মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৩+১৪
মোনা বাসায় ফিরে রুমে ঢুকে দেখে নিশান বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। নিশানের মাথার কাছে বসে নিশানের পিঠে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে জ্যাকের একজন কাজের লোক বার বার বলছে,
-“হোয়াই আর ইউ ক্রাইং?প্লীজ টেল মি?ডোন্ট ক্রাই, ডোন্ট ক্রাই।”
প্রথমত নিশান ইংরেজি বুঝে না আর দ্বিতীয়ত বুঝলেও উত্তর দিতে পারতো না। মোনা কে দেখে লোকটা রুম থেকে চলে গেল। মোনা নিশানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-“এই নিশান,নিশান।”
নিশান যেন এই ডাকের অপেক্ষা করছিল। তড়াক করে উঠে বসে। মোনা শক্ত গলায় বলল,
-“তোমায় কান্না করতে না করেছিলাম না? তুমি অযথা কেন কান্না করে ওঁদের বিরক্ত করছ?আমার কি ভার্সিটি তে যেতে হবে না? ভার্সিটিতে তোমায় নিয়ে যেতে পারব?”
নিশান কান্না ভেজা চোখে মোনার দিকে তাকায়। ইশারায় বলে,
-“আমি তো তোমায় ছাড়া থাকতে পারিনা।”
-“আমি তো আমায় ছাড়া থাকতে বলিনি। আমি যেটুকু টাইম ভার্সিটিতে থাকি অতটুকু টাইম একা থাকতেই হবে। কিছু করার নেই। তুমি যদি এমন পাগলামি করো তাহলে কিন্তু তোমায় লাগেজ ভরে প্লেনের পাখার সাথে বেঁধে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবো।”
নিশানের কান্নার গতি বেড়ে গেলো। মোনা হেসে নিশানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে গলায় বলল,
-“মজা করেছি।‌‌‌কান্না থামাও। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমায় খাইয়ে দিচ্ছি।”
মোনা একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।‌ নিশান কে নিয়ে কি করবে ভেবে পায়না। নিশান কাঁদলে মোনার খারাপ লাগে খুব বেশী।ভার্সিটি, জব সব মিলিয়ে কত সময় একা থাকতে হবে নিশানের। মোনা ফ্রেশ হয়ে এসে নিশান’কে খাইয়ে দেয়। ছোট বেলা থেকে সব সময় মায়ের হাতে খেতে খেতে এমন অভ্যাস হয়েছে হাত দিয়ে খেতে পারেনা নিশান। মোনা ভাবছে ও যখন বাসায় থাকবে না তখন নিশান খাবে কিভাবে?থাকবে কিভাবে?
-“আর খাবে?”
নিশান মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে।
-“আচ্ছা তুমি তাহলে বসো , আমি প্রিন্সেস’কে নিয়ে আসছি।”
মোনা প্রিন্সেসের রুমে গিয়ে দেখে প্রিন্সেস হাত-পা নাড়াচ্ছে আর একা একা হাসছে। মোনা কোলে তুলে নেয়।
-“প্রিন্সেস একা একা হাসছে কেন এভাবে?”
মোনার কথা শুনে প্রিন্সেসের হাসি যেন বাড়লো। মোনা প্রিন্সেসের নাক আলতো করে টেনে বলে,
-“এই বুড়ি হাসছিস কেন? তুই আমার কথা বুঝিস?”
