#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১২)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
মেহজার এখন আর বাকি কোনো কিছুতেই মনোযোগ নেয়। সে ব্যস্ত ইরফানকে দেখতে। মানুষ কতোটা স্বার্থপর হতে পারলে এমন বদলে যায়। ছয় মাস হয়েছে তাদের শেষ দেখার না হয়েছে তালাক না হয়েছে কোনো ঝগড়া। অদৃশ্য দেওয়ালের জন্যই তো কাছে থেকেও বহুদূর তারা। কোথায় মেহজা তো পাল্টায়নি! অবশ্য মেহজা ইরফানকে কতটুকুই বা চিনে! প্রথম দেখায় ভালোলাগা তারপর ভালোবাসা আর তারপর হুট করেই বিয়ে। ইরফানের ভালোবাসার কেউ আছে সেই সম্বন্ধে তো মেহজার আদৌ কোনো ধারণা নেই। ইরফানের সাথে এই মুহূর্তে একটি মেয়েকে দেখে তার ভঙ্গুর হৃদয় এবার ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র, অনু পরিমাণ হয়ে গেল যেন! মেয়েটির চাল চলন, ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে যথেষ্ট মর্ডান আর ম্যাচিউড। এমন কাউকেই তো ইরফান ডিজার্ভ করে। নিজেকে নিয়ে তার অনুশোচনা হচ্ছে। তাচ্ছিল্যের হাসিটা সে নিজের জন্যেই হয়তো বরাদ্দ রেখেছিল যা এখন বেরিয়ে আসছে।
মেহজা ততক্ষণ তাঁকিয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা দৃশ্যমান ছিল। হুট করেই এক আকাশ খারাপ লাগা শুরু হলো তার। প্রথি মেহজাকে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন?”
তখন সিনান আর অনাও মেহজাকে দেখে আর দুজনেই চিন্তিত হয়ে পড়ে। সবাই এক নাগাড়ে প্রশ্ন করেই চলছে তাতে মেহজার অস্বস্তিও আরো বেড়ে চলেছে। হাতের পার্স থেকে তিনটে এক হাজার টাকার নোট বের করে প্রথির হাতে গুজে বলে, “বিল দিয়ে দিস।”
তারপরেই হনহন করে হাঁটা ধরে সোজা লিফ্টে উঠে পড়ে। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব সকলেই। এটা কী হয়ে গেল? সবার মাথাতেই একই প্রশ্ন। প্রথি ওয়েটারকে ডেকে বিল আনতে বলে ওয়েটার তা নিয়ে আসলে সিনান বিল পে করতে নিলে অনা একপ্রকার ধমকে বলে,
“আমাদের কী আপনার ভিখিরি মনে হয়? টাকা নেই আমাদের কাছে! আপনি আমাদের খাবারের বিল দেবেন কেন?”
“এক্সকিউজ মি মিস! আমি কি একবারো বলেছি আপনারা ভিক্ষুক, টাকা নেই আপনাদের কাছে তাই আমি বিল দিচ্ছি। বলিনি তো! আর কোন আইনে আছে ভিখিরি বিল পে করতে পারেনা? আর একটা কথা! মেহজা আমার চেনাপরিচিত মানুষ। আমরা একসাথে বসে যেহেতু খেয়েছি তাই আমি বিল দিতেই পারি।”
“না পারেন না।”
কথাটা বলেই অনা নিজের পার্স থেকে টাকা বের করে টেবিলে রেখে চলে যায়। পেছনে প্রথিও দৌঁড়ে যায়। ওয়েটারও টাকা নিয়ে চলে গেল। শুধু থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রয় সিনান। এতটুকু মেয়ে তারমতো একজন আর্মি অফিসারকে অপমান করে গেল! তাও পাব্লিক প্লেসে!
