#মনোপ্যাথি
#পর্ব:১
#অরিত্রিকা_আহানা
সবাই রেডি হচ্ছে।আমি চুপচাপ বসে সবার সাজগোজ দেখছি।
এমন সময় ভাইয়া এসে তড়িঘড়ি করে বললো “এই তনু,মনোপ্যাথিতাড়ামনোপ্যাথিতাড়ি আমার রুমে কাউকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দে তো।” মেজাজটা পুরো খারাপ হয়ে গেলো।ভাইয়ার এই এক অভ্যেস সময় অসময়ে মেহমান নিয়ে বাসায় হাজির হবে।ঘরভর্তি এত মানুষজন সবার ফরমাশ খাটতে খাটতে আমার হাতে পায়ের জয়েন্টগুলো সব ঢিলে হয়ে গিয়েছে তারমধ্যে আবার কোন ঝামেলা এনে হাজির করেছে কে জানে?শান্তিমত যে একটু সাজগোজ করবো সেই উপায়টুকুও নেই।
আমি বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলাম।রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম ভেতরে ঢুকবার জো নেই।চাচীরা সব রান্নাঘরের দরজায় বসেই গল্প জুড়িয়ে দিয়েছে।
আমাকে দেখেই মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে তুই এখনো রেডি হোস নি?”
আমি বিরক্ত মুখে না বললাম, “তোমার ছেলে আবার কাকে নিয়ে হাজির হয়েছে কে জানে?আমাকে বললো ওর ঘরে নাস্তা পাঠিয়ে দিতে।”
মা আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না শুধু বললেন, “ফ্রিজে মিষ্টি রাখা আছে,বের করে নে।”
আমি মায়ের কথামত মিষ্টি বের করে পাঁচ ছয়টার মত মিষ্টি পিরিচে নিলাম।কে জানে কয়জন এসেছে?ভাইয়ার আক্কেল দেখলে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।বলা নেই কওয়া নেই দুপুরবেলা লোকজন নিয়ে এসে বলবে, “মা আমার ঘরে ভাত পাঠিয়ে দাও তো।” এমন অনেক দিন গিয়েছে মাকে আবার নতুন করে ভাত রান্না করা লেগেছে কিংবা তরকারি।
আমি মিষ্টির প্লেট একটা ছোট্ট ট্রে তে নিয়ে তাতে একগ্লাস পানি ঢেলে আমাদের কাজের মেয়ে রুনুকে দিয়ে ভাইয়ার ঘরে পাঠাতে নিলে মা বাধা দিল, “শুধু মিষ্টি দিচ্ছিস কেন?একটু ফল কেটে দে?” আমি অনিচ্ছা সত্বেও ফ্রিজ থেকে দুটো আপেল আর কমলা বের করে নিলাম।ফল কাটা শেষ হতেই আমি রুনুকে নিয়ে ভাইয়ার ঘরে পাঠিয়ে দিলাম।
আপুর রুমে এসে দেখলাম সবার মোটামুটি সাজগোজ শেষ।আমিই বাকি আছে।মনে মনে খুশিই হলাম।যাক!এবার নিশ্চিন্ত মনে সাজগোজ করা যাবে।গিজগিজ পরিবেশ আমার একদম পছন্দ না।
আধঘণ্টার মধ্যেই আমার সাজগোজ প্রায় শেষ।এবার শাড়ি পরার পালা।এদিকে আপুকে নিয়ে বোধহয় সবাই ছাদে উঠে গেছে।আমি আমার আলমারি থেকে কলাপাতা রংয়ের শাড়িটা বের করে নিলাম।হলুদের পরবো বলে কিনেছি।শাড়িটা তসর সিল্ক।গাঢ় সবুজ পাড় সাথে হলুদ স্ক্রিনপ্রিন্ট।মা অবশ্য বেশ আপত্তি করেছিলো।যেহেতু হলুদের প্রোগ্রাম তাই মা চেয়েছিল আমি হলুদ জামদানী কিংবা কাতানের মধ্যে কোন শাড়ি নেই।কিন্তু শেষমেশ আমার জোরাজুরিতে বাধ্য হলো কিনে দিতে।
শাড়ি পরা শেষ কপালে একটা গাঢ় সবুজ টিপ পরে নিলাম।নিজেকে আয়নায় দেখে কিছুক্ষণ আপনমনে হাসলাম।আমাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে আমি হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সেজেছি।মা নিশ্চই দেখলেই মেজাজ খারাপ করে ফেলবেন।যদিও আমাকে দেখতে ততটা খারাপ লাগছে না তবুও হলুদের প্রোগ্রামে এমন সাজ সত্যিই বেমানান হবে কি না কে জানে?
বাইরে কোন শোরগোল শোনা যাচ্ছে না।তারমানে সবাই ছাদে চলে গিয়েছে।বিয়েবাড়িতে আসা মেহমানরা অনেকেই আমার এমন আচরণের অসন্তুষ্ট।কনের ছোটবোন হিসেবে সবার আগে আমারই এইসব নিয়ে হৈচৈ করার কথা আর আমি এখনো রেডিই হতে পারি নি।আপুর এংগেইজম্যান্ট এর দিন তো ইমতিয়াজ ভাইয়া মানে আমার দুলাভাই এর এক খালা বাবার মুখের ওপর বলেই ফেললেন, “মেয়েমানুষের এমন খামখেয়ালি স্বভাব ভালো কথা নয়।মেয়েকে না শোধরালে কপালে দুঃখ আছে।” তার এমন বলার কারন হচ্ছে, সবাই যখন এংগেইজম্যান্ট নিয়ে ব্যস্ত আর আমি তখন আমাদের একেবারে কোনার রুমটায় দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোতে চলে গেলাম।তবে আমি অবশ্য লোকের কথায় তেমন কান দেই না।
আমার মা বলেন,আমরা চারভাইবোন চারটি ভিন্ন প্রজাতির প্রানী।সবার আগে আমার আপুর কথা বলি।চারভাইবোনের মধ্যে ও দ্বিতীয়। বাস্তববাদী, অসম্ভব সুন্দরী এবং ভীষণ মিশুক প্রকৃতির।মানে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মত মেয়ে।তবে শুধু রূপে নয় পড়াশোনায়ও বেশ ভালো।ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ।শুনেছি বিয়েরপর ও আর ইমতিয়াজ ভাইয়া মিলে পিএইচডি করতে যাবে।একসাথে মধুচন্দ্রিমাও হয়ে যাবে।
ইমতিয়াজ ভাইয়া,আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ যার কথা না বললেই নয় দারুণ হাসিখুশি একজন মানুষ।ভীষণ হ্যান্ডসাম,ফর্সা গায়ের রঙ,সাথে ঘন কাল চুল।লম্বায় প্রায় ছ’ফিট।সোজা বাংলায় যাকে বলে একেবারে সুপুরুষ।তবে উনাকে দেখলে বোঝাই যায় না উনি পড়াশোনায়ও ততটা ভালো যতটা দেখতে ভালো।কোথায় যেন পড়েছিলাম “সুন্দর ছেলেরা জীবনে সফল হয় না।” এই কথাটা ইমতিয়াজ ভাইয়ার বেলায় ডাহা ফেল!
ইমতিয়াজ ভাইয়া আর আপুর কিন্তু প্রেমের বিয়ে নয়।ইমতিয়াজ ভাইয়া অবশ্য প্রথমে আপুকে প্রপোজ করেছিলো।কিন্তু আপু রাজী হয় নি।আর ভাইয়া তার জায়গাতেই অনড় ছিলো,বিয়ে করলে আপুকেই করবে।শেষমেশ বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো।বাবা মাও উনার মত সুপাত্র হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
এবার আমার ভাইয়ার কথায় আসি।আপুর তিনবছেরর বড়।খুবই ইমোশনাল,পেশায় ডাক্তার, এমবিবিএস শেষ করে এখন সার্জারি ওপর এফসিপিএস করছে।ভাইয়া হয়েছে একেবারে বাবার মত,সবার খেয়াল রাখবে।আপনজন ছআড়া বাইরের লোকেদের কাছে ভাইয়া কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট। ভাইয়ার বিয়ের জন্যেও বাবা মা পাত্রী খোঁজা শুরু করে দিয়েছে।কিন্তু ভাইয়ার এক কথা এফসিপিএস শেষ করে তারপর বিয়ে।তবুও বাবা মা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদি রাজী করানো যায়।
আমাদের সবার ছোট ইমু।সিলেট মেডিকেল কলেজে পড়ছে।দুটা প্রফ শেষ।বাকি দুটো দিলেই তারপর ইন্টার্ন ডক্টর।ওর ধ্যানজ্ঞান সব হচ্ছে পড়াশোনা।
আমি অবশ্য ওদের সবার মত মেধাবী না।এভারেজ টাইপ স্টুডেন্ট।উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে চেষ্টার জোরে পাবলিকে পড়ার সুযোগ পেয়েছি।তবে মা একটু দুঃখ পেলেও বাবা কিন্তু কোনদিন আমাকে সেটা বুঝতে দেন নি।বাবার কথা হাতের পাঁচটা আঙুল তো আর সমান হয় না।আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ।আমি সবসময়ই একটু শান্ত প্রকৃতির।নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করি।
ওদিকে নিশ্চই আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।ছাদে উঠতেই দেখলাম পুরো ছাদটা আলোতে ঝলমল করছে।স্টেজ সাজানো হয়েছে ছাদের দক্ষিণ পাশটায়।স্টেজের ওপর আপু হাসিমুখে বসে আছে।অসম্ভব সুন্দর লাগছে।চারদিকে লাইটিং,সাজসজ্জা এত কিছুর মধ্যেও আপুর হাসিমাখা মুখটাই যেন সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে।
আমি স্টেজের দিকে এগোতেই ইমু এসে বললো, “এতক্ষণ লাগে আসতে? কতক্ষন থেকে তোমার জন্য সবাই ওয়েট করছে?”
-“ভাইয়া মেহমান নিয়ে এসেছে তাই একটু দেরী হয়ে গেলো।”
আমার কথা শুনে ইমু ভ্রু কুঁচকে ফেললো।তারপর একটু বিরক্তি নিয়ে বললো, “এইসময় আবার কাকে নিয়ে এসেছে ভাইয়া?”
-“জানি না।”
ও আর কিছু বলার আগেই আমার ফোন বেজে উঠলো।ইমতিয়াজ ভাইয়া ভিডিও কল দিয়েছে।আমি ফোনটা হাতে নিয়ে ছাদের একেবারে শেষ মাথায় চলে গেলাম।এপার্টমেন্ট হওয়ায় আমাদের ছাদটা মোটামুটি বেশ বড়।
ফোনটা রিসিভ করতেই ইমতিয়াজ ভাইয়া হাসিমুখ বললেন,”তোমার আপু কোথায়?”
– “স্টেজে।”
ইমতিয়াজ ভাইয়া খানিকটা লাজুক গলায় বললো “আমি কতবার ফোন দিলাম ধরছে না।তুমি ওর কয়েকটা ছবি পাঠাতে পারবে আমাকে?”
আমি না করলাম না।বেচারা আশা করে বলেছে।বললাম, “ঠিক আছে, আমি ছবি তুলে তারপর আপনাকে পাঠাচ্ছি।”
তারপর আমি ফোনটা কেটে দিতে নিলেই ইমতিয়াজ ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বললেন,”এই তনু শোনো!”
-“আবার কি?”
ইমতিয়াজ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “তোমাকে কিন্তু ভীষণ সুন্দর লাগছে।” উনার কথার জবাবে আমি মুচকি হাসি দিলাম।উনিও উনার সেই ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে বললেন, “রাখছি।”
ফোন রেখে যখন স্টেজের দিকে যাবো,এমন সময় ছাদের দরজায় চোখ পড়তেই দেখলাম ভাইয়া হাসিমুখে ঢুকছে।নিশ্চই সাথে মেহমানও আছে।আমি ওর সাথে কে আছে সেটা দেখার জন্য একনজরে সেদিকে দিকে তাকিয়ে রইলাম।ছাদের দরজা দিকে তাকিয়ে থাকার সময় আমি কয়েকসেকেন্ডের জন্য পজড হয়ে গেলাম।আমার হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠলো,বুকের ভেতর তীব্র ভূমিকম্প শুরু হলো যার মাত্রা পৃথিবীর যে কোন রিখটার স্কেলে ক্যাপচার করা অসম্ভব!
কাকে দেখছি আমি?ভাইয়ার সাথে ইনায়াজ ভাই!উনার তো আসার কথা ছিলো না?তবে কি ছুটি পেয়েছেন?নিশ্চই পেয়েছেন,ছুটি না পেলে তো আসতে পারতেন না।
কি সুন্দর লাগছে উনাকে!কালো পাঞ্জাবী সাথে সাদা চুড়িদার।হাসিমুখে ভেতরে ঢুকছেন।গলায় ক্যামেরা ঝোলানো।আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
ইনায়াজ ভাই, ভাইয়ার সেই ছোটবেলার বন্ধু।দুজনে একই সাথে স্কুল,কলেজ পার করে শেষে একই মেডিকেল পড়েছে।ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাসার সবার সাথেই উনার খুব ভালো সম্পর্ক।এমনকি উনার বাবা মাও প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন।
তবে আমার সাথে উনার সম্পর্কটা ঠিক বাকি সবার মত না।ছোটোবেলা থেকেই আমি উনাকে দেখলেই এড়িয়ে যেতাম।লজ্জায় কখনো উনার সাথে কথা বলতে পারি নি।উনিও হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন আমি উনার সাথে কথা বলতে সংকোচ বোধ করি তাই বাসার সবার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকলেও আমার সাথে কখনো অতোটা ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করেন নি।
আমি এতক্ষনে বুঝতে পারলাম ভাইয়া তাহলে উনার জন্যই নাশতা পাঠাতে বলেছিলো।ইশশস!এখন আফসোস হচ্ছে।ফ্রিজে পিঠা রাখা ছিলো। উনি পিঠা খেতে খুব পছন্দ করেন।ভাইয়ার ওপর জেদ করে কেন যে দিলাম না!রাগ লাগছে নিজের ওপর।