ডাক্তার সাহেব পর্ব-১৩
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা

সে ঠোঁটটা এগিয়ে দিয়ে আমার কানের কাছে এসে যা বলল তা শুনে আমার শরীরটায় নতুন মাত্রায় রক্তচড়া অনুভূতির জ্বালা ধরে গেল।

– তোমার দাঁতগুলো যে কোদালের মতো কখনও কী লক্ষ্য করেছো আয়নায়? এ কোদালের মতো দাঁত দিয়ে আমার ঠোঁটে খাবলা বসাতে লজ্জা লাগেনি! ছিহ…ছিহ… লাজ সরম কী সব গুলিয়ে খেয়েছো? দিন কে দিন কী থেকে কী হচ্ছ? আমি যদি দাঁতের ডাক্তার হতাম তাহলে তোমার দাঁতগুলো সার্জারি করে কোদাল আকার থেকে কুড়াল আকারে আনতাম। ঠোঁটের চারপাশ এখনও ব্যথায় টনটন করছে। আর দুপুরে কী বিরিয়ানি খেয়েছিলে নাকি? মুখ থেকে বিরিয়ানির গন্ধ আসছিল। ছিহ….ছিহ…. ঠিকঠাক মতো খাওয়া দাওয়া করে মুখও ধুও না। তার উপর আরেকজনের ঠোঁটের উপর খাবলা বসাও। কী গিদররে বাবা…। আচ্ছা তুমি কী গোসল ঠিক করে করো নাকি সেটাও দু একদিন পর পর করো? কাল থেকে একই জামা পরে আছো। তোমাকে কত পরিষ্কার ভাবতাম সে তুমি কী না এত গিদর। আর শুনো মেয়ে হুটহাট এ কোদালের মতো দাঁত নিয়ে খাবলা বসাবা না আমার ঠোঁটে। নিজেকে সামলাও। মাথার তার ছুটে গেলে বলো তোমার বাবাকে বলে পাবনার টিকেট কেটে আনি।

নীলের কথা শুনে শরীরটা রাগে গজগজ করতে লাগল। রক্ত যেন মাথায় চড়ে বসল। আমার দাঁত কোদালের মতো? দাঁত নাহয় একটু বড়ই তাই বলে কোদালের মতো? নীলকে ধরে জোরে ধাক্কা দিয়ে পেছন দিকে ফেলে বললাম

– দুপুরে আমি শুটকি দিয়ে ভাত খেয়েছি। হুদাই মানুষকে পঁচাতে ভালো লাগে তাই না? কোদালের মতো দাঁত মানে কী? এ দাঁতের অনেক গুণ সেটা তুমি বুঝবে কী করে। সে ঘিলু তোমার নেই। আর হাসপাতালে প্রতিদিন গোসল করার পরিবেশ থাকে না এটা সবার জানা। তবে সারা শরীরে সুগন্ধি মাখানো সেটা কী নাকে যাইনি! জীবনে অনেক বেদ্দব দেখেছি তোমার মতো বেদ্দব পোলা দেখিনি। কীভাবে প্রেমিকার প্রশংসা করতে হয় তাই তো জানো না। আসছে প্রেম করতে।

– বয়সে তোমার ১২ বছরের বড় আমাকে বেয়াদব বলো সাহস তো কম না। তোমার বাবার কাছে বিষয়টা বলতে হবে।

আমি মুখটা কাচুমাচু করে বললাম

– বাবাকে এখানে আনতে হবে কেন? আমরা আমরাইতো। বাবার কথা বাদ দাও। কথায় কথায় বাবা, বাবা করবে না। অনেক রাগ উঠে যায়। শুধু শুধু রাগ তুলো।

নীল হালকা হাসলো। তার হাসির দিকে তাকিয়ে যেন আমি চুপ হয়ে গেলাম। এ হাসি যেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। নীল তো কোনো হিরো না, দেখতেও হিরোর মতো না। তবুও কেন তাকে ভালো লাগে। তবুও কেন তার স্পর্শ পেতে আমার ব্যাকুল মনটা আকুল হয়ে থাকে। তার প্রতি থাকা সবটা অভিমান কেনই বা চলে যায় তার হাসি দেখে। যতবার সে হাসে ততবার কেনইবা কারণে অকারণে তার হাসিতে আমি ডুবে যাই। আমার ভেতরে তার জন্য ঢিপঢিপ করে। মনে হয় এই আলো নিভছে, এই আলো জ্বলছে। আলো জ্বলা নিভার এ পরিক্রমাটা অনেকটা বিদুৎ চমকানোর মতো। আমি নীলের দিকে তাকিয়ে আছি। তার হাসির রেশ এখনও কাটেনি। রেশটা তার মুখে বরাবরেই অনেকক্ষণ স্থায়ী হয়। বিষয়টা অন্য কারও চক্ষুগোচর না হলেও আমার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। রেশটাকে বিস্তৃত করে বলল

– প্রিয়সী এত রাগ বা এত আবেগ ভালো না। আস্তে ধীরে হাঁটো। ভালোবাসাকে সুন্দর করে উপভোগ করো। এত তাড়াহুড়ো করলে থুবরে পড়বে। নিজের অস্তিত্ব কখন যে বিলীন হয়ে যাবে বুঝতে পারবে না। নিজেকে নিয়ে ভাবো। নিজের ভাবনায় অন্য কাউকে এত পরিমাণ আনবে না যেটাতে তোমার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যহত হয়। তোমার স্বাভাবিক আচরণ বদলে যায়। এবার একটা সত্যি কথা বলব?

আমি হালকা হালকা দম ছেড়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম

– বলো।

– তোমাকে সত্যিই অনেক মায়াবী লাগে। তোমার এ চোখ আমাকে ভীষণ ভাবে টানে। তোমার এ চোখের মায়ায় ডুবে যেতে মন চায়। তবে বয়সের ভারে সে পাগলামিটা তোমার মতো করতে পারি না। মনে ইচ্ছা জাগে আমি যদি সেই ২১ বছরের টগবগে যুবক হতাম তাহলে তোমাকে আঁকড়ে নিজের করে দখল করে নিতাম। মাঝে মাঝে মানুষ গাজার নেশায় মাতাল হয় না, কারও চোখের নেশাতেই তার মাতাল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। তোমার চুলগুলো যখন সামনে এসে পড়ে তখন আমার ঠোঁটের স্পর্শে তোমার চুল গুলো সরিয়ে দিতে মন চায়। কিন্তু তফাৎ টা কোথায় জানো?

বলেই নীল চুপ হয়ে গেল। নীলের এ নিস্তবতায় যেন আবেগের অতল সাগরে তলিয়ে যাওয়া থেকে হুট করে ভেসে উঠলাম। হালকা গলায় জবাব দিলাম

– কী?

– তফাৎ টা হচ্ছে তুমি চাইলেই পাগলামি করতে পারো আমি পারি না। তোমার বয়স যখন ২০ পার হবে তখন এ কথা গুলো মনে হয়ে হাসবে তুমি। তখন তোমার জীবনে হয়তো আমি থাকব, হয়তো না। যদি তোমার জীবনে না থাকি তাহলে এ কথা গুলো মনে করে আমাকে স্মরণ করবে। আমি চাই তুমি ধীর, স্থির হও। এ বয়সটা অনেক খারাপ। তুমি যেটাকে ভালোবাসা বলে দাবি করছো সত্যি বলতে সেটা আবেগ ছাড়া কিছুই না। যদিও এ কথাগুলো তোমাকে হাজার বার বললেও মানবে না বা বুঝবে না। তাই বলছিও না। তোমার পাগলামি গুলোই তোমার কাছে নিয়ে আসে আমাকে। এ পাগলামিগুলো যেন আজীবন তোমার মাঝে থাকে। সময়ের সাথে যেন হারিয়ে না যায়। ধীর স্থির হলেও যেন এ পাগলামি সুপ্ত অবস্থায় তোমার মাঝে বিরাজমান থাকে সেটাই চাই। এই পাগলামিগুলো যেন নির্দিষ্ট কারও জন্য বরাদ্দ থাকে সেটা চাই৷

নীল চুপ। আর আমি নীলের দিকে অকোপটে তাকিয়ে আছি। চোখটা তার চোখ থেকে সরাতে পারছি না। নীল যতই বলুক এটা আমার আবেগ তবে আমি জানি নীলকে কতটা ভালোবাসি আমি। যদি ভালো না বাসতাম নীলের ঐ চোখে ডুবে থাকতে পারতাম না। নীল তার হাত দিয়ে আমার চোখের সামনে হাতটা নাড়িয়ে বলল

– সিঁথি রাণী এভাবে তাকিয়ে থেকো না। এভাবে তাকালে এ বৃদ্ধের যে তরুণ হতে মন চায়।

আমি মৃদু হেসে বললাম

– তরুণ হতে কে মানা করছে? তরুণ হয়ে যাও না!আমার দিকে তাকিয়ে সহস্র যুগ পার করে দাও। আমাকে ভালোবেসে সব উজার করে দাও। আমি তোমাকে ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরতে চাই।

নীল এবার অট্ট হেসে বলল

– সার্টিফিকেটে বয়স কত? ১৬ হয়েছে?

– হুম হয়েছে।

– তাহলে আরেকটু বড় হও। বিয়ের বয়সটা আরেকটু হোক। এখনেই এসব হাবিজাবি চিন্তা করে আবার খাবলা বসিয়ে দিও না।

কপাল ভাঁজ করে উত্তর দিলাম

– বারবার খাবলা খাবলা করবা না। আমি ইচ্ছে করে এমন করেনি। তুমি আমাকে উস্কে দিয়েছিলে তাই করেছি।

– হ্যাঁ। এখন যতদোষ নন্দঘোষ। বরং এটা বলো যে তুমি তোমার লাজ সরম গিলে খেয়েছো তাই এমনটা করেছো। তা ‘না হলে একটা বিবাহ যোগ্য অবিবাহিত পুরুষের ঠোঁটে কেউ খাবলা বসায়? নেহাতেই বড় অন্যায় করেছো। এসব আর করবে না।

– করলে কী করবে?

– তা জানি না। তবে উচিত না।

– এত উচিত অনুচিত ভাবতে চাই না।

বলেই নীলের কাছে গেলাম। নীল একটু পিছিয়ে বলল

– ছেড়ে দে সিঁথি আর এগুস না। তুই আমার ঠোঁট পাবি কিন্তু ঠোঁটের ভালোবাসা পাবি না।

কথাটা শুনে আমি পিছিয়ে গেলাম। পেট ফেটে হাসি আসলো। মুখটা চেপে হাসতে লাগলাম। এমন সময় কেবিনের দরজাটায় ধাক্কার শব্দ আসলো। বুঝতে পারছিলাম বাবা এসেছে। নীল ঝটপট উঠে চেয়ারে গিয়ে বসলো। আমি নিজেকে সামলে দরজাটা খুললাম। আমার ধারণা মিথ্যা না, বাবায় এসেছে। বাবা আমার দিকে এক ব্যাগ ফল এগিয়ে দিয়ে বলল

– নীলের জন্য কেটে আনো তো।

তারপর নীলের পাশে বসলো। বাবার আওয়াজ পেয়ে রিদি ঘুম থেকে উঠে মায়ের পাশেই বসলো। মুখে হাই তুলতে তুলতে বলল

– খালু কখন এসেছেন?

– মত্রই।

আমি ফলগুলো ধুয়ে ছুরি দিয়ে ফল কাটতে লাগলাম। বাবা নীলের সামনের চেয়ারটায় বসলো। নীলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল

– তোমার ঠোঁট এত লাল হয়ে আছে কেন? ঠোঁটে কী হয়েছে?

বাবার প্রশ্ন শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল। নীলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে নিশ্চুপ। বাবা দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করলো। রিদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও চুপ। রিদির মুখ অবয়ব দেখে বুঝতে পারছিলাম সে বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরেছে। আমি চুপ হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। হার্টবিট যেন দ্রূতগতিতে বাড়তে লাগল। নীলের দিকে তাকিয়ে রইলাম তার জবাবের আশায়। নীলের ঠোঁট নড়ে উঠল। সে বাবাকে বলল….

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here