ডাক্তার সাহেব পর্ব-২৯
#শারমিন আঁচল নিপা

– কী শর্ত বাবা।

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

– আগে তুমি সুস্থ হও তারপর সব বলব। অনীলের পরিবারের সাথেও কথা বলতে হবে এ ব্যাপারে। দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্তে যাব। মা রে কারও জন্য জীবন থেমে থাকে না। এত অবুঝ হলে কী জীবন চলবে? তোমাকে তো বুঝতে হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠতে হবে। আত্মহত্যা কী কোনো সমাধান? কখনই না। অনীলের পরিবার তাদের ছেলের জন্য যোগ্য মেয়ে চাই। আর এ ঘটনার পর তার পরিবার তোমাকে আরও মেনে নিবে না। কারণ সুইসাইডাল মেয়েদের কেউ এই সংসারের একজন সদস্য বানাতে চায় না। তোমার মা তো তোমার ভালোর জন্যই এমন করেছে। সবে মাত্র পড়ো ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে এখনই কী দুনিয়ার সব দেখা আর পাওয়া শেষ? মারে জীবন অনেক কঠিন। জীবনের এ কঠিন অধ্যায়গুলো সামনে সুন্দর করে সাজিয়ে পার হতে হয়। এ বয়সটা ভীষণ খারাপ। এ আবেগ তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নাহয় সারাজীবন তুমি এ আবেগের জন্য আফসোস করবে। আমার কথা গুলো একটু চিন্তা করো। তোমার মা,বাবা আমরা, এই ১৬ বছর তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি আমাদের থেকে অন্য একজন এতই আপন হয়ে গেল যে তুমি তোমার জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিলে? একবারও আমাদের কথা ভাবলে না। কেন রে মা আমরা কী দোষ করেছি।

বলেই বাবা আরও কাঁদতে লাগল। বাবার কান্না যেন আমাকে আবারও বুঝিয়ে দিয়েছে আমি যা করেছি সেটা অন্যায়, ভুল। এমনটা করা সত্যিই উচিত হয়নি। আমি বাবার হাতটা ধরে বললাম

– বাবা আমি বুঝতে পারিনি। কথা দিচ্ছি এমন আর করব না। আমাকে মাফ করে দিও। আমি তোমাদের ভীষণ ভালোবাসি আবার নীলকেও ভালোবাসি। আমি বুঝে উঠতে পারিনি কী করব। তাই এমনটা করে ফেলেছি। বাবা আমাকে মাফ করে দাও।

বাবা আমার হাতটা থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চোখের জলটা মুছতে মুছতে বলল

– মারে সেই ছোট থেকে তোর মা আর আমি তোকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। কখনও অভাব বুঝতে দেইনি। তুই জন্ম নেওয়ার পর তোর মায়ের আর সন্তান হবে না ডাক্তার বলে দিয়েছিল। তোর মা মন খারাপ করে বলেছিল আমাদের কোনো ছেলে সন্তান নেই। আমি তোর মায়ের হাতটা ধরে বলেছিলাম আমার মেয়েই আমার ছেলে। আর সেই তুই এমন কাজ করলি আমার কলিজায় লাগছে রে মা। এমন আর কখনও করিস না। তোর কিছু হলে যে আমরা মরে যাব। আমাদের কথাও ভাবিস।

বাবার কথাগুলো যেন আমার বুকে বিঁধল। ১৬ বছরের ভালোবাসার কাছে এক মাসের ভালোবাসা এতই প্রখর হয়ে গেছিল যে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে আমি নীলকে ছাড়াও থাকার কথা ভাবতে পারি না। নীলকে ছাড়া থাকলে আমার বুকের ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগে। মনে হয় কী নেই কী নেই। তবে আমি বাবা, মাকেও ভীষণ ভালোবাসি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যত ঝড় আসুক না কেন আমি আর বিচ্যুত হব না। সবুর করব, অপেক্ষা করব তবুও বাবা,মাকে আর কষ্ট দিব না। এমন পদক্ষেপ আর নিব না। যে পদক্ষেপ সবাইকে কষ্ট দেয়। আর মৃত্যুর পরেই কী আমি শান্তি পেতাম? আমাদের ধর্মে যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে আত্মহননকারী কখনও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। সেখানে আমি কীভাবে এমন কাজ করলাম। যেখানে আমার জায়গা হত জাহান্নামে। হায় আল্লাহ আমি কী করতে যাচ্ছিলাম? মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বললাম যে আমার আল্লাহ আমায় দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে শুধরে নেওয়ার জন্য। নিজেকে বুঝালাম নিজেই। শরীরটা আবারও খারাপ লাগছে। চোখ মেলে বেশিক্ষণ আর তাকাতে পারলাম না। চোখটা বন্ধ করে ফেললাম।

