ডাক্তার সাহেব পর্ব- ১
#শারমিন আঁচল নিপা
ডাক্তারের সাথে প্রেম করার মূখ্য উদ্দেশ্য নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম কলেজ ফাঁকি দিয়ে। রোজকার মতো কলেজ ক্যাম্পাসে বসেই আড্ডা দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে এক ফ্রেন্ড বলে উঠল হাসপাতালে অনেক ইয়ং ডাক্তার যোগদান করেছে তাদের কাউকে পটাতে পারলে ১ হাজার টাকা দিবে। টাকাটা মূখ্য বিষয় ছিল না। বাজিটা জিতায় মূখ্য বিষয় ছিল। আমি কেন জানি না হুট করে বলে উঠলাম ইহা কোনো ব্যপারেই না।
আমার বাণী শুনে আমার বন্ধু মহল বলে উঠল দেখা যাবে কতদূর পারিস। আমি চ্যালেন্জ ছুরে দিয়ে বললাম আমার দ্বারা অসম্ভব কিছু না। বয়স তখন ১৬৷ সবে মাত্র এস এস সি পাস করে ইন্টারে উঠেছিলাম। বয়স ও বেশ কাঁচা। কাঁচা বয়সে এমন উদ্ভট স্টেপ নেওয়া কোনো ব্যপার ছিল না। সেদিনেই ফয়সালা হলো আমি হাসপাতালের যেকোনো একটা ইয়ং ডাক্তারের সাথে এক মাস প্রেম করব তার বিনিময়ে বাজির এক হাজার টাকা আমার খাতায় যোগ হবে।
সব ফয়সালা শেষে সেদিনেই কলেজ ফাঁকি দিয়ে দেয়াল টপকে তিনজন বান্ধবী বাইরে বের হয়ে আসলাম। কলেজ ছুটি হবে বিকেল চারটায়। এখন বাজে বারোটা। ২ টার পর হাসপাতালে গেলে ডাক্তার থাকবে না। কারণ ঐ সময়টায় সব ডাক্তাররা নিজেদের চেম্বারে বসে। তখন দেখাতে গেলে টাকা লাগবে। তাই কলেজ ফাঁকি দিয়েই হাসপাতালে পৌঁছালাম।
বেলা বাজে বারোটা ত্রিশ। হাসপাতাল গিজগিজ করছে রোগীতে। টিকেট কাউন্টারে গিয়ে পাঁচ টাকা খরচ করে একটা টিকেট নিলাম। ৫ নম্বর চেম্বারের টিকেট দিয়েছে। ভাবতে লাগলাম কেমন ডাক্তার কে জানে! মেয়ে ডাক্তারও তো হতে পারে। মেয়ে ডাক্তার হলে আবার টিকেট চেন্জ করার প্যারা। সব মিলিয়ে বেশ দুটানা নিয়ে তিনজন চেম্বারের কাছে গেলাম। হালকা উঁকি দিয়ে দেখলাম একজন অল্প বয়স্ক বাচ্চা ছেলে রোগী দেখতেছে। বাচ্চা বললাম এজন্য যে উনাকে দেখতে বাচ্চার মতোই লাগতেছিল। মনে মনে হালকা ভালো লাগাও তৈরী হলো। তবে মুখে প্রকাশ করলাম না। বেশ সাবলীল ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম উনার যদি গার্লফ্রেন্ড অথবা বউ থাকে তাহলে নেহাত সমস্যার সৃষ্টি হবে। পরবর্তী পন্থা অবলম্বনের জন্য পাঁচ টাকা খরচ করে আরেকটা টিকেট কাটতে হবে। তার উপর একটা ভালো লাগা কাজ করছিল বসে থাকা এই ডাক্তার মহাশয়ের উপর। তাই মনে মনে দোয়া করতেছিলাম তাহার যেন কোনো গার্লফ্রেন্ড বা বিবাহিত বউ না থাকে। চুপিসারে এসব ভাবতে ভাবতেই বান্ধবী মিহু আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল
– সিঁথি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কী বিড়বিড় করছিস!
মিহুর কথায় ভাবনার দেয়ালে পড়া মনটাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলাম। আমার পুরো নাম সিথুন হলেও বন্ধু মহলে সবাই সিঁথি ডাকে। সাথে যে দুজন বান্ধবী এসেছে তারা হলো মিহু আর কবিতা। আমি ভাবনার ঘোর থেকে বের হয়ে মিহুর দিকে তাকিয়ে বললাম
– কিছু না চেম্বারে ঢুক।
চেম্বারে ঢুকেই ডাক্তারের হাতে টিকেট দিয়ে বসে পড়লাম এক কোণে। উপজেলা গুলোতে সাধারণত ডাক্তারদের চেম্বারে ঢুকেই টিকেট দিয়ে সেখানে বসতে হয়। বরাবরেই ছটফটে স্বভাবের হওয়ায় মিহু আর কবিতার সাথে কথা বলতে বলতে অট্ট হাসি দিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই ডাক্তার মহাশয় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
– এই যে আস্তে….। এত জোরে হাসলে তো রোগী দেখায় মনোযোগ দিতে পারব না। একটু আস্তে হাসুন। বাকি রোগীদের সমস্যা হচ্ছে।
দিলে চুট লাগল মনে হলো। প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভীত চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলাম। তিনিও হালকা হাসলেন। এ হাসির রেখা মনের গহীনে অদ্ভূত ভাবে বিচরণ করছিল। তার দিকে চেয়ে থাকতেই যেন বেশ স্বাচ্ছদ্যবোধ অনুভব করলাম। যতই তাকিয়ে ছিলাম নিষ্পলক ফেলে ততই মনে হচ্ছে আরও বেশি এলোমেলো লাগছে সব। প্রেম বুঝি হয়েই গেল। বিড়বিড় করে পাশের দুটোকে বলতে লাগলাম
– প্রেম হয়ে যাবে রে! যে হাসি দিয়েছে মনে হয়না প্রেম আটকে যাবে।
পাশের দুটো আমার অস্থিরতা দেখে বলল
– কী রে… তুই কী ঠিক আছিস? জীবনেও তো কোনো ছেলের প্রতি এত আগ্রহ দেখলাম না। আজকে এত আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিস যে?
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
– ধুর বাজি জিততে হবে তাই। আমার মতো মেয়ের জীবনে প্রেম শব্দ নেই। প্রেমে এলার্জি আমার।
এর মধ্যেই চেম্বারটা বেশ ফাঁকা লাগছে। কোনো রোগী নেই আমরা তিনজন ব্যতীত। নিস্তব্ধ এ চেম্বারের এক পাশের জানালা দিয়ে যেন হালকা বাতাস ধেয়ে আসলো। বাতাসের সে ঝাঁপটায় কপাল জুড়ে পড়ে থাকা চুল গুলো অবাধে উড়তে লাগল। নড়েচড়ে উঠল শরীর। সে সাথে মনের ভেতরে যেন কুহু ডাকের আস্তরণ অনুভূত হলো। ডাক আসলো- সিঁথি কে? এদিকে আসুন।
আমি নামটা শুনেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। হাত পা যেন অসাড় হয়ে গেল। বিমূর্ত মৃদু সুরে বললাম আমি! উনি পাশের চেয়ারটা ইশারা করে বসতে বললেন। আমি পাশের চেয়ার টেনে আস্তে করে বসলাম। মিহু আর কবিতা আগের জায়গাটাতেই বসে রইল। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো রোগ কী? আমি এক নাগারে যত রোগ ছিল সব বলে দিলাম। উনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছিল এ প্রথম এত রোগ নিয়ে সুস্থভাবে কথা বলা কোনো মেয়ে দেখছেন। আস্তে করে আমাকে বললেন
– আপনি একটু ধীরে কথা বলুন। রোগের বিবরণগুলো ধীরে বলুন। এত দ্রূত বললে বুঝতে পারব না।
উনার কথায় বেশ জড়তা লক্ষ্য করছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম তুতলা না তো! হাবিজাবি অনেক কিছু ভেবেই আনমনে বলে উঠলাম
– আপনার নম্বরটা কী দেওয়া যাবে? মানে আমি চাচ্ছিলাম আপনাকে কল দিয়ে সমস্যাগুলো বলব। একেক সময় একেক সমস্যা হয় তো তাই। যখন যেটা হলো তখন বললাম।
উনি আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গজগজ করে টিকেটের পেছনের দিকটায় নম্বরটা লিখে দিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন
– এখানে নম্বর আছে মাথা ঠান্ডা করে কল দিয়েন। আর সিক্স, সেভেনের বাচ্চাদের এত অস্থির হওয়া ঠিক না।
আমি উনার কথা শুনে জ্বলে উঠলাম। রাগটা পাহাড়সম হলো। রাগে ফেটে গিয়ে বললাম
– আমি কলেজে পড়ি।
উনি আমার দিকে মৃদু হেসে বললেন
– বাচ্চা বাচ্চা লগে। স্বভাবেও বাচ্চাটাইপ চেহারাতেও সেইম।
কথাটা শুনে বেশ রাগ নিয়ে অভিমানী গলায় জবাব দিলাম
– আপনাকে দেখেও মনে হয় কলেজে পড়েন। প্রথমে ভেবেছিলাম ডাক্তারের কমপাউন্ডার। কিন্তু রোগী দেখতেছিলেন তাই নিশ্চিত হলাম আপনি ডাক্তার। যাইহোক আমি কলেজে পড়ি। যথেষ্ঠ বড় এবং ম্যাচুউর।
তিনি আমার কথা শুনে মাথা নাড়লেন। কোনোরূপ রাগের প্রতিফলন উনার মুখে চক্ষুগোচর হলো না। হালকা হাসির একটা মায়াবী প্রতিচ্ছবি মুখে ভেসে উঠল। মৃদু সুরে জবাব আসলো
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমার ভুল আমি স্বীকার করলাম। কিসে পড়েন?
– ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।
– কোন গ্রূপ।
– সায়েন্স।
– খুব ভালো। আমার ছোট বোন ও আপনার সাথে পড়ে। ওকে আমি কোলে নিয়ে বড় করেছি।
কথাটা শুনে মনে মনে ভাবতে লাগলাম একি আমাকে তার ছোট বোন বানিয়ে দিবে নাকি! বেশ সাহস করেই বলে উঠলাম
– আপনার বয়স কত?
উত্তর আসলো
-দুই,আট, আটাশ ২৮।
তার মানে এ মহাশয় আমার ১২ বছরের বড় অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কত ইয়ং। এটা কী তার শারিরীক ত্রুটি নাকি আমার চোখের বিচ্যুত ত্রুটি। কারণ একজন বয়স বেশি লোককে আমার কাছে বেশ ইয়ং লাগতেসে। সে যাইহোক আমি গালটা ভার করে বললাম
– আমি আপনার ছোট বোন না। আমার সাথে আপনার পরিচয় আজকেই।
তিনি আরেকটু হাসলেন। আমার হাতটা ধরতে নিলেই আমি হাত পেছন দিকে নিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি আমার বিস্ময় কাটিয়ে তুলার জন্য বললেন
– প্রেসার মাপবো। এসেছেন যখন এটুকু দায়িত্ব পালন করি। আর এখন রোগীও নেই আপনি ছাড়া। সুতরাং হাত দিন প্রেসার মেপে পাঁচ টাকা উসুল করে দিই।
আমি আমতা আমতা করে হাতটা বাড়ালাম। প্রেসারটা মাপার জন্য হাতটা স্পর্শ করতেই কেমন জানি শিহরণ লাগছিল। উপরে ফ্যান চললেও আমি রীতিমতো ঘামতে লাগলাম। বুকটা ধুকধুক করছিল। হাতটা হালকা কাঁপছিল। আমার অস্থিরতা টের পেয়ে উনি হাতটা ছেড়ে দিলেন। সুক্ষ্ম ছোট একটা নিঃশব্দ নিঃশ্বাস নিলাম। মনে হচ্ছিল কোনো যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমি নেমে গিয়েছিলাম, তলোয়ার বা তরবারি নিয়ে কোনো যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধক্ষেত্রটা ছিল আবেগের তুমুল বর্ষণ থেকে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচার যুদ্ধ৷
তেমন কিছু না বলেই মুচকি হেসে বিদায় নিয়ে বাসায় আসলাম। আসার পর থেকেই মনে খছখছ করতেছে উনাকে কল দেওয়ার জন্য। তবুও দিলাম না। সাহস হচ্ছিল না বলা চলে । একটা মেসেজ দিয়ে বললাম ‘ আপনি অনেক কিউট ভুল বললে সরি’। সারাদিন অপেক্ষা করলাম কোনো রিপ্লাই আসলো না। কল দিয়ে কথা বলতেও বেশ দ্বিধা কাজ করছিল। রাত তখন বারোটা। এদিকে বাজি জিততে হবে ঐদিকে কল দিতেও দ্বিধা কাজ করতেছে। বেশ দুটানা নিয়ে কল দিলাম। কল দিতেই গজ গজ করে বলে উঠলাম
– আপনার সাথে আমার কথা আছে একটু কী কথা বলা যাবে?
– কে আপনি? আমি তো এখন ইমারজেন্সিতে।
– আপনি তাহলে কাজ সারুন। জীবন মরণের ব্যাপার। কথা না বললে হবে না।
উনি চিন্তিত গলায় উত্তর দিলেন
– কাজ সেড়ে কল দিচ্ছি।
কলটা কেটে গেল। ২৫ মিনিট পার হয়ে গেল। এখনও কল আসলো না। হয়তো মহাশয় বেশি ব্যস্ত নাহয় আমার কথাটা তার কানে ঢুকেনি। বেশ বিরক্ত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। এর মধ্যেই কলটা বেজে উঠল। আমি কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে উনি যা বলে উঠলেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
পরবর্তী পর্ব কাল রাত আটটায় দেওয়া হবে।
(কপি করা নিষেধ)