ডাক্তার সাহেব পর্ব-২০
#শারমিন আঁচল নিপা
ওপাশ থেকে যা উত্তর আসলো তা শুনে কলিজা কেঁপে উঠল।
– আমার হাজবেন্ডের নম্বরে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে আমি কে? আপনি কে এত রাতে ওকে কল করেছেন।
মেয়েটার কথাগুলো বেশ শক্ত এবং পাকাপোক্ত ছিল। আমার শরীর যেন কাঁপতে লাগল। কন্ঠে জড়তা এসে গেল। কী উত্তর দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মাথাটা একদম ভার হয়ে মনে হচ্ছিল চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। কোনোরকম কলটা কেটে মোবাইলটা বিছানার নীচে রাখলাম। মাথাটা বেশ গরম হয়ে গেছে। বমি বমিও লাগছে অনেক। কখন মাথা ঘুরে পরে যাই বলতে পারব না।
চোখটা যখন খুলি তখন নীল আমার পাশে। নানীর মুখটা অন্ধকার, মাও আমার রুমে চেয়ারের এক কোণে বসে আছে। মায়ের মুখটাও আবছা হয়ে আছে। আমার চোখের কার্ণিশে মেঘ জমেছে নীলকে দেখে। হাতটা তুলতে নিয়ে লক্ষ্য করলাম হাতে স্যালাইন দেওয়া। আমার চোখ খোলাতে যেন সবাই স্বস্তি পেল। নীল মাকে বলে উঠল
– আন্টি এবার গিয়ে আপনি বিশ্রাম করুন। এভাবে থাকাটা আপনার জন্য রিস্ক। সিঁথির জন্য চিন্তা করতে গিয়ে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। পরিবারের দুজনই অসুস্থ হয়ে গেলে হ্যান্ডেল করা মুশকিল হয়ে যাবে।
মা শুধু দম ছাড়ল। চেয়ার থেকে উঠে আমার মাথার কাছে আসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল কয়েকবার। তারপর উঠে পাশের রুমে চলে গেল। মায়ের এ চুপ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা প্রথম না, যখন বেশ চিন্তায় থাকে তখন মা কথা বলতে পারে না একদম চুপ হয়ে যায়। এখনও যে মায়ের চিন্তার পরিমাণটা অনেক উঁচু হয়ে আছে সেটা মায়ের এ আচরণটায় বলে দিচ্ছে। নীলের কন্ঠস্বরটা আবারও কানে আসলো।
– নানু সিঁথির জন্য খাবার নিয়ে আসুন।
– আমি এখনি আনতেছি।
বলেই নানু পাশ থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেল।এদিকে নীলের দিকে আমি তাকাতেই পারছিলাম না। যতই তাকাচ্ছিলাম ততই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল। ভাঙা গলায় বললাম
– তুমি এসেছো কেন? তোমার যে বউ আছে সেটা বলোনি কেন? এত বড় সত্যিটা কী করে লুকালে?
নীল আমার হাতটা ধরতে নিল, আমি হাতটা নীলের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম
– একদম হাত ধরবে না। অনেক হয়েছে। তোমার তামাশা দেখার জন্য আমি বসে নেই।
– আরে তুমি না জেনে এসব কী বলছো! ঐ মেয়ে আমার কলিগ তান্নি ছিল। একসাথে দুজনের ডিউটি ছিল রাতে। আমি রাউন্ডে গিয়েছিলাম। মোবাইলটা নীচে রেখে গিয়েছিলাম। তান্নি তোমার ব্যাপারে জানে। ও এমনি একটু মজা করেছে। তাই বলে তুমি যাচাই না করেই শরীরের এ অবস্থা করবে। তোমাকে নিয়ে আর পারলাম না। এরপর তোমাকে কতবার কল করা হয়েছে দেখেছো? দেখবেই বা কীভাবে এগুলো শুনে তো চিৎপটাং হয়ে গেছ। মজাও বুঝো না কেন? এত অবুঝ হলে চলবে?
