||অনামিকার সাক্ষ্য|| || অংশ:১১||
শরীর ছুঁয়ে দেওয়ার আগে কেবল একজন প্রেমিক মুখ ফুটে তার প্রেমিকার অনুমতি চাইবে, অথবা সম্মতি চাইবে কিন্তু পৃথিবীর বুকে খুব কম স্বামী আছে যে তার স্ত্রীকে ছুঁয়ে দেওয়ার আগে সম্মতি চাইবে। কেননা যে শরীর সে দলিল করে এনেছে সে শরীর ছুঁয়ে দেওয়াতে তাকে কেউ বাঁধা দিতে পারে না। অথচ কোনো অচেনা অজানা মানুষ যখন হাতটা ধরবে তখন ঠিক কেমন অনুভব হয় তা একটা মেয়ে ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। সোনিয়ার হাত যখন মিজান ধরলো তখন তার ইচ্ছে করছিল মাটি খুঁড়ে গর্তে ঢুকে যেতে। তবু মনকে শক্ত করে বসে থেকেছে সে। হাজার অচেনা হলেও মানুষটা এখন তার স্বামী। আর স্বামী যা চায় তাই তার করতে হবে। নাহলে ঘর সংসার করা হবে না তার। সোনিয়ার হাত দিয়ে মুখের ভেতর পান পুরে নেয় মিজান। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাবিরা মজা করছে। লজ্জা পেয়ে হাসছে সে।
১৩.
শেষ বিকেলের রক্তিম সূর্যের আলো পৃথিবীর বুকে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। চারপাশ লাল হয়ে আছে। অনামিকার মনে একটু ভয়, একটু আনন্দ মিশে অপূর্ব সুন্দর এক অনুভূতি খেলে যাচ্ছে। মিলনকে যতক্ষণ ধরে পড়াচ্ছে ততক্ষণ ধরেই রেহানা তাকে বেশ ভালো করে অবলোকন করছে। তার উচ্ছাস দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক খুশি। অথচ সোনিয়ার বিয়ে হয়েছে তার মন খারাপ থাকার কথা। কিন্তু তার চোখের মণিজোড়া সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে বারবার। কিছু একটার অপেক্ষায় অধৈর্য হয়ে আছে।
দোরগোড়ায় বাদল এসে দাঁড়াতেই সেই চেহারার উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। মুখটা লজ্জায় ঈষৎ আরক্ত হয়ে এলো। আর বিলম্ব সহ্য হচ্ছিলো না। কীভাবে কথা শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
“এক কাপ চা দিবা আপা? আম্মা কই?”, রেহানাকে উদ্দেশ্য করে বলল বাদল।
“আম্মা একটু ক্ষেতে গেছে। তুই বয়, আমি চা বানাই আনতাছি।”
রেহানা বসে কাঁথা সেলাই করছিল। কাঁথাটা রেখে উঠান পেরিয়ে পাকঘরে চলে গেল। শোবার ঘর থেকে পাকের ঘরটা আলাদা। আজ কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে রেহানার মাঝে। পরিবর্তন এসেছে টেলিফোন আসার পর থেকে। আব্দুল হক টেলিফোনে জানিয়েছে কাল সে আসবে এখানে। কথা বলে আসার পর থেকে তাকে একটু ফুরফুরে লাগছে। সময় যতই খারাপ যাক না কেন, মানসিক শান্তি দেওয়ার মতো যদি কেবল একটা মানুষ থাকে মানুষ সব বিপদ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। রেহানার এই মানসিক শান্তি দেওয়ার মানুষটার টেলিফোন আরো আগে আসা উচিত ছিল। মানুষটা যদি তার পাশে থাকতো তাহলে এতটা ভেঙে পড়তো না সে৷
বাদল এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে বিব্রতবোধ করছিল। বসতেও পারছে না। একটুখানি হেসে উলটো ঘুরে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়৷
“আ…আপনের সাথে আমার কিছু কথা আছিলো।”, অপ্রস্তুত গলায় বলল অনামিকা।
থেমে ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বাদল। পেছন ফিরে তাকিয়ে ম্লান গলায় শুধালো, “কী কথা?”
অনামিকার হাত ভীষণ কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। বুকটা ধুকপুক করছে। এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কলিজার পানি শুকিয়ে এসেছে। উলটো ঘুরে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। ব্লাউজের ভেতর রাখা চিঠিটা বের করে বাদলের দিকে এগিয়ে দেয়। সে সরোষ দৃষ্টিতে তাকালো। চিঠি খুলতে যাচ্ছিল তখনই তাকে বাধা দিয়ে বলল, “এহন খুইলেন না। নিজের ঘরে গিয়া খুইলেন। আমি সইন্ধ্যা বেলা আপনের অপেক্ষা করুম। বাকি কথা ওইহানে হইবো, যেইহানে লোকে দেখার ভয় নাই৷”
বাদল বুঝতে পারে সে তাকে সুপারি বাগানে দেখা করার কথা বলছে। ক্ষণকাল নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থেকে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের ঘরে এসে চেয়ার টেনে জানালার ধারে বসে পড়ে। বাইরে নিষ্পলক চোখে আনমনে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। তার জানালা বরাবর বাড়ির রাস্তা। পাশের ঘরের চাচাতো ভাই কাঁধে কোদাল নিয়ে ক্ষেত থেকে ফিরছে। মাগরিবের আজান হতে বেশজ দেরি নেই। সন্ধ্যার সূর্য ডুবে গেছে। দৃষ্টি নামিয়ে চিঠিতে চোখ বোলায়। আলতো করে চিঠির ভাঁজ খুলে। কিন্তু চিঠি খুলে অবাক হয় সে৷ তার দেওয়া চিঠিটাই ফেরত দিয়েছে। বিষন্নতার চাদরে মনটা ঢেকে যায়। অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই আবার চিঠির দিকে তাকায় নিচে তার নাম বাদল কেটে দিয়ে ঘাসফড়িং লিখা রয়েছে। লেখার উপর বার কয়েক হাত বোলায়। ভেতরে চাপা কষ্টরা বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে অশ্রু নামে। অনামিকা তাকে ভালোবাসে, হ্যাঁ তার তৃণলতা ঘাসফড়িংয়ের কাছে ধরা দিতে চায়। সারামুখে সে-হাসি ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই হৃদপিণ্ডের চলন দ্রুত হয়ে এলো। শিলার নিষ্প্রাণ চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে আসে। সে যদি অনামিকাকে ভালোবাসে তাহলে মিলনকেও যদি হারাতে হয়! ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠে। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চারদিকে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। অনামিকা কলপাড়ে অজু করে রেহানার থেকে জায়নামাজ নিয়ে নামাজ পড়ে নেয়। এখান থেকে সোজা সুপারি বাগানে যাবে। বাদল তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। রেহানা এসে হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে যায় তার অন্ধকার ঘরে। বাইরে এখনো আলো। অন্ধকার হতে ক্ষণকালের অপেক্ষা। তার চোখের সামনে দিয়ে অনামিকা হেঁটে যাচ্ছে। সে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে।
১৪.
দিগন্তবিস্তৃত নির্জন বাগানে মৃদু অন্ধকার। চাঁদের আলোর কাছে অন্ধকার আজ ফিকে হয়ে গেছে। রুপোর থালার মতো মুহররমের চাঁদ পুকুরে নেমে এসেছে। পানিতে তার প্রতিচ্ছবি ভাসমান। তারারা মিটিমিটি হাসছে। অনামিকা বাঁশের সিঁড়ি করা ঘাটের উপর বসে পড়ে। আসার সময় কিছুটা ভয় করছিল কিন্তু এখানে এসে মনটা উৎফুল্ল হয়ে গেছে। শান্ত স্নিগ্ধ সুষমায় ভরা হাওয়া থেমে থেমে বইছে। হাঁটু ভাঁজ করে দু’হাত কোলের উপর রেখে বসে আছে। অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে মাথাটা কাঁধের উপর হেলিয়ে দেয়৷ অপেক্ষা কিছুটা বিরক্তিকর হলেও তার ফল মধুর মতো মিষ্টি হয়। সে মধু পান করলে কলিজা জুড়িয়ে যায়। আপাতত তার হৃদয় জোড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু হৃদয়ের মানুষটা আসবে কখন! চোখে তন্দ্রাভাব চলে এসেছে।
বাদল কখন এসে তার পাশে বসেছে কিছুই বলতে পারে না। নিষ্পলক চোখে চাঁদের আলোয় অনামিকার মুখটা জ্বলজ্বল করছে।
“অনামিকা…”, ডাক শুনে পলক নড়ে উঠলো।
নিজের নাম অনেকের মুখে শুনেছে কিন্তু প্রিয় মানুষের মুখে শুনে মনে হচ্ছে যেন এভাবেই বারবার ডেকে যাক আর সে শুনে যেতে থাকুক। ক্ষুদ্র চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাদলকে দেখছে। মন চাইছে একটু ছুঁয়ে দিয়ে বলতে, “তোমারে ভালোবাসি বাদল মিয়া, খুব ভালোবাসি। আমারে নিয়া ঘর বাঁধবা? একচালা ঘর? যেই ঘরে দুইটা কামরা থাকব একটা ঘরে তোমার লাইগা রান্ধুম আরেকটা ঘরে তোমার বুকে মাথা রাইখা ঘুমামু।”
সে হয়তো বলবে, “তোরে আমার কইলজার মইধ্যে জায়গা দিমু। সব মাইনষে তো প্রিয়তমারে মন ভইরা দেখে। আমি তোরে পেট ভরে দেখুম।”
অনামিকা মৃদু হাসছে। ক্ষীণ গলায় সহসা বলে উঠল, “আমার তাতেই চলব বাদল মিয়া।”
বাদল ভ্রুজোড়া বাঁকিয়ে বলল, “কিছু কইলা?”
কী এক তন্ময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল সে। সলজ্জ হেসে বিব্রতবোধ করলো নিজের কাজের উপর। এমনভাবে ভাবনায় হারিয়ে ছিল যে কিছুর খোঁজ ছিল না। কিন্তু বাদলের মুখটা কেমন শুকনো, চিন্তিত লাগছে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা