#মনোপ্যাথি
#পর্ব:৯ষ
#অরিত্রিকা_আহানা
একটুপরই আপু ইমতিয়াজ ভাইয়া আর নাফিস ভাইয়াকে নিয়ে আমার ঘরে ঢুকলো।আমাকে দেখেই নাফিস ভাইয়া মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো, “এখন কেমন আছো?”
আমি শুধু বললাম, “ভালো।”
উনি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “ভাবীর কাছে শুনলাম তুমি নাকি নিজের শরীরের প্রতি একটুও যত্ন নাওনা?..হুটহাট ঘুরে পড়ে যাওয়া তো ভালো লক্ষন নয়?..নিজের শরীরের প্রতি এমন অযত্ন করলে চলবে হুম?”
নাফিস ভাইয়ের কথা শুনে আপু নালিশের সুরে বললো, “কাকে কি বলছো তুমি? ওর নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়ার সময় আছে নাকি?সারাক্ষণই চিন্তাবিদদের মত কি জানে ভাবে আল্লাহই জানে।এই তো আজকে দুপুরেও না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
নাফিস ভাইয়া আপুর কথা শুনে আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন।আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।অস্বস্তি লাগছে।
– “এখন থেকে সবসময় শরীরের যত্ন নেবে ঠিক আছে?..আমি কিন্তু অনিয়ম একদম পছন্দ করি না।শরীর ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে।খাওয়াদাওয়ার কোন অনিয়ম করবে না।এই বয়সে প্রতিটা মেয়েরই উচিৎ হেলথ এন্ড হাইজিন মেইনটেইন করে চলা।তা না হলে তাদের গাফিলতির জন্য নেক্সট জেনারেশন সাফার করবে।”
তারপর আবার নিজে থেকেই হেসে উঠে বললেন,”স’রি! লেকচার দিয়ে ফেললাম না?বোঝোই তো মেরিনের মানুষ।ডিসিপ্লিন মেনে চলতে সবাইকে সেই উপদেশ দেওয়াটা অভ্যেসে পরিনত হয়ে গেছে।তুমি কিছু মনে করো না।তোমার বেলায় নাহয় একটু আধটু ছাড় দিলাম।কি বলো?”
আমি কিছু বললাম না।
উনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,”সরি।অনেক বেশি সরি!” আমি বোকার মত উনার দিকে চেয়ে আছে।উনি কি ধরে নিয়েছেন আমি বিয়েতে রাজী?ইচ্ছে করলো উনাকে কিছু কথা শুনিয়ে দেই কিন্তু উনার মুখের ওপর কিছু বলতে পারলাম না।
সন্ধ্যেবেলায় উনি চলে যাওয়ার পর আমি রুমে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম এমন সময় আপু এসে আমার হাতে একটা বক্স ধরিয়ে দিল।
জিজ্ঞেস করলাম, “কি এটা?”
আপু বললো, “দেখতে পাচ্ছিস না গিফট বক্স,তোর জন্য।নাফিস যাওয়ার আগে আমার কাছে দিয়ে গেছে।খোল তো দেখি!”
আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপুর জোরাজুরিতে গিফট বক্সটা খুললাম।অনেকগুলো চকলেট বক্স আর র্যাপিং করা একটা প্যাকেট।প্যাকেটটা খুলতেই দেখলাম কালো আর খয়েরী রংয়ের এক জোড়া জামদানী,সাথে একটা চিরকুট।শাড়িগুলো দেখে আপু বললো, “নাফিসের তো দারুণ পছন্দ।শাড়িগুলো ভীষণ সুন্দর।”
আমি কোনরকম উচ্ছ্বাস বোধ না করে বললাম, “তুমি নিয়ে নাও।আমার তো তেমন শাড়ি পরা হয় না।”
আপু নাকমুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো, “তুই এমন কেন বলতো? বেচারা শখ করে তোর জন্য শাড়ি দিয়ে গেছে ওর তুই আমাকে নিয়ে যেতে বলছিস?ভদ্রতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে?”
মনে মনে ভাবলাম,ভদ্রতা??..এই ভদ্রতা নামক জিনিসটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যাই হোক!আপুকে আর বেশি চটালাম না।ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, “তোমার পছন্দ হয়েছে তাই ভাবলাম তুমি নিলে তো পরতে পারবে আমার তো খুব বেশি শাড়ি পরা হয় না।আচ্ছা সরি!”
আপু শান্ত হলো। বললো, “চিরকুটে কি লিখেছে?”
আমি চিঠিটা খুললাম।গোটগোট হাতে লিখা, “ফর ইউ,স্পেশালি!” নিচে দিকে ছোট্ট করে সরি লিখা।আমি চিঠিটা ভাঁজ করে তোশকের নিচে রেখে দিলাম।
আপু এবার সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকালো।সন্দিগ্ধ গলায় বললো, “তোর কি হয়েছে বলতো? তুই কি আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস?”
আমার মা বাবা ভাইবোনেরা আমাকে বুঝে।তাই সর্বক্ষণ আমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকে।হয়ত অন্যান্য ভাইবোনদের তুলনায় পিছিয়ে থাকায় তারা একটু বেশিই কেয়ার করে।তবে ওদের এই ভালোবাসার মাঝে কোন কৃত্রিমতা নেই।
,
আমি বললাম,”তোমার সবাই আমাকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবো।আমার আবার কি হবে।সবে মাত্র পরীক্ষা গেলো রেজাল্ট নিয়ে একটু টেনশনে আছি এই আর কি।”
আপু আর কিছু বললো না।চুপচাপ বেরিয়ে গেলো।ভাবছি কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাকে?একদিকে যাকে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছি,সেই মানুষটা আরেকদিকে পরিবার!!আর নাফিস ভাই?? উনাকে ফিরিয়ে দেবো কি করে? কিচ্ছু মাথায় আসছে না!সব অসহ্য লাগছে!”
সেদিন রাত্রিবেলা আমাকে বাবার ঘরে ডাকা হলো।ভেতরে সবাই গোল করে বসে আছে।
বাবা ইনায়াজ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “সবাই তো সবার মতামত দিলো,তুমি কি বলো?”
ইনায়াজ ভাই আমার দিকে তাকালো।আমি উনার দিকে চেয়ে আছি।এই প্রথম উনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি।মনে মনে খোদাকে বলছি খোদা!ইনায়াজ ভাই যেন বাবাকে বারণ করে দেয়।উনি যেন আমার চোখের ভাষা একটু হলেও বুঝেন!!আল্লাহ!আমার প্রতি একটু সদয় হও।এই মানুষটা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারে! অলৌকিক কিছু ঘটার অপেক্ষায় ছিলাম।
ইনায়াজ ভাই আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঠান্ডা গলায় বাবাকে বললো, “সবার আগে তনুর মতামতটা জানা প্রয়োজন।আপনি আগে ওকে জিজ্ঞাসা করুন,ওর কোন আপত্তি আছে কি না? ওর যদি কোন আপত্তি না থাকে আপনি এগোতে পারেন, ছেলে হিসেবে নাফিসকে আমার ভালোই লেগেছে।”
উনার কথা শুনে আমার কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠলো।হৃদপিন্ডে কেউ ছুরি চালিয়ে দিলো মনে হচ্ছে।আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না।এমন কেন এই মানুষটা?আচমকা জেদ চেপে গেলো।
আমি চোখমুখ শক্ত করে কঠিন গলায় বললাম, “আমার কোন আপত্তি নেই বাবা।তুমি ওদেরকে হ্যাঁ বলে দাও।”
আমার এমন গলা শুনে সবাই একটু চমকে উঠলো।ইনায়াজ ভাই স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন।আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
সোজা আমার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।চোখের পানি আজকে আর বাধ মানছে না।অনবরত ঝরেই চলেছে।আমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে ইনায়াজ ভাইয়ের নির্লিপ্ত জবাব।বারবার মনে হচ্ছে একতরফা ভাবে কেন উনাকে ভালোবাসতে গেলাম!আমি হলফ করে বলতে পারি উনার জীবনে যত মহীয়সী নারীই আসুক না কেন আমার চেয়ে বেশি ভালো উনাকে কেউ বাসতে পারবে না।কেউ না!আমি আমার সমস্তটা দিয়ে ইনায়াজ ভাইকে ভালোবাসি।অনেক ভালোবাসি!
কাঁদতে কাঁদতে কখন বেহুঁশ হয়ে গেছি বলতে পারবো না।জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম হস্পিটালের বেডে শুয়ে আছি।কতগুলো মুখ উৎকন্ঠা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।আমার জ্ঞান ফিরতে দেখেই সবাই চিন্তামুক্ত হলো।কিন্তু আমি কোন কথা বলতে পারছি না।মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।মাস্কটা খুলতে নিলেই ভাইয়া বাধা দিয়ে বললো, “আজকে তিনদিন পর তোর জ্ঞান ফিরেছে।তুই এখনো পুরোপুরি সুস্থ না।এখন কথাবলার দরকার নেই।”
ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।তিনদিন যাবত আমি বেহুঁশ ছিলাম??