– আমি অবুঝ জানো তারপরও কেন মজা করো। যে মজাগুলো আমি নিতে পারি না সেগুলোই কেন করো। আমি যেমন সেভাবেই সবাই মেনে নিয়েছে তুমিও মেনে নাও। না মেনে নিতে পারলে বাদ দাও জোর তো করা হচ্ছে না তোমায়। তবুও যে মজাগুলো আমি পছন্দ করি না যেগুলো করলে আমার কষ্ট হয় সেগুলো করতে যেও না।
– তান্নি বুঝতে পারে নি৷ সকাল বেলা তোমার মায়ের কাছে জানতে পারলাম তোমার জ্ঞান নেই। হন্তদন্ত হয়ে আসি। তান্নিই সামলাচ্ছে হাসপাতালের বাকি কাজ। সে ও অনুতপ্ত, বুঝতে পারেনি তোমার এমন কিছু হয়ে যাবে। তান্নির সাথে কথা বলবে তুমি? দাঁড়াও ওকে কল দিই।
বলেই নীল মোবাইলটা বের করে উনাকে কল দিলেন। মোবাইলটা আমার কানে ধরা হলো। ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দটা ভেসে আসলো। আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে উনার কথাগুলো ধেয়ে আসলো।
– এত বোকা কেন তুমি? আমি তো মজা করছিলাম। আর বলেও দিতাম তোমায়। হুট করে কল কেটে এমন অবস্থা করবে বুঝিনি। যদিও বাচ্চা মেয়ে। যাইহোক আমি তোমার বড় বোনের মতো। দোয়া করব সকল বাধা অতিক্রম করে তোমরা যেন একত্র হতে পারো।
ভাঙা গলায় জবাব দিলাম
– আমি বুঝতে পারিনি। আর ঐ সময় ঐ কথাটাও নিতে পারেনি। একদিন বাসায় আসবেন।
– সে তো তোমাকে দেখতে আসতেই হবে। নিজের যত্ন নিও।
– হুম।
কলটা কেটে গেল। নীলের দিকে তাকালাম। বারবার এ মানুষটাকে আমি অবিশ্বাসে মুড়িয়ে দূরে সরিয়ে দিই আর সে বারবার অবিশ্বাসটাকে বিশ্বাসের চাঁদরে মুড়িয়ে কাছে টেনে আনে। মুখের কোণে ইষৎ হাসি আমার। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছি তার দিকে। নীলের মুগ্ধকর কন্ঠ কানে আসলো।
– পরশু তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। আমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। আমার বোনও তোমার সাথে পড়ে। ওকেও তোমার কলেজে ভর্তি করিয়েছে। যদিও ও আর্টসে তবুও তো একসাথেই পড়ো। ওর সাথে পরিচয় করালে তোমার সময় ভালো কাটবে।
এর মধ্যেই নানু খাবার নিয়ে চলে আসলো। নীল আর কোনো কথা বাড়াল না। ঘড়ির কাটায় সকাল ৭ টা। নীল নানুমনির কাছে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। নানু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসতে হাসতে বলল
– এ বুড়া মনে হয় তোর প্রেমে পড়েছে।
আমি কপালটা কুঁচকে নানুর দিকে তাকিয়ে বললাম
– বুড়া বলছো কেন? উনি কী বুড়া? দেখতে তো এখনও টগবগে জোয়ান পোলা। বয়স হওয়ার সাথে সাথে তোমার চোখ ও গেছে নানু।
নানু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে জবান দিল
– তোর তো অনেক বড় হবে তাই বুড়া বললাম। তোর নানা আমার ১৫ বছরের বড় ছিল। মানুষটা আমার তুলনায় বুড়া হলেও আমারে ভালোবাসছিল। তোর নানা এত বড় হওয়ার পরও সবসময় আমার কাছে জোয়ান লাগত। কত সুন্দর আছিল তোর নানা৷ এখনও চোখে ভাসে। এ পোলাটার নাম কী রে বনু।
– নীল। কিন্তু হুট করে এ ডাক্তারের পেছনে লাগলে কেন?
– তুই বুঝবি না। পোলাডা তোরে ভালোবাসে তার চোখ বলে দিচ্ছে। বয়সের সাথে চোখের পাওয়ার কমলেও অভিজ্ঞতা কমেনি।
নানুর কথায় আমি চুপ হয়ে গেলাম। নানুকে তেমন উত্তর দিলাম না। এখন উত্তর দিতে গেলে হাজারটা গল্প শুনার বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে। তাই কথাখানা এড়িয়ে গিয়ে বললাম
– হয়েছে যাও তো এবার। আর কথা বাড়িও না। আমি একটু ঘুমাব।
নানু মুখটাকে কালো করে আমার পাশ থেকে উঠল। কী জানি বিড়বিড় করতে করতে মায়ের রুমে গেল। আমি এদিকে বিছানার নীচ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলাম ৫৬ টা মিসডকল আর প্রতিটা কলেই নীল দিয়েছে। নীলের প্রতি থাকা সব দুটানা যেন নিমিষেই মুছে গেল।
তার নম্বরে কল দিলাম। সে কলটা ধরেই এক রাশ হাসলো। তার হাসির শব্দ কানে আসতেই যেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। নম্র গলায় বলে উঠলাম
– সরি।
– সরি কেন?
– বারবার তোমাকে ভুল বুঝার জন্য।
– বারবার তুমি ভুল বুঝবে আর আমি তোমার ভুল ভাঙাব। তোমাকে আমার মতো করে গড়ে নিব। তা মহারাণী খাবার কি খাওয়া হয়েছে নাকি বিছানার পাশে নিয়েই শুয়ে আছো?
– খাব একটু পর।
– কথা রেখে এখন খাও। আর শরীর ভালো হলে কাল লুকিয়ে ঘুরতে নিয়ে যাব। সুতরাং ঘুরতে যেতে হলে শরীর ঠিক করতে হবে।
ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে যেন মন প্রফুল্ল হয়ে গেল। প্রস্ফুটিত গলায় বলে উঠলাম
– আমি এখনি খাচ্ছি। কিন্তু কাল কখন যাবে। আর কাল কী তোমার ডিউটি নেই?
– হুম….না। কাল ফ্রি একদম। তোমার কলেজ যেন কয়টা থেকে কয়টা?
– সকাল ৯ টা থেকে ৩ টা।
– তাহলে কাল সকাল ৯ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত বাইক দিয়ে ঘুরব।
– কিন্তু কেউ দেখলে তো বাবা, মা কে বলে দিবে , আমি যাব কী করে?
– তোমার বি এফ আছে কী জন্য? আমিই সব ব্যবস্থা করে নিব। তুমি নিশ্চিন্তায় খাও আর ঘুমাও। শরীর ঠিক না করলে কিন্তু ঘুরতে নিয়ে যাব না।
– আচ্ছা আচ্ছা…রাখলাম।
কলটা কেটে দিলাম। বেশ আনন্দ নিয়েই খাবার গুলো খেলাম।
অলস সময়টা টুংটাং করে পার হয়ে গেল। রাতের আকাশে গোলাকার প্রশস্ত চাঁদ। বিছানায় শুয়েই জানালা দিয়ে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ অন্ধকার রাজ্যটাও এ আভায় বেশ আলোকিত। নীলের কথা মনে পড়ছে অনেক। এখন পাশে থাকলে নীলকে নিয়ে ছাদে উঠতাম। দুজন হাতে হাত রেখে ছাদে বারকয়েক পায়চারি করতাম। ছাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের চাঁদটা উপভোগ করতাম। মাঝে মাঝে চোখটা বন্ধ করে দিতাম আর নীল সে চোখে ঠোঁট ছোয়াতো। আমাদের ছাদে একটা দোলনা আছে এ চাঁদের আলোয় সে দোলনায় বসতাম। নীল অবাধ্য হয়ে আমার কোলে মাথা রাখত। আমি তার মাথাটা হাত বুলিয়ে দিতাম। সে চোখটা বন্ধ করত আর তখনি তার কপালে আমার ঠোঁট ছোয়াতাম। কী অদ্ভুত অনুভূতি বিচরণ করছে মনে। ভাবলেই যেন দম ভারী হয়ে যাচ্ছে। চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। নীলের মসৃণ মুখ অবয়বটা চোখে ভেসে আসলো। নীলকে খুব কাছে অনুভব করছি। মনে হচ্ছে সে আমার একদম কাছে। এমন সময় মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠল। অবচেতন মনেই চোখটা খুললাম। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম নীল কল করেছে। কলটা ধরতেই বলল
– আজকের চাঁদটা কী দেখেছো?
