ডাক্তার সাহেব পর্ব-১৯
#শারমিন আঁচল নিপা
পেছন ফিরে তাকিয়ে রিদির কান্ড দেখে ভড়কে গেলাম। রিদি আমার মোবাইলটা হাতে নিয়ে হেলদুল খাচ্ছে। কিছুটা বিস্মিত হলাম তার আচরণে। বিস্ময়ের রেশটা মুখ থেকে না কাটতেই সে মোবাইলটা মেঝেতে আছাড় মারল। আমার ভাবান্তর ঘটার পূর্বেই চেঁচিয়ে উঠলাম।
– তুই আমার মোবাইলটা ভেঙে দিলি কেন? কী করেছি তোর? আমার সাথে এমন কেন করছিস? তোর তো কোনো ক্ষতি আমি কখনও করিনি। তাহলে এমন কেন করছিস আমার সাথে?
রিদির বজ্র কন্ঠ কানে আসলো।
– এ মোবাইলেই তোকে নষ্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সিঁথি আমি তোর বোন তোর ক্ষতি আমি চাইব না। নীলকে আমার মোটেও সুবিধার লাগছে না। তোর কার্যক্রম আমার রাগটা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই মোবাইলটা রাগের বশেই ভেঙে দিয়েছি। আর আজকে আমি চলে যাব। নানুমনি আসার আগেই চলে যাব৷ খালামনি অসুস্থ তাই তোর ব্যপারটা উনার কান পর্যন্ত নিলাম না। যা করছিস চরম খারাপ হচ্ছে এটাই মনে রাখিস।
– তাই বলে তুই আমার মোবাইল ভেঙে দিবি। মোবাইল কী দোষ করছিল? আমাকে এখন বাবা নতুন মোবাইলও কিনে দিবে না। এমন কেন করলি?
রিদির মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। ব্যাগ পত্র নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। আমি শুধু বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মেঝেতে আমার ভাঙা মোবাইলটার অংশবিশেষ পড়ে আছে। কভার এক জায়গায় সিম আরেক জায়গায়। দামী কোনো মোবাইল না হলেও এটার প্রতি আমার মায়া প্রবল। বাটনগুলো এদিক ওদিক ছুটে গেছে। বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। নীলের সাথে কীভাবে কথা বলব ভেবেও বুকে কষ্টের তাণ কম্পন দিচ্ছে। বুকের ভেতরটা বেশ খছখছ করছে৷ নিজেকে সামলে নিলাম। ভাঙা অংশ গুলো একত্র করে জোরা লাগানোর কাজে লেগে পড়লাম। জোরা লাগাতে সক্ষম হলেও মোবাইলটা ওপেন আর করতে পারলাম না। চোখ দিয়ে গড় গড় করে পানি পড়ছে। দৌড়ে মায়ের রুমে গেলাম। মায়ের রুমে যেতেই প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম
– কী রে… রিদি এভাবে চলে গেল কেন? তোর সাথে কী ঝগড়া হয়েছে?
মায়ের প্রশ্নের কী জবাব দিব বুঝতে পারছিলাম না। মুখটা স্বাভাবিক করে হালকা গলায় বললাম
– আমি জানি না কেন চলে গেছে। ওর নাকি কাজ আছে বলল।
– অনীল কী চলে গেছে?
– সে তো কখনই গেছে৷
– তোর হাতে কী?
মায়ের প্রশ্নটা শুনতেই আমার কলিজায় কষ্টটা যেন আবারও তাজা হয়ে গেল। নীচু গলায় বললাম
– আমার মোবাইল হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। নষ্টও হয়ে গেছে।
– কীভাবে পড়ল?
– আচমকা হাত থেকে পড়ে গেছে। মা আরেকটা মোবাইল কী কিনে দিবে?
– এখন মোবাইল কেনার জন্য কী বাড়তি টাকা আছে নাকি বাবু। এখন তো আমার পেছনে তোর বাবার কতগুলো টাকা গেল। মাস দুয়েক পর একটা মোবাইল কিনে দিবনে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর তোর তো মোবাইলের বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। এত আপসেট হওয়ার কারণ দেখছি না।
– হুম।
শব্দটা উচ্চারণ করেই চলে আসলাম আমার রুমে। মা তো আর জানে না এ মোবাইলটা এখন আমার কত দরকার। নতুন মোবাইল পেতেও মাস দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। আর মায়ের মোবাইলটাও সবসময় আমাকে দিয়ে রাখবে না। রাতে কীভাবে কথা বলব সে চিন্তায় মগ্ন আমি৷ আবারও মায়ের রুমে গেলাম। মায়ের মোবাইলটা নিয়ে নীলের নম্বরটায় কল দিলাম। ওপাশ থকে সুমুধুর কন্ঠ ভেসে আসলো।
– আসছালামুআলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?