—————-
ইরফান হন্তদন্ত হয়ে নিজের বাসায় ঢুকে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে ঢুকে হাতের ফাইল গুলো বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে। রাগে তার শিরা উপশিরা কাঁপছে। শাওয়ার নিতে গিয়ে এক ঘন্টা বাথটাবে শুয়ে থাকে। আর সেটাই হয় কাল! জ্বর বাঁধিয়ে ফেলে। খাবারও খায়না একপ্রকার নিজের শরীরের সাথে অন্যায়, অবিচার শুরু করে দেয়। মেহজা আর সিনান এক সাথে এক টেবিলে পাশাপাশি বসে খাবার খাচ্ছিল! আর সিনানও মেহজার মতোই তার প্রিয় স্যুপ অর্ডার করেছে, ভাবা যায়! পেছনের টেবিলে থাকায় সে সবই শুনেছে ও দেখেছে। মেহজার আগেই সে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। মেহজাদের পেছনের টেবিলে থাকায় আর বিপরীতে মুখ করে থাকায় সিনান এবং মেহজা কেউই তখন তাকে দেখেনি। মেহজা এসেছে থেকেও কতবার এদিক ওদিক চোখ বুলিয়েছে কিন্তু ইরফান তার নজরেই পড়ে নি। তবে সে যখন ইরফানের প্রিয় কালো রঙের জামদানি শাড়িটি পড়ে এসেছিল তখন ইরফান তাকে খুব করে দেখেছে। দু নয়ন জুড়িয়ে দেখেছে। আজ হুমায়রার সাথে যদি কফি খেতে না যেত হয়তো এতসব দেখতো না। একদিকে যেমন ভালো হয়েছে অন্যদিকে খুবই খারাপ হয়েছে।
ইরফান নিচে এসে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পড়ে। শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে। একটুও ভালো লাগছেনা। মায়ের সান্নিধ্য চাইছে মনে প্রাণে। আবার মন থেকে কেউ যেন বলে উঠছে, “আহ্ মা! কেন করলে এতসব! আজ এই বিরহের কষ্টটাও সেই তোমার ভুলের জন্যই হচ্ছে।” ল্যান্ড লাইনটা বেজে উঠেছে নিশ্চয়ই বোনেরা কেউ কল করেছে তার নম্বর বন্ধ পেয়ে। টেলিফোন কানে নিয়ে “হ্যালো” বলতেই ইমার ধমকে কানটা ফেটে যায় বোধ হয় ইরফানের। এই বোনটার রাগ মারাত্নক। ইমা ফোনেই ইরফানের কন্ঠ শুনে বুঝে নেয় তার ভাইয়ের শরীর ভালো নেই বোধ হয়!
সব রাগ নিয়ে গড়গড় করে এক নাগাড়ে পড়েই চলছে মেহজা। পড়ার পড়া কিছুই হচ্ছেনা উল্টো চিৎকার করে এনার্জী নষ্ট করছে। প্রথি তো কয়েকবার জিজ্ঞেস করে ছিল “কি হয়েছে!” মেহজারও একটাই জবাব ” কিছুই হয়নি, সামনে পরীক্ষা পড়তে হবে।” অনার কাছে বিকেলের পর থেকে কিছুটা খারাপ লাগছে তাই সে আরো আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও মেহজার করা শব্দে কিছুক্ষণ পর পর জেগে উঠছে। তবুও মুখ খুলে মেহজাকে কোনো কড়া কথা শুনায়নি। সে বুঝতে পারছে তার এই সখীটার মনটা খুবই খারাপ।
রাত ৯ টা বেজে ৬ মিনিট। এই মুহূর্তে ইমার কল পেয়ে মেহজা অবাক না হয়ে পারলো না। ইমা কখনও তো এই সময়ে কল করেনি। আজ হঠাৎ! হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে ইমা বলে ওঠে,
“জরুরী জিনিসপত্র বই আর জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে আসো। হোস্টেলের ম্যানেজারের সাথে আমি কথা বলেছি আটকাবে না। আর শোনো! ব্যাগ রেডী করা ছাড়া আর কিছু করতে হবেনা। নিজের সাজসজ্জা না করে যেই অবস্থায় আছো সেই অবস্থায় বের হয়ে এসো। কোথায় যাবে কেন যাবে এসব প্রশ্ন এখন করবেনা একদম। ইটস্ আর্জেন্ট এটাই ভালো করে শুনে নাও।”
মেহজা প্রতিউত্তর করার আগেই ঐ পাশ থেকে লাইন কেটে দেওয়া হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহজা ব্যাগ গুছাতে থাকে। কারণটা কী সেটা নাহয় পরেই জানবে। ইমার কথা অমান্য করার সাধ্য তার নেই। প্রথি মেহজাকে ব্যাগ গুছাতে দেখে বলে,
“কীরে ব্যাগ গুছাচ্ছিস কেন? কোথায় যাবি! ইমা ম্যাম কী বলেছে?”
“বাসায় যাব আর্জেন্ট। নিশ্চয়ই মা বাবা কোনোভাবে নেওয়াচ্ছে।”
“এই সময় না গেলে হয়না!”
“হয়না বোধ হয়। আর্জেন্ট বলে দিয়েছে।”
“ম্যাম তোর উপর এতোটা খবরদারী কেন করে বুঝে পাইনা আমি। সামান্য প্রতিবেশিই তো!”
“প্রতিবেশি সামান্য হলেও শিক্ষিকা অসামান্য।”
মেহজা কথাটা মৃদু হেসে বলে। প্রথিও আর কিছু বলেনা। আসলে বলার মতো কিছু পাচ্ছেই না। মেহজা সচারচর যায়না বাসায়। হোস্টেলেই থাকে বেশি। মেহজাকে ছাড়া একা একা লাগবে বড্ড! অনা এবং মেহজার, দুজনের মধ্যে একজনেরও অনুপস্থিতি তার বরারবই অপছন্দ।
মেহজা অনাকে জাগিয়ে তোলে বাই বলে ব্যাগ কাধে বেরিয়ে পড়ে। অনা হ্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে থাকে শুধু। সদ্য ঘুম থেকে ওঠায় কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। মেহজা কাউকেই বলেনি তার বিয়ে, সংসার, স্বামী এসবের ব্যাপারে। বলতে চায়না সে। ইরফান কি কাউকে বলেছে তার স্ত্রী আছে? তার স্ত্রী হচ্ছে একটি অবলা নারী। নাম তার মেহজা নাযাল। হুহ! বলেনি কখনও……
গেট দিয়ে বের হয়েই বড়সড় একটা ঝটকা খায় মেহজা। ইমা ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। বাহ্! সে ড্রাইভও জানে? গাড়ির দরজা খুলে ইমার পাশেই সামনের সিটটায় বসে পেছনের সিটে ব্যাগটা রেখে বলে,
“আপু? তুমি ড্রাইভ করতে পারো?”
“ড্রাইভ করতে পারিনা মানে? আব্বা-আম্মা থেকে শুরু করে ইরফান পর্যন্ত আমরা সবাই ড্রাইভ করতে পারি।”
গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে ইমা। মেহজা উৎসাহিত হয়ে বলে,
“কবে শিখেছো?”
“আমি নাইনে শিখেছি একটু আধটু। ভার্সিটি লাইফ থেকে রেগুলার চালাতাম। এখন দরকারে ড্রাইভার রাখি।”
“ওহ্। তা কোথায় যাচ্ছি আমরা? বাসায় নাতো!”
“আরে না! পাগল নাকি?”
বাসায় যাচ্ছেনা শিউর। তাহলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ইমা তাকে! সে তো নাইট স্যুটে পড়ে আছে? ধুররর। ভালো লাগছেনা এতসব সাসপেন্স!
গাড়ি একটি হাউজিং এর মতো গলিতে ঢুকে পড়েছে। চারিদিকে উঁচু উঁচু দালান। এইসব বিলাসবহুল ফ্ল্যাট দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আশপাশটা দেখে বুঝলো এটা বসুন্ধরা এলাকা। মুহূর্তেই মেহজার বুকে কামড় বসে যেন। ইমা তাকে ইরফানের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না তো! না তা অসম্ভব। ইমা কখনোই এমন করবেনা।
কিন্তু হায় কপাল! মেহজার বিশ্বাসে এক গ্লাস পানি ঢেলে একটি বিল্ডিং এর নবম তলার ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে সে যে বাসার কলিংবেল বাজায় সেই দরজার ডান পাশেই দেওয়ালের মধ্যে বড় বড় করে লেখা ইরফান ইয়াজিদ। নেমপ্লেটটি দেখেই মেহজা আতংকিত হয়ে পড়ে। এটা ইমা কী করলো?
অসুস্থ শরীরে দরজা খুলে ইরফান ইমার পাশে মেহজাকে দেখে উতলা হয়ে উঠে। চোখ সরিয়ে নেয় মেহজার থেকে। সরে গিয়ে তাদের ভেতরে ঢুকার জন্য রাস্তা করে দিয়ে এলোমেলো পায়ে ছোটে কিচেনের দিকে। মেহজা ইরফানের তাকে দেখে চোখ সরিয়ে নেওয়াটা ভালোই খেয়াল করে। ভেতরে আসতে চায়না একদমই, ইমা তার হাত টেনে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়।
#চলবে