– হুম..
– আজকে বছরের সবচেয়ে বড় চাঁদ উঠেছে। এ মুহুর্তে তুমি কাছে থাকলে অনেক ভালো হত। তোমাকে অনেক মিস করতেছি। এ দূরত্ব যেন ভালোবাসাটাকে আরও প্রবল করে তাড়া করছে।
নীলের কথা শুনে আরও গলে গেলাম। অনুভূতির শেষ সীমায় চলে গেলাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বললাম
– বাসার নীচে আসো তোমাকে একটু দেখি।
– প্রিয়তম আজকে আর আসা যাবে না। গাল ফুলিয়ে থেকো না। আজকে হাসপাতালের সব কাজ সারতে হবে। কাল তো দেখা হচ্ছেই।
– আচ্ছা তোমার ইচ্ছা।
– এখন রাখতে হচ্ছে। কারণ বেশি কথা বলারও সময় নেই।
– ওকে।
কলটা কেটে গেল। আনমনা লাগছে ভীষণ। পরক্ষণেই একটা মেসেজ আসার শব্দ আসলো। মেসেজটা ওপেন করলাম।
“প্রিয়তম ধরে নাও আমি তোমার ভীষণ সন্নিকটে। তোমার হাতটা ছুইয়ে আছি। মুষ্টি করে তোমার হাতটা ধরে আমার বুকে চেপে রেখেছি আর সহস্রবার তোমাকে বলছি ” ভালোবাসি তোমায়”। চোখটা বন্ধ করে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে যাও।”
নীলের কথাটা শুনেই চোখটা বন্ধ করে নিলাম। কল্পনার জগতে নীল আর আমি। সে জগতে বিচরণ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম জানি না। সাকাল সাতটায় ঘুম ভাঙল।
ঘুম থেকে উঠেই নীলকে কল দিলাম। সে কল ধরেই বলতে লাগল
– হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও। তোমার বাসার গেইটের এক কোণে দেখো একটা ব্যাগ রাখা আছে। ব্যাগে একটা কালো বোরকা আছে। সেটা পরে তৈরী হয়ে নাও। এমন ভাবে মুখ আটকাবে যেন তোমাকে চেনা না যায়। তারপর রিকশা নিয়ে তোমার কোচিং এর পেছনে ফাঁকা জায়গায় চলে আসবে। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।
নীলের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিস্ময় কন্ঠে বললাম
– বোরকা কখন রেখে গেলে?
– তুমি তখন ঘুমুচ্ছিলে তাই তোমাকে কল দিইনি। কারণ আমি জানতাম এ সময় তোমার ঘুম এমনিই ভাঙবে। এখন যা বলছি তাই করো। আর এমন ভাবে বোরকা পরো যাতে পরিবারের কেউ বুঝতে না পারে।
– সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। মিহুর বাসায় গিয়েও বোরকা পরা যাবে।
– আচ্ছা। যেখানে বলেছি সেখানে এসে আমাকে কল দিও।
কলটা কেটে আমি শুয়া থেকে উঠলাম। তাড়াহুড়ো করে গেইটের সামনে থেকে বোরকাটা নিলাম। ফ্রেশ হয়ে কলেজ ড্রেস পরে নিলাম। মা আর নানু অনেক বারণ করল আজকে কলেজ যেতে কিন্তু আমি তো নাছোরবান্দা। আজকে তো আমাকে কলেজ যেতেই হবে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের কথা বলে বের হয়ে গেলাম । বাসা থেকে বের হয়ে মিহুর বাসায় চলে আসলাম। সেখানে এসেই বোরকাটা পরে নিলাম। বোরকাটা পরে মিহুর বাসা থেকে বের হতে যাব এমন সময় মিহু চেঁচিয়ে উঠল।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)