আমি সুতীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দিলাম
– আমি তোমার আন্টির মেয়ে।
উচ্ছাসিত কন্ঠে জবাব আসলো।
– তোমার মোবাইল বন্ধ কেন? কয়েকবার কল দিলাম বন্ধ দেখাচ্ছে। চার্জ নেই নাকি?
– মোবাইলটা ভেঙে গেছে।
– কীভাবে?
– রিদি ভেঙে দিছে।
– মানে?
বিস্ময় নিয়ে নীল বলে উঠল। এদিকে মুখটা আমার শুকিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় উত্তর দিলাম
– রিদি ভেঙে দিয়েছে। কেন ভেঙে দিয়েছে সেটা তো বুঝতেই পারছো। আজকে থেকে আর রাতে কথা হবে না। মায়ের ফোন নিয়ে কথা বললে বিপাকে পড়তে হবে। ২,৩ মাস আমাদের রাতে কথা হবে না। রাখলাম… মা এখনই ফোনের জন্য ডাক দিবে। পরে সুযোগ পেলে কল দিব। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে৷
বলেই কলটা কেটে দিলাম। সকাল গড়িয়ে বিকেল হলো। আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ মেঘ জমেছে। নীল আকাশের উপরে কালো মেঘের আস্তরণটা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে জোরে বর্ষণ পড়বে। চারপাশ ক্রমশেই কালো হয়ে আবারও পরিষ্কার হলো। এ আকাশটাও হয়তো দুটানায় আছে বৃষ্টি হয়ে নামবে নাকি আলোকিত হয়ে নিজেকে তুলে ধরবে। দরজায় খটখট আওয়াজের শব্দ পেলাম। বিশাল আকাশ থেকে চোখটা নামিয়ে দরজার দিকে দৌড় লাগালাম। দরজা খুলতেই নানুমনির হাস্যজ্জল মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
– কী রে কেমন আছিস? মন খারাপ নাকি? মুখ এত গোমরা কেন?
– তুমি যে হারে প্রশ্ন করছো আমি কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিব বলো তো। আগে ঘরে ঢুকো। তা এখানে দিয়ে গেল কে তোমায়? একা এসেছো নাকি।
– তোর মামা গাড়িতে তুলে দিছে। একাই আসতে পারি এখন। আমার মেয়ের খবর কী। যত্ন নিতেছিস তো ঠিক করে।
– নাহ, তোমার মেয়েকে আমি অযত্নে রেখেছি। কথা রেখে ঘরে ঢুকো তো। তোমার একটা বদঅভ্যাস প্যাচাল পারা। প্যাচালা পারা ছাড়া তুমি থাকতে পারো না।
আমার কথাটা শুনে নানু মুখটা গোমরা করে ফেলল। তেমন কোনো উত্তর না দিয়েই ঘরে চলে আসলো। মায়ের কাছে গিয়ে হাজারটা কথা জুড়ে দিল। নানা মারা গেছে বছরখানেক আগে। এরপর থেকে নানুমনির একাকীত্বের সঙ্গী হওয়ার মতো কেউ নেই। তাই যখন যাকে সামনে পায় তার সাথেই কথা জুড়ে দেয়। শেষ বয়সটা হয়তো এমনই।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। সাঁঝের আকাশে রক্তিম সূর্যটা লাল হয়ে ডুবছে। চারপাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সূর্য ডুবার পরও লালের আভাটা ছড়িয়ে আছে এখনও। পাখি গুলো কিচিরমিচির করে নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ প্রখর হচ্ছে। অন্ধকারে চারদিক যেন ডুবে গিয়েছে। মফস্বলে সন্ধ্যার পর বেশ নীরব হয়ে যায়। নীলের সাথে সকালের পর আর কথা হয়নি। নিঃসঙ্গতার সুর বাজছে বুকের ভেতর। মনে হচ্ছে আমি ভীষণ একা। খাটে বসে দেয়ালে মাথাটা হেলিয়ে দিয়েছি। দরজার কড়াটা নড়ে উঠল। ভেতর থেকে নানুমনি বলে উঠল
– সিঁথি দেখ তো কে এসেছে।
আমি খাট থেকে নেমে দরজা খুললাম। বুকের ভেতরটায় আচমকা নড়ে উঠল নীলের প্রশস্ত হাসি দেখে। সকল একাকীত্ব যেন তাকে দেখে ঘুচে গেল। মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। মুখে বাঁকা চাঁদের মতো হাসির রেখা টেনে বললাম
– তুমি আসবে সকালে বললে না তো।
– সকালে তো ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় সময় পাব না। এখন সময় পেলাম চলে আসলাম। আর তোমার তো মোবাইল নেই যে কল দিয়ে আগে জানিয়ে দিব।
ভেতর থেকে নানুমনি আবারও চেঁচিয়ে বলল
– সিঁথি কে এসেছে?
