গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_১৮
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
রাত পেরিয়ে ভোর হলো।সূর্যি মামা আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। আকাশে এক চিলতে আলোর রশ্মি দেখা দিচ্ছে।
সারাটা রাত দমবন্ধকর পরিস্হিতির মধ্যে কাটিয়েছে পৃথিশা।এতগুলো দিন বিয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলেও গতরাত থেকে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে তার। তাহাজ্জুদ আর ফজরের নামাজ পড়ে প্রতিদিনকার মতো আজ আর ছাদে গেলো না সে।ঘরে বসেই ফোন টিপে সময় কাটালো।
সকাল হতেই পৃথিশাদের বাসায় সাজ সাজ রব। ছোট কাজিনরা তাদের ড্রেস-জুয়েলারি নিয়ে ভীষণ উৎফুল্ল।কে কীভাবে সাজবে,কে কোন ড্রেস পড়বে তা নিয়েই আলাপ-আলোচনা চলছে তাদের।ছোট চাচী সকাল থেকে নিজের ঘরেই আছে,পৃথিশার দাদীও ঘর থেকে আর বের হয়নি। পৃথিশার বড় চাচী,সুমিতা বেগম মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যস্ত।রহমান সাহেব বিয়ের কাজ করতে সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে।
দুপুরে খাওয়ার পরে পৃথিশা ও তার কয়েকটা কাজিন যাবে পার্লারে সাজতে।তারপর সেখান থেকে একেবারে কমিউনিটি সেন্টারে।
সুমিতা বেগম আজ নিজ হাতে সকালে খায়িয়ে দিয়েছেন আর রহমান সাহেব দুপুরে।পৃথিশাকে সকাল থেকেই এড়িয়ে চলছে সুমিতা বেগম।কান্নাকাটি করে মেয়ের মন খারাপ করতে চান না তিনি।
দুপুরের রোদ একটু কমে যেতেই পৃথিশাকে নিয়ে পার্লারে রওনা হলো তার কাজিনরা।একেবারে কড়া কন্ঠে পৃথিশা আর্টিস্টদের বলে দিয়েছে হালকা করে সাজাতে।কেননা মারুফ এত ভারি সাজ পছন্দ করে না আর তার নিজেরও পছন্দ নয়।
লাল রঙের শাড়িতে আবৃত করা হলো পৃথিশাকে।যত্ন নিয়ে নিজের চোখের কোনায় গাঢ় করে কাজল দেওয়া হলো। লাল রঙের চুড়িগুলো ঠাঁই পেলো তার হাতে।চুলটা খোপা করে লাল-সাদা গোলাপ গুঁজে দেওয়া হলো তাতে।এক এক করে গয়নাগুলো গায়ে জড়িয়ে দেওয়া হলো।নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই চিনতে পারলো না পৃথিশা। একেবারে লাল টুকটুকে বউ লাগছে তাকে।
কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে নামার সাথে সাথেই ক্যামেরা ম্যানগুলো ছবি তুলা শুরু করে দিলোল।সুমিতা বেগম মেয়েকে দেখে কাজ ফেলে দৌড়ে এলেন।পৃথিশার এক হাত ধরে তাকে শাড়ি সামলাতে সাহায্য করলেন। পৃথিশা বাম হাতে মায়ের হাত আঁকড়ে ধরে ডান হাতে শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে গাড়ি থেকে নামলো। মারুফের পরিবার এখনো এসে পৌঁছাতে পারে নি।
বর-কনের জন্য বরাদ্দ থাকা রাজকীয় সোফাগুলোর একটিতে সাবধানে পৃথিশাকে বসিয়ে দিয়ে মেহমানদের কাছে চলে গেলেন সুমিতা বেগম।পৃথিশা একাই বসে আছে সোফায়। বড় বড় চোখ করে সবার উত্তেজনা দেখছে।
কনে এসেছে এ খবর শুনেই এক এক করে সবাই দেখা করতে আসছে। পৃথিশাও যথাসম্ভব হাসিমুখে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে।মারুফের বিয়ের খবর পেয়ে নেহাও এসেছে নিজের হাজবেন্ট নিয়ে।মারুফের সাথে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার একবছর পরই তার পরিবার তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
নেহা হাসি মুখে পৃথিশার দিকে এগিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কেমন আছো পৃথিশা?”
পৃথিশা নেহাকে দেখেই চিনতে পারলো।নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, “ভীষণ ভালো আছি,আপনি কেমন আছেন আপু?”
নেহা উত্তর দিলো, “তা তো দেখতেই পারছি ভালো আছো।আজকে তোমার জায়গাটা আমার হওয়ার কথা ছিল!”
পৃথিশা মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “অদ্ভুত ভাবে যে কথাটি আপনি এতদিন যার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন আজ আমাকে কষ্ট দেওয়ার চক্করে আপনার এতদিনের গোপন কথাটি ফাঁস হয়ে গেলো!”
নেহা অবাক চোখে তাকালো।পৃথিশা তাকে পাশ কাটিয়ে নেহার হাজবেন্টকে সালাম দিলো। লোকটি চোয়াল শক্ত করে নেহার দিকে তাকালো,নেহা ভয়ে কাঁপছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মারুফেরা এসে উপস্হিত হলো।গেট ধরার নিয়মটা বাদ দেওয়া হয়েছে পৃথিশার দাদীর কথায়।তিনি রহমান সাহেবকে বলে এই ব্যাপারে না করে দিয়েছেন। পৃথিশার-ও এটা পছন্দ নয়। কোন বাঁধা ছাড়াই মারুফ পৃথিশার পাশের সোফায় এসে বসলো।
পৃথিশা মাথা নিচু করে বসে আছে। মারুফের কয়েকজন কলিগ এসে তার সাথে কথা বলছে।পৃথিশা হু হা করে উত্তর দিচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে পৃথিশা আর মারুফের ছবি তুলা হলো।আত্নীয়-স্বজনরা এসে তাদের সাথে ছবি তুললো।দুজনে ঘন্টা ধরে বিরক্ত হয়ে বসে রইলো।
একপর্যায়ে পৃথিশা বিরক্ত হয়ে বললো, “আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে!”
মারুফ সামনে তাকিয়ে উত্তর দিলো, “যতক্ষণ না বিয়ে শেষ হচ্ছে।”
পৃথিশা নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে রইলো।তার এখন প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।
কিছু একটা মনে পড়তেই মারুফ বলে উঠল, “আচ্ছা তুমি দুপুরের পর খেয়েছিলে?”
পৃথিশা মেকি হাসি দিয়ে বলল, “আসলে এটা-সেটার ঝামেলার আর খাওয়া হয়নি।”
মারুফ রাগী চোখে পৃথিশার দিকে তাকালো।পৃথিশা হেসে হাত দিয়ে তার মুখটা সামনে ঘুরিয়ে দিলো।এই মূহুর্তটাও যান্ত্রিক ক্যামেরায় বন্দি করে নিলো ক্যামেরা ম্যান।
কিছুক্ষণ পরেই খাবার পরিবেশন করা হলো।পুরো হল খাবারের ঘ্রাণে ম ম করছে। এক এক করে সবাই খেতে বসে পড়েছে। খাবারের একটা অংশ পৃথিশার এনজিও-তে পাঠানো হবে।সবচেয়ে বড় কথা হলটার পাশে অনেক দরিদ্র-অনাহারী মানুষও আছে।খাবারের একটা বড় অংশ তাদের জন্য বরাদ্দ আছে।যে অতিরিক্ত খাবার থাকবে তা অপচয় না করে ওদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মারুফ-পৃথিশা মিলে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই পৃথিশাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এলো।সুমিতা বেগম এক কোণে গিয়ে চোখের পানি মুছছেন।রহমান সাহেব লাল চোখে তাকিয়ে আছেন।পৃথিশা রহমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো।রহমান সাহেবের মনটা হু হু করে উঠলো মেয়ের এমন কান্না দেখে।পৃথিশার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করলপন তিনি।কিন্তু পৃথিশা থামলো না, তাকে জড়িয়ে ধরে করুণ কন্ঠে কাঁদতেই থাকলো।রহমান সাহেব আদুড়ে কন্ঠে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।পৃথিশা শুনলো না।
রহমান সাহেব পৃথিশাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আম্মাজান!এভাবে কাঁদে কেউ?এভাবে কাঁদছেন কেন?আপনার আব্বা কষ্ট পাচ্ছে তো!”
পৃথিশা তার গলা জড়িয়ে আবারো কেঁদে দিলো।তিনি অসহায় চোখে মারুফের দিকে তাকালেন।মারুফ তার ইশারা বুঝতে পেরে পৃথিশাকে নিজের দিকে ফিরালো।পৃথিশা তখনো মুখ চেপে কেঁদেই যাচ্ছে।মারুফ অভিজ্ঞ হাতে তার চোখ মুছিয়ে দিলো।পৃথিশা কিছুটা শান্ত হয়ে সুমিতা বেগমের খোঁজ করলো।
সুমিতা বেগমকে দেখে তার কাছে দৌড়ে গেলো।সুমিতা বেগম মেয়ের উপস্হিতি পেয়ে চোখ মুছে মিথ্যা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলেন।পৃথিশা তাকে জড়িয়ে ধরে আবারো কেঁদে দিলো।সুমিতা বেগমও মেয়ের কান্না দেখে কাঁদছেন।কিছুটা সময় পর কান্না থামিয়ে পৃথিশাকে নিয়ে রহমান সাহেবের দিকে এগোলেন।
রহমান সাহেব পৃথিশার হাত মারুফের হাতে দিয়ে বলল, “আমার আম্মাজানকে দেখে রেখো।”
মারুফ মাথা নাড়লো।একপ্রকার জোড় করেই পৃথিশাকে গাড়িতে তোলা হলো।পৃথিশা তখনো কেঁদে যাচ্ছে।
রহমান সাহেব পান্জ্ঞাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখে চাপলেন।সুমিতা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
মারুফ পৃথিশার হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরালো।টিস্যু দিয়ে চোখ-মুখ মুছে দিলো।পৃথিশা নিজেকে শান্ত করে সিটে হেলান দিয়ে বসলো।
মারুফ ফিসফিসিয়ে বললো, “তোমাকে আজ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে!”
চোখ বন্ধ করেই লাজুক হাসলো পৃথিশা।একটা সময় পর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো।মারুফ পৃথিশাকে একপলক দেখে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো।
চলবে,,
স্কুলে পরিক্ষা চলছে।সাথে অ্যাসাইনমেন্ট তো আছেই,তাই দেড়ি হলো।পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত!