#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_27
ঝিলের শ্বাস বেড়ে গেছে সহস্র গুন। হসপিটালের মুমূর্ষু রোগীরা যেমন শ্বাস টানে ঠিক তেমনি ভাবে শ্বাস টানতে লাগলো। যেন এখনি শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে। ঝিলের অবস্থা বুঝে অভিনব আলতো হাতে ঝিলের বাহু তে স্পর্শ করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। অভিনব ঝিলের কম্পন স্পষ্ট অনুভব করছে।
সে বুঝতে পারলো ঝিলের অস্বস্তি আর ভয়ের কারন । তাই অধর কোনে হাসি ফুটিয়ে প্রস্থান করলো। অভিনব চলে যাওয়ার সাথে সাথে ঝিল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। অভিনব একি প্রশ্ন করলো তাকে ?
এর উত্তর কি হবে ? হ্যাঁ নাকি না ? ঝিল শুকনো ঢোক গিলে নিলো। এ কেমন যন্ত্রণা হলো। যাহ থেকে মুক্তির ফর্মুলা ই নেই। ঝিলের খুব করে মনে হলো এ বিষাদ ময় যন্ত্রণা তাকে পাগল করে দিবে।
না অভিনব কে ঠিক ভাবে গ্রহন করতে পারছে । আর না তার পাশে কাউ কে সহ্য করতে পারছে।
এর কি নাম দেওয়া যায় ভালোবাসা ?
ঝিলের তো কলেজে বেশ কিছু ক্রাশ ছিলো। যাদের দেখলেই মনে হতো অনেক কিউট। যাই একটু গাল টা টিপে দিয়ে আসি। কিন্তু অভিনবর ক্ষেত্রে তো ক্রাশ বলা যায় না। তাহলে এই বিচিত্র অনুভূতির নাম ই কি ভালোবাসা ?
ঝিল মাথা টা চেপে ধরলো। না আর নেওয়া যাচ্ছে না। প্রেমে পরার থেকে প্রেমে পরেছে কি না সেটা বোঝা সত্যি ই কষ্টকর।
এই শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি আর টলারেট করা যাবে না। নাহলে আজ ই তাকে পটল তুলতে হবে।
যা কিছুতেই চাইছে না ওহ। এখন রিলাক্স নেওয়ার প্রয়োজন।
ঝিল আপন মনেই হাঁটতে লাগলো। অদূরে পাপড়ি কে দেখা যাচ্ছে।
এই মেয়েটা বড় বোনের মতো কেয়ার করে ওকে।
যেমন ভালো তেমনি সুন্দর। এই ট্যুরে এক মাত্র এর সাথেই ঝিল কমফার্টেবল। আর অভিনব তো ভিন গ্রহের অনুভূতি ।
ঝিল সেই দিকেই পা বাড়ালো।
অভিনব কিছুক্ষন ভাবলো। ঝিল কে কি আরেক টু সময় দেওয়া দরকার। মেয়েটার চোখে মুখে ভালোবাসা থাকলে ও মনের কোনে জমানো ভালোবাসা টা অস্পষ্ট। তাই অভিনব ঠিক করে নিলো ঝিল কে এই বিষয়ে আর কিছু বলবে না।
গাছের গুরি থেকে উঠে দাঁড়ালো। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো ঝিল পাপড়ির সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। সময় প্রায় চারটার কাছাকাছি। অভিনব মাহের এর দিকে এগিয়ে গেল। মাহের এজেন্সির কারো সাথে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলছে।
চোখে মুখে সামান্য অসহায় ভাব। অভিনবর ভ্রু কুঁচকে গেল। কোনো সমস্যা হলো না তো। তাই সেটা দেখতে মাহের এর দিকেই পা বাড়ালো।
_ কোনো সমস্যা মাহের ?
_ না সমস্যা নেই ব্রো। বাট জামতলা সি বিচ এর বিভিন্ন জায়গায় নাকি চোরা বালি আছে। তাছাড়া ওনারা বলছেন এখানে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া না নামাই ভালো।
_ হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। পর্যাপ্ত জ্যাকেট তো আছে তাই না ?