আমার কন্ঠটাকে জরো করে বললাম
– নানুমনি তুমি চিনবে না। মা কে দেখতে ডাক্তার এসেছে। তুমি মায়ের পাশে বসো আমি উনাকে নিয়ে আসতেছি।
কথাটা শেষ করেই নীলের দিকে তাকালাম। ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম
– খুব বেশি কথা হয়তো হবে না। ভুলে যেও না কেমন।
নীল আমার হাত থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে একটা বক্স হাতে দিয়ে বলল
– সিমটা ভরে নিও৷
আমি বক্সটা লক্ষ্য করে দেখলাম একটা মোবাইলের বক্স। মুখে আমার হাসি ফুটে উঠল। গলাটা স্থিত করে বললাম
– কখন কিনেছো। কিন্তু মা জিজ্ঞেস করলে কী বলব।
– লুকিয়ে ব্যবহার করো। যখন তোমার মা কিনে দিবে তখন এটা আমাকে দিয়ে দিও। কথা মিস যাবে না প্রিয়তমা। যাই তোমার মাকে দেখে আসি। এখানে বেশি সময় কাটালে সন্দেহের দৃষ্টিতে চলে যাব।
চাপা সুরে বলে উঠলাম
– আচ্ছা।
নীল মাকে দেখতে মায়ের ঘরে গেল। নানুমনির সাথে যেন কী বকবক করছে। আমার ঘর থেকে সবগুলো কথা স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে না। আমি সে কথায় ততটা মনেযোগও দিলাম না। মেবাইলটার বক্স খুললাম। লাল কভারের একটা মোবাইল। হয়তো নতুন এসেছে। মোবাইলে ঝটপট সিম লাগিয়ে নিলাম। সিমটা লাগিয়েই পাশের রুম থেকে নীলকে কল দিলাম নীল কলটা কেটে দিল।
রাত তখন ৯ টা। নানুনমনির বকবক শুনে হয়তো নীল এতক্ষণে কপোকাত। বেশ জোর করেই বিদায় নিল। দরজার কাছে এসে বলল
– সিঁথি দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যাও।
আমি আমার রুম থেকে বের হয়ে হাসতে হাসতে বললাম
– এতক্ষণ কী এমন কথা বলছিলে?
– আর বলো না তোমার নানু তোমার নানার গল্প জুড়ে দিয়েছে, কোনোরকম নিজেকে বাঁচিয়ে বের হলাম। যে অবস্থায় ছিলাম মনে হচ্ছিল রাত শেষ হয়ে যাবে গল্প শেষ হবে না। আর তুমিও তো একবার ঐ রুমে গেলে না।
– পাগল না আমি। সেখানে আমি গেলে তোমার কান আরও পচে যেত। তাই ইচ্ছা করেই যাইনি। নাস্তাও দেইনি তোমায় কারণ এতে নানুর গল্পের হাট আরও জমে যেত।
– যা করেছো ভালো করেছো। আমাকে কল দিও ১১ টার পর।
– হুম।
নীল জুতাটা পড়তে লাগল। আচমকা গালে তার ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বলল
– গেলাম আমি।
তার শীতল স্পর্শে যেন আমি শান্ত হয়ে গেলাম। বুকের ভেতরটায় কেমন জানি অনুভূতি বিরাজ করল। এ অনুভূতি প্রকাশ করা ভীষণ কঠিন। মিনিট পাঁচেক এভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের সত্ত্বা যেন এ ৫ মিনিটে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। নিজের সত্ত্বার অস্তিত্ব যখন টের পেলাম তখন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে দরজাটা লাগালাম।
রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে আসলাম। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নীলকে কল দিলাম। কলের ওপাশ থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ ভেসে আসলো। কন্ঠটা কেনো অল্প বয়সী মেয়েরেই হবে। আমার বুকের ভেতরটা ছেদ করে উঠল। এত রাতে নীলের মোবাইল কার কাছে এটা চিন্তা করে। হালকা গলায় বলে উঠলাম
– আপনি কে?
ওপাশ থেকে যা উত্তর আসলো তা শুনে কলিজা কেঁপে উঠল।
চলবে?
(কপি করা নিষেধ)