#মনোপ্যাথি
#পর্ব:১০
#অরিত্রিকা_আহানা

আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি।কিন্তু ঘুম কি আসে? পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলাম ইনায়াজ ভাই বেডের পাশে চেয়ারে বসে নিউজফিড স্ক্রল করছে।আমি চোখ খুলতেই ধরা খেয়ে গেলাম,
ইনায়াজ ভাই ফোন থেকে চোখ না তুলেই বলল,”হুউ!..ঘুমাও!”
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
উনি ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন।চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই আমি খপ উনার হাত চেপে ধরলাম।
-“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
-“যাচ্ছি না তো।পানি খাবো।”
আমি উনার হাত ছেড়ে দিলাম।উনি পানির গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা খেলেন।আমার হৃদপিন্ডে তখন ভূমিকম্প।উনার এডামস এপলটা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।সহ্য হলো না।অধৈর্য গলায় বললাম,”পানি খাবো।”

ইনায়াজ ভাই পানির গ্লাস এনে আমার হাতে দিলেন।কিন্তু আমার হাতদুটো অনবরত ভাবে কাঁপছে।তারচেয়ে বেশি কাঁপছে আমার শরীর!রীতিমত ঝাঁকুনি দিচ্ছে!
ইনায়াজ ভাই আমার হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে নিজেই আমার মুখের সামনে ধরে ইশারা করলেন খাওয়ার জন্য।আমি বোকার মত উনার দিকে চেয়ে আছি।আজকে কি হচ্ছে আমার সাথে? আমি কি সত্যি সত্যি বেঁচে আছি? না মরে গেছি?নাকি পুরোটাই আমার ভ্রম।
ধ্যান ভাঙলো ইনায়াজ ভাইয়ের ডাকে।
-“পানি খাবে না?”
আমি মাথা দুলিয়ে না বোঝালাম।ভেবেছিলাম উনি বিরক্ত হবেন।কিন্তু উনি স্বাভাবিকভাবেই পানির গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে দিলেন।তারপর আবার চেয়ারে বসে বললেন,”এবার ঘুমাও।”
আমি আবারও বোকার মত উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।উনি কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”কিছু বলবে?”
আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম।
-“তাহলে ঘুমাচ্ছো না কেন?”
-“ঘুম আসছে না।”
-“আসবে।তুমি চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো।দেখবে ঠিক ঘুম চলে আসবে!”
উনি এত সুন্দর করে কথাটা বললেন যে আমার চোখদুটো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেলো।আমি ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো নার্সের ডাকে।বাসা থেকে বাবা,আপু, আর ইমু এসেছে,বারোটার দিকে আমাকে রিলিজ দেওয়া হবে।এখন বাজে সাড়ে আটটা।
আপু ভেতরে ঢুকে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,”ঘুম কেমন হয়েছে?”
আমি হাসলাম।গত কয়েকমাসে এত ভালো ঘুম হয়েছে কি না সন্দেহ আছে।একেএকে সবাই ভেতরে ঢুকলো।নাফিস ভাইও এসেছে।হাসিহাসি মুখ!চোখদুটো খুশিতে ঝলমল করছে।

সবার কথা বলা শেষে আপু বললো,”নাফিস কিছুক্ষন থাকুক তনুর পাশে।আমরা বাকি ফর্মালিটিজ গুলো সেরে নেই।”
ওরা বেরিয়ে গেলে নাফিস ভাই আমার পাশে বসলেন।নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”কেমন আছো এখন?”
-“ভালো।”
-“এই কয়েকদিন অনেক টেনশনে ছিলাম!”
আমি ভদ্রতাসূচক হাসি দিলাম।নাফিস ভাই বোধহয় মনঃক্ষুণ্ণ হলেন।পরোক্ষনেই আবার খুশি খুশি গলায় বললেন,”একটা গুড নিউজ আছে।”
-“কী?”
-“নাহ!বাসায় গেলে বলবো।”
-“আচ্ছা!”
-“থাক এখনই বলি?”
উনার অবস্থা দেখে আমি হেসে ফেললাম।বললাম,”বলুন!”
-“আমার প্রমোশন হয়েছে।”
-“বাহ!”
নাফিস ভাই বোধহয় এবারও হতাশ হলেন।আমার কাছ থেকে যেই পরিমান উচ্ছ্বাস আশা করেছিলেন তা আমি প্রকাশ করতে পারি নি।আমি উনার প্রমোশনের খবর শুনে খুশি হয়েছে।কিন্তু উনি যেই অর্থে খুশি বোঝাতে চাইছেন তা আমি হতে পারলাম না।
উনি মনে মনে হতাশ হলেও আমাকে বুঝতে দিতে চাইলেন না।ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বললেন,”থ্যাংকস!”
-“কেন?”

