মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৯+২০
দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা যাবৎ গাড়ি চলছে। গাড়ি কোথায়ও থামাচ্ছে না। প্রচন্ড উত্তাল ঢেউয়ের পর নদীর পানি যেমন শান্ত হয়ে যায়, মোনাও সেভাবে শান্ত হয়ে বসে আছে। স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“কোথায় যাচ্ছি আমরা? বাসায় ফিরবো কখন?”
প্রিয়ম কিছুটা চমকালো মোনার এমন নির্লিপ্ত ভাব দেখে। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকালো। খানিকক্ষণ পর ঠোঁট প্রসস্থ করে ধরা গলায় বলল,
-“হঠাৎ এত স্বাভাবিক হয়ে গেলে?”
মোনা কি যেন ভাবলো। চোখে মুখে কিছুটা বিরক্ত ভাব। হাতের কব্জিতে দেওয়া ঘড়িটা অকারণে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
-“আপনি এসব করে কি করতে চাচ্ছেন জানিনা। কিন্তু শুধু এইটুকু বলবো আপনি আমার বিরক্তের কারণ হচ্ছেন।”
-“অতিরিক্ত বিরক্তে কিন্তু ভালোবাসাও হয়।”
মোনা হাসলো। খুশি বা আনন্দের হাসি না ,ব্যঙ্গ করে হাসলো বোধ হয়। গাড়ি হঠাৎ থামলো। এত সময় পর গাড়ি থামায় ,প্রচন্ড জড়তার ফলে সিট বেল্ট বাঁধা সত্ত্বেও মোনা সামনের দিকে ধাক্কা খেলো। প্রিয়ম গাড়ি থামিয়ে নিজের সিট থেকে ক্রমগত এগুতে এগুতে মোনার দিকে ধাবিত হলো। মোনা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ম খুব ঘনিষ্ট হয়ে মোনার শরীর ঘেঁষে বসে। প্রিয়মের নিঃশ্বাস মোনার শরীরে বিঁধছে। প্রিয়ম মোনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোনার হাত আলতো করে প্রিয়ম ওঁর হাতের মুঠোয় নেয়। মোনা কাঠের পুতুলের মত বসে থাকে। চেহেরার ভাব-ভঙ্গিমায় কোন পরিবর্তন নেই। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে এটা স্বাভাবিক নিয়মে হচ্ছে। প্রিয়ম মোনার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
-“মোনা ভালোবাসি তোমায়।”
মোনার তাও কোন পরিবর্তন নেই। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গাড়ির সামনের দিকটা’তে। প্রিয়ম মোনার এমন নির্লিপ্ত ভাব দেখে বিচলিত হয়ে যায়। মোনার কাছ থেকে সরে বসে। মোনা আড়চোখে তাকায় প্রিয়মের দিকে।
-“সরে বসলেন যে?আসুন শরীর ঘেঁষে বসুন।”
মোনার এই আহ্বানে ক্ষোভ রয়েছে প্রচন্ড। অচেনা এক মোনা, যে মোনার হাত ধরলেও ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ছটফট করতো। সে আজ কত ভাবলেশহীন! মোনার কথায় প্রিয়মের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য মোনার ইচ্ছে হলো প্রিয়মের দিকে তাকাতে, কিন্তু তাকালো না। প্রিয়মের ঠোঁটে হাসির যে রেখা বিদ্যমান ছিলো তা অস্পষ্ট হতে হতে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় যেন তীব্র অন্ধকারে। প্রিয়ম ধরা গলায় বলে,
-“তোমার মনের ভিতর কি চলছে তা আমি জানিনা। কিন্তু আমি যা করছি সবটা তোমার হৃদয়ের বসবাসের জন্য করছি। তোমার হৃদ মঞ্জিলে জায়গা করার জন্য করছি। তোমার অবচেতন কিংবা চেতন মনের ভাবনা হওয়ার জন্য করছি।”
মোনার মুখ ক্রমগত কঠিন হয়ে ছাইরঙা আকার ধারণ করছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হচ্ছে প্রিয়মের চোখের গভীরতা মাপছে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মুখের গম্ভীর ভাব বজায় রেখে ধারালো গলায় বলল,
-“এর বিপরীতে আমি শুধুই বিরক্ত হচ্ছি।”
এইটুকু বলে মোনা যেন চিন্তার অতল গহ্বরে ডুবে যায়। চিন্তার অধ্যায় শেষ করে কপালে ভাঁজ পড়িয়ে বলে,
-“আমি বুঝতে পারছি না, আমেরিকান মেয়ে রেখে আপনি কেন আমার পিছনে পড়লেন?সত্যি আমি বুঝতে পারছি না।”
প্রশ্নের তীর প্রিয়মের দিকে ছুঁড়ল। প্রিয়ম এই প্রশ্নের বিপরীতে গুছানো উত্তরমালা খুঁজে পাচ্ছে না যেন। মনের ভিতর থেকে এলোমেলো কিছু শব্দ বেরিয়ে আসে।
-“ওঁরা তোমার মতো লজ্জা পায় না‌। তোমার এই লজ্জা পাওয়া, ভীতি হওয়া আমায় টানে,চম্বুকের মত টানে। তাছাড়া এটাও হতে পারে তুমি আমায় অবজ্ঞা করছো, তাই তোমার প্রতি আগ্রহ আমার বেড়ে চলেছে।”
অবজ্ঞায় আগ্রহ বাড়ায়, দূরত্বে গুরুত্ব বাড়ায়, কারো অনুপস্থিতি তাঁর জন্য অভাব বোধ উপলব্ধি করায়–এসব মোনার অজানা নয়। সকল প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলে,
-“আমি একটা পার্ট টাইম জব করি,এখন অন্তত আমার যেতে হবে।”
প্রিয়মের ভঙ্গিটা ঠিক অপ্রস্তুত।
-“তুমি কেন পার্ট টাইম জব করবে?আম্মু তোমার খরচ দিচ্ছে না?”
-“দিচ্ছে না বললে ভুল হবে, আমিই নিচ্ছি না।”
প্রিয়ম কিছু বলতে গিয়েও বলল না। গাড়ি ব্যাক করলো। প্রিয়ম দমে গেছে মনে হচ্ছে। মোনার দিকে কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছে। এক পর্যায়ে বলল,
-“মোনা তুমি আমার প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিচ্ছো না।”
-“এসব কথার উত্তরই আমার নেই। সন্তোষজনক আর অসন্তোষজনক!”
-“মোনা তুমি এতটা কঠিন মনের কেন?শুনেছি বাঙালিদের মন তুলোর ন্যায়।”
কথাটা বলে প্রিয়ম তাকালো মোনার দিকে। হয়ত উত্তরের আশায়। মোনা থেমে থাকে। অনেকক্ষণ কেটে যায়।
-“আমি হয়ত পাথুরে মনের বাঙালি।”
মোনা’কে ওঁর কর্মস্থানে পৌঁছে দেয়। মোনা গাড়ি থেকে নেমে একবারও তাকালো না প্রিয়মের দিকে।প্রিয়ম আশাহত হলো। মোনা যেন এতক্ষন খাঁচায় বন্দী পাখির ন্যায় ছিলো,মুক্তির আনন্দে এখন ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রিয়ম হতাশায় ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল। মোনার জন্য প্রিয়মের এই উথাল হওয়া,অস্থির হওয়া প্রিয়মের কোন বন্ধু সহ্য করছে না। বার বার বলে,
-“হোয়াট ইজ দিস প্রিয়ম?কি একটা মেয়ের পিছনে পড়ে আছো?পাগল হয়ে গেলে নাকি?”