মোনা প্রিন্সেসের গালে, চোখে চুমু খায়। প্রিন্সেস কে চুমু দিলে ওর মুখে কেমন একটা বিরক্ত ভাব ফুটে উঠে। বাচ্চা’রা চুমু খাওয়া পছন্দ করেনা কেন মোনা বুঝে না। মোনা বসে বসে ভাবছে প্রিয়মের কথা। প্রিয়মের ভাব দেখে মনে হয়েছে মোনা কে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলো। আসলেই কি চিন্তিত ছিলো? মোনা চায়নি ও বাসার কারো মুখোমুখি হতে আর। কিন্তু প্রিয়ম বাসায় গিয়ে নিশ্চই বলবে আর লিলি বেগম মোনার ভার্সিটির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। লিলি বেগমের প্রশ্নের কি উত্তর দিবে?যুক্তিযথ কোন মিথ্যা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সত্যি কথা মোনা কখনো কখনোই বলতে পারবে না, কখনোই না।
জ্যাক বাসায় আসে। মোনা প্রিন্সেস কে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। জ্যাক নিচ থেকে হাত নাড়ায়। মোনা হাসে, প্রিন্সেস’কে দেখানোর চেষ্টা করে জ্যাক আসছে। কিন্তু প্রিন্সেসের দৃষ্টি সে পর্যন্ত যায় না। জ্যাক কাছে আসতেই প্রিন্সেস জ্যাকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জ্যাকের চোখে মুখে মেয়ে’কে দেখার তীব্র তৃষ্ণা। জ্যাক কিছুক্ষণ প্রিন্সেস’কে নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কোন অসুবিধা হয়নি তো মোনালিসা?”
-“না।”
-“আপনাদের জন্য বাসা ঠিক করেছি,আমার এত বড় বিজনেস ,জব তো আপনি সেখানেই করতে পারেন।”
কথা বলতে বলতে জ্যাক বাসার ভিতরে যায়। জ্যাক ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় বসে।
-“উফ!কি লং জার্নি।”
মোনা তাকায় জ্যাকের দিকে।ওর এই দুঃসময়ে জ্যাক যেন আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলো। তীব্র খরার পর এক পশলা বৃষ্টি তে যেমন মানুষের মন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়, মোনার মনও প্রশান্তি’তে ছেয়ে যায়। আল্লাহ কখনো সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেয় না, কোন না কোন একটা দরজা, একটা উপায় কিংবা একটা মাধ্যম ঠিকই বের করে দেয়। মোনার এই খারাপ সময়ে জ্যাক ও ঠিক তেমন।
__
প্রিয়মের কথা শুনে লিলি বেগমের চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ে। বিস্মিত গলায় বলে,
-“তুই সত্যি দেখেছিস তো?”
-“উফ্ আম্মু! তুমি আমায় পাগল করে ছাড়বে। আমি ওর সাথে কথা বলেছি,ওর হাত ধরেছি। কিন্তু ও আমার সাথে এমন বিহেভ করেছে যেন আমাদের উপর ওঁর অনেক ক্ষোভ।”
-“আমি মোনা’কে এই কয়দিনে যতটুকু চিনেছি তাতে আমার মনে হচ্ছে না মোনা কোন কারণ ছাড়া এবাড়ি থেকে চলে গেছে। নিশ্চই কোন কারণ আছে যা আমরা জানি না।”
-“কারণ আছে কিনা জানিনা, কিন্তু ওঁদের এভাবে চলে যাওয়া’টা অদ্ভুত লেগেছে আমার কাছে।”
লিলি বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মোনার কোন ক্ষতি হয়নি, ওঁরা দুইজন ঠিক আছে এই ভেবে। ওঁরা যে কারণেই চলে গেছে যাক।লিলি বেগম এই কয়দিন চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। প্রিয়ম’কে বলল,
-“আমি কাল যাবো ওঁর সাথে দেখা করতে। আমায় নিয়ে যাস কাল।”
প্রিয়ম ওঁর রুমে গেলো। মোনা মেয়েটা সাধারণের মধ্যেও কেমন অসাধারণ। এমন বিশেষত্ব প্রিয়ম কখনো এখানকার মেয়েদের মধ্যে খুঁজে পায়নি। কয়েক দিন যাবৎ নাইট ক্লাবেও যাচ্ছে না প্রিয়ম। অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে। প্রিয়ম গভীর ভাবে ভাবছে মোনার কথা। মোনার বিষয়টা প্রিয়ম’কে এত ভাবাবে প্রিয়ম বুঝতে পারেনি। মোনা আগের রাগ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিল?নয়ত কেন এমন করছে? প্রিয়ম গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়। রুমে একা একা থাকলেই মোনা’কে নিয়ে সব চিন্তা এসে ঘাড়ে চাপে।
জ্যাক বাসায় এসে বিশ্রাম নিলো অনেকক্ষণ। তারপর মোনা কে রুমে ডাকলো।
-“নতুন বাসায় কবে উঠছেন?”
-“আজই তো উঠতে চাচ্ছিলাম।”
-“দুই ভাই-বোনে থাকবেন, ভয় পাবেন না রাতে? আপনি ভীতু তা আমি জানি।”
মোনা একটু হেসে বলে,
-“না।”
-“আপনি তো ভার্সিটি তে থাকবেন,জব করবেন ,আপনার ভাই তো একা কান্না করবে।”
মোনা চিন্তিত মুখে বলল,
-“এটা নিয়ে তো কিছু করার নেই।”
-“আচ্ছা আপনার ভাইয়ের একটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে,কথা বলতে পারে না। তাই বলে সে লেখাপড়া করবে না? কত মানুষ রয়েছে হাত-পা নেই অথচ পৃথিবী জয় করে ফেলে।”
জ্যাকের কথায় মোনা ভাবনায় পড়ে যায়। আসলেই মোনা কখনো নিশানের লেখাপড়া নিয়ে ভাবে নি কখনো। এত সব প্রবলেমের মধ্যে ভাবার সময় কোথায়? জ্যাকের দিকে মোনা বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটা এত কিছু বুঝে কিভাবে? এত কিছু ভাবে? আমেরিকার মত জায়গায় কিভাবে ভাই’কে লেখাপড়া করাবে?
জ্যাক আবার বলল,
-“আপনি ভার্সিটি তে থাকবেন আপনার ভাই স্কুলে থাকবে। এখানে অনেক ভালো স্কুল।”
মোনা চিন্তিত গলায় বলল,
-“আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলেন তো? আপনি কেন আমায় এত হেল্প করছেন? আপনি কি সবাইকে এমন হেল্প করেন?”
জ্যাক হেসে বলে,
-“আমি এত হেল্পফুল মানুষ না। আপনায় হেল্প করার কারণ আছে, সেটা অন্যদিক বলবো।”
-“এখন বলা যাবে না?”
-“না।”
মোনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“আপনি বলেছিলেন না আপনার বিজনেস আছে,সেখানে জবের কথা। আমি জবটা করবো না।”
জ্যাক ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“কেন?”
-“কারণ এই জবটা করার যোগ্যতা আমার এখন পর্যন্ত হয়নি। আপনি আমার প্রতি সহানুভূতি থেকে জবের অফার’টা করেছেন জ্যাক। আমি চাই নিজের যোগ্যতায় কোনো কিছু করতে।”
-“এই মেয়ে আপনি তো আমায় ইমপ্রেসড করে ফেলেছেন। আচ্ছা তাহলে তুমি লেখাপড়া আগে কমপ্লিট করেন। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ,তোমায় জোর করব না।”
জ্যাকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মোনার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। পৃথিবীতে কিছু মানুষ হাসনেহেনা ফুলের মত স্নিগ্ধ, পবিত্র হয় আর কিছু মানুষ নর্দমার কীট। জ্যাক মোনার চাহনির অর্থ বুঝতে পেরে বলল,
-“আপনি আমায় যতটা ভালো ভেবেছেন আমি ততটা ভালো নই মোনালিসা, বলতে পারেন আপনার জন্য ভালো।”
মোনা উত্তরে হাসলো শুধু। কি এমন কারণ? জ্যাকের সাথে তো আমেরিকায় এসেই দেখা হলো। কি কারণ থাকতে পারে? কারণটা ভালো না খারাপ? জ্যাক বলল,
-“ঘাবড়াবেন না। কোন খারাপ কারণ নেই।”
-“আপনি মন পড়তে পারেন?”