নাফিস ভাই কৃতজ্ঞতাসূচক হাসি হেসে বললেন,”বিয়েতে রাজী হওয়ার জন্য।আমি অনেক টেনশনে ছিলাম,ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় সত্যি সত্যি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। তারপর ভাবী যখন বলল তোমার বিয়েতে কোন আপত্তি নেই আমি বিশ্বাসই করতে পারতে পারছিলাম না।মনে হলো স্বপ্ন দেখছি।এরপর আংকেল নিজে ফোন করে বাবাকে পাকা কথা দিলেন।থ্যাংকস তনু আমাকে ক্ষমা করার জন্য।”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমি তো ভুলেই গেছিলাম সেদিন রাতের কথা!..বাবা কি সত্যি সত্যি পাকা কথা দিয়ে ফেলেছেন?
নাফিস ভাই উদ্বেগ নিয়ে বললেন,”তুমি খুশি হও নি তনু?”
-“আমি একটু রেস্ট নিবো নাফিস ভাই।হঠাৎ করে মাথা ব্যথা করছেন।”
নাফিস ভাই চূড়ান্ত রকমের হতাশা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।শুধু বললেন,”আসি!”

নাফিস ভাই যাওয়ার কিছুক্ষন পর ইনায়াজ ভাই এসে ঢুকলেন।
হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,”সব ঠিকঠাক?.ঘুম হয়েছে ভালোমত?”
আমি কিছুক্ষন ইনায়াজ ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।তারপর উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে কঠিন গলায় বললাম, “আপনি এখান থেকে চলে যান ইনায়াজ ভাই!”
ইনায়াজ ভাই বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালেন,কিন্তু আমি চোখেমুখে সেই একই দৃঢ়তা নিয়ে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
উনি কি বুঝলেন কে জানে।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে সরে গেলেন।উনি চলে যেতেই আমি বালিশ আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।আমি কি করবো?যেই মানুষ মুখ ফুটে বলার পরও আমার আকুলতা বোঝে নি তাকে আর বুঝতে দিতে চাইলাম না।

আমার সমস্ত মন প্রান জুড়ে এক বিষাদের ছায়া নামলো।যার ঘোর অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। উপুড় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছি খবর নেই।
ঘুম ভাঙ্গলো নার্সের ডাকে।একটু পরই আমাকে রিলিজ করা হবে।

বাসায় এসে ভাবছি হস্পিটাল থেকে চলে আসার আগে একবারও ইনায়াজ ভাইকে দেখলাম না।নিশ্চই চলে গেছে।ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় মরে যাচ্ছি আমি।কেন কালরাতে আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না।কি করলাম আমি? কেন উনাকে জানাতে গেলাম।যতই এসব ভাবছি ততই ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে মরে যাচ্ছি।কেন জানি না মনে হচ্ছে এটাই উনার সাথে আমার শেষ দেখা।আর কোনদিন হয়ত উনাকে দেখতে পাবো না।

দুপুরে গোসলের পর খাটের ওপর বসে চুল শুকাচ্ছিলাম।আমার চোখ গেলো টেবিলের ওপর পড়ে থাকা আমার রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের দিকে।
আমি কি মনে করে সেগুলো খুললাম আমার রিপোর্টে কি এসেছে দেখার জন্য।কিন্তু ফাইলটা খুলতেই প্রেসক্রিপশন এর ওপর লিখাটার দিকে আমার চোখ আটকে গেলো।
আমি হাত দিয়ে একবার লেখাটা ছুঁয়ে দেখলাম।লিখাটা ছুঁতেই আমার হৃদপিন্ডের ধুকপুক ধুকপুক বেড়ে গেলো।শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো।অদ্ভুত এক উত্তেজনা অনুভব করছি।সেটা দুঃখের না সুখের আমি জানি না।আবারও হাত দিয়ে লিখাটা স্পর্শ করলাম।চোখ বন্ধ করে চুমু খেলাম তাতে।প্রেসক্রিপশন এর ওপর সেই মানুষটার নাম লিখা যে নিজেই আমার রোগের কারন।
ডাঃ ইনায়াজ আহমেদ,এমবিবিএস,
বিসিএস (স্বাস্থ্য),এফসিপিএস পার্ট-২(মেডিসিন).
আমার ভেতরটা হঠাৎ ডুঁকরে কেঁদে উঠলো উনি কি আমার ওপর অভিমান করে চলে গেছে?একবার আমার কষ্টটা বুঝলো না?