মোনার আজ কাজে আসতে দেরি হয়ে গেলো। নতুন একটা মেয়ে এসেছে আজ। লরি মেয়েটা কে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। খুব বেশী মোটা মেয়েটা,এমন মোটা মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। মেয়েটা তো এত মোটা হওয়ার কারণে অস্বস্তি বোধ করে,শ্রুতিও তো কালো হওয়ার কারণে অস্বস্তি বোধ করে। কি বৈচিত্র্যময় ধরনী! কেউ খুব বেশী সুন্দর , কেউবা খুব বেশী কুৎসিত। মানুষ নিজের রূপ নিয়ে অহংকার করে অথচ কেউই নিজেকে নিজে গড়ায় নি।সৃষ্টার গড়ানো রূপ, সৌন্দর্য,লাবন্য! মোনা দের কলেজে একটা মেয়ে পড়তো। অমন সুন্দর মেয়ে সচরাচর কম দেখা যায়। মেয়েটা লেখাপড়ায় খুব বেশী ভালো ছিলো না। তবুও সব ছেলেরা ওই মেয়ের পিছনে পড়ে থাকত অথচ মেয়েটা ছিলো বিবৃতি মস্তিষ্কের। সর্বোচ্চ পনেরো দিনের বেশি কারো সাথে সম্পর্ক রাখতো না। মোনা অপ্রসাঙ্গিক চিন্তা-ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে যায়। মোনার কাজে মন বসছে না, কোন এক অজানা ভাবনা ওকে তাড়া করছে। লরি এসে বলল,
-“কোন সমস্যা মনা? কি অস্থির ভাব তোমার চেহেরায়।”
মোনা হেসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। মোনা নতুন আসা মেয়েটার কাছে গিয়ে বলল,
-“হায়!আমি মোনা।”
মোনার দিকে মেয়েটা বোধ হয় বিরক্ত হয়ে তাকালো। মোনা এর কারণ না বুঝলো না ঠিক। মেয়েটা শুধু বলল,
-“আমি এলিন।”
এই বলে কাজে মনোযোগ দিলো। মোনা ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসলো নিজের জায়গায়। এলিনের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ খুঁজে পেলো না।
মোনা বাসায় ফিরতে লম্বা শাওয়ার নিলো। জামাকাপড় বারান্দায় শুকাতে দিতে গিয়ে চোখ গেলো বারান্দার নিচে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলোতে এক মানব মূর্তির মত কিছু একটা দেখলো বারান্দার নিচে। মোনা প্রথমে ভয়ে আঁতকে উঠে। অবচেতন মনে নানারকম চিন্তা আসে। পরে মোনার মনে হলো ভুত, প্রেতাত্মা কিছুই নয়। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মোনার অবচেতন মন সায় দেয়,এটা প্রিয়ম নয় তো? মোনা রুম থেকে মোবাইল এনে নিচের দিকে টর্চ জ্বেলে মারলো। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখ বরাবর পড়লো। মোনার ধারণাই ঠিক হলো, প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে। মোনা টর্চ অফ করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্ধকারে কারণে প্রিয়মের মুখাবয়ব ঠিক বুঝা গেলো না। মোনা বিরক্তিতে চোখ বুঁজে রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। শান্তি পাচ্ছে না, স্বস্তি পাচ্ছেনা কিছুতেই। প্রিয়মের ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মোনার অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠেছে। প্রিয়ম কোন বিরক্ত না করলেও মোনা নিজ থেকে বিরক্ত হচ্ছে। মোনা ফোনটা হাতে নিয়ে প্রিয়মের নম্বরে টেক্সট করল,
“আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে, আমি মানসিক চাপ বোধ করছি। প্লীজ আপনি চলে যান।”
মোনার টেক্সটের অপেক্ষায় ছিলো যেন এতক্ষন। সাথে সাথে রিপ্লাই আসে,
