||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ২০||

অন্ধকারে মানুষটাকে চিনতে পারেনি অনামিকা। কিন্তু এই জায়গাটার কথা তো বাদল আর সে ছাড়া কেউ জানে না। তাহলে কী বাদল তার ইজ্জত নষ্ট করতে চেষ্টা করেছে! মাথা চেপে ধরে বসে আছে। তার যে সম্ভ্রমহানি হয়নি এটা সে কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। আপন বোনই বিশ্বাস করছে না। সবাই একাধারে বাদলকে দোষ দিয়ে যাচ্ছেন।

গুলবাহার বিবি ভ্রু বাঁকিয়ে বলেন, “হ, বেডা মাইনষে ধরব আর কিস্যু না কইরা এমনে এমনে ছাইড়া দিব!”

অনামিকার ইচ্ছে করছে মরে যেতে। এত এর কথার ভাঁড় সে নিতে পারছে না। একটু একা থাকতে চায়। কিন্তু কেউ তাকে একা ছাড়বে না।

সারাটা রাত বসে বসে চিন্তা করেই কাটিয়ে দেয় অনামিকা। চোখের পাতা এক করতে পারে না। চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। সকাল হলেই পুলিশ আসবে বাদলকে ধরে নিয়ে যেতে। কিন্তু সত্যিটা না জেনে অনামিকা তা কিছুতেই হতে দেবে না। সোনিয়া আর রিনি তার পাশেই শুয়েছিল। আফিয়া মাটিতে পাটি বিছিয়ে। সারারাত জেগে থাকলে এখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সবাই। বাইরে সূর্যের নতুন আলো ছড়িয়েছে। দিনটা যেভাবে নতুনভাবে শুরু হয় জীবনটাকে চাইলে যদি নতুনভাবে শুরু করা যেত! কিন্তু না উপরওয়ালা সেই সুযোগ আর ক্ষমতা আমাদের হাতে দেননি।

ভোর ছয়টা বাজে পরশ ঘুম থেকে উঠে। অনামিকার কামরায় আসতেই চমকে যায়। সবাই ঘুম কিন্তু সে নেই। আফিয়াকে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওই, অনু কই গেল? কই রে? তোরা এমনে ঘুমাইতাছস! হেয় কই গেল কইবার পারোস না?”

অনামিকা ছুঁটে চলেছে বাদলের বাড়ির দিকে। সে জানতে চায় বাদল কেন তাকে অপেক্ষা করতে রেখে আসলো না। নাকি সে এসেছিল ভিন্ন রূপ ধরে! মানুষটা কী আসলেই বাদল ছিল নাকি অন্য কেউ!

বাদলদের উঠানে এসে অস্ফুটস্বরে বেশ কয়েকবার ডাকলো, “বাদল মিয়া, বাদল মিয়া, বাইরে আসো।”

কথা বলার শক্তি জোগাতে পারছে না। রেহানা মাত্র দাঁত মেজে ঘরে এসেছে। অনামিকার কণ্ঠ শুনে বাইরে আসে। বিধ্বস্ত চেহারা আর শরীরের অবস্থা দেখে পা থমকে যায় বারান্দাতেই। বাদলের দরজায় একনাগাড়ে হাত পিটিয়ে ডাকে। বাদল ঘুম চোখে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।

“কী হইছে! কেউ মরছেনি? এমনে দুয়ার পিটাইতাছ ক্যান!”

রেহানা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি পানে তাকাতেই বাদলের বুকের কম্পন ক্ষণকালের জন্য থমকে যায়। প্রিয় মানুষটাকে কেউ এভাবে দেখবে কল্পনাও করে না। দৌড়ে অনামিকার কাছে যায়। বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। আজ তার লাজলজ্জার ভয় নেই। যে দেখার দেখুক। আশপাশের কারো কোনো ভীতি নেই মনে। বাছিদ মাস্টার আর রুজিনা বানুও ততক্ষণে জেগে উঠেছেন।

“এই কী হইছে তোমার? এই অবস্থা ক্যান? কিস্যু কইতাছ ক্যান? আরে এই কিস্যু তো কও।”, বাদলের কণ্ঠে তাকে নিয়ে চিন্তা।

না এই মানুষটা তাকে ধোঁকা দিতে পারে না। তার বিশ্বাস এত ঠুনকো হতে পারে না। মাথাটা বাদলের বুকে এলিয়ে দেয়। সে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত অনুভব করছে।

“আমার খুব ঘুম পাইতাছে বাদল মিয়া। একটুখানি শান্তির ঘুম ঘুমাইতে চাই।”, মৃদুস্বরে টেনে টেনে বলল।

ওখানেই মাটিতে বসে যায় অনামিকা। বাদল তাকে বুকের সাথে আগলে ধরে। চোখে আগুন ঝরছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে পুলিশ নিয়ে হাজির হয় পরশ আর সোনিয়ার বড় ভাই কবির। তাদের এমন অবস্থায় দেখে অনামিকাকে টেনে ছাড়িয়ে নেয়। বাদলের গালে সজোরে চড় বসাতেই পুলিশ তাকে আটকায়। এরই মধ্যে আফিয়া আর সোনিয়া চলে আসে সেখানে।

বাছিদ মাস্টার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হইছে দারোগা সাব? এইহানে এই সকাল বেলা?”

পুলিশ কর্মকর্তা কোমরে হাত দিয়ে প্যান্ট উপরে তুলে বলল, “স্যার, আইছি কী আর শখে। পরশ মিয়ায় তো কেইস ঠুইক্যা দিছে আপনের পোলার নামে। হেয় নাকি তার শালির সরলতার সুযোগ নিয়া, বিয়ার লোভ দেহাইয়া, ভালোবাসার নামে ইজ্জত নষ্ট করছে।”

“এইসব কী কইতাছেন সাব! আমার পোলা এমন না।”

বাদল তেড়ে এসে বলে, “কী আজেবাজে কথা কইতাছেন! আমি অনামিকারে ভালোবাসি। তারে আমি বউ বানাই এই ঘরে আনুম। আর যারে আমি বিয়া করুম তার ইজ্জতে ক্যান হাত দিমু?”

“বাদল মিয়া, মুখে মুখে সবাই কইবার পারে যে অমুকরে আমি ভালোবাসি, বিয়া করুম। কিন্তু ওই যে টসটইস্যা শরীর পাইয়া গেলে পরে আর বিয়ার শখ মিইট্যা যায়।” বলতে বলতে একগাল বিশ্রি হাসি দেয় পুলিশ কর্মকর্তা।

বাদল রেগে তার কলার চেপে ধরে বসে। পুলিশের মুখে এমন অশ্লীল কথা সে মেনে নিতে পারছে না। এটাই তার সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের মানুষের সাথে লাগার চাইতে কুকুরের সাথে লাগা ভালো। সরকারের গোলামদের সাথে লাগা মানেই নিজের পায়ে নিজে কোড়াল মারা। না চাইতেও বাদল সেই ভুল করে বসে।

“এই ধর হালারে, পুলিশের গায়ে হাত দিয়া ভালা করস নাই। এইবার কয়ডা কেইস খাইতে হয় দেহিস।”

অনামিকাকে পরশ ধরে রেখেছিল। নিজের হাত ছাড়িয়ে বাদলের কাছে ছুটে আসে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়, “কাইল আমি তোমার পথ চাইয়া রইলাম কিন্তু তুমি দেখা করবার আসলা না ক্যান বাদল মিয়া? সত্যি কইরা কইও।”

“তোমারে ছুঁইয়া কইতেছি, আমি গেছিলাম কিন্তু গিয়া তোমারে পাই নাই। বহু রাইত বইসা তারপর চইলা আসছি।”

অনামিকা বাদলের শার্টের বোতাম খুলতে লাগে৷ তার পরীক্ষায় যদি বাদল উত্তীর্ণ হয়ে যায় তাহলে অনামিকা নিজের সবটকু দিয়ে বাদলকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাবে। ধস্তাধস্তির মাঝে ওই মানুষটাকে সে খামচে ধরছিল। যদি বাদল তার সম্ভ্রমহানি করতে চেষ্টা করে তাহলে বাদলের বুকেও সেই দাগ থাকবে। শার্টের বোতাম খুলতেই অনামিকার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। চোখে জল টলমল করছে। ঝাপসা হয়ে আসে। ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল সোনিয়া দৌড়ে এসে তাকে পেছন থেকে ধরে।

“খাড়ায়া আছেন ক্যান সাব! নিয়া যান এই শালারে।”, হুংকার দিয়ে বলে উঠে পরশ।

অনামিকা কিছুই বলে না। সোনিয়ার কোলে মাথা রেখে কেবল হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে বিরতিহীন। এই কান্নার শেষ কোথায় জানা নেই তার। যাকে নিয়ে বিশ্বাসের সুউচ্চ পাহাড়ে অবস্থান করেছিল সে মানুষটা তাকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।

পুলিশ বাদলের হাতে হাতকড়া পরিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে তার মা-বোন কান্না করে যাচ্ছেন। বাবা পুলিশের পেছন পেছন অনুনয় বিনয় করে বলছেন তার ছেলে এমনটা করতে পারে না।

বাদল যেতে যেতে পথে থমকে গিয়ে কেবল একটা কথাই বলল, “আমার উপরে বিশ্বাসডা তো তুই রাখলি না রে অনামিকা। তোর বাদল বিশ্বাসঘাতক না, তোর বাদল চরিত্রহীন না। তোরে মোহরানা দিয়াই আপন কইরা নিতে চাইছিল, কাপুরুষের মতো না।”

অনামিকা নির্বিকার নির্লিপ্ততা নিয়ে বসে রয়। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে। বাদলের বলে যাওয়া কথা যেন কানে বাজে। তার ভালোবাসা এভাবে মিথ্যে হয়ে গেল! সে ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারছে না। কোনো না কোনোভাবে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় বাদল দোষী, চরিত্রহীন, লম্পট।

বাদলের মা, বাবা, বোন অনেকবার অনামিকাকে বোঝাতে যায়। তাদের ছেলে এমনটা করতে পারে না। সে নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করছে। পরশ অনামিকার সাথে তাদের কোনো কথাই বলতে দেয়নি।

২৪.
পরশ অনামিকার হয়ে মোকদ্দমা করে। এক সপ্তাহ জেলের ভেতর নানাভাবে অত্যাচার করার পর আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কাঠগড়ায় আসামীর জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে প্রেম হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধী। হ্যাঁ, বাদল নিজেকে ধর্ষণের অপরাধী ভাবে না, সে প্রেম হত্যার অপরাধী হয়েছে। বাদলের শরীরের যতটুকু দেখা যাচ্ছে মারের অনেক দাগ ভেসে আছে। তার পরিবারের সবাই তাকে দেখামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই ক’দিনে চুল-দাড়ি আরো বড় হয়ে গেছে। একদম জটিল অপরাধী লাগছে তাকে।

তার সম্মুখের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। এত কষ্টের মাঝেও মনের ভেতর এক শীতল প্রবাহ বয়ে যায়। চোখ শান্ত হয়ে আসে। প্রিয় মানুষের সাথে কখনো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কে ভেবেছিল! তাকে অপরাধী করে যদি অনামিকা ভালো থাকে তাহলে থাকুক।

অনামিকাকে জিজ্ঞেস করা হয় বাদল তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে কী না? সবার অপেক্ষার অন্ত ঘটায় তার “হ্যাঁ” সূচক উত্তর। বাদলের ঠোঁটে হাসি, চোখের জলের অদ্ভুত এক মিশ্রণ।

অনামিকা বাদলের দিকে চোখ তুলে তাকায়। চোখে চোখ রেখে কখনোই এই কথাটা বলতে পারতো না সে। কিন্তু তার ঠোঁটে, মুখে অদ্ভুত উজ্জ্বল হাসি দেখে অবাক হয়। এই হাসির অর্থ কী!

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here