মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩১/৩২
মহা দোটানায় ভুগছে মোনা। না পারছে প্রিয়ম’কে ভালোবাসতে, না পারছে মন থেকে জোর গলায় না বলতে। প্রিয়ম’কে ভালো না বাসার অনেক গুলো উপযুক্ত কারণ রয়েছে। আবার ভালোবাসার জন্য, মোনার জন্য প্রিয়মের চোখে যে ব্যকুলতা, তীব্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এসবই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে প্রিয়মের জন্য মোনার চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূলে তীব্র বেগে ঝড় বয়ে ভয়ংকর তাণ্ডব চালিয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে চিরনিস্তব্ধ হৃদয় উপকূল নিস্তব্ধ’ই থাকে, যেখানে কারো জন্য ছিটেফোঁটা মায়া, ভালোবাসা নেই। মোনার মনে হয় ওঁর মন বহুরূপী হয়ে গেছে।এক এক সময় এক এক রূপ ধারণ করে। নিজের মনের চাওয়া নিজের পক্ষে বুঝাই দুষ্কর হয়ে গেছে।
মোনা ছাদে যায়। বিষন্ন দৃষ্টি মেলে আকাশ পানে তাকায়। আকাশের বিশালতা দেখে ঔদাস্য হয়। তামাটে নীলাভ রং দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে।
মোনা কারো হাঁটার শব্দ পায়। শব্দ’টা ক্রমশ মোনার দিকে আসে। মোনার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়না। সব কিছুতে অনিহা, অনাগ্রহ মোনার স্বভাবে পরিণত হয়েছে আজকাল। মোনার কানে আকুল এক গলার স্বর বিদ্ধ হলো।
-“মোনা তুই এখানে?কাজ কি তোর এখানে?বলছি না প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকে বের হবি না।”
মোনা তাকিয়ে দেখে লিলি বেগম।মোনা হেসে, কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে লিলি বেগম’কে জড়িয়ে ধরলো। লিলি বেগমের উপস্থিতিতে মোনার উচ্ছ্বাসে লিলি বেগমের করা প্রশ্ন গুলো চাপা পড়ে।
-“খালা কখন আসলে তুমি? কতদিন বাদে আসলে।”
লিলি বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে রুমে যায় মোনা।
লিলি বেগম খাটের এক কোণে বসলো। বেশ আনন্দিত গলায় বলল,
-“প্রিয়ম এখন অফিসে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। আগের মত সারাক্ষন আড্ডা, পার্টির সময় পায় না। বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিলো। এখন বিয়ে করিয়ে বাসায় বউ নিয়ে আসলেই আটকা পড়বে পুরোপুরি।”
মোনা চমকে ওঠে। বুকের ভেতর দুরুদুরু করতে থাকে। প্রচণ্ড আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করে,
-“মেয়ে আগে থেকে পছন্দ করা আছে নাকি তোমার ছেলের?”
প্রশ্ন’টা করে লিলি বেগমের উত্তরের অপেক্ষায় থাকা প্রতিটা মুহূর্ত যেন ঘণ্টাসম। মোনার তর সইছে না। কয়েক মুহূর্ত পর লিলি বেগম বলল,
-“তুই তো তোর নিপা খালা’কে চিনিস না। নিপার ছোট মেয়ে বিভা। প্রিয়ম আর বিভা’র সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলাম।”
মোনার গলা বেদনায় ছলছল করে ওঠে। লিলি বেগমের কথার উত্তর করলেই যেন এই কষ্ট গলার স্বরের সাথে স্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করবে। মোনা শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে ‘ও’ বলল। আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পারলো না। চেহেরার ভঙ্গি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।
লিলি বেগম কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল,
-“মোনা যেতে হবে আমার।একটু কাজে বের হয়েছি।”
মোনা নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলো।মোনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। যেন লিলি বেগমের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারলো না। যথা সম্ভব সহজ গলায় বলল,
-“যেতে হবে মানে?মাত্রই তো আসলে।”
-“একটু তাড়া আছে।কাল পরশু আসবো আবার। মুখ ভার করিস না।”
মোনা লিলি বেগম কে তোরজোর করে বাঁধা দিলো না। মোনার মাথায় শুধু বিভা নাম’টা ঘোরপাক খাচ্ছে। আর কোন দিকে মনোযোগ নেই। অমনোযোগী ভাবে লিলি বেগমের পিছু পিছু মোনা বাসার নিচে পর্যন্ত গেলো। লিলি বেগম চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো মোনা।
মোনা রুমে ফিরে বিবর্ণ , বিধ্বস্ত মুখে খাটে বসে। মোনার আক্রোশ, আক্ষেপের সীমা রইলো না। বিয়ে ঠিক করা অন্য জনের সাথে তবুও কেন তামাশা? মোনার যত’টা না কষ্ট হচ্ছে, তার থেকে বেশি প্রিয়মের উপর ক্ষোভ হচ্ছে। তীব্র রাগে মোনার শ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। চোখ অগ্নিবর্ন ধারণ করলো। মোনা নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। দুই অক্ষি বেয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে, শুষ্ক কপোল ভিজিয়ে দিলো। মোনার চোখের পানি তে কষ্টের চেয়ে, ক্রোধ বেশি। মোনা ভার্সিটি’তে যায়, অফিসে যায় মনমরা হয়ে থাকে। সব কিছু’তে অনিহা লাগে।
____
সকাল বেলা ডোর বেল বেজে ওঠল। প্রিয়ম এই সময়ে অফিসে যায়। আর যাওয়ার পথে মোনার সাথে দেখা করে যায়।মোনা দরজা খুলে দেয়। চোখে ধারালো তেজ, মুখের অবস্থা গুরুত্বর। প্রিয়ম মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকায়।
-“কাউকে খুন করার প্রস্তুতি নিচ্ছো নাকি? অক্টোপাসের মত ফুঁসছো যে?”
প্রিয়মের এত আহ্লাদ পূর্ণ কথা মোনার তেতো লাগে। রাগ আরো বেড়ে যায়। মোনা জমানো সব ক্রোধ,আক্রোশ প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
-“প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করে যেতে হবে। রাত-বিরাতে আমায় দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। আমার প্রতি প্রেম উথলে পড়ে না?এত ভালোবাসা দেখাতে—-”
রাগে মোনার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসায় সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলো না। প্রিয়ম মোনার হঠাৎ এরূপ আচরণে নির্বাক হয়ে গেলো। নিঃসাড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। প্রিয়ম উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কি হয়েছে মোনা হঠাৎ?এমন আচরণ করছো কেন তুমি?”
মোনা প্রিয়মের কোন কথা শুনতে চাচ্ছে না। প্রিয়মের কথা মোনার তীব্র অসহ্য লাগে। রাগ বাড়ে, ক্ষোভ বাড়ে। প্রিয়ম মোনার হাত দুটো চেপে ধরে শান্ত গলায় বলল,
-“বলবে তো কি হয়েছে?কিছু না বললে আমি বুঝবো কিভাবে?”
মোনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। রাগে চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,
-“আপনার কিছু বুঝতে হবে না। আপনি আমার সামনে আসবেন না। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না।”
মোনা থেমে দম নেয়। মুহূর্তে’ই অকারণে এক মিথ্যা বলে ফেলে।
-“আপনার কারণে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা হচ্ছে।”
প্রিয়ম শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়মের চোখে-মুখে একটা প্রশ্ন স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে। চমকে গিয়ে বলল,
-“ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা!কিসের ব্যক্তিগত জীবন তোমার?”
-“আপনার জন্য আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার ঝামেলা হচ্ছে।”
মোনার বলা কথা’টা ডাঙায় রাখা মাছের মত প্রিয়মের বুকে তাপড়াতে থাকে। প্রিয়ম বজ্রাহত মানুষের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু মুহূর্ত মোনার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভারি গলায় বলল,
-“কি বললে তুমি মোনা?” প্রথমে শান্ত গলায় বললেও এ পর্যায়ে চেঁচিয়ে বলল,
-“কি বললে তুমি?”
মোনা চোয়াল শক্ত করে ফেললো। অসহ্য লাগছে, সহ্য হচ্ছে না প্রিয়মের এই অহেতুক প্রতিক্রিয়া। নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে, কেন আকৃষ্ট হলো প্রিয়মের প্রতি?