“আমি তো তোমায় বিরক্ত করছি না কোন ভাবে, আমার ভালো লাগছে দাঁড়িয়ে আছে। প্রেমবিলাস করছি।”
“আমি বলিনি আপনি আমায় বিরক্ত করছেন, কিন্তু আমার ভালো লাগছে না এমনটা।”
মোনা রাগে ফোন অফ করে রাখলো। মোনার মনে হচ্ছে কোন এক যন্ত্রনা ও’কে তাড়া করছে না। প্রিয়মের এত পাগলামি মোনা আর নিতে পারছে না। মোনা লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। নিশান আজ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও বার বার প্রিয়মের বিষয়টা মোনার চিন্তার জগতে জায়গা করে নিচ্ছে। মোনার ঘুম আসছে না। মোনার মনে হচ্ছে প্রিয়ম ওখান থেকে চলে গেলে ওঁর অস্থিরতা কমে যাবে। মোনা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে গেলো। মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই প্রিয়মের কথা মনে হলো। প্রিয়ম কি ওখান থেকে চলে গেছে? মোনা ঘুম ঘুম চোখে বেড সাইড থেকে ঘড়িটা হাতে নেয়। বেড সাইডের পাশে থাকা ল্যাম্পের আলোতে সময় দেখে। মোনা ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় যায়। প্রিয়ম চলে গেছে.. মোনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মোনার মাঝে মাঝে মনে হয় এমন এক জায়গায় চলে যেতে যে জায়গায় প্রিয়ম ও’কে খুঁজে পাবেনা। প্রিয়ম কে নিয়ে চিন্তা জোরপূর্বক যেন মোনার স্কন্ধে চেপে বসে।
মোনা ঘুম থেকে উঠে ঠিক করলো আজও ভার্সিটিতে যাবে না। জ্যাকের বাসায় যাবে। প্রিন্সেস’কে দেখতে ইচ্ছে করছে, জ্যাকের সাথে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে। জ্যাকের সাথে কথা বললে মোনার মন ভালো হয়ে যায়। একজন ভালো বন্ধুর মত জ্যাক। এর বেশি জ্যাকের কোন কোন আগ্রহ নেই মোনার। নিশান স্কুলে চলে গেলো। মোনা আজ একাই গেলো। জ্যাকের বাসায় গিয়ে শুনে জ্যাক বাসায় না। আসতে সন্ধ্যা হবে। মোনা প্রিন্সেসের কাছে যায়। প্রিন্সেসের রুমে যেতেই মোনার চোখ দুটো হঠাৎ অবাধ্য হয়ে উঠে। মোনার সেই বেগুনি রঙের ডায়েরি’টা পড়তে ইচ্ছে করছে। ডায়েরি’টা আগের জায়গায় নেই। খুঁজে বের করে ডায়েরি পড়বে? মোনা নিজেকে সংযত করে। এসব একদম উচিত না। প্রিন্সেস কে কোলে নিয়ে মোনা প্রিন্সেসের সাথে নানান কথা বলছে। আর প্রিন্সেসের মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ও মোনার সব কথা বুঝছে। মোনা চমকে যায়। জ্যাক এসেছে। লোকটা তো বলল জ্যাকের আসতে সন্ধ্যা হবে। জ্যাক হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল,
-“সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা হতো না,আপনার কথা শুনে আসলাম। একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং রেখে আসলাম।”
মোনা চমকে গিয়ে বলল,
-“কেন? ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং রেখে আসতে হবে কেন?”
জ্যাক মোনার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“অতিথির প্রতি উদাসীনতা আমার স্ত্রী মোটেও পছন্দ করত না। আমিও তাই এই রীতিতে অভ্যস্ত হলাম।”
মোনা হেসে বলল,
-“আমি তো নিত্য আসা অতিথি।”
জ্যাক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
-“নিশান আসে নি?”
-“না,ও তো স্কুলে গেছে।”
-“ও।”
জ্যাক আর মোনা কফি খেতে খেতে কথা বলছে। প্রিন্সেসের নড়চড়ার জন্য মোনা ঠিক ভাবে কফিতে চুমুক দিতে পারছে না। জ্যাক প্রিন্সেসের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় শাসিয়ে বলে,
-“মাদার, খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো।”
মোনা অনেকক্ষণ থেকে বাসায় ফিরে যায়‌। প্রিয়ম আজ সারাদিনে কোন ম্যাসেজ করেনি, কলও দেয়নি। মোনার সামনেও আসেনি। মোনা এমনটা চাচ্ছিলো তাও না।
(চলবে)

পর্ব-২০
শীতের তীব্রতা একদম কমে এলো। হালকা গরম পড়ছে।সকাল বেলার রোদ’টা মিষ্টি, দুপুর বেলা রোদের ঝাঁঝ খুব বেশী। ভরদুপুরে রোদে হেঁটে মোনার গলা শুকিয়ে যায়। সূর্যের কিরণ যেন তির্যক ভাবে ঠিক মোনার মাথা বরাবর পরছে। মোনা মাথায় হাত দিয়ে দেখে মাথার উপরিভাগে যেন গরম জলীয়বাষ্প বের হচ্ছে। মোনা গিয়েছিল নিশান কে আর্ট স্কুলে ভর্তি করাতে। মোনা চেয়েছিল বছর খানেক পর ভর্তি করাতে কিন্তু জ্যাকের পিড়াপিড়ি’তে এক্ষুনি ভর্তি করাতে হলো।আর নিশানেরও আঁকাআঁকির প্রতি গভীর আগ্রহ। মোনা একটা আইসক্রিম কিনলো, আইসক্রিমটা আরো ঠান্ডা হলে ভালো হতো বোধ হয়। হঠাৎ মোনার চোখে পড়লো শ্রুতি আর সমীর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সমীর স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও, শ্রুতি স্থির নয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভরদুপুরে শুদ্ধ বাংলায় যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে সমীর’কে। মোনা জানে যেকোন একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এমন করছে শ্রুতি। সমীরের ধৈর্যসীমা দেখে অবাক হয় মোনা। মোনা একবার ভাবলো এগিয়ে যাবে, মুহূর্তেই আবার মত পাল্টে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলো।
গত অনেকদিন যাবৎ প্রিয়ম মোনার সামনে আসছে না। মাঝে মাঝে বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন আসে কখন যায় মোনা বলতেও পারে না। ফোন কিংবা ম্যাসেজ কিছুই দেয় না। প্রিয়মের এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড মোনার মনে অহরহ না হলেও, মাঝে মাঝে চিন্তার সৃষ্টি করে। মোনা বাসায় আসে, কিচেনে রাখা সব থালা-বাসন পরিষ্কার করে। গলায় ব্যাথা অনুভব করে, এই গরমেও গলা ব্যাথা! মোনা বিরক্ত হয়। দরজায় পদাঘাতের শব্দ পায় মোনা কিচেনে বসে। তৎক্ষণাৎ মোনা ক্ষীপ্রবেগে দরজার দিকে যায়। কলিংবেল রেখে দরজায় ধাক্কাধাক্কি! মোনার মেজাজ বিগড়ে যায়। দরজা খুলতেই প্রিয়ম উদ্ভ্রান্তের মতো বাসার ভিতরে ঢুকলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মোনা হতভম্ব হয়ে ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম নিষ্পলক দৃষ্টিতে মোনার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত পেরুতেই মোনার ভয় ধীরে ধীরে আক্রোশ আর ক্রোধে পরিণত হতে থাকে। প্রিয়মের চুল গুলো উস্কখুস্ক, নীল চোখ গুলো যেন আরো নীলচে বর্ন ধারন করেছে। দেখে মনে হচ্ছে কোন ফেরারী আসামি, পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হন্তদন্ত হয়ে কারো বাসায় ঢুকে পড়েছে। মোনা কয়েক মুহূর্ত বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে থাকে, রুমে রুদ্ধনিঃশ্বাসের মত স্তব্ধতা নামে। মোনা রুক্ষ গলায় ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,
-“কি ব্যাপার প্রিয়ম ভাই? দরজায় কি কলিংবেল নেই? এভাবে কারো বাসায় ঢুকে পড়া কোন ধরণের ভদ্রতা?”
মোনা একটু থামে। প্রচন্ড বিরক্তে কপাল ভাঁজ করে। আবার বলে,
-“আপনি এক্ষুনি বাসা থেকে বের হন।”
প্রিয়ম ভাবলেশহীন ভাবে বসে থাকে। বেড সাইডে রাখা ল্যাম্প’টার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অকারণে। প্রিয়ম নির্লিপ্ত গলায় বলে,
-“তোমায় দেখতে আসলাম। ইচ্ছে করছিলো কাছ থেকে দেখতে।”
প্রিয়মের উপস্থিতিতে মোনা অস্থির হয়ে উঠে। মোনা বার বার বেড়িয়ে যেতে বলে বাসা থেকে। প্রিয়মের চোখে মুখে নির্লিপ্ততা আগের মতই বিদ্যমান। মোনার দরজা খুলে,দরজার সামনেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়ম ধীর পায়ে মোনার কাছে আছে। মোনার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। মোনা দূরত্ব বজায় রাখার জন্য কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়মের মুখ থেকে উদ্ভট একটা গন্ধ ছড়াচ্ছে, নেশা জাতীয় কিছু খেয়েছে। কিন্তু আচরণ নেশাগ্রস্ত মানুষের মত না, হয়ত অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে। মোনা হঠাৎ রাগে চিৎকার দিয়ে বলে,
-“আপনি কেন এসেছেন এখানে?”
-“তোমায় দেখতে।”
মোনা ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,
-“দেখছেন না আমায়?এবার বেড়িয়ে যান।”
-“হ্যাঁ দেখেছি। বেড়িয়ে যাবো?”
প্রিয়ম প্রশ্ন নিজেকে নিজে করেছে মনে হচ্ছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“আচ্ছা চলে যাচ্ছি। মোনা তুমি তো লেখাপড়া করছো না ঠিকমত। লেখাপড়া মেইন পয়েন্ট এটা চালিয়ে যেতেই হবে। আমি যতই বাজে কাজ করেছি কিন্তু লেখাপড়াও ঠিকঠাক চালিয়ে নিয়েছি। আর আমার ব্রেন অসম্ভব শার্প। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ফেলেছি এখন হাই স্যালারির একটা জব হয়ে যাবে। তারপর তোমায় নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করবো।”
শেষ উক্তিটা মোনার কানে তীরের মত বিঁধলো। মোনা বিরক্তে কপাল ঘুচিয়ে ফেলল।প্রিয়ম যেন বয়স্ক মানুষের মত উপদেশ দিলো গম্ভীর গলায়। নিজ দোষ ,গুণ আত্মপ্রকাশ করলো স্বচ্ছন্দে। প্রিয়ম চলে গেলো। প্রিয়ম’কে বুঝা মোনার পক্ষে দিন দিন দূর্বিষহ হয়ে উঠছে। প্রিয়মের অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড মোনার অহরহ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে যাচ্ছে যেন। মোনা এসব ভাবনায় ডুবে যায়। একটা মানুষ’কে যতই অবজ্ঞা করুক না কেন কোন এক অবসারে সেই মানুষটা’কে নিয়ে হাজারো চিন্তা মাথায় আসবে।
মোনা কিচেন পরিষ্কার করতে ছিলো কিন্তু ঘটনার স্রোতে তা যেন ভুলে গেলো।এই অচেনা প্রবাসে, নির্জন একটা রুমে মোনা যে ভালো আছে তাও না। মোনা ভালো নেই কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। মন খারাপ থাকলেই মোনা ছুটে যায় জ্যাকের বাসায়। মোনা এখানে ভালো নেই কিন্তু মাঝে মাঝে মন ভালো থাকে জ্যাক আর প্রিন্সেসের সান্নিধ্যে। মোনার বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। মায়ের ক্লান্ত চোখ-মুখ ভেসে উঠে প্রায়শ চোখের সামনে। অন্ধকারে একাকিত্বে মোনা স্মৃতিচারণ করে
—–
মোনার পরীক্ষা ঘনিয়ে আসে। প্রস্তুতি তেমন ভালো না। সারাদিন ভার্সিটি,জব ,রাতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে পড়তে ইচ্ছে হয়না। তাছাড়া নিশান কে সামলানো, রান্নাবান্না সব মিলিয়ে পড়ার সময় আর হয়ে ওঠে না। পড়ার সময় পেলেও মোনা কেন যেন পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলো না ভার্সিটির পরিবেশের সাথে।
কয়দিন ধরে মোনা রাতে প্রায় দুইটা-তিনটা পর্যন্ত পড়ে। এখানে আসার মূল কারণ লেখাপড়া। বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে মোনা লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যায়। মোনা পড়া শেষ করে রাত দেড়টার দিকে বারান্দার যায়। আকাশের দিকে তাকায়। এক ফালি বাঁকা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। তারা গুলো হীরার মত ঝলমল করছে। কয়দিন আগেও চাঁদটা পরিপূর্ণ গোলাকার ছিলো। মোনার হাতে থাকা মোবাইলটা ভাইব্রেশন থাকার ফলে ম্যাসেজ আসলে কেঁপে উঠে। অনেক রাত জাগার ফলে চোখে কিছুটা অস্পষ্ট,ঝাপসা দেখছে। মোনা ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল প্রিয়ম ম্যাসেজ করেছে-
“আমি তোমার বাসার কাছাকাছি। বারান্দার নিচে আসবো?এক ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছিলাম। বাসায় ফিরছি, ভাবলাম তোমায় একটু দেখে আসি।”
মোনা ভেবেছিল প্রিয়ম কয়েকদিন জ্বালাতন করে হাল ছেড়ে দিবে। একটা মেয়ের পিছনে এতদিন পরে থাকার মত মানসিকতা প্রিয়মের আছে মোনার জানা ছিলো না। প্রিয়ম সেই আগের মত অদ্ভুতই রয়ে গেছে। ম্যাথ সাবজেক্টের মত কঠিন, যা মোনা এখনও বুঝতে পারছে না।
মোনা রিপ্লাই দিলো,
“এত রাতে আমার বাসার বারান্দার নিচে আপনার কি?খরবদার ভুলেও আসবেন না।”
প্রিয়মের থেকে কোন উত্তর আসলো না। খানিকক্ষণ পর প্রিয়ম এসে গেলো। মোনা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। মোনা চায় না প্রিয়ম এখানে আসুক। মোনার ভালো লাগে না, অস্বস্তি লাগে ভীষণ। এত অবজ্ঞার পরও মোনার প্রতি কোন অভিযোগ নেই, কোন আক্রোশ কিংবা রাগ নেই। মানুষ প্রেমে পড়লে বদলায়। তখন মানুষ মাতাল হয়ে যায়। একজন মানুষ মাতাল অবস্থায় হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তেমনি একজন প্রেমে পড়া মানুষও সব করতে পারে। কিন্তু এসব প্রিয়মের মত মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায়না। প্রিয়মের এসব অপ্রত্যাশিত কাজ আজকাল মোনার ভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। মোনা একবারও বারান্দায় যায় না। প্রিয়ম আছে কিনা চলে গেছে তাও আজকাল জানার আগ্রহ জাগে না। প্রতিনিয়ত প্রিয়মের এমন আচরণ দেখতে দেখতে মোনা যেন তেতো হয়ে গেছে। অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে।
প্রিয়ম প্রায় প্রতিদিনই মোনার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে গাড়ি নিয়ে। প্রতিদিন মোনা কে বলবে,’চলো পৌঁছে দিই।’ মোনা একদিনও প্রিয়মের গাড়িতে আসেনা, গ্রাহ্য করেনা। তবুও রোজ নিয়ম করে প্রিয়ম এই কথাটা বলবে।
প্রায়ই মোনার বাসার সামনে ঘুরঘুর করবে, রুটিন করে মোনা যেখানে কাজ করে সেখানে যাবে বসে থাকবে। মোনার কেন জানি কোন অনুভূতিই জাগে না, প্রিয়মের কোন কাজই মোনার অনুভূতি কে জাগ্রত করতে পারেনা। হয়ত মোনার মন কঠিন হয়ে যাচ্ছে কষ্ট সহ্য করতে করতে।
—–
লিলি বেগম মোনার উপর রাগ করে আছে, কিন্তু প্রকাশ করছে না। রাগের মূল কারণ মোনা রাজি হয়না লিলি বেগমের বাসায় যেতে। কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আপনজনের রাগ বিরক্তের কারণ হয়ে উঠে।মোনারও তাই হয়েছে। মোনা যদি তাঁদের বাসায় না যায় তাহলে মনে হচ্ছে এই রাগ যাবে না। কিন্তু তা মোনার দ্বারা কখনো সম্ভব না। মোনা কখনো যাবে না। লিলি বেগম বার বার জিজ্ঞেস করবে,’কেন যাবি না তুই আমার বাসায়?’ এ প্রশ্নের উত্তর মোনার কাছে আছে। কিন্তু বলতে গেলে মনে হয় কেউ ভিতর থেকে গলা চেপে ধরেছে মোনার। মোনার গলা ধরে আসে। ভিতর থেকে কথা বের হয়না। মোনা চায় না এসব কখনো বলতে।
মোনা লিলি বেগম কে ফোন দিয়ে আসতে বলে। মোনা জানে লিলি বেগম যতই রাগ করে থাকে কিন্তু আসবে। এ ব্যাপারে মোনার ধারণা মিথ্যা হয়না। লিলি বেগম আসে। লিলি বেগম আসলে মোনার আর রান্না ঘরে যেতে হয় না। লিলি বেগম বার বার মোনা কে বুঝিয়ে বলবে,’জবটা ছেড়ে দে, কত ডলারই বা পাস মাসে?’ এ কথা শুনলেই মোনার মুখ শক্ত হয়ে আসে।
লিলি বেগম থাকাকালীন একদিন জ্যাক আসে প্রিন্সেস কে নিয়ে মোনার বাসায়। জ্যাক যখনই আসবে,প্রিন্সেস’কে নিয়ে আসবে। লিলি বেগম দরজা খুলে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়।জ্যাক চমকে যায়। অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
-“এ বাসায় তো মোনালিসা থাকে।”
লিলি বেগম ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি টানে। জ্যাক হাসি দেখে সহজ হয়। লিলি বেগম বলে,
-“হ্যাঁ,হ্যাঁ ভিতরে আসো।”
জ্যাক প্রিন্সেস’কে নিয়ে ভিতরে এসে বসে। লিলি বেগম বলে,
-“মোনালিসা শাওয়ার নিচ্ছে। অপেক্ষা করো।”
জ্যাক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।লিলি বেগমের চোখ যায় প্রিন্সেসে দিকে। সদ্য ফোঁটা ফুলের মত পরিস্ফুট প্রিন্সেস! লিলি বেগম বলে,
-“হাউ সুইট বেবি!”
মেয়ের প্রশংসা শুনলে যেন খুশি হয় জ্যাক। মোনা বাথরুম থেকে কথার শব্দ পায়। ভেবে নেয় লিলি বেগম এ বাসায় তাই প্রিয়ম নয়ত এরিক এসেছে, হাবিব সাহেব কখনো আসে না।
মোনা বেড়িয়ে দেখে জ্যাক আর প্রিন্সেস এসেছে। মোনা ভেজা কাপড় শুকাতে দিয়ে দ্রুত রুমে আসে। চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে পেঁচানো। ভালো করে না ঝাপটানোর ফলে তোয়ালে ভিজে চুলের পানি দুই-এক ফোঁটা গড়িয়ে ফ্লোরে পরছে।
মোনা কে দেখেই অভ্যাস অনুযায়ী প্রিন্সেস ঝাঁপিয়ে পড়ে মোনার কোলে। লিলি বেগম আড়চোখে দেখছে। বুঝতে পারছে না, এঁদের সাথে মোনার কিসের এত খাতির?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here