঝুঁকে তাকায়। রেস্ট হাউজে রোহন কে দেখতে পায়। রোহন ঘুরে তাকাতেই কেউ একজন তাকে ঘুরিয়ে নেয়।
_ ঝিল এখানে কি করিস তুই ?
_ মৌন তুই কখন ঘুম থেকে উঠলি ?
_ অনেক আগেই, তোকে রুমে না পেয়ে ছাঁদে যাই। আর ছাঁদ থেকেই দেখলাম নিচে আসতে।
_ আসলে কী হয়েছে বল তো , সুন্দরবন ঘুরতে ঘুরতে ঘরে মন টিকে না আর। শুধু প্রকৃতির সখ্যতা জাগে ।
_ হুমম বুঝলাম।তাহহ সুন্দরবনেই মন হারালি না তো ?
_ উফফ মৌন
মৌনতা ফিক করে হেসে উঠে। ঝিলের এক বাহু তে টান দিতেই পেছন থেকে রোহন এর কন্ঠ
_ কে ?
_ ভাইয়া আমি আর মৌন।
_ এখানে এতো রাতে ?
_ এমনি এসেছিলাম হাওয়া বিলাস করতে। তুমি গেস্ট হাউজে কেন ?
_ একটু দরকার ছিলো। ফাইল টাইল রেডি করতে হচ্ছে। খটখট আওয়াজ হবে তাই গেস্ট হাউজে চলে এসেছি।
মৌনতা একপলক তাকালো। পরক্ষনেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। হাঁফ ফাঁস করতে করতে বলল
_ সাড়ে তিনটা বাজে ঝিল, চল এবার ঘুমোতে যাই।
ঝিল সম্মতি জানায়। মুখ টা একদম চুপসে গেছে। ফোঁস করে দম ফেলে। ফোন টা ভায়ব্রেট হচ্ছে। ফোন রিসিপ করার কোনো স্কোপ নেই। একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিলো।
ইসসস অভিনব কে দেখার জন্য মন টা কেমন আকুপাকু করছে। কাল ই দেখা করতে হবে। না হলে হার্ট ব্লক হয়ে মারা যাবে মেয়েটা।
*
” পাপা আমি বের হবোই। আগে তো কখনো বারন করো নি এখন কেন বারন করছো ? ”
_ সেটাই তো মামনি আগে তো কখনো বারন করি নি। এখন বারন করছি মানে কিছু কারন আছে ।
_ আমি কোনো কারন শুনতে চাই না। আর্জেন্ট বের হতে হবে আমায়।
_ মামনি ।
হাতের কাছে থাকা গ্লাস টা ফেলে দেয় ঝিল। গটগট করে রুমে চলে যায়। কষ্ট গুলো কেমন কান্না হয়ে বের হচ্ছে। অভিনবর দেখা না পেলে নির্ঘাত কিছু একটা হয়ে যাবে। মৌনতা মাত্র ফ্রেস হয়ে আসলো। ঝিল কে সাজ গোঁজ করে বসে থাকতে দেখে বলল
_ এই ঝিল এই ভোর সকালে কোথায় বের হচ্ছিস ?
_ বের হতে দিলো না । ভালো লাগে না এই পরিবারে থাকতে। সারাক্ষণ মাথায় ভয় নিয়ে চলতে হবে।
এভাবে মানুষ বাঁচে বল তো ?
_ থাক না। আঙ্কেল রা যখন বারন করছেন নিশ্চয়ই কোনো
_ প্লিজ মৌন তুই জানিস না কতোটা জরুরি বের হওয়া।
কথা টুকু বলেই ঝরঝরে কেঁদে উঠে ঝিল
হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে মৌনতা। সাধারন একটা বিষয়ে এভাবে কাঁদে কেউ ?
ঝিলের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে মেয়েটা। ঝিলের বের হওয়ার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
তবু ও বলে
_ তুই ঠিক কি কারনে বের হতে চাস বল তো ঝিল ?
এড়িয়ে যেতে গিয়ে ও পারে না। বেহায়া মন দমিয়ে রাখা ভালোবাসা টুকু প্রকাশ করতে চায়। এক পর্যায়ে সমস্ত কিছু বলে দেয় মেয়েটা। জ্ঞান হারানোর উপক্রম মৌনতার। এতো কিছু হয়ে গেল।
_ ভাইয়ার সাথে দেখা করবো আমি।
_ হচ্ছে না তো। পাপা তো যেতেই দিচ্ছে না।
_ আচ্ছা চল আমি বলে দেখি।
চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় ঝিল । সর্বকালের লেট মৌনতা আজ পাঁচ মিনিটেই তৈরি হয়ে যায়। মৌনতার উন্নতি তে ফিচেল হাসে মেয়েটা।
জাফরের পাশে বসে তোষামোদে করছে মৌনতা। মেয়েটার এমন আচারনে লজ্জিত জাফর। মৌনতার মাথায় হাত রেখে বলল
_ জানোই তো আমাদের শত্রুর অভাব নেই। এখন বের হলে যদি কিছু হয়ে যায় ?
_ আঙ্কেল কিছু হবে না। আচ্ছা আপনি ই বলুন মেয়েটা এই ভয়ের কারনে সারা জীবন ঘর বন্দি থাকবে ?
_ সেটা নয় মা কিন্তু
_ চলে আয় মৌন। এখানে বসে নিজের এনার্জি লস করে কোনো লাভ নেই। আমি যে শক্তিহীন মেয়ে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হচ্ছে। এতো দিনের বলা সব কথাই মিথ্যে।
ঝিলের কথাতে অবাক হলেন জাফর। মেয়েটার এমন অভিমানে বুক ভারী হয়। রোহন কে ডাইনিং এ যেতে দেখে বলল
_ রোহন শোন তো।
_ হুম ছোট আব্বু।
_ ঝিল বের হতে চাচ্ছে যেতে দিবো ?
_ হুমম দাও। প্রকৃতির সাথে ঘুরে ফিরে এসেছে এখন ঘরে মন টিকবে না।
খুশি হয়ে যায় ঝিল। ফোঁস করে দম ফেলে জাফর। দুই বান্ধবী বেরিয়ে যায়। রোহনের মনে খটকা বাজে। ঝিল কি কিছু লুকাচ্ছে ?
ফোন বেজে উঠে রোহনের। বিরক্তিতে মন তেতে উঠে। কল রিসিপ করেই বলে
_ আমাকে কল করার কথা ভাববি ওহ না তুই। যে আগুন তুই লাগিয়েছিস তাঁর জন্য তোকে প্রস্তাতে হবে। আমার বোনের নখের যোগ্য ও না তুই।
_ রোহন আমার কথা টা শোনো।
কোনো কথাই শুনে না রোহন। শরীর কাঁপছে তাঁর। সুমা নামক মেয়ে টি কে ভালোবেসেছে ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে। গাজীপুরে খবর টা সুমাই রটিয়েছে। কাল রাতে সমস্ত ডিটেলস পেয়েছে সে।
এই মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে ও কিছু তথ্য পেয়েছে। অত্যন্ত নিকৃষ্ট এই মেয়ে। দ্রুত ফোন পকেটে পুরে নেয়।
বের হতে হবে। ঝিলের উপর নজর রাখতেই হবে।
মেয়েটার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। প্রয়োজনে জান দিবে তবু ও বোনের ক্ষতি হতে দিবে না।
*
রঙিন ছাতা দ্বারা সজ্জিত এক রেসট্রন। খানিক টা বিদেশী ধাঁচের। মূলত বাঙিলী রেসট্রনের মতো আপ্যায়ন হলে ও খাবার গুলো বিদেশী। উত্তরা মডেল টাউনে এসেছে ঝিল অভিনব আর মৌনতা। কোনো দিকে না তাকিয়ে অভিনবর কাছে ছুটে গিয়েছে মেয়েটা।
মৌনতার সামনে এমন আচারনে অভিনব ভারী লজ্জা পেয়েছে।
এক গাদা খাবার অর্ডার করে নিলো মৌনতা। মেকি হাসি দিয়ে বলল
_ আমি বাবা কাবাবের হাড্ডি হতে চাই না। তোরা কথা বল আমি খাবার খেতে থাকি।
ঝিল মুচকি হাসে। অভিনব ও ঝিল একে অপরের চোখের দিকে তাকায়। তৃষ্ণাময় দুটো চোখ যেন ঝলমল করছে। দুটো দিন কতো টা কষ্টে কেটেছে। হাজারো ভালোবাসার মাঝে ও খামতি ছিল। যে শূন্যতা দুজনের বুকে রক্তক্ষরণ করেছে।
_ কেমন আছো ঝিল ?
_ যেমন দেখছো ।
_ কেঁদে ছিলে ?
কেঁপে উঠে ঝিল। অভিনব কি করে বুঝলো বিষয় টা। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়ায়।
অভিনব তাঁর শক্ত হাতে মেয়েটার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ।
পরপর কয়েক বার চুমু খায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে
_ আজ ই আমি তোমার আর আমার কথা বাসায় জানাবো। সব কিছু যেহেতু ঠিক হয়ে গেছে তাই তোমাকে আর দূরে রাখতে চাই না।
_ সবাই মেনে নিবে তো অভিনব?
_ কেন নিবে না ? আমার স্ত্রী তুমি গার্লফ্রেন্ড নও যে যা বলবেই তাই হবে।
_ আমি সবাই কে নিয়ে ভালো থাকতে চাই অভিনব । একটা সুস্থ পরিবার চাই। আমি ক্লান্ত এই পৃথিবীতে।
_ চিন্তা করো না ঝিল। কথা দিলাম সবাই কে নিয়েই আমরা সংসার গড়বো।
মৃদু হাসে ঝিল। অভিনবর হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ওপাশ থেকে মৌনতা বলে
_ ভাইয়া প্রেম করার জন্য আলাদা স্পেস লাগবে নাকি?
_ না শালিকা আপনি বলেছেন এতে ই আমি খুশি। আমার জন্য এতো ভেবেছেন তাই আপনার হানিমুনের পুরো খরচ আমার।
অভিনবর কথায় মৌনতার দম বন্ধ করা হাসি। ঝিল চোখ রাঙিয়ে বলে
_ অসভ্য হয়ে যাচ্ছো তুমি।
_ অসভ্য তো হতেই হবে বউ।
_ আজব।
_ উহহুহ আজব না। আমাদের হানিমুন টা কোথায় হবে বলো তো ?
_ কোথায় ?
_ সাইবেরিয়া যাবো ভাবছি।
_ পাগল তুমি ? সাধারন তাপমাত্রায় আমি জমে যাই আর যাবো সাইবেরিয়া।
তুমি জানো সেখানের তাপমাত্রা কতো হয় ?
_কতো আর মাত্র – 50৹+
_এটা কে, মাত্র বলছো তুমি ?
_ তো।
_ তো মানে আমি যাবো না।
_ কামন ঝিল । তুমি না ট্রাভেলার্স, একজন প্রকৃতি প্রেমি হয়ে এতো ভয় পাও। ছিইই
_ রিতি মতো আমাকে অপমান করছো তুমি।
_ প্লিজ ঝিল।
মুখ গোমড়া করে নেয় ঝিল। পরক্ষণেই এক চিলতে হাসে মেয়েটা। চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে বলে সে যাবে।
হঠাৎ করেই পেছন থেকে এক গুমোট কন্ঠ ভেসে আসে।
চলবে