-“যা বলেছি তা শুনেছেন?এখন চলে যান। অযথা চেঁচাবেন না।”
প্রিয়ম রাগি স্বর নিস্তেজ হয়ে গেল যেন। বুকের ভেতর অভিমান ঢেউ খেলছে। তরঙ্গহীন গলায় বলল,
-“আমি অযথা চেঁচামেচি করি তাই না মোনা?এত দিন পরে এসে বললে তোমার ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা হচ্ছে।”
প্রিয়মের একটু আগের সমস্ত রাগ,ক্রোধ কষ্টে পরিনত হলে।মনে হুতাশন দাউদাউ করে জ্বলছে। চোখে মুখে তার তাপের আবির্ভাব হচ্ছে। কষ্টে গলা ধরে আসছে।যন্ত্রনায় জর্জরিত গলায় অভিমানি হয়ে বলল,
-“আসবো না আর কখনো তোমার সামনে মোনা।”
প্রিয়ম আর এক বারও তাকালো না মোনার দিকে। হেঁটে চলেছে সিঁড়ি বেয়ে। মোনা তাকিয়ে রইল। রক্তশূন্য সে দৃষ্টি। মোনার মনে যে অভিমান জমে নি, তাও না। তীব্র চাপা অভিমানে বুঁদ হয়ে আছে মোনা।
_____
এই বিজন শহরে মোনা একাকিত্বের কবলে মোনা যেন নিঃশেষিত হয়ে পড়লো। নিভৃতে নানান ভাবনায় ডুবে কাতর হয়ে যায় মোনা। মোনার বিবশ, বিহ্বল মনে প্রিয়ম নাম’টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মোনার ভিতর’টা আরো কাতর হয়ে পড়ে।
মোনা ভার্সিটি’তে যাচ্ছে, অফিসে যাচ্ছে। সব কিছুই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে লাগলো। খানিকের অবকাশে বিষাদময় হয়ে ওঠে মন’টা।
সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যায় ম্লান আলোয় ব্যাপ্ত হয় পৃথিবী। মোনার চোখ থেকে মাঝে মাঝে দুই এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জিত হয়। শোক জিনিস’টাও সুবিধাবাদী। এক সাথে যেন জীবনের সব বেদনা জড়ো হয়।
প্রিয়ম দুই দিনে একবারও মোনার সামনে আসেনি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। মোনা চায় নি প্রিয়ম দ্বিতীবার ওঁর সামনে আসুক। কিন্তু মনের গহীনে ব্যক্তি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন এক ক্ষীণ ইচ্ছার প্রদীপ নিভু নিভু করে জ্বলে।সে চায় প্রিয়ম আসুক,বার বার আসুক।
সে চাওয়া’টা বোধ হয় পাঁচ দিন পর পূর্ণ হলো।
ভার্সিটি শেষে মোনা বের হচ্ছে। মোনার নাম ধরে লম্বা গলায় ডাকলো। এই ডাক’টার প্রতীক্ষায়,প্রত্যাশায় ছিলো যেন। মোনার বুকের ভিতর হাতুড়ে পেটা শুরু হয়। মোনা ওঁর সুদীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট লোচনে অধীর হয়ে তাকায় পিছনে। প্রিয়ম গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থির দৃষ্টিতে মোনার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়মের চোখের ভাষা অসীম উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর। মোনা কয়েক পা এগিয়ে যায়। সহজ ভাবে তাকাতে পারছে না। সংকোচ, দ্বিধা কাজ করছে। প্রিয়মের চোখ মুখে প্রখর অভিমান স্ফুরিত হচ্ছে।
প্রিয়ম ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো মোনা’কে।অভিমানে আচ্ছাদিত পূর্ণ গলায় বলল,
-“মিথ্যা কেন বললে মোনা?আর বিভার ব্যাপার’টা পুরো না জেনে নিজের মত ভেবে নিলে।”
প্রিয়মের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মোনা কাঠের পুতুলের ন্যায় হয়ে যায়। খানিকক্ষণের জন্য মোনা চারপাশের অবস্থান ভুলে গেলো, ভুলে গেলো ও কোথায় আছে। মোনার শুধু মনে হলো কয়েকদিন যাবৎ ও যে বিভীষিকায় পুড়েছে তা কিছু’টা হলেও শমিত হয়ে। হিমশীতল একটা ভাব মোনার মনে জুড়ে দোল খাচ্ছে।
মোনা নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল না। আবার প্রিয়ম’কে জড়িয়েও ধরলো না। জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিয়ম বিভার কথা বলল?প্রিয়ম কিভাবে জেনেছে?মোনা চমকায়।
কয়েক মুহূর্ত পর প্রিয়ম মোনা’কে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে মোনার চোখের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করে বলল,
-“মিথ্যা কেন বললে?”
মোনা ঈষৎ কাঁপছে। নিরীহ গলায় বলল,
-“মিথ্যা বলেনি।”
প্রিয়ম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। মোনার এমন মিথ্যা কথায় রাগ হলো প্রচণ্ড। রাগে মিশ্রিত গলায় মোনা’কে শাসিয়ে লম্বা সুরে বলল,
-“মোনা!’
মোনা তাকায় প্রিয়মের দিকে। বুঝতে পারে ও ব্যর্থ। প্রিয়মের থেকে দূরে থাকা ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই না। মোনার বিবশ মনে নিভৃতে প্রিয়ম মোনার মনে জায়গা করে নিয়েছে,মোনা অস্তিত্বে বিস্তার শুরু করেছে। মোনা চাইলেও পারবে না এ থেকে বের হতে। অজানা এক মোহনীশক্তি মোনায় চম্বুকের ন্যায় টানবে। চম্বুকের সেই আকর্ষন উপেক্ষা করতে ব্যর্থ মোনা। ব্যর্থতার গ্লানি’তে মোনা নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।
প্রিয়ম জোর গলায় আবার বলল,
-“মোনা তুমি চুপ কেন? কে বলেছে তোমার কাছে বিভার কথা?”
