ডাক্তার সাহেব পর্ব-২৩
#শারমিন আঁচল নিপা

নীরবতার রেশ কাটে একটা অচেনা মেয়েলী কন্ঠসুরে। খানিকটা চমকে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বরফের মতো হিম হয়ে গেলাম। মিহু, কবিতা, তুর্য,সায়রান,শুভ্রা,সৌভিক,তনয়, তামান্না দাঁড়িয়ে আছে। চোখ আমার কপালে উঠে গেল। এরা এখানে আসলো কী করে। সব যেন এলোমেলো লাগছে। উত্তর মেলাতে পারছিলাম না। কিছু বলে উঠার আগেই জোরে চিৎকার কানে আসলো। সবাই এক জোট হয়ে বলে উঠল

– হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ৷

আমার বিস্ময়ের রেশ আরও বেড়ে গেল। আমার জন্মদিন আমিই ভুলে গিয়েছিলাম। প্রতিবছর মা এদিনে সকাল সকাল পায়েস রান্না করে দিত। মায়ের পায়েসের সুঘ্রাণেই মনে করিয়ে দিত আমার জন্মদিন। এবছর মা অসুস্থ থাকায় নিজের জন্মদিনের কথা বেমালুম ভুলে বসে ছিলাম। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথায় বের হচ্ছে না। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পরিকল্পনাটা কার বুঝতে পারছি না। নীরবতা আমাকে বেশ ভালোভাবেই গ্রাস করছে। আমিও নীরবতা কাটানোর চেষ্টা করিনি। মিহুর কথা শুনতে লাগলাম দাঁড়িয়ে।

– ভাইয়া এত দেরি কেন হলো? আপনারা তো বাইকে এসেছেন। আমাদের আগে চলে আসার কথা। সে কখন আমরা চলে এসেছি। আপনি যেভাবে প্ল্যান করেছিলেন সেভাবেই সব গুছিয়ে রেখেছি। পরে আপনার মেসেজ পেয়ে বুঝতে পারলাম আপনাদের আসতে দেরি হবে। ফোন দিলাম অনেকগুলো ধরলেন না।

নীলের মুগ্ধ কন্ঠসুরে উত্তর আসলো

– আরে ঝামেলায় পড়েছিলাম। সে কাহিনি পরেও বলা যাবে। তোমার বান্ধবীর মাথার তার তো কয়েকটা ছেড়া জানই। সারাদিন যা করেছে কী আর বলব। সহজ কাজগুলো জটিল করেছে। কেক নিয়ে এসেছো তো?

কবিতা চিৎকার করে বলে উঠল

– আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই সবটা করেছি। ঐ তো দূরে কেক সাজানো।

সবার কথোপকথনে বুঝতে পারলাম সারপ্রাইজ দেওয়ার পরিকল্পনাটা নীলেরেই ছিল। এমনভাবে সারপ্রাইজ পাব কল্পনাও করতে পারিনি। মায়ের অসুস্থতার জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম আজকে ২৭ সেপ্টেম্বর। এত কাহিনির সম্মুখীন হয়েছি যে নিজের জন্মদিনের কথাটা ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক না। এমন সময় নীল আমার চোখটা চেপে ধরল। আমি নীলের হাতটা ধরে বলতে লাগলাম

– আরে করছো কী? চোখ ছাড়ো।

তনয় আর সৌভিক উঁচু গলায় হাসতে হাসতে বলল

– সিঁথি তুই এত অস্থির কেন? তোকে তো আর ভাইয়া কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে না। চোখ যখন ধরেছে কারণ তো অবশ্যই আছে।

– তোরা ঠিক কী করছিস বলতো? মিহুর বাসা থেকে সকালে বের হলাম সেও কিছু বলল না। আমার থেকে তোদের কাছে নীল বেশি হয়ে গেল তাই না?

তুর্যের অট্ট হাসি কানে আসলো

– বললে কী আর এমন সারপ্রাইজ হতি? শুন.. আমরা তোর ফ্রেন্ড, তোকে খুশি করতে কেউ চাইলে বাঁধা দিব না কিন্তু কেউ কষ্ট দিলে অবশ্যই বাঁধা দিব। নীল ভাইয়া তো তোর হাসিমুখটায় দেখতে চেয়েছে সেখানে বাঁধা দিই কী করে।

সবার কথা শুনছিলাম আর অন্ধের মতো সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। মনের ভেতরটা প্রশান্তিময় হয়ে উঠল। কী জানি অপেক্ষা করছে জানি না। তবে ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে সেটাই বুঝতে পারছি। দিনকে দিন নীল আমার মনের সমস্ত জায়গা বিচরণ করে নিচ্ছে। এ জায়গাটা কখনও যেন খালি হয়ে না যায় সে চিন্তা করতেই মনে অজানা ভয়ও গ্রাস করে নেয় মাঝে মাঝে। একদিকে তার প্রতি অধিক ভালোবাসাও কাজ করে অপরদিকে তাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাও গ্রাস করে। এ দুটানা চিন্তা বেশ যন্ত্রণা দেয়। আমি থেমে গেলাম। নীল আমার চোখটা ছেড়ে দিল। সামনের দিকে তাকিয়ে আরও বেশি সারপ্রাইজ হলাম। পাশাপাশি দুটো নৌকা নদীর কিনারায় দাঁড় করানো। একটা নৌকার মেঝেটা সাদা আর লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো। ছাউনির এক পাশে থেকে অপর পাশ পর্যন্ত কয়েকটা ইংরেজি অক্ষর দিয়ে সাজিয়ে লেখা আছে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’। ফুলের মাঝখানে একটা কেক। নৌকার কার্ণিশটা বেলুন দিয়ে সাজানো। ছাউনির ভেতরটায় কী আছে দেখা যাচ্ছে না। আমি কোনো কথায় যেন বলতে পারছিলাম না। জীবনের প্রথম এরকমভাবে জন্মদিন উদযাপন হচ্ছে। চোখ দিয়ে গড়গড় করে অশ্রু ঝরছে। এ অশ্রুটা কষ্টের না আনন্দের। আবেগটা ধরে রাখতে পারিনি বলেই চোখ দিয়ে অশ্রু নামিয়ে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালাম। নীলকে কেন জানি না ঝাঁপটে ধরলাম। এমন সময় পার্টি স্প্রে এর আগমনে মনে হচ্ছিল তুলার মতো চারপাশে বরফ কণা উড়ছে। হ্যাপি বার্থ ডে টু সিঁথি ধ্বনিতে যেন চারপাশ মুখরিত। নীলও আমাকে জোরে ধরে বলতে লাগল

– আরে পাগলি কাঁদছো কেন? নিজেকে সামলাও।

– আমি কষ্টে কাঁদছি না। আমি ভাবতেও পারিনি কেউ কখনও আমাকে এভাবে সারপ্রাইজ দিবে। কতটা ভালো লাগছে বুঝাতে পারব না।

– সবকিছু আমাদের ভাবনার মধ্যে হয় না পাগলি। আমি চাইব সবসময় তোমাকে এরকম ভাবনার বাহিরের সুখগুলো খুঁজে দিতে। বৃদ্ধ হলেও তোমার প্রেমিক রোমন্টিক আছে।

– তোমাকে তো কখনও আমি বৃদ্ধ বলি না। সবসময় তোমায় আমি টগবগে যুবক বলি।

– তোমার বয়সের তুলনায় আমি বৃদ্ধ, বেমানান বটে। এবার আমাকে ছাড়ো। তোমার ফ্রেন্ড সার্কেল কী না কী ভাবছে। নিজেকে সামলাও।

নীলের কথায় নিজেকে সামলে তাকে ছেড়ে দিলাম। সাজানো নৌকায় আমি আর নীল উঠলাম আর পাশের নৌকাটায় আমার বন্ধুমহলের সবাই উঠল। কেকটা কেটে সবাইকে খাইয়ে দিলাম। দুজন মাঝি ততক্ষণে নৌকায় এসে হাজির হলো। দুটো নৌকা চলতে লাগল। আমি আর নীল এক নৌকায় অপর নৌকায় তারা। নৌকাটা মাঝ নদীতে আসতেই নীল ছাউনি তল থেকে একটা পাখির খাঁচা নিয়ে আসলো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– এ পায়রা নিয়ে এসেছো কেন?

– পায়রাটাকে মুক্ত করে দাও। ধরে নাও ভালোবাসার স্মৃতিস্বরূপ একটা বন্দি পাখিকে আমরা ডানা মেলে উড়তে দিয়েছি।

নৌকায় দাঁড়ালাম। পেছন থেকে সে আমাকে ধরে রেখেছে। পায়রাটা হাতে নিয়ে আকাশে ছেড়ে দিলাম। সথে সাথে আরও কতগুলো পায়রা যোগ হলো। পাশের নৌকা থেকে আমার বন্ধুমহলের সবাই আরও পায়রা মুক্ত করল। গ্যাস বেলুন গুলো উড়তে লাগল। নীল আমার হাতে একটা ফানুস ধরিয়ে দিল। ফানুসটাও অজানা গন্তব্যে উড়তে ছেড়ে দিলাম। সে আমাকে ধরে নৌকায় বসালো। নৌকায় বসে আকাশটার দিকে তাকালাম। পায়রা গুলো ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। ফানুসটা জ্বলতে জ্বলতে ছুটে চলেছে অচেনা শহরে। গ্যাস বেলুনগুলো গন্তব্যহীন হয়ে হেল দুল খাচ্ছে। এত মুখরিত পরিবেশ যেন মনটাকে শীতল করে দিল। এবার নীলের দিকে তাকালাম। সে আমার পা ‘টা টেনে তার হাঁটুর উপর রাখল। ততক্ষণেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না সে কী চাচ্ছে। বুঝে উঠার জন্য খুব বেশি অপেক্ষাও করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা রূপার পায়েল পায়ে পড়িয়ে দিল। তারপর আমার হাতটা ধরে চোখে চোখ রেখে বলল

– প্রতিজ্ঞা করছি সারাজীবন তোমার পাশে এভাবে থাকব। তোমার ছোট ছোট খুশি গুলোকে যত্ন করে রেখে দিব। তোমাকে কখনও কষ্ট পেতে দিব না। কষ্ট দিলেও চেষ্টা করব তোমার কষ্টটা কমিয়ে দিতে। তোমাকে আমি ভালোবাসি। বড্ড ভালোবাসি। সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই এভাবেই ভালোবাসতে চাই।

নীলের বুলিতে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছি কখন জানি না। চোখের নেশায় কখন ডুবে গিয়েছি জানি না। অকোপটে বলতে লাগলাম

– জানি না তোমায় এত ভালো কী করে বাসলাম। তোমার চোখে কেন আমি ডুবে যাই জানি না। তোমার মায়া কাটিয়ে উঠা বড় দায়। তোমাকে এত ভালোবাসি বলেই কী তোমাকে হারিয়ে ফেলার এত ভয় পাই। তুমি আমার অস্তিত্বের সমস্ত জায়গায় বিচরণ করছো। কখনও তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমি শুধু তোমাকে হারাব না বরং আমার অস্তিত্বটাকে বিলীন করে ফেলব। হয়তো সেদিন মরেই যাব।

নীল আমার মুখটা তার হাত দিয়ে চেপে ধরল। কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে জবাব দিল

– মরে যাওয়ার কথা একদম বলবে না। এ কথা ফের যদি বলেছো চাপায় একটা দাঁত ও থাকবে না। কষিয়ে চড় দিয়ে সব ফেলে দিব।

নীলের কথা শুনে হালকা হাসলাম। এ শাসন কষ্ট দেয় না। এ মিষ্টি শাসন আরও ভালোলাগার অনুভূতি দেয়। নীলের বুকে মাথাটা ঠেকিয়ে দিলাম। হাসতে হাসতে বললাম

– কখনও যদি হারিয়ে যাই কী করবে?

– খুঁজে নিব।

– মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে লুকিয়ে পড়ব আর তুমি আমাকে কীভাবে খুঁজো সেটা দেখব। তোমার অস্থিরতা আমি অবলোকন করব। তোমাকে মিষ্টি যন্ত্রণা দিব।

– লুকিয়ে থেকো হারিয়ে যেও না। তোমাকে হারালেও বড্ড কষ্ট আমার হবে। যন্ত্রণা আমাকে ঘিরে ধরবে। স্বাভাবিক কাজগুলো আমি করতে পারব না। তোমাকে হারানোর ভয় আমারও কাজ করে। তফাত এটাই তুমি সবসময় বলে প্রকাশ করো আমি করতে পারি না। এ বলদটা তো মনের অব্যক্ত কথাগুলোও বলতে পারে না সাজিয়ে।

– আমি এ বলদটাকে কথা বলা শিখিয়ে নিব।

– যখনই বলদ ডাকার সুযোগ পেলে হাত ছাড়া করলে না। কী অকোপটে নিজের ভবিষ্যত স্বামীকে গালি দিচ্ছ।

নীলের কথা শুনে আরও হেসে দিলাম। এখন মনে হচ্ছে নীল আমার বয়সে ছোট আমি তার বয়সে বড়। মাথাটা তার বুকে ঠেঁকিয়ে বললাম

– বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

কোনো এক চিৎকারের আওয়াজ আবারও কানে আসলো সে সাথে আরও বড় একটা সারপ্রাইজ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুখের কথাও যেন উড়ে গেল।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here