_ হুমমম। আমি আসলে একটা ফুটবল চাচ্ছিলাম। পানি তে খেলা যেত। বহু দিন হলো পানি তে ফুটবল খেলা হয় না।
অভিনব এক চিলতে হেসে বলল
_ আমার কাছে কিন্তু ফুটবল আছে।
মাহের চকচকে চোখে তাকিয়ে হাত দিয়ে শিষ বাজালো। হাসি মুখে চিৎকার করে বলল
_ অমিত , শাকীল ফুটবলের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আয় , সময় কম।
মাহেরের ডাকে ছুটে আসলো দুজনে। অভিনব ব্যাগ থেকে মুরানো ফুটবল টা বের করে নিলো। পাম্প দিয়ে ফুটবল টাকে টুসটুসে করে নিলো।
তারপর ই সবাই পানির দিকে ভৌ দৌড়। ফুটবল নিয়ে পানি তে নেমে গেল। অভিনব সাঁতারে মোটামুটি ভালো। তবু ও বেশি জোড় দেখাচ্ছে না। কারন খেলা সমানে সমানেই মজা।
সবাই ধীরে ধীরে পানিতে নেমে যাচ্ছে। ঝিল ও নামতে চাচ্ছে কিন্ত ভয় হচ্ছে। সবাই তো যে যার পার্টনার এর সাথে নেমে যাচ্ছে । ওহহ এখন কি করবে ?
মন খারাপ করে গাছের গুরি তেই বসে রইলো। অভিনব টা ও ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত। ঝিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অভিনবর গায়ের কালো শার্ট টা পানিতে ভিজে চুপচুপ। গাঁয়ে একদম ই লেপ্টে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা শরীর টা বেশ আকর্ষিত লাগছে। এতো দিন পর ঝিল লক্ষ্য করলো ছেলে টা রোজ জিম করে। কারন তাঁর ফল ফুটে উঠেছে অভিনবর বডিতে।
ঝিল ফাঁকা ঢোক গিললো। এর এক হাতের সামনে ঝিল নেহাত ই বাচ্চা। এমন কেন হলো ?
ঝিল কি আরেকটু শক্তিশালী হতে পারতো না। এতে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত। সত্যি কি চন্দ্র সূর্য মিলে যেত ?
যদি নাই ই হয় তাহলে ওহ কেন অভিনবর সামনে পিচ্ছি একটা বাচ্চা । ওর তো শক্তিশালী হওয়ার খুব প্রয়োজন।
অমিনব দু বার ঝিল কে ডেকেছে। কিন্তু ঝিল গভীর ভাবনাতে মত্ত। এই দিকে সময় ও কম অভিনব ভেজা হাতেই ঝিলের বাহু তে স্পর্শ করলো। হালকা শীতে কনকনে শীতল পানি সাথে অভিনবর স্পর্শ মিলে যেন কারেন্ট সৃষ্টি করে ফেলেছে। ঝিল ছিটকে দূরে চলে গেল। আমতা আমতা করতে লাগলো।
অভিনব ছোট করে শ্বাস নিয়ে বলল
_ আসুন। এভাবে বসে আছেন যে পানিতে নামার ইচ্ছে নেই ? ধ্যান কোথায় থাকে ? এতো ডাকার পর ও কোনো রেসপন্স পাই না।
ঝিল কয়েক সেকেন্ড ভেবে লম্বা শ্বাস নিলো। অভিনব ভাবুক দৃষ্টিতে তাকাতেই ঝিল মেকি হাসি দিয়ে বলল
_ আসলে আপনি তো আমার আগেই নেমে গিয়েছেন।
আমি তো সাঁতার জানি না। তাই লাইফ জ্যাকেট সহ ও ভয় হচ্ছে খুব ।
_ আপনার কি পানি তে ফোবিয়া আছে ?
_উহহু
_ তাহলে সমস্যা কোথায়? আচ্ছা আসুন। আমি আছি তো ?
ঝিল মাথা ঝাঁকালো । অভিনব একটু আগে হাঁটতে লাগলো। কোমর অব্দি পানিতে নেমে বলল
_ আসুন। এখনো পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? সবাই কতো মজা করছে।
_ অভিনব আমার খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে পানিতে নামলেই আমি পরে যাবো। আর সাথে সাথে তলিয়ে যাবো । এই বয়সে জীবন ত্যাগ করা কি ঠিক হবে?
_আরে কিছু হবে না আসুন। একটু পানিতে ই তো নামবেন ।
_ না নাহ আমি এখানেই ভালো আছি। আপনি থাকুন আমি যাই।
_ ঝিল আমার কথা শুনুন। আরে ঝিল
অভিনবর কথায় পাত্তা না দিয়েই ঝিল আরেকটু উপরে উঠে গেল। পচন্ড ভয় হচ্ছে। যদি ও পানি গুলো দেখতে বেশ লোভনীয় তবে প্রানের থেকে বেশি নয়।
অভিনব দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। এই মেয়েটা খুব বেশি করছে । এভাবে একদম ই মজা করতে পারবে না। শেষে তাকেই দোষ দিবে।
অভিনব সাত পাঁচ না ভেবেই উঠে আসলো । এবার ঝিল কে টেনে নামিয়ে নিলো। ঝিল তো নামবেই না। প্রচন্ড ভয়ে বেচারির গলা শুকিয়ে কাঠ । শুষ্ক গলা তেই বার বার ফ্যাচ ফ্যাচ করে বলছে
_ আমি নামবো না । প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।
_ উহহু নামতে হবেই। আমি একা একা নামছি না। সবাই যে যার বউ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি কিনা দেবদাশ হয়ে বসে থাকবো ।
তা ও আমার বিয়ে করা বউ পাশে থাকতে।
শেষের কথা টা অভিনব চোখ টিপেই বললো। কথা টা ঝিলের কানে কর্নপাত হতেই ঝিল দমে গেল। অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। বউ কথা টা কারো মনের কোনো এমন সুখ এনে দিতে পারে তা জানা ছিলো না। কি অদ্ভুত এ দুনিয়া। আজ যেটা বিরক্তির কারন হয়ে আছে সেটা হয়তো কাল সব থেকে বেশি সুখ এনে দিবে।
ঝিল অদ্ভুত ভাবে অভিনবর দিকে তাকিয়ে আছে । অভিনবর দৃষ্টি সামনের দিকে। অভিনব যদি একবার পেছন ঘুরে তাকাতো তাহলে নির্ঘাত প্রান হারাতো ঝিল। উরু সমান পানিতে নামতেই ঝিলের ধ্যান ফিরলো। ভয়ে ফুটো বেলুন হয়ে অভিনবর সাথে লেপ্টে গেল। অভিনবর ভেজা শার্ট টাই খামছে ধরলো । যেন ছেড়ে দিলেই ওহ পরে যাবে।
অভিনব মৃদু হাসলো । দু হাত পেছনে নিয়ে ঝিলের হাত টা নামিয়ে দিলো । ঝিল অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। অভিনব তার রাঙা ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি এনে ঝিলের দু বাহু চেপে ধরলো। ঝিল শিউরে উঠলো। অভিনব এক হাতে ঝিল কে জড়িয়ে ধরে খানিকটা উঁচু করলো। বুক সমান পানিতে এসে ঝিল কে ছেড়ে দিলো। ঝিলের নাক অব্দি পানি চলে এসেছে। ঝিল জাপটে ধরলো অভিনব কে। অভিনব একটু হাসলো। লাইফ জ্যাকেট থাকার পর ও ঝিল ভয় পাচ্ছে । অভিনব ধীর হাতে ঝিলের লাইফ জ্যাকেট খুলে ফেললো। ঝিল চমকে তাকালো। অভিনবর চোখে মুখে খুশির ঝলকানি। ঝিল বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
_ ভরসা করতে পারবেন আমায় ?
ঝিল চমকে তাকালো। অভিনব উত্তর পাওয়ার আসায় রয়েছে। ঝিল আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে মাথা ঝাঁকালো । অভিনবর ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো । সে সাঁতারে দু বার চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। তাছাড়া পানির সাথে বেশ ভালো সখ্যতা তার। কত বড় বড় সাগরে ও সাঁতার কেটেছে। যদি ও সাথে সেফটির নানা জিনিস পত্র রেখেছে । তবু ও নিজের প্রতি এইটুকু নি ভরসা আছে।
অভিনব মুচকি হেসে ঝিল কে নিজের পায়ে নামিয়ে দিলো। ঝিল অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো
_ আপনার কষ্ট হবে না ?
অভিনব মৃদু হাসলো। এক হাতে ঝিলের নাক টিপে দিয়ে বলল
_ আপনি বোধহয় জানেন না পানি তে সব কিছুর ভর কমে যায়।
সেই হিসেবে একটু ও কষ্ট হচ্ছে না। তাছাড়া আপনার সামন্য ওজন বহন করার ক্ষমতা অভিনব রাখে মিসেস।
ঝিল লজ্জা পেল। আজকাল অভিনব তাকে বেশ লজ্জা দিচ্ছে। মিসেস বলার কারন টা সঠিক বুঝে উঠতে না পারলে ও অভিনব তার প্রতি যে দুর্বল তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে । ঝিলের খুব লজ্জা হচ্ছে।
ঝিলের লজ্জা মাখা মুখ টা অভিনব কে অবাধ্য করে দিচ্ছে। নিজের কিশোর বয়স টা অনুভব করছে। যদি ও ঝিল তার স্ত্রী তবু ও তাঁদের সম্পর্ক যে স্বাভাবিক নয়।
তাই অভিনব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না নিজেকে দমিয়ে রাখতে। অভিনবর এক হাত ঝিল কে জড়িয়ে আছে। অন্য হাতে ঝিলের কপালে পরা চুল গুলো কে গুছিয়ে দিতে লাগলো।
অভিনবর হাতের স্পর্শ কপালে লাগতেই ঝিল চোখ বন্ধ করে নিলো।
অভিনব একটু ঝুঁকে ঝিলের কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে নিলো। ঝিল চমকালো, সাথে খামচে ধরলো অভিনবর শার্ট। অভিনবর নিশ্বাস গুলো ঝিলের মুখে এসে লাগছে । আর ঝিলের উষ্ণ নিশ্বাস আঁচড়ে পরছে অভিনবর গলায় । তাতেই অভিনব শিউরে উঠলো। এ কেমন প্রেম ময় অনুভূতি । এই সামান্য স্পর্শ গুলো কেন অসামান্য লাগছে। ঝিল হঠাৎ করেই অভিনব কে জরিয়ে ধরলো । চোখ বন্ধ করেই অভিনবর বুকে মাথা রাখলো। তার চোখের পাপড়ি গুলো কাঁপছে । অভিনব বুঝতে পারলো মেয়েটা তাঁর সাথে একদম ই লেপ্টে আছে। হয়তো নিজের ধ্যানে ই নেই।
অভিনব ঝিল কে ছাড়াতে চেয়ে ও ছাড়ালো না। শুধু ঝুঁকে মুখ টা ঝিলের কানের কাছে নিয়ে আসলো। ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া ঝিলের কানে পরতেই ঝিল যেন হারিয়ে গেল। নিজে কে পাগল মনে হচ্ছে। অদ্ভুত শিরশিরানি তে ছেয়ে গেছে শরীর। ভালো লাগার সাথে লজ্জার মিশ্র অনুভূতি নেশাক্ত করে তুলেছে।
অভিনব হঠাৎ করে ঝিলের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। ঝিল চোখ মেলে তাকালো। অভিনব চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। ঝিল নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না তবে একটু উঁচু কন্ঠে বলল
_ অভিনব।
অভিনবর কানে সে ডাক পৌছালো নাকি সন্দেহ তবে ঝিল কে আরেকটু চেপে ধরলো। গালের সাথে গাল মিলিয়ে ফিস ফিস করে বলল
_ কখনো কেউ এভাবে পানিতে নেমে ভালোবাসার কথা বলেছে কি না জানি না। তবে আমার খুব ইচ্ছে করছে বলতে। খুব ইচ্ছে করছে দু একটা চুম খেয়ে নিতে।
আমি জানি না কখন তোমার প্রতি ঝুঁকে গিয়েছি। তবে জানি তুমি ছাড়া আমরা ভাবনা গুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছে। ভাবনার এক অংশ জুড়ে শুধুই তুমি।
আমি তোমাকে ভালোবাসি ঝিল।
চলবে