-প্রতিদিন রাতে বাসায় ফিরলে আপনার স্ত্রীর মুখ থেকে যদি তাজা রক্তের গন্ধ বের হয় তাহলে ব্যাপারটা কতটা ভয়ঙ্কর ভেবে দেখেছেন?

সহকর্মী আবিদের এমন অদ্ভুদ কথা বোধহয় মনছুর ঠিক হজম করতে পারলো না।তার মুখ থেকে ছিটকে পানি মেঝেতে গিয়ে পড়ল।হাত থেকে কাঁচের গ্লাস রেখে বলল,সরি,ঠিক সামলে উঠতে পারিনি।ভাই,আমি মানুষটা প্রচন্ড ভীতু প্রকৃতির।প্লিজ,আমার সাথে মজা করবেন না।

-আমি আপনার সাথে এমন বিষয় নিয়ে মজা করতে যাবো কেন বলুন তো?গত এক সপ্তাহ ধরে আমার বাসায় অদ্ভুদ সব কান্ড ঘটছে।কি যে করবো ঠিক ভেবে উঠতে পারছি না,বলল আবিদ।

আবিদের কথা এবার বোধ হয় মনছুর গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে।চেয়ারটা সামনে টেনে আবিদের একদম গা ঘেঁষে বসে বলল,আপনার কথা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।একটা মানুষ কিভাবে রক্ত খাবে?আমাকে একটু ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলুন তো।

আবিদ কিছুটা গম্ভীর হয়ে মনছুরের দিকে তাকালো।মনছুরের গা ঘেঁষে বসাটা পছন্দ হয়েছে কিনা চেহারা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে না।আবিদের কপাল কিছুটা কুঁচকে আছে।বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,দিন দশেক আগের ঘটনা।সারাদিনের অফিসের চাপে বিকাল থেকে শরীরটা কেমন খারাপ হতে শুরু করলো।কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আর থাকতে না পেরে আমার বাকি কাজটুকু শফিককে বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসি।সেদিন রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা থাকায় আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই।বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর মোটামুটি সুস্থ বোধ করলাম।সপ্তাহখানেক আগে একটা বই কিনেছিলাম,কিন্তু ব্যস্ততায় পড়া হয়নি।বইটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম।এমন সময়ে কুলছুম এসে বারবার আমার পাশে ঘুরঘুর করছিল।কুলছুমকে তো আপনি চিনেন।আমার স্ত্রী তার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল।মেয়েটার দুকূলে আপন বলতে কেউ নেই।সাপের কামড়ে মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করে ফেলে।সৎ মা কুলছুমকে খেতে দেয় না।এদিকে ওর বাবাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।তবে ওর সৎ বোনটা খুব ভালো।এসব দেখে রেহানার ভীষণ মায়া হয়।রেহানা তখন সঙ্গে করে কুলছুমকে এখানে নিয়ে আসে।গত পাঁচ-সাত বছর ধরে আমাদের সাথেই ওর বেড়ে উঠা।যাই হোক,কুলছুমকে কখনো এমন করতে দেখিনি।বেশ কয়েকবার ঘুরঘুর করার পর আমি বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কিছু বলবি?

কুলছুম সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশে বসে পড়ল।ওর এমন আচরণে আমি তখন অবাক না হয়ে পারলাম না।বলল,ভাইজান,আপামনির কিছু একটা হইছে মনে হয়।আমার কিছুই ভালো মনে হইতাছে না।

আমি তখন কুলছুমের কথায় হেসে বললাম,কি হয়েছে তোর আপামনির?তোকে বকাটকা দিয়েছে নাকি?

কুলছুম বলল,সন্ধ্যায় আপামনি অফিস শেষে বাসায় ফিরলে মুখ থেকে রক্তের গন্ধ বের হয়।প্রথম প্রথম মদের গন্ধ ভাবতাম।কিন্তু এখন গন্ধটা আরও তীব্রভাবে পাই,আমার বমি আসে।কুলছুমের মুখে এমন একটা কথা শুনবো কল্পনা করিনি।তখন প্রচন্ড মেজাজ গরম হলেও নিজেকে সামলে বললাম,কই আমি তো কখনো পাইনি রক্তের গন্ধ।আমার তো আরও বেশি নাকে আসার কথা।তোর আপামনির সাথে রাতে আমাকে ঘুমাতে হয়।কুলছুম বলল,আপামনি বাসায় এসে অনেকক্ষণ বাথরুমে গোসল করে।তারপর আর গন্ধটা থাকে না।কুলছুমের সাথে ওইদিনই আমার শেষ কথা হয়।কারণ পরদিনই কুলছুমকে পুরো বাড়ি খুঁজেও কোথাও পাইনি।

-বেশ অদ্ভুদ ব্যাপার তো!মনছুরকে দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ উত্তেজিত।আচ্ছা তারপর কি হয়েছে?

আবিদ আবার বলতে শুরু করল,কুলছুম নিঁখোজ হওয়ার পর থেকে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করি।তখনও পর্যন্ত আমি এই বিষয়টা বিশ্বাস করিনি।কিন্তু মনে একটা খটকা থেকেই গেল।একসময় কুলছুমের কথাটা মিথ্যা প্রমান করার জন্য একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাসায় চলে আসি।কথাটা বিশ্বাস করিনি এটা যেমন সত্য আবার মনে মনে একটা ভয়ও কাজ করছিল।সত্যিই যদি রেহানার এমন কিছু হয়ে থাকে আমি কোথায় যাবো?আমার সময় যেন সেদিন ঘড়িতে আস্তে আস্তে চলছিল।ঠিকমতো এক জায়গায় স্থিরভাবে বসতেও পারছিলাম না।একসময় কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেলাম।আর দেরি না করে সোফা থেকে উঠে দরজা খুলে আমাকে দেখে রেহানা কিছুটা অবাক।আমি বললাম,আজকে তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আগেই চলে এসেছি।তা কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?

রেহানা বলল,সত্যিই আমি তোমাকে বাসায় দেখবো আশা করিনি।

কথাটা বলতেই রেহানার মুখ থেকে একটা ভোটকা গন্ধ নাকে লাগলো আমার।এত বাজে গন্ধ কারো মুখ থেকে বের হতে পারে জানা ছিল না।সঙ্গে সঙ্গে আমার বমি চলে আসে।সেদিন রেহানাকে বুঝতে দেইনি,আমি যে তাকে নিয়ে সন্দেহ করছি।

আবিদ দেখতে পেল,মনছুরের চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।গ্লাসে পানি ঢেলে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু শেষ করে বলল,যদিও আমার ভয় লাগছে।কিন্তু পুরোটা না শুনেও থাকতে পারছি না।প্লিজ,পরে কি হয়েছে বলুন?

-দিনে দিনে রেহানা আরও দেরি করে বাসায় ফেরা শুরু করলো।জিজ্ঞেস করলে বলতো,রাস্তায় জ্যাম ছিল।কিন্তু রেহানা যে রাস্তায় বাসায় আসে সবসময়ই ফাঁকা থাকে।আমিও সবকিছু স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলাম।ভাবলাম,একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু আমার জন্য আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে স্বপ্নেও ভাবিনি।

-আরও বড় কিছু!বিস্ময় প্রকাশ করে বলল মনছুর।আপনি এই বাসায় কিভাবে থাকেন ভাবতেই আমার শরীরে কাঁটা দেয়।

-তারপর একদিন,কথার মাঝে থামতে হলো আবিদকে।কলিং বেলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।মনছুর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল,রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি।সে এখানে এসেছে প্রায় দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছে।মনছুর বলল,এইসময়ে কে এসেছে আবার?

আবিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,কে আবার রেহানা।একটু বসুন আমি দরজা খুলে দিয়ে আসি।

মনছুর রেহানাকে দেখেছিল ঠিক পাঁচমাস আগে।দুজনের বিবাহবার্ষিকীতে দাওয়াত পেয়েছিল সে।কিন্তু তখনকার রেহানা আর এই রেহানার মাঝে কত পরিবর্তন।তখন ভাবি বলে কত মজার রান্নাই খাইয়েছিল তাকে।আর এখন প্রাণ নিয়ে বের হতে পারলেই বাঁচে মনছুর।রেহানা রুমে ঢুকতেই মনছুর উঠে দাঁড়ালো।কাঁপা গলায় বলল,কেমন আছেন,ভাবি?অনেকদিন পর আপনাদের বাসায় আসলাম।

রেহানা মনছুরকে দেখে যেন বেশ খুশিই হলো।বলল,আরে মনছুর ভাই আপনি!কত দিন পর বাসায় আসলেন।তা হঠাৎ কি মনে করে?

মনছুরের নাকে একটা বাজে গন্ধ এসে ঠেঁকলো।বুঝতে পারলো,এই সেই গন্ধটা যা কুলছুম আবিদকে বলেছিল।মনছুর খুব কষ্টে নিজেকে সামলে বলল,এইতো ভাবি,একটু আড্ডা দিতে আসা।

-ঠিক আছে রাত তো প্রায় অনেক হয়েছে।আপনাকে না খাইয়ে কোথাও যেতে দিচ্ছি না।আজ আপনাকে আমার হাতের বিশেষ একটা রান্না করে খাওয়াবো,এই বলে রেহানা ভেতরে চলে গেল।

রেহানা যেতেই মনছুর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।চেয়ারে বসে বেশ জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলল,একটু হলেই বমি করে দিতাম।কি বিশ্রি গন্ধ!

আবিদ হেসে বলল,আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বাজে গন্ধটার চেয়ে রেহানাকে সামনে দেখে বেশ আঁতকে উঠেছেন।

-আপনার মুখ থেকে যা শুনছি সেটা হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি?আমি মানুষটা এমনিতেই খুব ভীতু আপনি ভালো করেই জানেন।আর রেহানা ভাবিকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেছে।কথাই বের হচ্ছিল না তখন মুখ দিয়ে।

-রেহানা বাসায় আসার একদমই স্বাভাবিক থাকে।তাছাড়া আপনার সাথে আমি তো আছি,মনছুরকে অভয় দিয়ে বলল আবিদ।

-সেই ভরসা আমার আছে।মনছুর আবার আবিদের দিকে ঝুঁকে বসে বলল,তারপরের অংশটুকু বাকি ছিল তো।বড়কিছু আপনার জন্য অপেক্ষা করছিল বললেন।

আবিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমে উঁকি দিয়ে দেখে নিল,আশপাশে রেহানা আছে কিনা?ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে এসে দরজা কিছুটা বন্ধ করে চেয়ারে বসে বলল,তারপর থেকে আমি ঘন্টাখানেক আগেই অফিস ছেড়ে বাসায় চলে আসি।বাকিকাজগুলো বাসায় শেষ করি।কারন রেহানা কখন কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে সে চিন্তা থেকেই যায়।

আবিদকে মাঝপথে থামিয়ে মনছুর জিজ্ঞেস করলো,আচ্ছা আপনি কখনো রেহানা ভাবির পিছু গিয়ে দেখেননি,কোথায় যাচ্ছে?তাহলে তো ব্যাপারটা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেতো।

-সে চেষ্টা কি আমি করিনি ভেবেছেন?রেহানার পিছু নিয়ে হাঁটা শুরু করলে কিছুক্ষণ পরই রাস্তা হারিয়ে ফেলি।কখনো নিজেকে খোলা মাঠে আবিষ্কার করেছি,কখনো পরিত্যক্ত গাড়ির গ্যারেজে।টানা তিনদিন আমার সাথে একই ঘটনা ঘটেছে।শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বাসায় বসে রেহানার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় আমি দেখিনি।

মনছুর মাথা নেড়ে বলল,বেশ অদ্ভুদ।মনে হচ্ছে অশরীরী ব্যাপার।আপনাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়ার জন্য দুঃখিত।আসলে কৌতূহলী মন তো।যাই হোক,বড়কিছু অপেক্ষা করছিল বললেন।

-সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল।আমি কাজ শেষ করে সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম।সময়ের সাথে বৃষ্টিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল।রেহানার চিন্তায় কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না।অন্যদিনের চেয়ে ঠিক আধঘন্টা দেরিতে রেহানা বাসায় ফিরে।কিন্তু অদ্ভুদ ব্যাপার হলো,সেদিন আমি রেহানার মুখে কোনো গন্ধ পাইনি।ব্যাপারটায় তখন এতটা খুশি হয়েছিলাম!ভেবেছিলাম,যাক সমস্যা তাহলে চলে গেছে।কিন্তু কিছুক্ষণ পরই যে আমার জন্য এতবড় কিছু অপেক্ষা করছে আমি দো’আ করি আমার শত্রুও যেন ওই দৃশ্যের সম্মুখীন না হয়।

আবিদের কথা যতই শুনছে মনছুরের উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে।সঙ্গে শরীর বেয়ে ঘাম পড়ছে।কিছুক্ষণ পরপর গ্লাসে করে পানি নিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে।আবিদকে চুপ থাকতে দেখে বলল,থেমে গেছেন কেন?কি দেখেছেন বলুন।

-সেদিন রাতে টেবিলে বসার পর রান্নার আয়োজন দেখে আমি কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।সঙ্গে গরুর মাংস,মুরগির মাংসের পাশে আরও একটি ভিন্ন রকমের মাংস চোখে পড়ল।সেদিন কোনো মেহমান আসার কথা ছিল না।রেহানা কাউকে দাওয়াত করলে অবশ্যই আমাকে বলবে।কিন্তু রেহানাও কিছু বলেনি।তাহলে এতগুলো মাংসের রান্না কার জন্য?আর কৌতূহল সামলাতে না পেরে রেহানাকে জিজ্ঞেস করলাম,আজ কি বাসায় বিশেষ কেউ আসবে?রেহানা বলল,না তো।এই বৃষ্টিতে কে আসবে?আমি বললাম,তাহলে,এত খাবার কে খাবে?কথাটা শুনে রেহানা আমার দিকে অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তাকালো।সে দৃষ্টি রেহানার ছিল কিনা আমার সন্দেহ আছে।

আমি কথা ঘুরিয়ে বললাম,এটা কিসের মাংস রেহানা?

সঙ্গে সঙ্গে রেহানার আচরণে আমার কেন যেন ভয় লাগলো।একটু আগে এই মেয়েটাই আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে ছিল!উত্তরে রেহানা হেসে বলল,আগে খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?তারপর বলবো,কিসের মাংস?

ভিন্ন রকমের মাংস দেখে খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে ওই মাংস দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।প্রথমে জিহ্বায় দিতেই কেমন একটা নোনতা স্বাদ।কিন্তু যতই ভিতরে যাবে এত মজা!বেশ লাগছিল খেতে।আমি তিথির অথবা খাওয়ার উপযোগী সব পাখির মাংস খেয়েছি।কিন্তু এমন ভিন্ন স্বাদের মাংস সেদিনই প্রথম।যাই হোক,আমার ভাতের সাথে লেবু না থাকলে খেতে পারি না।রেহানার সেদিন লেবু আনতে মনে ছিল না।রেহানার বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া দেখে আমি নিজেই উঠে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলতে যাবো এমন সময়ে চোখ পড়লো গ্যাস সিলিন্ডারের পাশে।এই দৃশ্য আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলতে পারবো না।

রেহানাকে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতে দেখে থেমে গেল আবিদ।রেহানা মনছুরের দিকে তাকিয়ে বলল,দরজা বন্ধ করে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন?আমার রান্না শেষ।খেতে আসুন।এই তুমিও আসো।

খাবারের কথা শুনে মনছুর যেন বেমালুম ভুলেই গেল সে এতক্ষণ কোথায় ছিল।সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বলল,অনেকদিন ভাবির হাতের রান্না খাওয়া হয়না।আজ জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হবে।আপনিও আসেন।

আবিদ যেন কিছু বলতে যাবে কিন্তু মনছুর সে কথা কানে না নিয়ে একপ্রকার দৌঁড়ে চলে গেল রুম থেকে বেরিয়ে।

টেবিলে এত খাবারের আয়োজন দেখে মনছুর খুশিতে উৎফুল্লিত হয়ে বলল,বাহ,বেশ ভালোই আয়োজন হয়েছে।মনছুরের হঠাৎ একটা বাটিতে চোখ পড়ল।বেশ ভিন্ন রকমের মনে হলো দেখে জিজ্ঞেস করল,ভাবি,এটা কি?আমার কাছে তো মাংস মনে হচ্ছে।

রেহানা বলল,হুম আমার হাতের স্পেশাল মাংস।আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি,এই মাংস খাওয়ার পর অন্য কোনো মাংস খেতেই চাইবেন না।

-মনছুর ভাই,আগে মুরগি আর গরুর মাংস নিয়ে খাবার শুরু করুন।পরে ওই স্পেশাল মাংস খাবেন,এই বলে আবিদ মাংসের পাত্রটা একটু দূরে সরিয়ে রাখল মনছুরের প্লেটের সামনে থেকে।

-নাই ভাই,আগে ভাবির হাতের স্পেশাল মাংসটা খেয়ে দেখি কেমন স্বাদ?মুরগি আর গরুর মাংস তো প্রায় খাওয়া হয়,এক প্রকার জোর করে মাংসের বাটি থেকে এক পিচ মাংস প্লেটে রাখলো মনছুর।মুখে দিয়ে বেশ তৃপ্তি নিয়ে মনছুর বলল,এত স্বাদের মাংস আমি কখনো খাইনি।কি যে মজা!

আবিদকে ব্যাপারটায় বেশ বিরক্ত মনে হলো।কপালে বিরক্তের ভাজ পড়লেও বেশ হাসিমুখেই বলল,এবার মুরগি আর গরুর মাংস নেন।এগুলোও বেশ মজা হয়েছে।বেশ জোর করেই ওনার প্লেটে তুলে দিল আবিদ।

রাতে খাওয়ার পর আবিদের সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস।বারান্দার এক কোণে বসে সিগারেট টানছে সে।অন্যপাশে মনছুর নিজের আপন মনে কথা বলেই চলেছে।বারান্দায় বসার পর থেকেই রেহানার রান্নার প্রশংসা শুনতে শুনতে আবিদও বেশ বিরক্ত।আবিদ সিগারেট শেষ করে মনছুরের কিছুটা গা ঘেঁষে এসে মনছুরের কাঁধে হাত রেখে বলল,আমি এখন আপনাকে যে কথাটা বলবো তা শোনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।

মনছুর হঠাৎ আবিদের কথায় থেমে গেল।সে ভুলেই গিয়েছিল রেহানার ব্যাপারটা।হঠাৎ মনে পড়তেই বলল,সন্ধ্যা থেকে আপনি যা বলেছেন তা শুনেই আমার শরীরের অবস্থা এমনিতেই খারাপ।রান্না খেয়ে কিছুটা ভালো লাগছে।আপনি বলুন,আমি প্রস্তুত।

আবিদ একটু সরে এসে বলল,আপনি যে মাংসটা তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছেন তা আসলে মানুষের মাংস।রেহানার স্পেশাল রান্না করা মানুষের মাংস।

মনছুর নিজেকে সামলাতে পারলো না।আকাশ-পাতাল ভারি করে বমি করতে শুরু করলো।ভাগ্য ভালো বারান্দায় একটি খালি বালতি পাশে রাখা ছিল।

-সেদিন ফ্রিজ খুলতে গিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের পাশে একটা মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিলাম।রেহানা আমাকে মানুষের মাংস খেতে দিয়েছিল।ব্যাপারটা বুঝতেই সেদিন সারারাত বমি করতে করতে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।আজ আপনাকে যখন বলল,স্পেশাল মাংস রান্না করে খাওয়াবে তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম,নতুন কেউ শিকার হয়েছে।তাই বারবার মাংসের পাত্রটা জোর করে সরিয়ে রাখছিলাম।কিন্তু আপনি তো আমার ইশারাও বুঝতে পারলেন না।

মনছুর ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে।দেখে মনে হচ্ছে,সে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।বলল,আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় দিয়ে আসেন।এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমার কিছু একটা হয়ে যাবে।

আবিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,চলুন,আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে,আপনি এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি।আমার হাতটা ধরে উঠার চেষ্টা করুন।

মনছুর আবিদের হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,কাল আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবেন?আমার তো ব্যাপারটা বেশ সাংঘাতিক মনে হচ্ছে।সেখানে গেলে হয়তো পজিটিভ কিছু আশা করতে পারি।

মনছুরকে থামিয়ে দিয়ে আবিদ বলল,বাদ দিন না।শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার।আর ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলে আমি মুখ লুকাবো কোথায়?সমস্যাটা এমনি ঠিক হয়ে যাবে।

-কিছুই ঠিক হবে না,ভাই।বরং আরও মানুষের মৃতদেহ আসবে আপনার রান্নাঘরে।কে বলতে পারে,কতগুলো মানুষ এই পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে?আর কতগুলো মানুষের প্রাণ হারাতে চলেছে?আমরা যদি সব জানার পরও চুপ করে বসে থাকি,তাহলে নিষ্পাপ মানুষগুলোর মৃত্যুর জন্য আমরাও দায়ী থাকবো,বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল মনছুর।

মনছুরের শেষ কথাগুলো আবিদের মনে দাগ কেটে গেল।সত্যিই তো,সব জানার পরও চুপ করে বাসায় বসে থাকলে সমাধান তো হবে না।বরং প্রাণ যাবে কিছু পরিবারের নিরাপরাধ মানুষগুলোর।কিন্তু রেহানার হঠাৎ এমন হিংস্র হয়ে উঠার কারণ কি হতে পারে?

………..চলবে………..

#তাহার_আগমন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here