একটু পরেই নার্স এসে সবাইকে বের করে দিলো।যাওয়ার আগে আপু আমাকে বললো, “আজকে তিনদিন ধরে নাফিসও আমাদের সবার সাথে হস্পিটালে।বেচারা লজ্জায় সামনে আসছে না।”
আমি কিছু বললাম।শুধু ভাবছি সবাই আমাকে দেখতে এলো অথচ ইনায়াজ ভাইকে একবারও দেখলাম না? আজ তিনদিন যাবত আমি বেহুঁশ ছিলাম জেনেও উনি আমাকে একটাবার দেখতে এলো না? আমার এই অবস্থা জেনেও উনি কি চিটাগাং চলে গেছেন? নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না।উনার ওপর ভীষন রাগ হচ্ছে।উনি আসলে একটা নিষ্ঠুর,উনার মন বলতে কিচ্ছু নেই,উনার মত একটা মানুষকে ভালোবাসা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
জ্ঞান ফিরার পর আরো চারদিন আমাকে হস্পিটালে রাখা হলো।আগামীকাল আমাকে রিলিজ দেওয়া হবে।আমি চুপচাপ কেবিনে শুয়ে আছি।রাতে হস্পিটালে কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না।দিনে এসে সবাই দেখা করে যায়।প্রতিদিনই নাফিস ভাই আসার সময় এটা ওটা নিয়ে আসে।বিরক্ত লাগে কিন্তু কিছু বলি না।বেচারা আশা করে নিয়ে আসে।আপু জানতে পারলে কষ্ট পাবে তাই চুপ করে থাকি।সাথে সেই ভদ্রতা সূচক হাসি তো আছেই।আজকে
ইদানীং কিছুতেই শান্তি পাই না।অস্থির অস্থির লাগে।আজকে বিকেলে সবাই এসে দেখা করে গেছে।
এখন ঘড়িতে রাত বারোটা একটুপর নার্স এসে দেখে যাবে ঘুমিয়ে পড়েছি কি না।প্রতিদিনই এসে দেখে আমি জেগে আছি।কোন কোন দিন আমাকে ঘুমানোর জন্যে বলে যায় অথবা কোন দিন মাইল্ড সিডেটিভ দিয়ে যায়।
আমি নার্স আসার অপেক্ষায় ছিলাম।এমন সময় পায়ের আওয়াজ পেয়ে ভাবলাম নার্স বোধহয় এসে গেছে।কিন্তু আবছা আলোতে স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার সামনে এগিয়ে আসছে একটা পুরুষ মানুষের ছায়া।আরেকটু কাছে আসতেই চেহারাটা স্পষ্ট হলো!সেই শান্ত স্নিগ্ধ পৌষরদীপ্ত চেহারা!
পরনে কালো শার্ট,কালো জিন্স।গায়ে সাদা এ্যাপ্রন!গলায় স্টেথো ঝোলানো।হাতে বরাবরের মত ঘড়ি!আমার হার্টবিট মিস হয়ে যাওয়ার উপক্রম।আমার হৃদয় টা হাহাকার করে উঠলো!ইয়া আল্লাহ!আমি জীবনে আর কিচ্ছু চাইবো না।শুধু এই মানুষটাকে আমার চাই!! মানুষটাকে আমার করে দাও খোদা!!
আমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে উচ্চারণ করলাম,”ইনায়াজ ভাই!”
ইনায়াজ ভাই আমার কথার জবাব না দিয়ে আমার পাশে চেয়ারটেনে বসলো।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন, “অনেকদিন থেকে তোমাকে জিজ্ঞেস করবো করবো ভাবছি কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠে নি!তোমার নাফিসকে বিয়ে করতে সত্যিই কোন আপত্তি নেই তো?বিয়ের ব্যাপারে কথা উঠলেই দেখছি তুমি হুটহাট জ্ঞান হারিয়ে ফেলো।এনিথিং রং?”
আমি উনার কথার জবাবে কিছু বলতে পারলাম না।স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।অতিরিক্ত উত্তেজনায়,মুহূর্তেই আবার জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম ইনায়াজ ভাই একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ।আমার দিকে একটু ঝুঁকে মৃদুস্বরে ডাক দিলেন,”তুমি ঠিক আছো?…তনু?”
উনার সেই ডাক আমার হৃদয় পর্যন্ত পৌছে গেলো।আমি ছলছল চোখে উনার দিকে তাকালাম!আমার কি হলো জানি না শোয়া থেকে উঠে উনাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্বাস চেপে রেখেই বলে ফেললাম, “আমি আপনাকে ভালোবাসি ইনায়াজ ভাই!আপনি কেন বোঝেন না?”
ইনায়াজ ভাই কোন উত্তর করলেন না,শুধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে,আমি বুঝতে পেরেছি! তুমি শান্ত হও!এই মুহূর্তে উত্তেজনা তোমার শরীরের জন্য ঠিক নয়।”
উনি আমার শুইয়ে দিলেন।আমার প্রেশার চেক করলেন।আমার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে!বারবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি! বরফের মত জমে যাচ্ছে আমার পুরো শরীর!ইনায়াজ ভাই আমার হাতে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিলেন।আমি অপলক ভাবে উনাকে দেখছি! উনি আন্তরিকভাবে হেসে বললেন,”চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো,কেমন?” আমি বন্ধ করলাম না।চোখ বন্ধ করলেই যদি উনি চলে যায়?”
উনি বললেন,”ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি!এবার ঘুম আসবে।তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো!আমি আছি!”