আপু দুপুরবেলা ভাত নিয়ে এলো আমাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য।আমি খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম,”আমার ট্রিটমেন্ট কে করেছে আপু?”
কেন জিজ্ঞেস করলাম জানি না।হয়ত উত্তরটা বারবার শুনতে চাই বলে।
আমার কথা শুনে আপু অবাক হয়ে বললো, “কেন তুই জানিস না?”
আমি বললাম, “না!”
-“ইনায়াজ ভাই।উনি তো হস্পটালেই ছিলো তুই দেখিস নি?”
আমি শুধু বললাম, “ঘোরের ভেতর ছিলাম তাই মনে নেই হয়তো!”
আমি ভেবেছিলাম ইনায়াজ ভাই আমাকে দেখতে এসেছে।কিন্তু আমার ট্রিটমেন্ট যে উনি করেছে সেটা আমি জানতাম না।অথচ হস্পিটাল থেকে চলে আসার সময় একবার সামনে পর্যন্ত এলেন না।

আপু মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করতে পারে নি।আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।

পরেরদিন সকালবেলা নিজের ঘরে শুয়ে আছি।এমন সময় আপু বলল,”নাফিস এসেছে তোর সাথে দেখা করার জন্য!”
আমি কিছু বললাম না।আপু নাফিস ভাইয়াকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলো।নাফিস ভাই আমার পাশে বসলেন।আমি খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম।উনি আমাকে ভালো করে একবার দেখে নিয়ে বললেন,”ভালো আছো?”
-“হুম!”
-“একটা কথা বলতে চাই।”
-“বলুন।”
-“না মানে এইমুহূর্তে বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না।তুমি সবে হস্পিটাল থেকে ফিরলে!”
-“আপনার ইচ্ছে।”
– “আংকেল বলছিলেন আমি আগামীবার ফিরে এলে বিয়ের ডেইট ফিক্সড করবে।আমার ছুটি আর মাসখানেকের মত আছে।তাই চাইছিলাম ছুটি শেষ হওয়ার আগেই বিয়েটা সেরে ফেলতে অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”

উনার কথা শুনে আমি অসহায় চোখে উনার দিকে তাকালাম।উনি আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে কৈফিয়ত দেওয়ার মত করেই বললেন, “তুমি না চাইলে আমি অপেক্ষা করতে পারবো।আমার কোন অসুবিধে হবে না।”

আমি উনার কথার কোন প্রতিউত্তর করলাম না।ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।নিজেকে এতটা অসহায় কোনদিন লাগে নি।ইনায়াজ ভাই কি সত্যিই আমাকে একটুও ভালোবাসে না।আমার এত আকুলতা দেখেও উনি এভাবে চলে গেলেন?আমার ভালোবাসা,অভিমান কি উনি একটুও বুঝে নি? কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
আমার আকস্মিক কান্নাতে নাফিস ভাই ভয় পেয়ে গেলেন।উনার ডান হাতটা আমার মাথার ওপরে রাখতে গিয়ে আবার সংকোচে সরিয়ে নিলেন।নরম গলায় বললেন,”কেঁদো না প্লিজ।”

আমি চোখ মুছে ইনায়াজ ভাইয়ের ওপর অভিমান করে বলে ফেললাম, “আপনি বাবার সাথে কথা বলুন।আমার কোন আপত্তি নেই।”
আমার উত্তর শুনে নাফিস ভাই অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।চোখেমুখে কৌতূহল।
আমি উনার মনের কথা বুঝতে পারলাম,কিন্তু তার উত্তর যে আমি চাইলেও দিতে পারি না।
আমি শুধু বললাম, “আমি রাজি।”
উনার চোখজোড়া খুশিতে ঝলমল করে উঠলো।মুখে তৃপ্তির হাসি।আমি আবারও ঠোঁট চেপে কান্না আটকালাম।
উনি মুখে কোন কথা বললেন না কিন্তু আমি উনার চোখে অপরিসীম আনন্দ দেখতে পাচ্ছি।সেই সাথে আমার জন্য একরাশ ভালোবাসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here