মোনা এসব শুধু শ্রুতির কাছে বলেছে। মোনা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি শ্রুতি এসব বলবে প্রিয়মের কাছে কিংবা প্রিয়ম শ্রুতি অবধি যাবে।
মোনা নিচু স্বরে বলল,
-“বিভার কথা যে বলার বলেছে সেটা তো মিথ্যা না।”
-“সত্যির পিছনেও অনেক সত্যি থাকে। আম্মু বলেছে না?তুমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছো এসব?আচ্ছা..আচ্ছা বিভার কথা শুনে তুমি এত ঈর্ষান্বিত কেন হলে মোনা?এত পাগলামি!”
মোনার মুখের লজ্জায় রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে কিছু’টা। অপরাধ করে ধরা পড়া মানুষের ন্যায় চেহেরার ভঙ্গি। মোনা অস্বীকার করে বলল,
-“আমি ঈর্ষান্বিত নয়! আপনার ফিঁয়ান্সি থাকা সত্ত্বেও কেন —”
প্রিয়মের বাঁধার মুখে পড়ে মোনার কথাটা অর্ধসমাপ্তই থেকে গেলো। প্রিয়ম তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,
-“ফিঁয়ান্সি!এত বাড়িয়ে বাড়িয়ে ভাবো কেন তুমি?ছোট বেলায় কে কি ঠিক করে রেখেছে সেটা কি আমার বিষয়?আর আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই?আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করার মত কেউ নেই মোনা। আর ফিঁয়ান্সি হলো কিভাবে?ওঁর সাথে না হয়েছে আমার বিয়ে, না হয়েছে এ্যাংগেজমেন্ট।”
প্রিয়ম কথা শেষ করে তাকালো মোনার মুখের দিকে। প্রিয়ম মোনার দিকে তাকাতেই মোনা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। প্রিয়ম হাসলো। চিন্তার ভান ধরে বলল,
-“আচ্ছা মোনা বিভার কথা শুনে তুমি এত ঈর্ষান্বিত হলে কেন?”
মোনা মহা গম্ভীর মুখে বলল,
-“আমি ঈর্ষান্বিত নয়! আমি বিরক্তি হয়েছি। বাসায় বউ রেখে আমার পিছনে লেগে আছেন।”
মোনা’কে রাগাতে গিয়ে প্রিয়ম নিজেই যেন রাগান্বিত হয়ে গেল। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
-“বাসায় বউ মানে?মোনা খারাপ হচ্ছে। আর শুনো তুমি র্ষাপরায়ণ হও নি, এটা অন্তত বলো না লোক হাসবে। সত্যি স্বীকার করো। আমায় ভালোবাসো সেটা স্বীকার করো।”
প্রিয়ম থেমে আবার বলল,
-“যাক কয়েকদিন কষ্ট করে লাভ হলো।আমার জন্য কারো ছলছল করা চোখ দেখলাম। তাও সে বলবে সে আমায় ভালোবাসে না।”
মোনা এসব কথা উপেক্ষা করল। উত্তর দেওয়ার ভাষা পেলো না। হয়ত সত্যি কথা এগুলো। কিন্তু মোনার মানতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ওসব কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
-“আমার মাথা ব্যথা করে বাসায় যাবো।”
প্রিয়ম’কে দেখে মনে হলো বেশ আনন্দিত। খুশিতে চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মন জুড়ে হিমশীতল শিহরণ জাগে। মোনা গাড়ি’তে উঠে। প্রিয়ম গাড়ি স্টার্ট করেছে। হঠাৎ বেজে উঠলো,
“ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাঁহার তালটি শিখো তোমার চরণমঞ্জীরে।”
প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার পছন্দের গান। গান যেন আমার প্রতি তোমার হৃদয়কথন প্রকাশ করছে।”
মোনা চোখ বুঁজে আছে। কতদিন পর শুনছে এই সুর। মোনার কর্ণপ্রান্তের অলক মুখে পড়ছে। মোনা হাত দিয়ে সরাচ্ছে বার বার। গানের নেশায় মোনা মোহনীয় হয়ে আছে।
(চলবে)
মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩২
মোনা’কে বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে প্রিয়ম চলে যায়। মোনার আজ অফিসেও যাওয়া হয়নি। অস্থি মজ্জায় শুধু এখন প্রিয়ম’কে নিয়ে ভাবনা গেঁথে আছে। প্রিয়ম যে মোনার
অহর্নিশ উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠবে সেটা মোনা কয়েকদিন আগেও বুঝতে পারেনি। মোনার মনের সরল স্বীকারোক্তি সে প্রিয়ম কে ভালোবাসে। কিন্তু এটা মুখে প্রকাশ করতে অজ্ঞাত কারণে মোনার আত্মসম্মানে আঘাত হানে যেন। এটা মুখে প্রকাশ করা মানে যেন নিজের ব্যর্থতা। নিজের ব্যর্থতার কেউ কি কখনো প্রকাশ করে?মোনার মনে হচ্ছে ও প্রিয়ম’কে ভালোবাসে নি বরংচ প্রিয়মের কাছে হেরে গেছে। মোনা বিবশ চিত্তে নিজেই যেন বিমূঢ় হয়ে যায় প্রিয়ম’কে ভালোবেসে ফেলেছে এই ভেবে। ভালোবাসা জিনিস’টা বড্ড অদ্ভুত যেন! নিজের আপন খেয়ালে চলে।
লিলি বেগম ছেলের বউ হিসেবে বিভা’কে প্রত্যাশা করে। লিলি বেগম মোনা’কে খুব বেশি ভালোবেসেছে, মায়ের অপূর্ণতা পূর্ণ করার চেষ্টা করেছে। মোনা’কে যতই ভালোবাসুক কিন্তু প্রিয়মের সাথে মোনার প্রেম এমন কিছু প্রত্যাশা করবে না।যে মানুষ’টা এত ভালোবেসেছে তাঁর অপ্রত্যাশিত কাজ করবে? তাঁর আশা ভঙ্গ করবে? অন্যদিকে হাবিব সাহেব, ঘৃন্যিত একটা মুখ। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ যেন। এমন কত শত যুক্তি রয়েছে প্রিয়ম’কে ভালো না বাসার। কিন্তু ভালোবাসার এক অদ্ভুত নিয়ম আছে। হাজার হাজার যুক্তি তার কাছে পরাস্ত। বিবেকের স্বচ্ছ চিন্তা-ভাবনা গুলোরও ঠাঁই নেই তার কাছে। ভবিষ্যতে কি হবে ,কি হবে না? এসব ভাবনা গুলোও যেন তখন অনাদৃত। সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে শুধু একটা মন্ত্র’ই যেন দিগ্বিদিক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
মোনা অন্যমনস্ক হয়ে এসব চিন্তায় বিমগ্ন থাকে। কতক্ষণ ধরে কলিংবেল বেজে চলেছে। কলিংবেলের শব্দ মোনার কানে বিদ্ধ হলেও, অবচেতন মস্তিষ্কে দরজা খোলার সায় দিচ্ছে না। খানিক বাদে মোনার সম্বিত ফিরে যেন। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে। নিশান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে নিদারুণ বিরক্তি, এতক্ষণ পর দরজা খোলায়। মোনা দরজা বন্ধ করে পুনরায় স্বীয় ভাবনায় মগ্ন হয়। মোনার দিনের অর্ধেকই যেন কাটে নানান চিন্তাভাবনায়।
প্রিয়ম অফিসে ব্যস্ত থাকায় আগের মত সারাক্ষণ ব্যাপি আর মোনা’কে বিরক্ত করা হয়ে ওঠে না। প্রিয়মের সে সব বিরক্তকর কাজ গুলো শূন্যতা হয়ে হৃদয়ে উঁকি দিচ্ছে যেন। প্রিয়মের যে সব বিরক্তকর কাজ গুলো’তে রাগে মোনার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যেত, মাথার রগ গুলো দপদপ করত। সে কাজ গুলোও প্রচণ্ড মিস করছে। মোনার এসব অবান্তর চিন্তা-ভাবনার অবসান ঘটে নিশানের ডাকে। রান্নার কথা যেন ভুলেই গেছে। মোনা নিজের উপর বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিচেনে যায়। দ্রুত হাতে সব কাজ করে।
___
কয়েক দিন ধরে প্রিয়মের সাথে অনামা এক সম্পর্ক যাচ্ছে মোনার। মোনার স্বীয় স্বীকারোক্তির অভাবে এটা’কে প্রেম বলে অভিহিত করা যাবে না। প্রিয়ম দিনে দুচার বার ফোন দিয়ে খোঁজ নিবে। তেমন কোন কথা হয় না। খেয়েছ, কি করছো এসব ধরণের কথা। তবুও এর মাঝে ভালোলাগা, প্রশান্তি রয়েছে। অন্যরকম এক অনুভূতি রয়েছে ।
মোনার জীবন নিয়মমাফিক’ই চলছে। সকালে উঠে নাস্তা তৈরি করা,নিশান’কে স্কুলে পাঠানো, নিজে ভার্সিটি’তে যাবে,ভার্সিটি শেষে অফিস করে বাসায়।একই নিয়মে আবদ্ধ হয়ে চলছে জীবন।
প্রিয়ম মাঝে মাঝেই সকালে অফিসে যাওয়ার পথে মোনার সাথে দেখা করে যাবে। সকালে কলিংবেলের শব্দ ধ্বক করে পাঁজর কাঁপিয়ে দেয় মোনার। কলিংবেল বাজা মানেই একটা শব্দ যেন মোনার মন, মস্তিষ্ক জুড়ে তরঙ্গিত হয়।সেটা হলো সে এসেছে। মোনা প্রতিদিনের ন্যায় আজও উন্মত্ত হয়ে দরজা খোলে। দরজা খুলতেই প্রিয়মের স্নিগ্ধ হাসি মোনার মন জুড়ে শিহরণ জাগায়। প্রিয়মের গায়ের ঘ্রান’টা মোনার নাকে ভেসে আসে মৃদু বাতাসে। এই ঘ্রান’টার অপেক্ষায় অধীর হয়ে থাকে যেন। প্রিয়ম চেয়ার টেনে বসলো। মোনা ছুটে কিচেনে গেলো, নাস্তা বানানো শেষ হয়নি। নিশানের কে কাছে ডাকলো প্রিয়ম। নিশান প্রিয়মের কাছে এসে জড়সড় হয়ে দাঁড়লো। নিশানের মুখ দেখে মনে হয় প্রিয়ম’কে ভয় পায় ও। প্রিয়ম হেসে বলল,
-“নিশান তুমি আমায় দেখলে আড়ষ্ট হয়ে থাকো কেন?ভয় পাও?”
নিশান মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে অন্য রুমে চলে যায়। প্রিয়ম চেয়ারে বসে বসে মোনা’কে দেখছে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে রুম থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। প্রিয়ম চেয়ার ছেড়ে উঠে। শব্দহীন পায়ে ধীরে ধীরে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। মোনা কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে দ্রুত। প্রিয়মের উপস্থিতি টের পায় না। মোনার কপালে ভোরের শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মোনা বাম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঘাম মুছছে। প্রিয়ম নিঃশব্দে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে।প্রিয়ম হঠাৎ পিছন থেকে দুই হাতে মোনার কোমড় জড়িয়ে ধরে। মোনা অকস্মাৎ প্রচণ্ডভাবে চমকে পিছনে ঘুরতেই প্রিয়ম’কে দেখে। খুব কাছে প্রিয়ম। মোনা সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠে মুহূর্তেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। মোনার হাত-পা মৃদু কাঁপছে যেন। শ্বাস-প্রশ্বাস কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেলো। মোনার শিরা উপশিরায়,শরীরের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে তোলপাড় শুরু হলো। মোনা রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলল,
-“ছাড়ুন।”
প্রিয়ম ছাড়লো না। প্রিয়মের নিঃশ্বাস মোনার শরীরে বিঁধছে। অদ্ভুত এক স্পর্শানুভূতি মোনার শরীর মন অবশ করে রেখেছে যেন। যেখানে প্রিয়ম’কে বাঁধা দেওয়ায় ইচ্ছা খুব ক্ষীণ। প্রিয়ম আবেগপূর্ণ হয়ে ধরা গলায় বলল,
-“ছাড়বো না। বলো ভালোবাসো আমায়?”
কি এক ধারালো মোহময় ছিলো সে গলা। প্রখর মোহে মোনা যে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। মোনা দুর্বল গলায় বলল,
-“ছাড়ুন।”
প্রিয়মের মুখ মোনার ডান কাঁধ বরাবর। ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া ধারালো ভাবে বিঁধছে সেখানে। নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো অচেতন হয়ে শক্তিহীন পায়ে দাঁড়িয়ে রইল মোনা। প্রিয়ম পুনশ্চ জিজ্ঞেস করল,
-“মোনা ভালোবাসো আমায়?”