-“না চোখের ভাষা বুঝি।”
মোনা নিজের ব্যাগ, লাগেজ গোছাচ্ছে। খারাপ লাগছে এখানে থেকে যেতে। জ্যাক,প্রিন্সেস দুইটা মানুষের জন্য তীব্র মায়ার জন্ম হয়েছে।মোনার অদ্ভুত এক কারণে কান্না পাচ্ছে। এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে যেন। মোনা ঠোঁট চেপে কান্না চাপানোর চেষ্টা করছে। মোনার এই ছোট্ট জীবনে খুব কম মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা, সহানুভূতি পেয়েছে। তাই হয়ত এমন হচ্ছে।
জ্যাক গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোনা আর নিশাক কে নতুন বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মোনা বার বার বাসা’টার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। জ্যাক হেসে বলল,
-“এভাবে না তাকিয়ে থেকে যান।”
মোনা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলো। জ্যাকের কোলে প্রিন্সেস। মোনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে প্রিন্সেস বুঝতে পেরেছে মোনা চলে যাচ্ছে। মোনার বুকের সাথে মিশে আছে। জ্যাক মোনার কোলে থেকে নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রিন্সেস কে, প্রিন্সেস ঘাপটি মেরে আছে। মোনা হাসছে। কেয়ারটেকার কে বলল,
-“ও’কে নিয়ে যাও,আমরা বের হবো।”
কারো কোলে যাবে না প্রিন্সেস। জ্যাক বিরক্ত হয়ে তাকায় প্রিন্সেসের দিকে।রাগি গলায় বলে,
-“প্রিন্সেস এদিকে এসো।”
মোনার কোল থেকে জোর করে নিতেই কান্না শুরু করে। মোনার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। ফ্যাকাশে মুখে তাকাচ্ছে প্রিন্সেসের দিকে। জ্যাক বলল,
-“মোনালিসা আপনিও কি প্রিন্সেসের মত কেঁদে দিবেন?”
মোনা ম্লান হেসে গাড়িতে উঠে। হাত নাড়িয়ে প্রিন্সেস কে টাটা দিচ্ছে।
(চলবে)

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৪
জ্যাক মোনা আর নিশান’কে বাসায় পৌঁছে দেয়। ওঁদের সাথে সাথে বাসার ভিতরে আসে। আশ্বস্ত গলায় বার বার বলল,
-“নার্ভাস হবেন না মোনালিসা। আমি বলে দিয়েছে কোন ধরণের প্রবলেম হবে না। আমার উপর আস্থা রাখুন।”
মোনা অসহায় চোখে তাকালো জ্যাকের দিকে।বলল,
-“না নার্ভাস হচ্ছি না।”
জ্যাক পুরুষ্ঠ ঠোঁটের নীচে দু পাটি মোটা দাঁত বের করে হেসে বলল,
-“সিরিয়াসলি নার্ভাস হচ্ছেন না?আয়নায় নিজের চেহেরা দেখুন।”
মোনা চোখে মুখের অস্থির ভাব কাটানোর চেষ্টা করে।জ্যাক মুখে চিলতে হাসি টেনে বসে পড়ে খাটের উপর।
-“ফিরে যাবেন?”
মোনা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-“কোথায়?”
-“আমার বাসায়।”
-“আপনি বেশি বেশি চিন্তা করছেন। আমি থাকতে পারবো।”
নিশান ক্লান্ত ভর করা শরীরে চুপচাপ বসে আছে। রুমের ভিতর নিরবতা বিরাজ করছে। মোনা রুমের চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জ্যাক সব ম্যানেজ করেছে। খুব বড়সড় রুম না। মোনা যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমন’টা। রুমের পাশে সুন্দর একটা বারান্দা আছে। মোনা মাঝে মাঝে কথা খুঁজে পায়না, তখন খুব অস্বস্তিতে পড়ে। জ্যাকের সাথে কথা বলে সঙ্গ দেওয়া উচিত, জ্যাকের প্রতি মনযোগী হওয়া উচিত। মোনা খুঁজে পেল না কি কথা বলবে। জ্যাক নিজেই কথা বলতে শুরু করল।
-“মাঝে মাঝে কফি খেতে আসতে পারি?”
মোনা হাসে।‌ মোনা শুধু ভাবছে কি করলে জ্যাকের করা এত উপকারের ঋণ শোধ করা যাবে। মানুষের কাছে ঋণী হয়ে থাকাটা অস্বস্তিকর। জ্যাক তো স্বয়ংসম্পূর্ন একজন মানুষ। জ্যাকের তো কোন কিছুর প্রয়োজন বোধ নেই। জ্যাকের উপকার করারও সুযোগ নেই।
-“ইচ্ছে হলে প্রতিদিন আসেন কফি খেতে।”
-“আপনি মাঝে মাঝে যাবেন না প্রিন্সেস’সে দেখতে?”
-“যখনই সময় পাবো তখনই যাবো। মায়া পরে গেছে প্রিন্সেসের উপর।”
জ্যাকের ফোনে কল আসে। জ্যাক একটু দূরে সরে কথা বলল। হাতের কব্জিতে থাকা সোনালী বেল্টের ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
-“মোনালিসা আমার যেতে হবে। জরুরী কল আসছে। কোন প্রবলেম হলে যাস্ট কল মি।আমার ধারণা কোন প্রবলেম হবেনা।”
জ্যাক বেড়িয়ে পড়ে। মোনা তাকিয়ে আছে যতক্ষণ জ্যাক কে দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত। জ্যাক মোনার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে মোনা রুমটার প্রতি মনযোগী হলো। মোনার মাথায় একটা প্রশ্ন বার বার নাড়া দিচ্ছে। কি কারণে জ্যাক হেল্প করছে ও’কে? কি কারণ থাকতে পারে? মোনা অবচেতন মনে নানা রকম কারণ খুঁজে। মোনা নিশানের দিকে তাকিয়ে দেখে নিশান ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছে।‌ মোনা’কে একাকিত্বে গ্রাস করে। মোনার ভীষণ রকমের মন খারাপ হয়। এই মন খারাপের কারণ বা ব্যাখ্যা মোনা দিতে পারবে না। মোনা শুধু বুঝতে পারছে ও’র একা থাকতে ভালোলাগছে না।
শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামে। সূর্যের রক্তিম আভায় লালচে রঙ ধারণ করেছে যেন চারদিকের পরিবেশ’টা। মোনার ফ্ল্যাটের পাশেও কয়েক’টা ফ্যামিলি থাকে। তা সত্ত্বেও সব শুনশান, কোন কোলাহল নেই। মোনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোনার চোখ অকারণে ভিজে যাচ্ছে। মোনা দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে, মোনা বার বার ডান হাত দিয়ে চোখ মুছছে। মোনা কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলো, এখন আবার অকারণে কান্না পাচ্ছে। এমন নির্জনতায় মোনার শরীর’টা ভার হয়ে আছে। এই নিরবতায় মোনার কষ্ট বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। মোনা বই নিয়ে বসে। জোর করে পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে।‌‌‌ এখানে লেখাপড়া করতে এসেছে, লেখাপড়া করতে হবে। মোনা মনের বিষন্নতা, বিমর্ষতার বিরুদ্ধে কঠোর হয়। জীবন’টা কে ভালো একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। মোনা কিছুক্ষণ বই ঘেঁটে শুয়ে পড়ে। নিশান সেই কখন ঘুমিয়েছে মাত্র উঠে খেতে চাচ্ছে। মোনা রান্নার কথা ভুলে গিয়েছিলো। ওঁর যে রান্না করতে হবে একথা মোনার মাথায় আসে নি। জ্যাক বলেছে সব ম্যানেজ করে দিয়েছে। মোনা কিচেনে ঢুকে। মোনার রান্নার হাত একদম অনাড়ি। মায়ের কারণে রান্না ঘরে যেতে হয়নি। তারপর থাকলো হোস্টেলে। সেখানে পানির মত ডাল, আর হাঁটু সমান ঝোলওয়ালা ডিম রান্না খেয়েছে। মোনার হোস্টেলের ডাইনিংএ গেলেই কান্না পেতো। গলায় ভাত আটকে যেত।‌ এত জঘন্য রান্না! মোনা সে সব দিন নিয়ে ভাবছে। মোনা রুটি বানায়। অনেক চেষ্টা করেও রুটি গোল হয়নি। মোনার চোখ-মুখে ব্যর্থতার ছাপ। নিজেই হাসছে রুটি দেখে। মোনা নিশান’কে খাইয়ে, নিজে খেয়ে নিলো। খাওয়া করে উঠতেই ফোন বাজলো। মোনা নিশ্চিত জ্যাকের ফোন। মোনা রিসিভ করেই বলল,
-“কি করছেন?”
ওপাশ থেকে বিস্মিত গলায় বলে,
-“শুরুতেই কি করছেন?”
মোনা থমকে যায়। এটা জ্যাকের গলা না। কেউ একজন শুদ্ধ বাংলায় বলেছে কথাটা। মোনা ফোনের স্ক্রিনের দিয়ে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“কে?”
-“প্রিয়ম।”
মোনা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো। মোনা তো সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছিল। ওপাশ থেকে বলল,
-“চুপ কেন?”
-“আপনি?”
-“হ্যাঁ আমি। প্রথমে যেভাবে কথা বলা শুরু করেছিলে মনে হলো অন্য কাউকে আশা করেছ।”
মোনা বিরক্ত ভরা গলায় বলল,
-“আপনি কেন ফোন দিয়েছেন? প্রবলেম কি আপনার? এখনো আমার পিছনে লেগে আছেন। এখন তো আমি আপনাদের বাসায় থেকে আপনাদের বিরক্ত করছি না।”
-“আচ্ছা মোনা রিল্যাক্স। আমি কি কখনো বাসায় থাকা নিয়ে কিছু বলেছি?”
মোনা চুপ করে আছে।
-“আমি তোমার বাসার নিচে। তোমায় ভীষণ ভাবে মিস করছি। দেখতে ইচ্ছে করছে। একটু দেখা করবে?”
মোনা তাচ্ছিল্য করে বলল,
-“আপনি আমায় কখনো খুঁজে পাবেন না।”
-“তোমার মত মোনালিসা কে খুঁজে পাওয়া পাঁচ মিনিটের ব্যাপার।”
মোনা এবার কিছুটা সিরিয়াস ভাবে নিলো কথাটা। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। প্রিয়ম কি ও’কে বোকা বানাচ্ছে? মোনা দ্রুত বারান্দায় গেলো। মোনা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। প্রিয়ম সত্যি এসেছে? কিভাবে সম্ভব? মোনা নিজের চোখ কচলিয়ে ভালো করে দেখল চোখে কি ভ্রম দেখছে? মোনা দৌড়ে রুমে চলে আসে। ফোন কানের কাছেই।
-“কি চলে গেলে কেন? বিশ্বাস হয়েছে?”
মোনা চুপ হয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
-“কি চান আপনি? আমি তো আমেরিকান মেয়েদের মত ফার্স্ট ক্লাস না,শর্ট-কাট কাপড় চোপড় পড়ি না। আমি বাঙালি থার্ড ক্লাস, ন্যারো মাইন্ডেড মেয়ে। আমার জন্য নিজের টাইম নষ্ট না করে এখান থেকে চলে যান। আপনি কিন্তু আমায় মেন্টাল টর্চার করছেন।”
প্রিয়ম নির্লিপ্ত গলায় বলল,
-“নদীর পাড়ে যাবে? সুন্দর বেঞ্চ পাতানো আছে। সুন্দর টলমলে পানি জোছনার আলোর সাথে খেলা করে।”
-“আর ইউ ওকে? ট্রিটমেন্ট দরকার আপনার। রাখছি। নাইট ক্লাবে যান ফুর্তি করেন।”
-“আমি তোমায় ভীষণ ভাবে মিস করছি। তোমার জন্য—”
প্রিয়মে কথা শেষ না হতেই ফোন কেটে দিলো মোনা। বিরক্তিতে চোখ বন্ধ খাটের উপর বসে আছে। ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছে। অনেকক্ষণ কেটে যায়। মোনা কৌতুহলী হয়ে উঠে। প্রিয়ম কি এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে? মোনা উঁকি মেরে দেখে কেউ নেই। মোনা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। রুমে এসে শুয়ে পড়লো। প্রিয়ম কেন এমন আচরণ করছে?মোনা বার বার ভাবছে। প্রিয়মের বিষয়টা মোনা না চাইলেও মোনা’কে ভাবাচ্ছে।
মোনা সকালে ঘুম থেকে উঠলো। ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখেছিল। মোনা ফ্রেশ হয়ে কিচেনে গিয়ে নাস্তা তৈরি করে। নিশান ঘুম থেকে উঠে মোনার কাছে রান্নাঘরে যায়। মোনার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। মোনা ভার্সিটিতে জন্য রেডি হচ্ছে। নিশান মুখ ভার করে তাকিয়ে থাকে। মোনা নিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-“মন খারাপ করে না, কয়েকদিন পর তুমিও স্কুলে যাবে। তখন একা থাকতে হবেনা।”
মোনা বাসা থেকে বের হয়। জ্যাক এর ভিতর একবারও ফোন দেয়নি। মোনার পাশে এসে কার থামে। মোনা তাকিয়ে দেখে জ্যাক। মোনা’কে দেখে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটালো।
-“মোনালিসা গাড়িতে উঠুন। পৌঁছে দিই।”
মোনা গাড়ি তে উঠলো। প্রিন্সেসের কথা জিজ্ঞেস করলো। জ্যাক বলল,
-“কাল থেকে আমি নিঃশ্বাস ফেলানোর সময় পাইনি। একবারও ফোন দিতে পারেনি। সব ঠিকঠাক আছে?”
-“হ্যাঁ সব ঠিকঠাক।”
-“আমি যাবো একটু ফ্রী হয়ে কফি খেতে। আর হ্যাঁ প্রিন্সেস’কে নিয়ে যাবো ওটা আর বলতে হবে না। প্রিন্সেসের সেই কান্না থামাতে দুই ঘন্টা লেগেছে।”
মোনা ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামায়। আজকেও একাকী ক্লাসে বসে থাকতে হলো। মোনা মনোযোগ বসাতে পারছে না ক্লাসে। সবাই আড্ডা দিচ্ছে, হৈচৈ করছে আর মোনা চুপচাপ বসে আছে। কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস রপ্ত করতে পারেনি। ভার্সিটি ছুটি হওয়ার পর মোনা ভেবে নিয়েছে আজ নিশ্চই লিলি বেগম আসবে। কিন্তু না আসে নি। মোনা কিছুটা আশাহত হলো। মোনা রৌদ্রজ্জ্বল পথ দিয়ে হাঁটছে, আজ রোদটা একটা প্রখর। এখানে তেমন ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। চারদিকে নির্জন, মাঝে মাঝে দুই একটা ইংরেজি তে বলা কথা শুনা যায়।
-“এ্যাই, এ্যাই।”
এই অচেনা শহরে মেয়েলি কন্ঠে কে ডাকবে মোনা কে।মোনা পিছনে ফিরে তাকায়। গায়ের রং কুচকুচে কালো, চুল গুলো চোখে পড়ার মত লম্বা মেয়েটার। চোখ গুলো ঝলঝল করছে। মেয়েটা শুদ্ধ বাংলায় বলল,
-“তুমি বাঙালি? তোমায় দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”
-“হ্যাঁ।”
মেয়েটার কথাবার্তায় চঞ্চলতা রয়েছে। সুস্থির নয়, অস্থির ভঙ্গিতে কথা বলছে।
-“আমি শ্রুতি। ইন্ডিয়াতে বাসা। ক্লাসে সব সময় চুপচাপ থাকো কেন? অমনোযোগী থাকো।”
মোনা বুঝতে পেরেছে মেয়েটা ওঁর সাথেই পড়ে। মোনা খেয়াল করেনি। মোনা একটু হেসে বলল,
-“আমি মোনালিসা, বাংলাদেশী।”
দুইজন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলো। শ্রুতির কথা বলার ভঙ্গি অসাধারণ। অসম্ভব রকমের চঞ্চল, গুছিয়ে কথা বলে। চোখে মুখে চপলতা রয়েছে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here