চারপাশে বৃষ্টির সমাগম। মাতাল হাওয়া বইছে। বাতাসে জানালা বারবার ঝাঁপটা দিয়ে শব্দ করছে। নীলের হাসিটা কানে আসছে। প্রখর হাসি যেন আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। নীলের মুখটা এত মিষ্টি কেন সেটাই ভাবছি। নীলের কালো দুটো ঠোঁট যেন আমাকে টানছে তার দিকে তার চোখ দুটো আমাকে ডুবিয়ে দিতে চাচ্ছে নেশার অতল গহ্বরে। আমি হালকা হেসে নীলকে বলছি

– সিগারেট খেয়ে ঠোঁট এত কালো করলে কেন? আর কখনও সিগারেট খাবে না কেমন?

নীল খলখল করে হাসছে। নীলের হাসি কানে এসে ঝংকার তুলছে। দম ভারী হয়ে যাচ্ছে আমার। হাতটা বাড়িয়ে দিলাম নীলের দিকে। যতই হাত বাড়াচ্ছি ততই যেন সে দূরে সরে যাচ্ছে। একটা সময় দূরে যেতে যেতে কোথায় যেন সে মিলিয়ে গেল৷ নীলকে ধরার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু ধরতে পারছি না। আচমকা মনে হলো খুব উচু থেকে আমি নীচের দিকে আঁচড়ে পড়েছি। কেমন জানি অনুভূত হচ্ছে। একবার কথায় কথায় নীল বলেছিল ঘুমের মধ্যে এরকম হুট করে উপর থেকে পড়ে যাওয়ার বিষয়টা উপলব্ধ হয়ে যদি মনে হয় সেটা বাস্তব তাহলে সেটা একটা রোগ। অল্প বয়সীদের সাধারণত এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এ রোগের নাম হলো হিপনিক জার্ক। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটা বিলীন হয়ে যায়। এটা সাধারণত স্বপ্নে ঘটে থাকে। স্বপ্নে মনে হবে উচু জায়গা থেকে হুট করে আঁচড়ে পড়েছি আর সে স্বপ্ন বাস্তবে উপলব্ধ দিবে। আচ্ছা আমি এসব ভাবছি কেন। কেনই বা এত চিন্তা আমাকে গ্রাস করছে। হাত পা কেন কুঁকড়ে চলে আসছে। দম নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছি আমি।

শরীরটায় কোনো শক্তি পাচ্ছি না। নিঃশ্বাস টা ঝড়ের বেগে হামলা দিচ্ছে। ঘনঘন হয়ে বের হচ্ছে। কারও হাতের স্পর্শ পেলাম। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলছে।

– রোগীর অবস্থা ভালো না জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।

আরও কী কী যেন বলছিল। কথা গুলো আস্তে আস্তে মৃদু হয়ে আসলো। আমি শুধু নীলের কথা, নীলের হাসি,নীলের চোখ কল্পনা করছি। অনুভূতির সমস্ত জায়গা জোরেই যেন নীল। আচ্ছা আমার এত খারাপ লাগছে কেন? মনে হচ্ছে দম বের হয়ে যাচ্ছে। জানি না তারপর কী হলো। মনে হচ্ছে আমার জীবনের শেষ দিনের প্রহর চলে এসেছে। চারপাশে কান্নাকাাটির আওয়াজ শুনতে পারছি। কেউ একজন আমাকে ধরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায়? আর কিছু ভাবার অবকাশ পাচ্ছি না। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এবং যন্ত্রণা আমাকে গ্রাস করছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে প্রশ্বাস নিতে পারছি না। এত বাঁধা কোথা থেকে আসতেছে। বুকেই বা কেন এত ব্যথা করতেছে। চোখ,মাথা ব্যথায় ছেয়ে যাচ্ছে। আমি ক্রমশ ও দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। চারপাশের কোনো আওয়াজেই আমার কানে আসছে না। আস্তে আস্তে শরীর ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে গেল।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here