প্রিয়মের মিহি স্বরের কথা টুকু মোনার কান অবধি পৌঁছে। মোনা ঘোরলাগা অবস্থায় কোন ভাবনা চিন্তা বাদে প্রিয়মের স্পর্শেদ্রি’তে বিবশ হয়ে বলল,
-“ভালোবাসি।”
মোনার মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়া এই একটা শব্দ শোনার জন্য প্রতীক্ষা করেছে মাসের পর মাস। সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দ’টা শুনে প্রিয়মের মন জুড়ে বসন্তের হিমেল পবন মৃদু ভাবে বইতে লাগল। প্রিয়ম চোখ বন্ধ করে যেন সেই বসন্ত পবনের স্নিগ্ধাতা অনুভব করছে যেন। মোনা তীব্র সুখকর অনুভূতি’তে অবশ হয়ে বজ্রাহত মানুষের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে যেন। কেউই কোন কথা বলছে না। মানুষ যখন খুব কাছে আসে তখন মুখে কথা হয়না,কথা হয় যেন হৃদয়ে হৃদয়ে নিঃশব্দের নীরবতায়।
প্রিয়ম মোনা’কে নিজের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে দেয়। মোনা তাকায় না প্রিয়মের দিকে। প্রিয়মের দিকে তাকানো মোনার জন্য এখন পৃথিবীর সব থেকে দুরূহ কাজ যেন। মোনার ইচ্ছে করছে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে প্রিয়মের মুখাবয়ব দেখার। কিন্তু অস্বস্তি জড়িমা তার আপন চিত্তে মোনায় জড়িয়ে রেখেছে। মোনা ছুটে চলে যায় রুমে। গিয়ে দরজা বিকট শব্দে বন্দ করে দেয়।বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে প্রিয়মের দেওয়া অনুভূতি টুকু এখনো অনুভব করছে যেন। সে অনুভূতির রেশ এখনো কাটেনি।
মোনা কয়েক মুহূর্ত পর চোখ খুলে। একটু তফাতেই বসে আছে নিশান। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় মোনার দিকে। মোনা চোখ-মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। নাস্তানাবুদ মুখে নিশানের দিকে তাকায়।
-“স্কুলের যাওয়ার সময় হয়েছে।আসো রেডি করিয়ে দিই।”
মোনা নিশানের সাথে কথা বলছে কিন্তু মস্তিষ্কে একটু আগের অনুভূতি আন্দোলিত হতে থাকা। হৃৎপিণ্ড জুড়ে শীতল রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে যেন। মোনা অন্যমনস্ক ভাবে নিশান’কে রেডি করিয়ে দিচ্ছে। দরজার বাইরে থেকে প্রিয়মের কন্ঠ মোনার কানে আসে।
-“মোনা দরজা আটকে রেখেছো কেন?”
মোনা উত্তর দেয়না। প্রিয়মের মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। ওপাশ থেকে পুনশ্চ বলে,
-“মোনা আমি চলে যাচ্ছি।”
মোনার গলার স্বর মন্থর। বলল,
-“যান।”
মোনার প্রত্যুত্তর প্রিয়মের কানে হয়ত পৌঁছেছে নয়ত পৌঁছে নি।প্রিয়ম নির্বিবাদে চলে যায় কথা বাড়ায় নি। ঘটনার রেশ কাটতে মোনার বেশ সময় লেগেছে। এমন অনুভূতির সাথে মোনা প্রথম পরিচিত হওয়া। প্রথম প্রেমানুভূতি, প্রথম স্পর্শানুভূতি প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ, প্রখর,শাণিত। যার রেশ কাটতে সময় একটু বেশি লাগে।
___
মোনা ভার্সিটি’তে যায়। সব কিছু’তে অমনোযোগী। কেউ কোন কথা বললে বিহ্বল চিত্তে হ্যাঁ, হুঁ বলে। হঠাৎ প্রবল জোরে একটা ধাক্কা পড়লো মোনার কাঁধে। হঠাৎ এমন আক্রমনে মোনা অপ্রস্তুত ভাবে কেঁপে উঠলো। পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে শ্রুতি দাঁড়িয়ে আছে। মোনা ভড়কে গিয়েছে দেখে শ্রুতি হাসলো। পলকেই গম্ভীর হয়ে বলল,
-কি হয়েছে মোনা তোমার? সারাক্ষণ চিন্তিত ভাব নিয়ে বসে থাকো?আমায় বলা যায় না?”
শ্রুতি এই টুকু বলে মোনার পাশে বসল ঘনিষ্ঠ হয়ে। তারপর আবার মোনার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে আগ্রহী গলায় পুনর্বার বলল,
-“কি হয়েছে বলো তো? তমসাচ্ছন্ন ভাব নিয়ে থাকো।”
মোনা শ্রুতির দিকে তাকিয়ে হাসলো। কোন এক অজ্ঞাত কারণে মোনার শ্রুতির কাছে বলতে ইচ্ছে হয়না কিছু। মোনা হাই তুলতে তুলতে বলল,
-“আরে কিছু না। বাংলাদেশের কথা মনে পড়লো হঠাৎ।”
শ্রুতির কাছে কথা’টা গ্রহনযোগ্য মনে হলো না কেন জানি। বরাবরের মতো পুনরায় আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
-“বলবে না তুমি আমার কাছে। যাকগে বাদ দিই। আচ্ছা ভার্সিটির পর রেস্টুরেন্টে যাবে?”
