||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ২২||
সলজ্জে মাথা নিচু করে অর্ধ উন্মুক্ত শরীরে বসে আছে প্রহেলি। দিব্য নিজের পছন্দে কালো রঙের একটা শাড়ি আলমারি থেকে বের করে এনে জিজ্ঞেস করল, “আমি তোমাকে ধরে দাঁড় করালে পরতে পারবে?”
“এই সময়ে শাড়ি পরে থাকা কষ্ট হবে না? সামলাতে পারব না আমি।”
সে আবদারের সুরে বলল, “শুধু আজকের রাতটা। আমি তোমাকে শাড়িতে দেখতে চাই।”
প্রহেলি দিব্যের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “পারব। তুমি কেবল শক্ত করে ধরে রেখ আমায়।”
দিব্য আগের মতো তার বুকের খানিকটা নিচে হাতটা শক্ত করে ধরলো। প্রহেলি অনেক কষ্টে শাড়িটা পরে। হাঁপিয়ে উঠে খানিকটা। বিছানায় বসিয়ে রেখে সে নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দেয়। অল্প কয়টা খেয়ে আর খেতে পারে না। বড় হওয়ার পর এই প্রথম অন্যের হাতে খেয়েছে সে। কেন জানি মনে হচ্ছে এই অল্পটাও বেশ তৃপ্তি ভরে খেল।
পাশাপাশি শুয়ে আছে দু’জন প্রহেলি চোখ বন্ধ করে নেয়। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কেন যেন তার মনে হয় কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ খুলে অবাক হয় সে। দিব্য আসলেই তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঘুম ধরা কণ্ঠে বলল, “তুমি এখনো জেগে আছ যে! এভাবে কী দেখছ?”
দিব্য তার বালিশ থেকে সরে এসে প্রহেলির মুখোমুখি হয়ে বলল, “তোমাকে দেখছিলাম। তুমি এত স্নিগ্ধ, সুন্দর না হলেও তো পারতে।”
এই মধ্যরাতে এমন অদ্ভুত কথা শুনতে হবে কল্পনাও করেনি সে। কেন জানি দিব্যের প্রতি ভালোবাসা আসছে তার। আচমকা নিজের একটা হাত দিব্যের গালে রেখে বলল, “অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড় প্লিজ। নাহলে শরীরের ক্ষতি হবে।”
“কিন্তু আমি যে তোমাকে এভাবেই দেখতে চাই।”
“কাল দেখবে। এখন ভালো ছেলের মতো চোখ বন্ধ করো। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
প্রহেলির এমন পরিবর্তন দিব্য নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে সুখে আজ সে মরে যাবে। কিন্তু সে এখনই মৃত্যুকে চায় না। সে প্রহেলির সাথে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একসাথে থাকতে চায়। সহসা দিব্য বলল, “আমি চাই, আমরা যতদিন পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকি একসাথে যেন বাঁচি। আর আমার মৃত্যুর অন্তত একদিন৷ আগে যেন তোমার মৃত্যু হয়।”
প্রহেলি মাথাটা দিব্যের দিকে ঈষৎ হেলিয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে! এমন অদ্ভুত ইচ্ছে কেন তোমার?”
“শুনেছি স্বামীর আগে স্ত্রী মারা গেলে, যদি সেই স্বামী স্ত্রীর জন্য আফসোস করে একফোঁটা চোখের জল ফেলে, দোয়া করে তাহলে সেই স্ত্রীকে আল্লাহ জান্নাত দান করেন। আর আমি না হয় জান্নাতে যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ আমল করব পৃথিবীতে। কারণ আমি তো জান্নাতে কোনো হুর-কে নয় বরং তোমাকেই অনন্তকালের সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই।”
প্রহেলির চোখে জল। কিন্তু এটা সুখের কান্না। কতটা ভালোবাসলে কেউ কেবল ইহকালে নয়, পরকালের জন্যেও ভাবতে পারে এটা তার জানা নেই। সে কোনো মজনুকে দেখেনি তবে তার দিব্যকে দেখেছে। দিব্য চোখ বন্ধ করেছে।
প্রহেলি মাথাটা এগিয়ে এনে তার চোখের পাতায় গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে বলল, “এতদিন তো তুমি আমাকে ভালোবেসে গিয়েছ দিব্য। এবার তোমার প্রহুর পালা। এত ভালোবাসা দিব তোমায় যে, তোমার জগতে কেউ পা ফেলতে হলেও আগে আমাকে মাড়িয়ে তারপর যেতে হবে।”
হুট করে চোখ খুলে তাকায় সে। প্রহেলি ভেবেছিল দিব্য ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে চোখ খুলতেই লজ্জা পেয়ে সরে যায় নিজের জায়গায়। অন্যদিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। দিব্যের উষ্ণ নিশ্বাস প্রহেলি ঘাড়ের পাশে অনুভব করছে। মানুষটা যে তার একদম কাছেই আছে তার সে ভালোই আঁচ করতে পারছে। বুকের ধুকপুকানি তীব্র মাত্রায় বেড়ে যায়। সে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “আজ যদি তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার কোনো অপরাধ করে বসি তাহলে কী ক্ষমা পাব?”
প্রহেলি ঘন নিশ্বাস ফেলে মৃদু গলায় বলল, “শাস্তিস্বরূপ সারাজীবন এভবেই ছুঁয়ে দিতে হবে।”
এই কণ্ঠস্বর যেন দিব্যের হৃদয়ে সুরের ঝংকার তুলে। ভেতরে কম্পন বয়ে যায়। অনুমতি পেয়ে চোখেমুখে অদ্ভুত এক হাসি ছড়িয়ে পড়ে। আলতো করে কানে চুমু খায়৷ প্রহেলি শিউরে উঠে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে। ঘাড়ের পাশে গভীরভাবে ঠোঁটের উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। একটা হাত শাড়ির ভাঁজে পুরে উন্মুক্ত কোমরে রাখে। সারা শরীর যেন দুলে উঠে তার। আজ আর রক্ষে নেই। এই ছেলে তাকে আদরের সাগরে ডুবিয়ে মারবে। ঠোঁট জোড়া কোমরে স্পর্শ করাতেই প্রহেলি তার দিকে ফিরে। দিব্যের চুল খামচে ধরে। মরিচ বাতির আলোয় প্রহেলির মুখে হলদে-সোনালি আভা ছড়ায়।
দিব্য তার গালে হাত রেখে ক্ষীণ গলায় বলল, “আমার দিকে তাকাও৷ এভাবে চোখ বন্ধ করে রাখলে কী চলবে?”
সে চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “আমার সেই শক্তি বা দুঃসাহস নেই। প্লিজ এই আবদারটা করো না।।”
দিব্য আবার বলল, “কিন্তু আমার যে অনেক দিনের ইচ্ছে, যখন প্রথম তোমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিব অন্তত একবার তুমি আমাকে কাছ থেকে দেখবে। চোখে চোখ রাখবে। যখনই ঠোঁটের অতলে হারাবো তখন চোখ বন্ধ করবে।”
প্রহেলি চোখ খুলে তার মুখ চেপে ধরে। ঠোঁট কাঁপছে তার। বুক দ্রুত উঠানামা করছে।
“এভাবে বলো না, লজ্জায় আমি মরেই যাব…”, আর কোনো কথা বের করতে পারে না মুখ দিয়ে। দিব্য তার শুষ্ক ঠোঁট প্রহেলির কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বসত গড়ে তুলে। ঠোঁটের অন্দরে অন্দরে কথা হয় চুমুতে চুমুতে। জিভ ছুঁয়ে যায় মুখের ভিতরের জমি। দু’জনের চোখের পাতা ঠেকাঠেকি হয়। প্রজাপতির পাখার মতোই ডানা ঝাপটে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে রয়। ঠোঁট ছাড়িয়ে গলায় চুমু খেতেই শিউরে উঠে সে। চুমু যখন শরীরে ছড়িয়ে যায় তখন যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে যায়। সময়-জ্ঞান নেই দু’জনের কারো মধ্যে। অসুস্থতাও যেন হার মেনেছে তাদের ভালোবাসার কাছে। ভালোবাসা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। অনন্তকাল ধরে এভাবেই ভালোবাসা নতুন উপায়ে ধরা দিক তাদের মাঝে।
টানা দুইমাস পর আজ প্রহেলি কারো সাহায্য ছাড়াই হাঁটতে পারছে। এই একটা মাস যতটা কষ্ট প্রহেলির হয়েছে তার থেকে বেশি কষ্ট হয়েছে দিব্যের। কিন্তু সে কখনোই তাকে তা বুঝতে দেয়নি। এই দুইমাসে প্রহেলি অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। সৌন্দর্য তাকে আবারো ধরা দিয়েছে। যে সৌন্দর্যের পেছনে ছেলেরা ঘুরঘুর করতো।
আজ তারা দিব্য তাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তৈরি হতে বলে রুম থেকে বাইরে আসে সে৷ একটা পরিচিত নম্বরে মোবাইলে কল এসেছে। কল রিসিভ করে ওপর পাশের কিছু কথা শোনার পর দিব্য বলল, “আজ তোমার বেখেয়ালির জন্য আমার প্রহেলিকে এতদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। আর তুমি এখনো আমার কাছে ক্ষমা চাইছো? তোমাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম তাও তুমি সঠিকভাবে করতে পারলে না!”
ওপর পাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠে সেই ব্যক্তি বলে উঠল, “আমি তো নাহিয়ানের গাড়ির ব্রেক ফেল করে দিয়েছিলাম ঠিকমতো। এখন সে যে ওই রাস্তায় যাবে তোকে মারতে তা কী আর জানা ছিল আমার? এবার অন্তত এসব ভুলে যা।”
দিব্য আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিকাছে, বাদ দাও এসব। আজকের পর এই বিষয়ে আমাদের মাঝে কোনো কথা হবে না। প্রহেলিকে নিয়ে আমি একটা জায়গায় যাচ্ছি। তুমি কখনো ভাবিকে নিয়ে ঘুরতে এসো। রাখলাম।”
কলটা কেটে মোবাইল পকেটে ভরে রুমে চলে যায় দিব্য। এতক্ষণ আর কারো সাথে নয় মেহরাবের সাথে কথা বলছিল সে। মেহরাবের সাথে প্ল্যান করেই নাহিয়ানের এক্সিডেন্ট করাতে চেয়েছিল সে। করেছেও তাই। যদিও এতে প্রহেলিকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। যেটা সে কখনোই চায়নি।
দিব্য প্রহেলিকে নিয়ে একটা পার্কে এসেছে। দূর থেকে একজনকে হুইল চেয়ারে বসতে দেখা যায়। গুটিগুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায় দুজন।
প্রহেলি উদ্ধিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখানে কেন এসেছি?”
“এখনই টের পেয়ে যাবে।”
সেই হুইল চেয়ারের সামনে এসে থামে দু’জন।কাছাকাছি আসতেই মানুষটার চেহারা স্পষ্ট হয়ে আসে চোখের সামনে। এই ব্যক্তিকে দেখে প্রহেলির গা বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। নাহিয়ান! নাহিয়ানের এই অবস্থা দেখতে হবে কখনো কল্পনা করেনি সে। ঘাড়টা বেঁকে গেছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে আপনা-আপনি। ফরসা মুখটা কেমন কালচে হয়ে গেছে। সেই সুদর্শন যুবক আর নেই। যে যুবক অজস্র সুন্দরী মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে স্বার্থ উদ্ধার করার পর ব্যবহার করা জিনিসের মতো ছুঁড়ে ফেলেছে আজ সেই একটা জিনিস হয়ে স্থির বসে আছে। তাকে হাত নাড়িয়ে বারবার কিছু বলতে চাচ্ছে সে। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। প্রহেলির চোখেও অজান্তেই কয়েক ফোঁটা জল জমে যায়। তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসাকে এভাবে দেখতে পারছে না। সে আর এক মূহুর্তও এখানে থাকতে পারে না। উলটো ঘুরে দৌড়ে ছুটে যায় গাড়ির দিকে। গাল ভিজে গেছে জলে।
দিব্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রহেলিকে দেওয়া কষ্টের শাস্তি এর থেকে বড় কিছু আর নেই। তবে সে এতটাও বাজে অবস্থা হোক এটা চায়নি। হাত-পা ভেঙে কিছুদিন বিছানায় পড়ে থাকুক এটা চেয়েছিল। সেই অনুশোচনায় নাহিয়ানের চিকিৎসার সকল খরচ সে নিজে বহন করছে।
প্রয়োজনে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাবে। কিন্তু এখন তার প্রহেলির পাশে থাকতে হবে। গাড়ির দিকে সেও পা বাড়ায়। তাকে সামলাতে হবে। ভালো তো সেই বাসে যে অতীত জেনেও ক্ষমা করে ভালোবেসে যায়। দিব্যও প্রহেলিকে সেভাবেই ভালোবাসবে। তাদের নতুন জীবনে নাহিয়ানের মতো অন্য কারো ছায়াও পড়তে দেবে না সে। প্রহেলিকে সবসময় মায়ার জালে আটকে রাখবে।
সমাপ্ত….
লিখা: বর্ণালি সোহানা