#ডাক্তার সাহেব পর্ব-৩৫
#শারমিন আঁচল নিপা
#

দরজায় খটখট আওয়াজ করছে কারা যেন! দরজাটা খুলতেই কয়েকজন পুলিশের আগমন ঘটল। তাদেরকে কারা যেন জানিয়েছে এখানে বাল্য বিবাহ হচ্ছে। বিষয়টা এত দূর জানাজানি কী করে হলো কারও বোধগম্য হচ্ছে না। বাবা কিছুটা ভয়ার্ত। নীলের বাবার মুখটাও শুকিয়ে আছে। নীল ও হতভম্ব। এ বিষয়টা নিয়ে চাকুরিটা চলে গেলে শুধু বিপদ না মহা বিপদ হবে। নীলের স্বপ্ন সব ধুলিসাৎ হয়ে যাবে সে সাথে হতাশাও তাকে গ্রাস করবে। আর প্রত্যক্ষ্য হোক বা পরোক্ষ হোক এটার দায় এড়ানো যাবে না। দায় টা আমার উপরেই পড়বে। তাই আমারও গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল খাঁ খাঁ মরভূমির মতো।

আমার শ্বশুর বাবা পুলিশকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলেন যে দুই পরিবার এবং পাত্র পাত্রীর সম্মতিতেই বিয়েটা হচ্ছে। নাছোরবান্দা পুলিশগুলো কেন জানি সেটা মানতে পারছেন না। তাদের ধারণা আমি ছোট বাচ্চা আমাকে জোর করে যোগ্য একটা পোলার সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার পুরো দায় আমার আর নীলের পরিবারের। আর নীলের উপরও সিভিল সার্জন অফিসে অভিযোগ আনবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নীলের মুখ অবয়বে ভয়ের ছাপটা ফুটে উঠেছে। যতই হোক চাকুরিটা তার একটা স্বপ্ন। এ চাকুরির জন্য তাকে সাধনা করতে হয়েছে অনেক। এটা চলে গেলে তার অবস্থা করুণ হবে সেটা আমি একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছি এখন। আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম সবকিছু যেন ঠিক হয়।

দুই পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আমার শ্বশুর বাবা আর বাবা বিষয়টা সামাল দিতে বেশ হিমিশিম খাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে ফেরেশতার মতো আগমন করলেন আমার মামা শ্বশুড়। তেমন কিছু না পুলিশকে চুপ থাকার জন্য চুক্তি করতে বললেন। পুলিশের হুংকারও ক্রমশেই মলিন হয়ে গেল। এক লাখ টাকা দাবি করা হলো। অগত্যা এক লাখ টাকা পরিশোধ করে ব্যাপারটা মিটানো হলো।

আমাদের দেশটা একটু বেশিই আপডেট হয়ে গিয়েছে। এখানে ছেলে মেয়েদে বিয়ের আগে প্রেমে সমস্যা নেই তবে বিয়তে সমস্যা। যাইহোক এসব ঝামেলা মিটতে মিটতে সময় লেগেছে ঢের। সন্ধ্যা নেমে আসলো চারপাশে। মসজিদের ইমাম সাহেব মাগরিবের আযান দিচ্ছেন। ছেলেরা সবাই মসজিদে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো। মেয়েরাও ঘরে নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। আমি উঠে আমার রুমে গেলাম। অযু করলাম। মিহু আর আমি পাশাপাশি বসেই নামাজ আদায় করলাম। নামাজটা শেষ করতেই মিহু আমার হাতটা চেপে ধরে বলল

– সুনীল কিন্তু আমার। ওকে একটু আমার কথাটা বলিস। বিয়েই যেহেতু করতে হবে আগে করলেই ভালো। তোর মতো হয়ে গেলে আরও ভালো। দুই বান্ধবী একসাথে থাকব আমাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিব কত মজাই না হবে।

আমি মুচকি হেসে বললাম

– নিজের গতি নিজে কর আমাকে বলে লাভ নাই। তুই গিয়ে বল। আর না হয় নীলের দেওয়া গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে যা।

মিহুর চাপা রাগটা আবারও প্রকাশ পেল। রাগে কপালটা কুঁচকে বলল

– ফাজলামু করবি না। নীল ভাইয়া কাজটা মোটেও ভালো করেনি। নীল ভাইয়ার জন্য এখনও আমি মায়ের কথা শুনি। মা তো আসার সময় বলতেছিলই সিঁথির কী ঐ বজ্জাত পোলার সাথে বিয়ে হচ্ছে!

