#মনোপ্যাথি
#পর্ব:৮#অরিত্রিকা_আহানা

সকালবেলা বেশ দেরীতে ঘুম ভাংলো আমার।ঘুম হওয়াতে ফ্রেশ লাগছে।আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ গেলাম।সবাই বসে নাশতা করছে।রুহিকে মামা এনে দিয়ে গেছে।ইনায়াজ ভাই এসেছে শুনে আমাদের বাসায় আসার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলো।মামা অফিসে যাওয়ার সময় দিয়ে গেছে।
আমাকে দেখেই আপু বললো,”উঠে গেছিস? আমি কয়েকবার ডাকতে গিয়েছিলাম ভাইয়া বারণ করলো তাই আর ঘুম ভাঙাই নি।” আমি আপুর কথার জবাবে কিছু বললাম না।নাশতা করতে বসে গেলাম।

মা এসে জিজ্ঞেস করল কি খাবো।টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আজকে অনেক আইটেম করা হয়েছে।আমি বললাম,”তোমার যা ইচ্ছে দাও।তবে বেশি দিও না।”
আমার কথা মা আমাকে দুটো শুকনো রুটি আর ভূনা মাংস দিয়ে গেলো সাথে একগ্লাস দুধ।কোন রকমে গিলে রুমে চলে এলাম।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম চুলগুলো সব আউলাঝাওলা হয়ে আছে।পরনে ফতুয়াটাও কুঁচকে আছে।নিশ্চই কালরাতে আপু বদলে দিয়েছে।আমার ঠিক মনে আছে আমি যখন বেহুঁশ হয়েছিলাম তখন আমার পরনে লাল রংয়ের একটা শাড়ি ছিলো।
আমি আলমারি থেকে কালো রংয়ের একটা থ্রিপিস বের করে নিলাম।ইনায়াজ ভাই বাসায় থাকলে আমি কখনোই ফতুয়া, স্কার্ট, গেঞ্জি এসব পরি না।ভীষণ অকওয়ার্ড লাগে।

আমি ওয়াশরুমে ঢুকে মাথাটা হালকা করে একটু ধুয়ে নিলাম।বেশি ভেজালাম না আপু দেখলে রাগারাগি করতে পারে।চেইঞ্জ করে জামাকাপড় গুলো ঝুড়িতে রেখে বেরিয়ে এলাম।

আমি চিরুনি দিয়ে চুলের জট খোলার চেষ্টা করছি এমন সময় মা এসে আমার কানে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো,”ইমু,তোর সাথে কথা বলবে।” আমি হ্যালো বলতেই ইমু উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনতে পেলাম।
-“হ্যাঁ আপু এখন কেমন আছো?”
-“আমি ঠিক আছি।তোর পরীক্ষা শেষ?”
-“হুম। হল থেকে বেরিয়েই তো ফোন করলাম।”
-” কেমন হয়েছে?”
ইমু হেসে উঠে বললো,”হয়েছে মোটামুটি! পাশ করবো মনে হচ্ছে।”
আমি জানি ইমুর পরীক্ষা ভালো হয়েছে,ও বরাবরই প্লেস করা স্টুডেন্ট।তবে ওর কাছে পরীক্ষা ভালো হওয়া মানে একশোতে একশো।ছোটবেলার অভ্যেস এতবড় হলো এখনো বদলাতে পারে নি। ফার্স্ট প্রফ যেবার দিলো,সেবার পরীক্ষা শেষে পনেরো ঘর থেকে বের হয় নি।ভাইবা বোর্ডে এক্সটারনাল নাকি ওর কোয়ালিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো।বাচ্চাদের মত মন খারাপ করে বসে থাকতো।কত বোঝালাম ভাইবা বোর্ডে এসব কমন ব্যাপার কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেষে ইনায়াজ ভাই আর ভাইয়া দুজনে প্ল্যান করে ট্যুরে নিয়ে গেলো।

ইমু বলল,”নেক্সট এক্সামের আগে পাঁচদিন বন্ধ আছে।ভাবছি একবার আসবো।” আমি অবশ্য ওকে বারন করে দিয়েছি।বারবার করে বলেছি এখন আসার দরকার নেই।কিন্তু আমি জানি শুনবে না।ঠিক আসবে।তবে সবে ঠিকই কিন্তু বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকবে।
-“ইমু?”
-“হুম?”
-“তোর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কি?..বই?”
ইমুর হাসির আওয়াজ পাচ্ছি ওপাশ থেকে।হাসি থামিয়ে বলল,”আমার লাইফের সবচেয়ে জিনিস বই কি না জানি না তবে সবচেয়ে পছন্দের মানুষ হচ্ছে আপু।লাইফে এত জলি পার্সন আমি খুব কম দেখেছি।লাইফ নিয়ে ওর পজিটিভ ভিউ গুলো আমাকে দারূণভাবে মোটিভেট করে।যেটা আমাদের কারো মধ্যেই নেই।তোমার তো না-ই! শী ইজ রিয়েলি আ ব্লেসিং ফর মি।কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমাকে।আপুর সবকিছু আমার ভালো লাগে বাট ভালোবাসি তোমাকে বেশি।তাই তোমার অনেক কিছু তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি।আরো একজন কে ভালোবাসি আমি।
হাসি ফুটে উঠলো আমার ঠোঁটে।আমি জানি ইমু মিথ্যে বলছে না।একবর্ণও না।হি লাভস মি মোর দ্যান এনিথিং।প্রেম ভালোবাসার ধার ও ধারে না।তবে একটা ব্যাপার আজকে বুঝতে পারলাম,ইমু অনেক ম্যাচিউর হয়ে গেছে।
-“সেই আরো এক জনটা কে বলা যাবে?”
-“যাবে।”
-“কে শুনি।”
-“ইনায়াজ ভাই।”
-“উনাকে কেন?”
-“কারণ তুমি!”
-“আমি??”
-“হ্যাঁ!তুমি উনাকে ভালোবাসো তাই!”
ইমুর কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।ইমু..!!
-“হ্যালো আপু?”
আমার জবাব নেই।
-“আমি কিন্তু আজকে আসছি।হোস্টেলে গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে রওনা দিবো।”
-“আজকেই?”
-“হুম।”
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।ইমু ফোন রেখে দিলো।কেটে দেওয়ার আগে শুধু বলল,”ভয় নেই।আমি এমন কিছু করবো না যাতে তোমার আত্মসম্মান নষ্ট হয়।বাট আই থিংক হি লাভস ইউ।”

ফোন রেখে আমি কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইলাম।ইমুর কথাগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।মাথাটা ভার লাগছে।কানের কাছে ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হচ্ছে।
আমি চুলগুলো জুঁটি বেধে নিলাম।আপুকে বললাম আমি একটু ছাদে যাবো।এখন প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে।অন্য সময় হলে আপু হয়ত বলতো বিকেলে যেতে কিন্তু শরীর খারাপ দেখে আজকে আর না করলো না।

আমি সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে উঠে গেলাম।ছাদে রোদ নেই।কেমন যেন একটু শীত শীত করছে।শীতকাল বোধহয় চলে এসেছে।আমি গুটিগুটি পায়ে গিয়ে ছাদের দক্ষিন পাশের কার্নিশের ওপর বসলাম।আমাদের ছাদের কার্নিশগুলো বেশ চওড়া।তাই মাঝে মধ্যে উঠে বসা যায়।

কার্নিশের ওপর বসে বসে গতকাল রাতের কথা ভাবছি।ইমুর বলা কথাগুলোও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।ইমু কি করে বুঝলো?
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক থেকে।কি থেকে কি হয়ে গেলো?আমি জানি আজকে আবার আমার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করা হবে।সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে নাফিস ভাইকে ওদের ভালোই পছন্দ হয়েছে।এদিকে বিয়েটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।কিন্তু আটকাবো কি করে?আর যাই হোক আমি কখনো ইনায়াজ ভাইকে বলতে পারবো না আমি উনাকে ভালোবাসি।এই ভালোবাসা তো আজকালকার নয়।সেই ছোটবেলা থেকেই উনাকে ভালোবেসে এসেছি।

আচ্ছা,,উনি যদি কোনভাবে জানতে পারেন আমি উনাকে ভালোবাসি তাহলে কি উনি হেসে উড়িয়ে দেবেন নাকি গোলগাল চোখে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন?উনার রিয়েকশন কি হতে পারে ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমি বসে বসে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ দেখলাম ইনায়াজ ভাই ফোন কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে।উনাকে দেখেই আমি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম।উনি আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন!!
উনি যে ছাদে আছেন সেটা আমি জানতাম না।এইজন্যই নাশতার টেবিলে উনাকে দেখি নি।আমি মনে মনে দোয়া করছি উনি যাতে ছাদ থেকে নেমে যায় অথবা আবার ওই পাশে চলে যায় তাহলে আমি এক দৌড়ে নিচে নেমে যেতে পারবো।

আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি দুটোর একটাও করলেন না।উনার দিকে না তাকালেও উনি যে সোজা আমার দিকে আসছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি।আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে উত্তেজনায়!!উনি এদিকে আসছেন কেন আমার মাথায় আসছে না।
উনি আমার কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ের মধুর গলায় বললেন,”কাল রাতেই তো মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলে।এই শরীর নিয়ে কার্নিশের ওপর বসেছো যদি বিপদ আপদ কিছু ঘটে যায়?”

আমি চট করে কার্নিশের ওপর থেমে নেমে গেলাম তবে ছাদে আর দাঁড়ালাম না।সোজা নিচে চলে এলাম।আমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বড়বড় দম নিলাম।উত্তেজনায় নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না।বুকের ভেতর ঢোল পেটাচ্ছে!!আমাকে এভাবে দৌঁড়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে মা আর আপু বাইরে থেকে দরজা ধাক্কানো শুরু করে দিলো।আমি কোন জবাব দিলাম না।চুপ করে বসে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি।বাইরে দরজা ধাক্কানোর পরিমান ক্রমশ বাড়ছে।আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই মা আর আপু হুড়মুড়িয়ে ভেতর ঢুকে পড়লো।মা আমার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বললো, “কিরে আবার শরীর খারাপ করছে নাকি?এভাবে দৌঁড়ে নেমে গেলি যে?” কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কি না দেখলো।মায়ের কথার জবাবে আমি কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না।বললাম,
– “আমার মাথা ব্যথা করছে।”
ওদেরকে একরকম জোর করে বাইরে বের করে দিলাম।বারান্দায় বসে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছি।ইনায়াজ ভাই আমার সাথে কথা বলেছে ভাবতেই মনে হচ্ছে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি।ভাগ্যিস উনি আমার সামনে এসে দাঁড়ান নি তা না হলে আমি হয়ত লজ্জায় মরেই যেতাম।

দুপুরের দিকে আমি চুপিচুপি ভাইয়ার রুমের উঁকি দিলাম।ভাইয়া বাসায় নেই।ভেতরে ইনায়াজ ভাই ঘুমাচ্ছে।দুইহাত ভাঁজ করে তারওপর মাথা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন উনি।উনার পিঠের ওপর উপুড় হয়ে রুহি ঘুমাচ্ছে।কি সুন্দর দৃশ্য!!যেন পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসাগুলোর একটি!

আমি আবার চুপিচুপি সরে এলাম।রুমে এসে ইমুর বলা কথাগুলো ভাবছি।ছাদের ঘটনাটা ভাবতেই অকারণে লাল হয়ে যাচ্ছি।
এসব ভাবতে ভাবতে যে কখন বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই বলতে পারবো না।ঘুম ভাঙ্গলো আসরের আজান শুনে।আমি তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে উঠে ভেতরে চলে এলাম।ভেতরে এসে ভাবছি এত বেলা পর্যন্ত ঘুমালাম অথচ কেউ আমাকে ডাকলো না?
আমি দরজা খুলে বেরিয়ে দেখলাম ড্রয়িংরুম থেকে হাসাহাসির আওয়াজ পেলাম।ড্রয়িংরুম এ উঁকি দিয়ে দেখলাম ভাইয়া,নাফিস ভাই,ইনায়াজ ভাই,ইমতিয়াজ ভাইয়া সবাই সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে।আমি তাড়াতাড়ি সেদিক থেকে সরে রান্নাঘরের দিকে গেলাম।আপু আর মা দুজনে মিলে নাশতা বানাচ্ছে।

আমাকে দেখে আপু বললো,”এতবেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমালে চলবে?খাওয়াদাওয়া কিছু লাগবে না?”
আমি আপুর কথা জবাব না দিয়ে বললাম,”ড্রয়িংরুমে মেহমান দেখলাম মনে হচ্ছে?”
আপু মুচকি হেসে বললো,”নাফিস এসেছে তোকে দেখতে।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে দেখতে?..?”
আপু আমার কথা বুঝতে পেরে বললো, “হ্যাঁ!ইমতিয়াজের কাছে তোর অসুস্থতার কথা শুনেই তোকে দেখতে চলে এলো।যা দেখা করে আয়!”

আপুর কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে নাফিস ভাইকে বাসার সবার পছন্দ হয়েছে।আমি আর কোন কথা না বলে সোজা আমার ঘরে চলে এলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here