-“তোমার আর সমীরের মাঝে কাবাবের হাড্ডি হতে যাবো?”
-“আমার সাথে যতবার গিয়েছো কখনো কি তোমার নিজেকে কাবাবের হাড্ডি মনে হয়েছে? আমরা অমন না।”
শ্রুতি একটু থামে। হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসে।বলবে কি বলবে না তাই নিয়ে দ্বিধান্বিত হচ্ছে। ইতস্তত বোধ করে বলেই ফেলল,
-“প্রিয়ম কে আসতে বলি?”
কথা’ট বলেই মোনার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ স্বরূপ জিহ্বায় কামড় দেয় শ্রুতি। মোনার প্রতিক্রিয়া যে এ ব্যাপারে ভয়াবহ সে শ্রুতি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারে। কিন্তু শ্রুতির ধারণা মিথ্যা হলো। মোনা স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“প্রিয়ম এখন অফিসে।”
স্বাভাবিক নিয়মের বিঘ্ন ঘটেছে যেন। শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল,
-“প্রিয়মের কথা বললাম তাও এত স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিয়েছে। বিশাল পরিবর্তন!”
মোনা হেসে বলল,
-“তোমার কি ধারণা আমি সব সময় মানুষের সাথে রুক্ষ ব্যবহার করি? আর প্রিয়মের কথা বললে আমি রাগ করবো কেন?”
-“হ্যাঁ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমার তো সে ধারণাই ছিলো।প্রেম-ট্রেম হয়ে গেলো নাকি?”
মোনা বিরক্ত হয়ে তাকালেও কয়েক মূহুর্ত পর হেসে দিলো। নিপুণতার সাথে প্রসঙ্গ দ্রুত পাল্টাতে বলল,
-“তোমার আর সমীরের বিয়ের ব্যাপারে কি হলো?”
কথার স্রোতে প্রিয়মের ব্যাপার’টা হারিয়ে গেলো। মোনা এটাই চেয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আবার ক্লাস শুরু হয়।
ভার্সিটি শেষে শ্রুতি খুব জোর করলো মোনা’কে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মোনা নানান অজুহাতে গেলো না। সমীর আর শ্রুতির মাঝে অস্বস্তি লাগে মোনার। মোনা ওঁর অফিসে যায়। রাতে হয়ত প্রিয়ম ফোন দিবে নয়ত দেখা করতে আসবে। কিভাবে যাবে প্রিয়মের সামনে? মোনার মুখ রক্ত জবার মত রক্তিম হয়ে ওঠে লজ্জায় কিংবা অস্বাচ্ছন্দ্যে।
___
মোনা অফিস শেষে বাসায় ফিরে। আগের মত আজ আর ক্লান্ত লাগেনি। অফিস থেকে এসে নিশানের পাশে বসে গল্প করে,নিশান’কে সঙ্গ দেয় কতক্ষণ। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। মোনা প্রতীক্ষা করছে একটা ফোন কলের নয়ত ম্যাসেজ টিউনের।মোনার স্পহণীয় ম্যাসেজের টিউন বাজে।
“বারান্দার নিচে আমি।একটু আসো। লজ্জাবতী রানী কে দেখি।”
মোনা বারান্দায় যেতে উদ্যত হয়। আবার মন্থর হয়ে যায়। অস্বস্তি জেঁকে ধরেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে,বুকের ভিতর দুরুদুরু করছে। আবার কয়েক পা সামনে বাড়ায়। তমসাবৃত রাত। ঘন আঁধারের চাদর চারদিক’টা জড়িয়ে রেখেছে। অন্ধকারে শুধু প্রিয়মের হাতে মোবাইলের টর্চে একটা মানব আকৃতি বুঝা যায়। মুখ দেখা যায় না। মোনা জানে প্রিয়ম কালো শার্ট বা টি-শার্ট গায়ে।যা অন্ধকারের সাথে মিশে আছে।
মোনার হাতের টর্চের আলো আর রুম থেকে আসা আলো’তে প্রিয়ম মোনা’কে স্পষ্ট দেখছে। মোনার মুখে রক্তিম সূক্ষ্ম বর্ণ ফুটে উঠেছে। এই অন্ধকারে সেটা হয়ত প্রিয়মের দৃষ্টিগোচর হয়েছে নয়ত হয় নি। কিছু চমৎকার মুহূর্ত এভাবে নিঃশব্দে কেটে যায়। যার সাক্ষী এই তিমির রাত।
(চলবে)