||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ:১০||

ভোর বেলা রেল লাইনে একটা কাটা লাশ পাওয়া গেছে। লোকে বলাবলি করছে ট্রেনে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে তার। লাশের চেহারা চেনা মুশকিল। আশেপাশে কেউ চিনে না। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গ্রামের কিছু মানুষকে সাথে নিয়ে দাফন কাজ করে ফেলে পুলিশ। বাদলও জানাজা থেকে ফিরছে। রেহানা আজকাল সংসারের কোনো কাজ করে না। শুধু একদিকে তাকিয়ে থাকে। মিলনকে অনামিকা এসে রোজ বিকেলে পড়ায়। ছেলেটা পড়ায় আরো অমনোযোগী হয়ে গেছে। রেহানার অবস্থা তেমন নয় যে কথা বলবে। তার স্বামী আব্দুল হক সেই যে মেয়ের জানাজায় এসেছিল আর আসেনি। কোনো খোঁজও করেনি। নাহলে তার সাথে কথা বলা যেত। কিন্তু এখন বাদলের সাথে কথা বলতে হবে তাকে। দু’এক দিনের মধ্যে একবার কথা বলবে ভাবছে সে।

সূর্য ঠিক মাথার উপরে। উত্তাপ ছড়াচ্ছে রোদ। অনামিকা গোসলে বেরিয়েছে। রিনিকে বেশ কয়েকবার ডাকলো গোসলের জন্য কিন্তু এই মেয়ে আসলো না। পুকুর ঘাটে এসে কিঞ্চিৎ আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকায়। সামনে সোনিয়াকে দেখে অবাক না হয়ে পারে না। গতকাল রাতেই তো সোনিয়াকে আড়াল করে সে পালাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সে এখানে কীভাবে!

দ্রুত পায়ে এগিয়ে সোনিয়ার এক বাহু ধরে মৃদুস্বরে বলল, “তুই এইহানে! তোর না আইজ রশিদ ভাইয়ের সাথে বিয়া হওনের কথা।”

সোনিয়া শান্ত চোখে এক পলক তাকায়। মৃদু হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বচ্ছ পানির দিকে। কে যেন গলা চেপে ধরে আছে তার। নিজের মাঝে আর পুকুরের পানির মাঝে আজ অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছে সে। দু’টোই গভীর শান্ত। পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মানুষটা ধোঁকাবাজ আছিল রে। হেয় আসে নাই৷ আমি সারাডা রাইত একলা বইয়া রইলাম হেয় আইলো না। ভোর রাইতে কোনো উপায় না দেইখ্যা বাড়ি ফিরা আসছি।”

তার ঠোঁটের কোণে হাসি কিন্তু চোখ লাল হয়ে আছে। চোখজোড়া অজস্র অশ্রু ঝরানোর সাক্ষি দিয়ে যাচ্ছে। রশিদ এমন করবে কেন! যদি না পালানোরই হয় তবে কেন সোনিয়াকে সে কথা দিল! প্রশ্নগুলো নিজেকে করে অনামিকা। ভেতর থেকে কোনো উত্তর ফিরে আসে না। সোনিয়াকে আর প্রশ্ন করে মন খারাপ করে দিতে চায় না সে।

“পরশু আমার বিয়া। মিজান মিয়ার সাথে। ওই যে পানের কারবার করে। হেয় নাকি দেরি করবার চায় না। আমিও না করি নাই ভাইজানরে। তুই আমারে সুন্দর কইরা সাজাই দিস। আমার রূপে যাতে মিয়া ঘায়েল হইয়া যায়, চোখ ফেরাইতে না পারে।”, কথাগুলো বলতে বলতে সোনিয়া গলা পানিতে নেমে যায়। চুলের খোঁপা খুলে ডুব দেয়। চুলগুলো আর ভিজে না, পানির উপরই ভেসে রয়।

কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো বই থাকলে অনামিকা যত দামই হোক না কেন কিনে নিতো। যেমন, “১০১টা সান্ত্বনা বাণী”

বাদল তো কবি নিশ্চয়ই সে মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জানে। কখনো সুযোগ পেলে সেই ভাষা আয়ত্ত করতে চায় নিজের মাঝে। আজ সোনিয়াকে সে কোনো কথায় সান্ত্বনা দিতে পারলো না। নীরবে কেবল শুনে গেল। ভেতরটায় কেমন চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে৷ যে মেয়ে বাদলকে ভালোবাসার জন্য তাকে বলে নতুন এক ভুবনে পাড়ি জমাতে চাচ্ছিল আজ সে নিজেই কুলহারা।

