#তাহার_আগমন

পর্ব:০২

বাড়ির অবস্থা দেখে অনুমান করা যায় বেশ পুরানো আমলের বাড়ি।দেয়াল থেকে চুন খসে পড়ার কারনে দূর থেকে ভাঙা মনে হলেও এখনও বেশ মজবুত বাড়িখানা।রঙের আস্তরণ এখনও কিছু জায়গায় বেশ তাজা।মনে হবে,এইতো কিছুদিন আগেই করা হয়েছে।চারদিকে নতুন দালান তৈরির হিরিকের মাঝে এই বাড়ি এখনও বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অকল্পনীয়।বাড়ির চারপাশটায় হিজল গাছ দিয়ে ঘেরা।দু’একটা ফলের গাছও উঁকি দিচ্ছে।এমন শান্ত-নিরিবিলি বাড়ি এখন তেমন একটা দেখা যায় না বললে চলে।শহর থেকে বেশ ভেতরে হওয়ার কারণে মানুষজনও খুব একটা নেই আশপাশে।বেশ কয়েকবার মেরামতে এখনও ব্রিটিশ আমলের বাড়িখানা কেমন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।বাড়ির অবস্থা দেখে আবিদের মনটা ভালো হয়ে গেল।ঘুরেঘুরে হেঁটে দেখছে সে।মনছুর বলল,বেশ সুন্দর না পরিবেশ?

আবিদ মাথা নেড়ে বলল,হুম সত্যিই খুব সুন্দর।এই বাড়ি যে এখনও কারো নজরে পড়েনি সেটা ভাগ্যের ব্যাপার।নাহলে জায়গায়টা অনেক আগেই নষ্ট করে ফেলতো।

-আমি এর আগেও একবার এসেছি।তবে খুব ছোটবেলায়।তখন যে পরিবার থাকতো সম্পর্কে আমার মামার আত্মীয় ছিল।পরে উনারা শহরে বাড়ি করার পর চলে যান।এখন যে ভদ্রলোক থাকে আমরা তার কাছেই এসেছি।

আবিদ আর দাঁড়িয়ে না থেকে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো।দুটো টোঁকা দিল দরজায়।বেশ কিছুক্ষণ পর কারো পায়ের আওয়াজ শোনা গেল।দরজা খুলল একটি মেয়ে।মাঝারি গড়নের রোগা শরীর।মেয়েটির চুল বেণী করা।আবিদ আর মনছুরকে দেখে মেয়েটি মনে হচ্ছে ঘাবড়ে গেছে।হয়তো এই বাড়িতে মানুষজন খুব একটা আসেনা।বেশ আস্তে বলল,আপনারা কারে চান?

মনছুর বলল,এটা সানাউল মির্জা সাহেবের বাড়ি তো?আমরা উনার কাছেই এসেছি।

ভেতর থেকে বেশ ভারি গলা শোনা গেল,কে এসেছে রে তরী?কে কথা বলে?

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলল,খালুজান,দুইজন ভাইয়া আসছে আপনার সাথে দেখা করতে।

লোকটি কি বলল,শুনতে পেল না আবিদ আর মনছুর।জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তরী মেয়েটির দিকে তাকাতেই দুজনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে তরী বলল,ভেতরে আসেন।খালুজান রাজি হইছে।

বাড়ির বাইরের অবস্থা দেখে পুরানো মনে হলেও ভেতরটা রাজপ্রাসাদের মত।কেউ বলবে না,এই বাড়িটার বাইরের অবস্থা বেশ নাজুক।আবিদ আর মনছুর দুজনে সোফায় বসে পড়লো।।মনছুর হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,রেহানা ভাবির কি অবস্থা?বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা,আমি কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি।চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল,এই বুঝি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আবিদ মুচকি হেসে বলল,ঠিক আছে আপনার ইচ্ছাই পূরণ করে দিবো।রেহানাকে আপনার কথা আজই বলতে হবে।

আবিদের কথা শুনে কিছুটা দমে গেল মনছুর।একটু দূরে সরে বলল,আমাকে না মারলে আপনার শান্তি হচ্ছে না তাই না?আপনি না আসলেই,কথা শেষ করার আগেই গলা খাঁকারি দিয়ে রুমে একজন লোক প্রবেশ করলো।

আবিদ আর মনছুর উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো লোকটিকে।ভদ্রলোকের হাতে বই।সম্ভবত বই পড়ছিলেন তিনি।বইটা টেবিলে রেখে বলল,আপনাদের ঠিক চিনতে পারলাম না।

আবিদ বলল,আমরা সানাউল মির্জা সাহেবের খোঁজে এসেছি।

ভদ্রলোক বললেন,আমিই সানাউল মির্জা।

আবিদ এবার সানাউল মির্জার দিকে ভালো করে তাকালো।চুলে এখনও পাক ধরেনি।চেহারাতে একটা কর্মট কর্মট ভাব আছে।চোখদুটো খুব স্থিরভাবে তাকায়,যে চোখের ভাষায় বুঝার উপায় নেই ভদ্রলোকের মনের ভেতর কি চলছে।বয়স কত আন্দাজ করা মুশকিল।তবে চল্লিশের কাছাকাছি অনুমান করলো আবিদ।বলল,আমরা খুব বিপদে পড়ে এসেছি।শুনেছি,আপনি রহস্যসন্ধানী মানুষ।রহস্যের পেছনে ছুটে চলা আপনার কাজ।আমরা চাই আপনি আমাদের এই বিপদে পাশে দাঁড়াবেন।

সানাউল মির্জা আবিদের দিকে ভ্রুঁ কুচকে তাকিয়ে বলল,আপনারা আমার খোঁজ কিভাবে পেয়েছেন?

মনছুর আগ বাড়িয়ে বলল,আনিসুজ্জামান স্যার আমার বাবার বন্ধু।উনি মাঝেমাঝে আমাদের বাসায় আসেন।একদিন কথায় কথায় আপনার কথা উঠেছিল।আপনার কাহিনীগুলো শুনে ভীষণ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।আজ বিপদে পড়তেই আপনার কথা প্রথম আমার মাথায় আসে।তাই দেরি না করে আপনার খোঁজে বেরিয়ে পড়া।

সানাউল মির্জার কপালের ভাজ ধীরে ধীরে সরে গেছে।হাসিমুখে বলল,আমি একসময় বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগে কর্মরত ছিলাম।নাস্তিক প্রকৃতির মানুষ হয়ে মাঝে কিছু বই লিখেছিলাম।কিন্তু হঠাৎ করে আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে মুহূর্তে আমার সকল ধারণা পাল্টে যায়।সে গল্প অন্য একদিন বলবো।তারপর থেকে এই রহস্যসন্ধানী মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয়।যেখানে প্রকৃতির রহস্য সেখানেই আমার পা ফেলা।তা আপনারা হঠাৎ কি বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছেন?

তরী মেয়েটি চায়ের কাপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো।সানাউল মির্জা দুজনের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে বললেন,খেয়ে ধীরেসুস্থে বলুন।

আবিদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত।ইদানিং সে অদ্ভুদ আচরণ করছে।বলতে পারেন,অশরীরী ব্যাপার।

আবিদের কথা শুনে তরী একবার আড়চোখে আবিদের দিকে তাকালো।আবিদ ব্যাপারটায় কেমন যেন স্বস্তি পেল না।ব্যাপারটা সানাউল মির্জার খেয়াল হতেই বললেন,তরী,তুই এখন যা।আমরা একটু কথা বলবো।

তরী চলে যেতেই সানাউন মির্জা উঠে দরজার পর্দা হাত দিয়ে টেনে ঢেকে দিলেন।তারপর বসে বললেন,তরী,এসব ব্যাপারে খুব একটা জানেনা।আসলে বাচ্চা মেয়ে তো বুঝতে পারেনি।যাই হোক,আপনি বলছিলেন,আপনার স্ত্রীর অদ্ভুদ আচরণ সম্পর্কে।আমাকে একেবারে প্রথম থেকে বিস্তারিত খুলে বলুন।

আবিদ হাত থেকে চায়ের কাপ রেখে বলল,দু’মাস আগে আমার এই শহরে বদলী হয়ে আসা।একদিন আমাদের বাসার কাজের মেয়ে কুলছুম এসে বলল,অফিস থেকে বাসায় ফিরলে আমার স্ত্রীর মুখ থেকে তাজা রক্তের গন্ধ বের হয়।আমি তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিলেও পরদিন থেকে মেয়েটা নিঁখোজ।ওর নিঁখোজের পর আমার কিছুটা খটকা লাগে।ব্যাপারটা দেখার জন্য আমি একদিন অফিস থেকে অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই চলে আসি।একটু পরে রেহানা বাসায় আসার পর সত্যিই সেদিন ওর মুখ থেকে রক্তের গন্ধ আমার নাকে লাগে।আবিদ একে একে সবকিছু বিস্তারিত বলল রহস্যসন্ধানী সানাউল মির্জাকে।

-আপনার স্ত্রী রেহানা শুধু কি রাতে বাসায় ফিরলেই এমনটা হয়?বাকিটা সময় সে কি একদমই স্বাভাবিক থাকে?জিজ্ঞেস করলেন সানাউল মির্জা।

-হ্যাঁ,ঘটনা শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি শুধু ওই সময়টাতেই রেহানার মাঝে এমন পরিবর্তন দেখতে পাই।দিনের অন্য সময়ে সে একদমই স্বাভাবিক থাকে,বলল আবিদ।

সানাউল মির্জা মাথা নেড়ে একটা ডায়েরীতে কি যেন লিখলেন।আচ্ছা রান্নাঘরে মৃতদেহ দেখার ব্যাপারটা একদমই কি নিজ চোখে দেখেছেন?আপনার ভুলও তো হতে পারে।

আবিদ বেশ জোর দিয়ে বলল,আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম।তাছাড়া মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা তো আমার আর মনছুর দুজনের সাথেই ঘটেছে।এটা তো মিথ্যা হতে পারেনা।

সানাউল মির্জা ডায়েরী বন্ধ করে বলল,আজ তো শুক্রবার।আপনার স্ত্রী আজও কি বাসা থেকে বের হবে?

আবিদ বলল,ঘটনা শুরুর পর থেকে মাঝে একটি ছুটির দিন ছিল।আমার যতদূর মনে পড়ে,সেদিন রেহানা বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বের হয়েছিল।

-আপনাদের বাসায় আজ সন্ধ্যার দিকে একটু ঘুরে আসবো।কোনো সমস্যা হবে না তো?

-না,কিসের সমস্যা?রেহানাকে দেখলে হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে আরও সুবিধা হবে আপনার জন্য,বলল আবিদ।

-ঠিক আছে,আপনারা এখন তাহলে আসুন।আমার একটু বের হতে হবে।প্রয়োজন হলে আমি যোগাযোগ করবো।

আবিদ ভেতর থেকে বেরিয়ে কেমন মনমরা হয়ে হাঁটছে দেখে মনছুর বলল,কি হয়েছে?কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত আপনি?

-লোকটাকে দেখে কেমন যেন পাগল মনে হচ্ছে।চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে।সঙ্গে এমনভাবে তাকায় যেন ভেতরে প্রাণ নেই।আমার মনে হচ্ছে না,উনি কিছু করতে পারবে।

-এখন আপনি এই ব্যাপার নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেলে সোজা মানসিক হাসপাতালের ঠিকানা ধরিয়ে দিবে।শেষ চেষ্টা হিসেবে না হয় এই পাগল লোকটার উপর ভরসা করে দেখুন।শূন্যতার চেয়ে কিছু আশা বাঁচিয়ে রাখা তো অন্ততপক্ষে ভালো।

মনছুরের কথায় আবিদ মাথা নেড়ে তেমন কিছু বললো না।বাড়িটার দিকে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,দেখা যাক ভাগ্যে কোথায় নিয়ে ফেলে।

দুই.

ওসি হামিদ শিকদার চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে আছে।উনার নাকের নিচের গোঁফ দেখে মনে হচ্ছে বেশ যত্নে রাখা হয়েছে।বামহাতে গোফঁ বারবার হাত বুলিয়ে কি যেন চিন্তা করছে।সামনে হরেক রকমের নাস্তার প্লেট সাজানো।খাওয়ার ইচ্ছে নেই তার।অন্যদিকে কনস্টেবল তাহের মিয়া একটার পর একটা মুখে পুরে চলেছে।কে বলবে,তার সামনে উর্ধ্বতন কর্মকতা চিন্তিত মুখে বসে আছে।মুখে একটা আপেল পুরে বলল,কি ব্যাপার স্যার,না খেয়ে কি ভাবছেন?খাবারগুলো খুব মজা হয়েছে।তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন।নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে যে।

ওসি হামিদ শিকদার ধমকে উঠে বলল,রাখো তোমার ঠান্ডা।এদিকে জীবন নিয়ে অঁজপাড়ায় পড়ে আছি।কখন প্রাণটা চলে যায় সেই ভয়ে রাতে ঘুম হয়না।তুমি আছো ঠান্ডা নিয়ে,যত্তোসব।

ওসির ধমকে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না কনস্টেবল তাহের মিয়ার।সে আরেকটা আঙুর মুখে দিয়ে বলল,প্রাণ যখন চলেই যাবে,খেয়ে নেওয়া সওয়াবের কাজ।

ওসি কড়মড় দৃষ্টিতে তাকাতেই তাহের মিয়া এবার বিচলিত হয়ে বলল,সরি স্যার,মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে।

দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো জমিদার প্রতাপাদিত্য বর্মণ।উনাকে দেখে ওসি হামিদ শিকদার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো।কনস্টেবল তাহের মিয়া খাওয়া ছেড়ে দাঁড়াতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল।জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও উনার বাপ-ঠাকুরদার আমলে কয়েকগ্রামের জমিদারির দাপট এখনও কিছুটা বিরাজমান।নিজেকে এখনও একজন জমিদারের চেয়ে কম কিছু মনে করেন না তিনি।বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়লেও এখনও উনার হুকুমে বাঘে-গরু একপুকুরে পানি খায়।তাছাড়া টাকা দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর কথাও গ্রামের লোকদের মুখেমুখে শোনা যায়।গ্রামপ্রধান হিসেবে তিনিই সর্বেসর্বা।বেশ কারুকার্য খচিত আসনে বসে বললেন,কি খবর ওসি সাহেব?

ওসি হামিদ শিকদার কাচুমাচু হয়ে বলল,খুবই খারাপ।প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাড়ি থেকে লোকজন নিঁখোজ হয়ে যাচ্ছে।লাশটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।লাশ খুঁজে না পেলে তদন্ত করবো কিভাবে?

জমিদার বর্মণ কি যেন চিন্তা করে বললেন,আপনার কি মনে হয় এই ব্যাপারে?আমার চৌদ্দপুরুষের আমলে এমনটা কখনো ঘটেনি।হঠাৎ এই কি কুনজর আমার গ্রামের মানুষের উপর পড়লো?

-সবচেয়ে খারাপ খবর হচ্ছে,অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে।সবার মুখেই এককথা,বেঁচে না থাকলে বাড়ি দিয়ে কি করবো?

-আচ্ছা ওসি সাহেব,শুধুই কি এই গ্রামেই এমন ঘটনা ঘটছে?আশপাশের গ্রামের কি খবর?জিজ্ঞেস করলেন জমিদার বর্মণ।

ওসি হামিদ শিকদার বলল,অদ্ভুদ ব্যাপার হচ্ছে শুধুই এই গ্রামেই নিঁখোজ হওয়ার ঘটনা ঘটছে।আমি খোঁজ নিয়ে শুনেছি,আপনার দায়িত্বে থাকা বাকি গ্রামগুলোতে সবই স্বাভাবিক।

জমিদার বর্মণের কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে।কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,এখনও তো আমার জমিদার বাড়িতে এর প্রভাব পড়েনি।আপনারা একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।এখন তাহলে আমি উঠি।

ওসি হামিদ শিকদার দাঁড়িয়ে বলল,স্যার,প্রাণটা নিয়ে এই মাসটা পার করে বদলী হওয়ার আবেদন করবো।রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনা।আমরা তাহলে এখন আসি।আপনি আপনার প্রাসাদে পাহারাদার আরও বাড়িয়ে দিন।

জমিদার বর্মণ চলে যেতেই দুজনে উঠে পড়ল।কনস্টেবল তাহের পানি খেয়ে বলল,আহা!পেট একদম ভরে গেছে।একটু ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পেল,জমিদার বর্মণ দেয়ালে টাঙানো ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।তাহের মিয়া সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলল,স্যার,ওই দুইজন কে?

ওসি হামিদ শিকদার বলল,বর্মণ সাহেবের দুই মেয়ে।অনেক আগে মারা গেছে।সেই শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে কনস্টেবল তাহের মিয়াকে চলে আসার ইশারা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

আবিদ রেহানাকে নিয়ে বারান্দায় বসে আছে।রেহানার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে সে।বারবার বকছে,চুলের যত্ন নেয় না কেন?সবকিছু তাকেই খেয়াল রাখতে হবে কেন?

রেহানা বলল,তুমি খেয়াল না রাখলে কে রাখবে বলো তো?এখন ভালো করে তেল দাও চুলে।বারবার ঘড়িতে তাকিয়ে কি দেখছো বলো তো?কেউ আসবে নাকি বাসায়?

কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবিদ বলল,না,এমনি।একটু পরে মাগরিবের আযান দিবে তো।নামাজ পড়তে হবে না?আবিদ ভাবছে,মির্জা সাহেব এখনও আসছে না কেন?বিকাল থেকে নানা বাহানায় রেহানাকে ব্যস্ত রেখেছে সে।কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ?একটু পরে যদি বাসা থেকে বের হয়ে যায় তখন তো এই রেহানা স্বাভাবিক থাকবে না।মির্জা সাহেবও আর খুঁজে পাবেনা রেহানাকে।কলিং বেলের আওয়াজ শুনতেই আবিদের মন হেসে উঠলো।যাক,এসেছে তাহলে।আবিদ ইচ্ছে করেই বলল,রেহানা,দেখো তো কে এসেছে?এই সময়ে হঠাৎ বাসায় কার আগমন?

রেহানা অভিমানি কন্ঠে বলল,শুধু আমাকে দিয়ে কাজ করাও তুমি।মুখ ভেংচি কেটে বেরিয়ে গেল বারান্দা থেকে।রেহানা দরজা খুলতেই দেখতে পেল,একজন লোক কোর্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।লোকটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে রেহানা বলল,আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।কাকে চান আপনি?

সানাউল মির্জা বললেন,আমি আবিদ সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি।আমার আন্দাজ যদি সঠিক হয়,আপনি কি সেই রেহানা?

সানাউল মির্জার কথায় রেহানা চমকে উঠলো।বলল,সেই রেহানা মানে?

-মানে মনছুর সাহেব তো আপনার রান্নার প্রশংসা করতে করতে আমাদের পেট অর্ধেক ভরিয়ে ফেলেছে।তাই আবিদের সাথে দেখা করতে এসে ভাবলাম,আপনার হাতের রান্নাও খেয়ে যাবো।

কথাটা বোধহয় পছন্দ হলো রেহানার।হেসে বলল,ভেতরে এসে বসুন আপনি।আমি আবিদকে ডেকে দিচ্ছি।

আবিদের পাশে রেহানা বসে আছে।সানাউল মির্জা আবিদের সাথে কথা বলার ফাঁকে রেহানার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করছেন।হঠাৎ রেহানার দিকে তাকিয়ে বলল,আপনার গলার হারটা খুব সুন্দর।বেশ মানিয়েছে আপনাকে।

সানাউল মির্জার কথায় মনে হলো রেহানা কিছুটা বিরক্ত।মাঝবয়সী লোকের এটা কেমন ধরনের কথা!তবুও ভদ্রতার খাতিরে বলল,ধন্যবাদ।

-আপনাকে গতকাল নয়টার দিকে আমি ইস্টার্ন মার্কেটের নিচতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম।আপনাকে হাত দিয়ে ইশারা দেয়ার পরও খেয়াল করেননি।

রেহানা বিস্মিত হয়ে বলল,কি বলেন আপনি?আমি তো আটটার মধ্যে বাসায় চলে আসি অফিস থেকে।কালও তো সময় মতো বাসায় ফিরলাম।আর দশটার দিকে মনছুর ভাই এসেছিল।উনাকে রান্না করে খাওয়ালাম।আপনি আমাকে ওই সময়ে কিভাবে দেখবেন?

সানাউল মির্জা স্বাভাবিকভাবে বললেন,তাহলে হয়তো আমি ভুল কাউকে দেখেছি।তিনি আবিদের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কি যেন ইশারা করলেন।

আবিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,রেহানা,তুমি উনার জন্য একটু চা নিয়ে আসো।আমরা কিছুক্ষণ গল্প করি।

রেহানা চলে যেতেই আবিদ উত্তেজিত হয়ে বলল,কিছু বুঝতে পারলেন মির্জা সাহেব?

সানাউল মির্জা সে কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন,আপনার স্ত্রী রাত আটটায় বাসায় চলে আসে প্রতিদিন।কিন্তু আপনি বললেন,প্রতিদিন রাত দশটার পর ফিরে।আবার গতকাল মনছুর সাহেব দশটায় আপনাদের বাসায় আসে সেটা সে বলল।অথচ মনছুর সাহেব বাসায় আসে সন্ধ্যার পর।তার মানে ফাঁকে এই দুই ঘন্টার সময়টা কোথায় ছিল আপনার স্ত্রীর মনে নেই।কিন্তু তো একটা অবশ্যই আছে।

আবিদ বলল,তাহলে বুঝতে পারছেন,ব্যাপারটা কতটা সাংঘাতিক?এখন আপনি আমার শেষ ভরসা।

সানাউল মির্জা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,সত্যিই সাংঘাতিক মনে হচ্ছে।আমি আজ তাহলে উঠলাম আবিদ সাহেব।আরও অনেক কিছুর খোঁজ নিতে হবে।

সানাউল মির্জা সিড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন।একটা ঠান্ডা বাতাস পাশ কাটিয়ে চলে গেল মনে হয়।মনের ভুল ভেবে তিনি আবার নামতে শুরু করলেন।এবার আর মনের ভুল নয়।কেউ যেন কানে ফিসফিস করে বলছে,”তুই মারা পড়বি।এই ঝামেলায় জড়াবি না।”

সানাউল মির্জা এবার বললেন,কে কথা বলে?কোনো উত্তর না পেয়ে তিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন।হঠাৎ সিড়ির লাইটগুলো বন্ধ হয়ে গেল।অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ।সানাউল মির্জা ফোন বের করতে যাবে এমন সময়ে একটা ছায়া যেন পাশে দাঁড়িয়ে আছে মনে হলো।তিনি ঘুরে তাকাতেই চমকে উঠলেন।একটা কুৎসিত চেহারা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।তারপরই হঠাৎ চারপাশ আলো জ্বলে উঠলো।তিনি দেখতে পেলেন,চারপাশ একদমই স্বাভাবিক।সানাউল মির্জা কি ভেবে যেন পেছনে তাকালেন।দেখতে পেলেন,দরজার সামনে রেহানা দাঁড়িয়ে আছে।শূন্য দৃষ্টিতে ঠোঁটের কোণে সেই কুৎসিত হাসি।যেন বলছে,”তুই মারা পড়বি।এই ঝামেলায় জড়াবি না।”

তিন.

কনস্টেবল তাহের মিয়া গাড়ি চালিয়ে ফিরছেন।ওসি হামিদ শিকদারকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে তার।তাহের মিয়া আপন মনে বিড়বিড় করছে,কি দিনকাল পড়লো!একটা মানুষও আশপাশে নাই।দোকানে বসে যে একটা সিগারেট খাবো সে উপায়ও নেই।কিসের নিঁখোজ?সব হলো ওই জমিদারের থেকে রেহাই পাবার ফন্দি।ভাবছে,কেউ কিছু বুঝে না?আমি তাহের সবই বুঝি।

আচমকা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল।কনস্টেবল তাহের বিশ্রি গালি দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির চাকায় একটা লাথি মেরে বলল,আর নষ্ট হওয়ার সময় পায় নাই।এই বিরান রাস্তায় এখন কি করবো?বিরক্ত হয়ে গাড়ির সামনের অংশ উঠালো।গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে দেখছে,ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কারন কি?হঠাৎ মনে হলো,আশপাশের ঝোপে কি যেন দৌঁড়ে চলে গেল।কনস্টেবল তাহের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকিয়ে বলল,কে দৌঁড়ায় ওইদিকে?

সবকিছু নিস্তব্ধ,কোনো আওয়াজ আসে না।কনস্টেবল তাহের হেসে বললো,শালার,ইন্দুর।তারপরই একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল সে।মনে হচ্ছে,কেউ যেন তার উপর ভীষণভাবে রেগে আছে।তাহের মিয়ার মনের ভেতরে এবার আস্তে আস্তে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে।কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে।কাঁপা গলায় বলল,কে নিঃশ্বাস ফেলে?পেছনে ফিরতেই কনস্টেবল তাহেরের চোখ যেন কপালে উঠে গেল।বলল,এটা কিভাবে সম্ভব?আপনি তো…

তার আগেই কনস্টেবল তাহের মিয়ার আত্মচিৎকারে চারপাশ যেন ভয়ে কেঁপে উঠলো।রক্তের স্রোতে মিশে গেল কাঁচা মাটির রাস্তা।

………..চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here