||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ:০৯||
পরীর দিঘিতে ছোট্ট এক পরী ভাসছে। এলাকার বড় ছোট সবাই এসে জড়ো হয়েছে দিঘির পাড়ে। ভিড় জমে গেছে অনেকটাই। পরীকে দেখার ভিড়! এই পরীর নাম শিলা।
হেলাল পানিতে নেমে শিলার নিথর দেহটা কোলে করে তুলে আনে। রেহানা এলো চুলে বেড়িয়ে গেছে বাড়ি থেকে৷ তাকে কেউ আটকে রাখতে পারেনি। বাড়ির আরো মহিলা তার পেছন পেছন গিয়েছেন। বাদল তার ছোট্ট পরীকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। নীরবে চোখের কোণ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়ছে। একদম ঘুমন্ত এক পরী। এই বুঝি চোখ খুলে বলবে, “মামা, আমার ময়ূরের পাখার বাচ্চা হয় না ক্যান? সক্কলের তো ঠিকই হয়।”
বাদল হেসে বলবে, “তোর ময়ূরের বিয়া দে আগে, বিয়া না দিলে পরে বাইচ্চা কেমনে হইবো?”
রেহানা বিলাপ করছে, “তোমরা আজেবাজে কথা কইও না দেহি। আমার শিলা ঘুমাইতাছে। দেখবা এহনই জাইগা যাইবো।”
মায়ের চোখের জল কী আর এক জনমে শোকাবে! রেহানাকে কেউ বোঝাতে পারছে না শিলা আর বেঁচে নেই। এতটুকু বাচ্চা মেয়েটাকে উপরওয়ালা এত তাড়াতাড়ি কেন নিয়ে গেল! তার চোখে এখনো কত রঙিন স্বপ্ন ছিল। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর কিছুই তো দেখা হলো না তার। কত কিছুই বাকি রয়ে গেল পৃথিবীর কাছে।
দূর মসজিদ হতে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আজান শেষে মসজিদে শিলার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়। আশেপাশে যারা খবর জানতো না তারাও জেনে যায়।
উঠানে শিলার মৃত দেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে। অনামিকা তাকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছে সোনিয়ার সাথে। একটু আগে যে বাচ্চা মেয়ের আঙুল ধরে হেঁটে এসেছিল সে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেল! মৃত্যু এত সহজ? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কান্না থামিয়ে রাখতে পারছে না কেউ। অনামিকা এসেছে ঘন্টা হয়ে গেল কিন্তু বাদলকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। তার চোখজোড়া বারবার বাদলকে খুঁজে যাচ্ছে৷ না জানি মানুষটা কোথায় আছে! কী করছে!
বাবলুদ্দিন কবরস্থানে শিলার জন্য কবর খুঁড়ছে। কিছুক্ষণ আগেও সে ভাবেনি এই সন্ধ্যাবেলায়ও তাকে একটা পবিত্র প্রাণের জন্য খবর খুঁড়তে হবে। জানাজা রাত নয়টায় হওয়ার কথা। যত তাড়াতাড়ি দাফনকাজ শেষ হয় ততই ভালো। বিপত্তি ঘটে বাদল আসতেই। বাদল একা আসেনি সাথে পুলিশকে নিয়ে এসেছে।
গ্রামের বাচ্চারা অল্প বয়সে সাঁতার শিখে ফেলে। শিলাও খুব ভালো সাঁতার জানতো। একজন সাঁতার জানা ব্যক্তি কীভাবে পানিতে ডুবে মারা যায়! তাছাড়া বাদল শিলার গায়ে আঁচড় দেখেছে। মনে হয়েছে কেউ মেরেছে তাকে। বাদলের এই পাগলামিতে গ্রামের মেম্বার ক্ষেপে যান। এতবড় দুঃসাহস কীভাবে দেখায় সে। কোনো সন্দেহ থাকলে এসব তাকে বলতো। সবার সাথে কথা বলে গ্রাম আদালতে বিচার হতো। বাইরের পুলিশ কেন এসবে জড়াবে! বাড়িতে পুলিশ ঢুকিতে দেবে না কেউ। নিষেধ করলে পুলিশ সবাইকে হুমকি দেয়, যা যা আইনি ব্যবস্থা নিতে হয় তারা সব নিতে প্রস্তুত।। কিন্তু গ্রামের সবাই এককথা। কেউ লাশ নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে দেবে না। রেহানাও রাজী নয় তার মেয়ের শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে। বাদলের অনেক বলাদ পরও কথা শুনে না। অনামিকা এসে রেহানাকে বোঝায় বাদল যা করছে ভালোর জন্য করছে। যদি কেউ শিলাকে হত্যা করে থাকে তাহলে পুলিশ তার ন্যায় বিচার করবে। অনেক বোঝানোর পর রেহানা লাশ নিয়ে যেতে দেয়। বাদল সাথে যায়। যদি এটা হত্যা হয় তবে হত্যাকারীকে ধরার জন্য যা যা করার সব করবে বলে আশ্বাস দেয় পুলিশ।
সর্বপ্রথম জেরা করার জন্য হেলালকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। যেহেতু শিলাকে শেষ সময়ে সেই দেখেছে। তার সাথেই ছিল। সে বারবার চিৎকার করে না করে যে সে কিছুই জানে না, কিছুই করেনি। শিলাকে রেখে বাজারে চলে গিয়েছিল তখন। কিন্তু বাদলেরও কিছু করার ছিল না। সত্য যেটাই হোক সামনে আসা চাই। পুলিশ তো ধরেই নেয় হেলালই অপরাধী। অনামিকা ভীষণ ভয় পাচ্ছে, যদি তাদের সেদিন দেখা করার কথা সবার সামনে চলে আসে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
১০.