আমি দুই কোমরে দুই হাত দিয়ে বললাম

– আমার বরকে বজ্জাত বললে কিন্তু ঠিক হবে না। মুখ সামলে কথা বল।

ইশ! এ বর বলার মধ্যে কত তৃপ্তি কত আনন্দই না পাচ্ছিলাম। মনটায় বেশ প্রফুল্ল লাগছে। মিহু কিছুক্ষণ হেসে বলল

– বজ্জাত কে বজ্জাত বলব না তো কী বলব হ্যাঁ?

এর মধ্যেই কাশির শব্দ আসলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সুনীল দাঁড়িয়ে আছে। আমি সুনীলকে চিনতে পারলেও মিহু পারেনি। সে তার সামনে গিয়ে বেশ অভিমানী গলায় বলল

– ভাইয়া ঐদিন কাজটা ঠিক করেননি। একদম বাজে কাজ করেছেন। এভাবে কেউ কাউকে গর্ভনিরোধক পিল দেয় নাকি। আমি না বুঝে কতগুলো খেলাম। ভাগ্যিস বেঁচে গেছি আমি। মা আমাকে কতগুলো মাইর দিলো জানেন। এখনও পিঠটা ব্যথা করে সেদিনের মাইরগুলোর কথা মনে করলে।

সুনীল মুচকি হাসতে হাসতে বলল

– মিহুমতি কার সাথে কী আকাম করেছেন যে আমার ভাই আপনাকে এ ট্যাবলেট দিল। অহেতুক তো একজন ডাক্তার হাবিজাবি ট্যাবলেট দিবে না। নিশ্চয় কিছু করেছেন। এখন যতদোষ আমার ভাইয়ের তাই না!

মিহু তো পুরোই স্তবির হয়ে গেল। যার সাথে সেটিং করতে চাচ্ছিল তার সামনেই নিজের ইজ্জত এভাবে ফালুদা বানাবে হয়তো আন্দাজ করতে পারেনি।জিহ্বায় কামড় দিয়ে পাশের রুমে ছুট লাগাল। সুনীল এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– মিস জরিনা ভাবী সবাই খাবার খাওয়ার জন্য ডাকছে। ভাইয়াও অপেক্ষা করছে। আর আপনার বান্ধবীরও কী আপনার মতো তার কয়েকটা ছেঁড়া আছে।

বলেই চলে যেতে নিল। আমি পিছু ডেকে বললাম

– শুনেন আমি জরিনা না সিঁথি। আমাকে সিঁথি ভাবী বলবেন। আর আমাকে তার ছেঁড়া বলছেন কোন সাহসে। আমি যতই হোক আপনার ভাবী। মিহুকে বলেন সমস্যা নেই আমাকে এমন বলবেন না।

– আচ্ছা জরিনা ভাবী। বলব না।

আমি রাগী চোখে তাকালাম তিনি আর এক দন্ডও দাঁড়ালেন না দ্রূত পায়ে চলে গেলেন।

দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ হলো সন্ধ্যা সাতটায়। ভীষণ ক্ষুধাও পেয়েছিল তবে এত মানুষের সামনে খেতে পারলাম না। মুরব্বিরা খাওয়ার পর বিদায় নিল। নীল,সুনীল আর মিহু রয়ে গেল বাসায়। বাকিরা সবার গন্তব্যে চলে গেল।

রাত বাজে এগারোটা। মফস্বলে রাত এগারোটা মানে অনেক রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। ছাদে সুনীল আর মিহু আছে৷ জানি না তাদের কিছু হচ্ছে কি না। দুজনকেই দুজনের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করতে খেয়াল করলাম। কবুল বলার পরপরই যেন আমার অস্থির ভাবটা চলে গেছে। মনে হচ্ছে আমি বেশ শান্ত শিষ্ট একটা মেয়ে। একটা কবুল যেন আমাকে একদম শান্ত করে দিল।

আকাশে প্রশস্ত চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঘরটা বেশ আলোকিত। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একদম চুপ হয়ে। নীল আমার পাশে দাঁড়াল। হাত দুটো তার হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল

– কী দেখছো।
– চাঁদটা। আচ্ছা চাঁদ বেশি সুন্দর নাকি আমি?
-চাঁদটা তোমার মতো সুন্দর। আর তুমিও চাঁদের মতো সুন্দর। কারও তুলনা কারও সাথে হবে না।
– তুমি দেখা যাচ্ছে চাঁদের মন রক্ষাও করলে সাথে আমারও।
– তা তো একটু করতেই হয়। বেচারা চাঁদের কত ধৈর্য এত সুন্দর হওয়ার পরও সকল প্রেমিকরা তাকে দেখিয়ে প্রেমিকাদের সুন্দর বলে। কোনদিন জানি চাঁদটা খসে পরে এর প্রতিশোধ নেয়।

নীলের কথা শুনে না হেসে পারলাম না। বেশ জোরেই হেসে দিলাম। নীল কেন জানি না আমার হাসিটা বন্ধ করতে তার ঠোঁটগুলোর সাহায্য নিল। আমি নীলকে জোরে জড়িয়ে ধরলাম। নীলের নিঃশ্বাসের বাতাস আমার মুখে থুবরে পড়ছে। নীলের এই পাগলামো সামলানোর ক্ষমতা আমার নেই। তাই নিজের পুরোটাই নীলের দিকে উজার করে দিলাম। ঘনঘন নিঃশ্বাস গুলো যেন এ ভালোবাসার সাক্ষী দিচ্ছিল।

বাইরে থেকে বাসন কোসনের আওয়াজ আসছে। সাজেদা খালা এসেছে বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে।সকাল বেলা বেশির ভাগ সময় ঘুম ভাঙে সাজেদা খালার বাসন কোসনের আওয়াজে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে ছয়টা বাজে। আমি উঠতে নিলে নীল আমাকে আরও জোড়ে ঝাঁপটে ধরে বলল

– কোথায় যাচ্ছ?

– ছাড়ো… বাইরে যাব।

– বুঝলাম না বিয়ের আগে এত আগুন দেখায়ছো এখন এত শান্ত বিড়াল কী করে হয়ে গেলে।

– বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা একটু শান্তই হয়ে যায়। কয়েকদিন পর বাচ্চা কাচ্চার মা হব। এখন পাগলামি মানায় নাকি?

– ওরে আমার পাগলি বুড়িটা এত বুঝধার হয়ে গেছো।

বলেই ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া গালে ছোয়াতে লাগল বারংবার। যতই নিজেকে ছাড়াতে চাচ্ছিলাম ততই যেন আমাকে সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছিল।

এর মধ্যেই সাজেদা খালার বজ্র কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। দুজনই বেশ চমকে গেলাম। সাজেদা খালার চিৎকার আরও বাড়তে লাগল। বুঝতে একটু অসুবিধায় হচ্ছিল যে খালা এভাবে ভেড়ার মতো চিৎকার কেন দিচ্ছে। দুজনই দ্রূত উঠলাম। বাইরে বের হয়ে দুজনই হতভম্ব হয়ে গেলাম। এমন ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা করেনি কখনও। বিষয়টা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নিব নাকি অস্বাভাবিক বুঝতে পারছিলাম না। নীল আর আমি দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম আবার মায়ের দিকেও তাকাচ্ছিলাম। লজ্জায় যেন দুজনের মাথায় কাটা যাচ্ছিল।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here