১২.
মিজান মিয়া এই বিয়েতে অনেক খুশি৷ বসে বসে পান চিবাচ্ছে আর লাল দাঁত বের করে হাসছে। মাঝেমাঝে রুমাল টেনে নিচ্ছে মুখের উপর। খুব বড় করে অনুষ্ঠান হচ্ছে না কিন্তু অনেক লোকজনকেই দাওয়াত করা হয়েছে। সোনিয়াকে নিজ হাতে সাজিয়েছে অনামিকা। সে তার কথা রেখেছে। খুব বেশি কিছু নয়, একটু পাউডার মেখে ঠোঁট লাল করে লিপস্টিক দিয়েছে আর চোখে গাঢ় করে কাজল। মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিয়েছে।

চুপচাপ কিছুক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। গায়ে কালো রঙের শাড়ি। আজ আর চুল বেণি করেনি, খোঁপা করে বকুল ফুলের গাজরা মুড়িয়ে রেখেছে। মুখে কিছু মাখেনি, শুধু চোখে হালকা কাজল। বের হয়ে বাইরে যেতেই বাদলের সাথে ধাক্কা খায়। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরেছে সে। কয়টা মাস পর আজ বাদলের চোখে চোখ পড়েছে৷ তার এত কাছে কখনোই আসেনি। এই প্রথম তার শরীর ছুঁয়ে দিল। ভাবতেই শরীর দুলে উঠে। মুখটা ঈষৎ আরক্ত হলো। ক্ষুদ্র চোখজোড়া তৃপ্ত হচ্ছে বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে। ছোট ছোট দাড়ি গজিয়েছে মুখে। চুলগুলো বড় হয়েছে। নিজের প্রতি বেখেয়ালি আচরণ করছে সে।

বড্ড বেশি ইচ্ছে করছে তার গালে আলতো করে হাতটা রেখে বলতে, “বাদল মিয়া, আমারে তোমার খেয়াল রাখতে দিবা?”

রিনি এসে পেছন থেকে অনামিকাকে টান দিয়ে বলল, “মণি, এইহানে ক্যান তুমি? আহো হুফুজান তোমারে ডাকে।”

দু’জন দু’জনের দিকে আরেকবার তাকায়। রিনি তার হাত ধরে টেনেই যাচ্ছে। কিছু বলতে যেয়েও বলা হয় না। রিনি তাকে সোনিয়ার কাছে নিয়ে যায়। তার পাশে গিয়ে বসে।

সোনিয়া ঘোমটা খানিকটা তুলে বলল, “দেখ, মিজান মিয়ারে চাইয়া দেখ। পেটডা একটু মোডা কিন্তু সমইস্যা হইবো না। ওই পেটের উপরে আরাম কইরা ঘুমাইতে পারুম। বালিশ লাগবো না। একবাদ বাদল মিয়ার দিকেও চাইয়া দেখিস। ওমন মানুষ চাই, না মিজান মিয়ার লাহান মানুষ চাই ভাইবা দেখিস।”

আবারো ঘোমটা টেনে নেয় সে। অনামিকা আর এক মুহূর্ত বসে না। তার যেন এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভীষণ তাড়া। একবার বাদলের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে আসে। বাদলের সেই চিঠিটা বের করে আরেকবার পড়ে নেয়। চোখে জল টলমল করছে তার। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। জল মুছে চিঠিটা নিয়ে আবার সোনিয়াদের ঘরে আসে। ততক্ষণে সোনিয়াকে পালকীতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ সখিকে শেষ দেখাটা দেখতে পারলো না। তার ব্যস্ত চোখ বাদলকে খুঁজছে কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না।

“আপা, আমি মিলনরে পড়াইতে যাইতেছি। আইতে দেরি হইবো।”, বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় অনামিকা।

চিঠিটা ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। গলাটা শুকিয়ে এসেছে তার। মনে হচ্ছে কত জনমের তৃষ্ণার্ত! পেটের ভেতর গুড়গুড় করে শব্দ হচ্ছে। বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। চেহারায় উজ্জ্বলতার ছাপ। এইতো আর কিছুক্ষণ রোদের শহরে হাঁটতে হবে তাকে। তারপর বাদল ছায়ায় আশ্রয় নেবে। একটু আশ্রয়ের আশায় এই পথ পাড়ি দেওয়া। অথচ সে জানেও না যে পথে কাটা বিছানো সে পথে হাঁটলে পা তো কাটবেই রক্তক্ষরণও হবে। বাদল ছায়ায় আশ্রয় পাবে কী না সেটাও অনিশ্চিত।

চলবে…

লিখা: বর্ণালি সোহানা

গত পর্বের লিংক কমেন্টে

[বিঃদ্রঃ প্রতিদিন ধারাবাহিক গল্পের সাথে একটা ছোট গল্প পোস্ট হবে। আপনার একটা মূল্যবান মন্তব্য লেখার আগ্রহ জাগায়। মন্তব্য করবেন। ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য প্রিয় পাঠক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here