আজ শিলার লাশ দাফন করা হলো। বাদল নিজ হাতে মাটি দিয়ে এসেছে তার প্রাণপ্রিয় ভাগ্নিকে। বাড়িটা কেমন নীরব হয়ে আছে। মিলন আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। তার বোনটাকে সে চাইলেও আর দেখতে পারবে না।
রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। হঠাৎ চালের উপর কে যেন ঢিল মারে। বাদল হারিকেন হাতে দৌড়ে বেরিয়ে আসে। চারদিকে খুঁজে কাউকে পায় না কিন্তু যেই ঢিল পড়েছে সেটা পেয়ে যায়। কাগজে মোড়ানো একটা পাথর। কাগজটা একটা চিঠি।
চিঠিতে লিখা, “অনামিকার থেইক্যা দূরে থাকিও বাদল মিয়া। না থাকলে কিন্তু আরেকটা লাশ পইড়তে সময় লাগবো না।”
হেলাল তখনও থানায়। বাদল পরদিন সকালে চিঠি নিয়ে থানায় যায়। চিঠি দেখে পুলিশ হেলালকে ছেড়ে দেয়। জেল থেকে বেরিয়ে হেলাল বাদলকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। তাকে সাথে করে নিয়ে বাড়ি আসে। সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য তাকে জেলে থাকতে হয়েছে। অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য এই ক’দিন হেলালকে অনেক মেরেছে পুলিশ। গায়ে মারের স্পষ্ট দাগ বসে গেছে। দাগগুলো তাকে দেখিয়ে কান্না করে দেয়।
বাদল তার কাজের জন্য অনেক অনুতপ্ত। কাছের বন্ধুকে সে বিশ্বাস করেনি।
রুজিনা বানু রান্না করে বেরিয়ে হেলালকে দেখে বললেন, “যে চইলা যাইবার হেয় তো গেল বাজান। মনে কিছু রাইখো না। চাইরডা খাইয়া যাইও বাজান।”
এই ক’দিন অনামিকা প্রতিদিন বিকেলে একবার এসেছে বাদলদের বাড়িতে। মিলনকে পড়াতে নয়, রেহানার পাশে কিছুক্ষণ বসে গল্পগুজব করে খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে সে। একটা জিনিস খেয়াল করেছে বাদল তার দিকে এক পলকের জন্যেও তাকায় না। আগে যখন তাকাতো সে ঠিকই টের পেয়ে যেত। কিন্তু এখন সে তাকালেও বাদল ফিরে তাকায় না। শান্ত জলের মতো হয়ে গেছে। চুপচাপ ঘরের ভেতর পরে থাকে। বাইরেও যায় না তেমন। শিলার মৃত্যুর জন্য বাদল নিজেকে দায়ী মনে করছে। সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। অনামিকার খুব ইচ্ছে করে তার পাশে বসে কিছুক্ষণ কথা বলতে।
১১.
সোনিয়া গভীর রাতে সবাইকে ঘুমে রেখে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়ে। রশিদ তার জন্য চৌরাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করছে। আজ তারা পালিয়ে যাবে। সোনিয়ার বিয়ে ঠিক করেছে পাশের গ্রামের এক পান ব্যাবসায়ীর সাথে। রশিদ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তার পরিবারের কেই রাজী হয়নি। সোনিয়া বিয়ে করবে না বলেছিল বলে তাকে উলটো ভাইয়ের হাতে মার খেতে হয়েছে। প্রেমকে সে কখনোই এত গভীরভাবে নেয়নি কিন্তু রশিদ তাকে এতটাই ভালোবেসেছে যে এখন তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। যাওয়ার আগে অনামিকার সাথে শেষবার দেখা করে যেতে চায় সে। কে জানে আর দেখা নাও হতে পারে।
অনামিকার চোখে ঘুম নেই। হুট করে বাদলের এমন পরিবর্তন তাকে পীড়া দিচ্ছে। এই একাকী সময়ে কেবল তার সেই চিঠিটাই ভরসা। কতবার যে পড়েছে তার কোনো হিসেব নেই। যতবার পড়েছে ততবার কেঁদেছে। সে ঘাসফড়িং এর তৃণলতা হতে চায়। জানালার পাশে ফিসফিস শব্দে কে যেন ডাকছে তাকে। দ্রুত উঠে জানালা খুলতেই সোনিয়াকে দেখে আৎকে উঠে সে। হারিকেনের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে।
অনামিকাকে সবকিছু খুলে বলে সোনিয়া চোখের কোণে জল জমে গেছে। হাসিখুশি মেয়েটাকে সে কোথাও দেখতে পায় না।
সোনিয়া ছলছল নয়নে অশ্রু লুকিয়ে বলল, “আমি চইলা যাইতাছি রে। বাদল ভাই তোরে বহু ভালোবাসে। তুই তারে ফিরায়া দিস না।”
অনামিকা কিছু বলতে যাবে তখনই হঠাৎ করে কে যেন বলে উঠে, “কে কথা কয় রে ওইহানে!”
চমকে উঠে দু’জনে। কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠে৷ ধরা পড়ে গেলে সোনিয়াকে জ্যান্ত পুতে ফেলবে তার ভাই।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা