||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০৭||

“পাত্ররে যৌতুকের সাইকেল দিতে হইলে জমিনডা বেইচ্যা দিবার লাইগা কইতেছে তোর দুলাভাই।”, আফিয়া কথাটা বলে বেশ কিছুক্ষণ অনামিকার পাশে নিশ্চুপ বসে রইল। সে ভালো করেই জানে পরশ নিজের টাকায় কিছুই করবে না। স্বামী হলেও কখনো কখনো তাকে কসাই কাদেরের মতো মনে হয়। কাদের নৈহাটি গ্রামের একমাত্র কসাই। এক কোপে ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি তার শরীরে। গরু ছাগল এমন দ্রুত গতিতে কাটে হাত আর ছুরি কোনোটাই দেখা যায় না। ভয়াবহ এক চেহারার অধিকারী সে। ঘাড় অবধি লম্বা চুল। মাথাটা আকারে মিষ্টি কুমড়ার মতো বড়। কোদালের মতো সামনের দুই দাঁত। হাসলে ভয়টা যেন দ্বিগুণ রুপ নেয়। নিজের স্বামীকে তার সাথে তুলনা করতেই শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে।

একমাত্র জমিটা বিক্রি করতে আফিয়াও চায় না কিন্তু অনামিকার একটা ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে হলে জমিটা বিক্রি করতেই হবে। আর জমি বিক্রি করলে পরশেরই লাভ। কিছু টাকা সেও হাতিয়ে নিতে পারবে। এতকিছু বোঝার পরেও আফিয়ার কিছুই করার নেই। মাঝেমধ্যে তার নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হয় কিন্তু এই অপরাধের শাস্তি কোনো আদালত দেয় না। ভেতরে ভেতরে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়াই একমাত্র শাস্তি। না কেউ দেখবে, না কেউ বুঝবে। কেবল অপরাধীই শাস্তি ভোগ করে যাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।

অনামিকার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নীরবে উঠে দাঁড়ায় আফিয়া৷ হাতের কাজ শেষ করতে হবে তাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো বলে। বাবা-মায়ের শেষ স্মৃতি এই জমিন আর বাড়ির ভিটা। অনামিকা চায় না এটা বিক্রি করা হোক৷ কিন্তু কেউ তাকে যৌতুক ছাড়া বিয়েও করবে না। জমিনটা বিক্রি করতেই হবে।

জানালায় ঠকঠক শব্দ শুনে কেঁপে উঠে অনামিকা। কেবল চোখ বন্ধ করেছিল। জানালার পাশে থেকে ফিসফিস শব্দে কেউ ডাকছে, “অনু, অনু এই অনু…”, ডাকছে তো ডাকছেই৷

অনামিকা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিতেই সম্পূর্ণ ঘরে আলো ছড়িয়ে যায়। চারিদিকে চাপা নিস্তব্ধতা। মাঝেমধ্যে শেয়ালের হাঁক শোনা যাচ্ছে। রিনি জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। এই রাতের নীরবতায় তার নিশ্বাসের উঠানামাও গোণা যাচ্ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে সে। বিছানা থেকে পা নামিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত এগারোটা বাজে। যে গ্রামে সন্ধ্যা আটটা হতেই রাত নামে সেখানে এগারোটা গভীর রাত। সবাই রাত আটটার আগে খেয়েদেয়ে ঘুমের জগতে পাড়ি জমায়। অনামিকা হারিকেন হাতে নিয়ে জানালার কাছে যায়। কণ্ঠটা তার বেশ পরিচিত। সোনিয়ার গলা শুনতে পাচ্ছে সে। এতরাতে সে চোরের মতো কেন ডাকছে! জানালা খুলে সোনিয়ার হাসি হাসি মুখ দেখে আরো চিন্তিত হয়ে যায় অনামিকা।

ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুই এই রাত্তিরে এইহানে কী করস? আমি কী তোর আশিক লাগি?”

অনামিকার চোখেমুখে কঠিন বিরক্তি। সোনিয়া তবুও হাসছে। এই হাসিটা আরো অসহ্যকর। পান খেয়ে দাঁত হলুদ করে রেখেছে যা দেখতে খুবই বিশ্রী।

“পান খাইয়া তো দাঁতগুলাতে দাগ লাগাইছস, তোর অন্তরেও কী দাগ লাগাইছস যে এমন কইরা হাসতাছোস? কী বলবার লাইগা এই রাতে এইহানে আইছস?”

সোনিয়া মুখটা ভেংচি কেটে শুকনো লাল মরিচের মতো করে রাখে। হাতে থাকা সাদা একটা কাগজ অনামিকার সামনে তুলে নাড়াতে নাড়াতে বলল, “হুদাই এইহানে ক্যাচাল পাড়তে আসি নাই এই রাইতের বেলা। তুই মিলন শিলা ওগোরে পড়াইতে যাস নাই আর ওইদিকে একজন তোর লাইগ্যা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ কইরা মজনু হইয়া গেছে। তার লায়লারে আমি কবুতরের মাইধ্যমে মোহাব্বতের পত্র পাঠাইছে।”

টান দিয়ে সোনিয়ার হাত থেকে চিঠিটা নেয় অনামিকা। বুকটা কেমন ধুকপুক করছে তার। কেন জানি মনে হচ্ছে যা সন্দেহ করছিল তাই হতে চলেছে। সোনিয়া যেতে যেতে খোঁচা মেরে বলে যায়, “আইজ রাইতে কারো চুক্ষের দুয়ার বন্ধ হইবো না। মনের দুয়ারে যে এহন উথাল ঢেউ। কিন্তু কাইল সক্কালে এই চিঠির সবগুলা হরফ আমারে শুনাইতে হইবো।”

“তুই যা তো এহন।”, সোনিয়ার মুখের উপর জানালার কপাট বন্ধ করে দেয়। অনামিকার শরীর কাঁপছে। হারিকেনের আলো কিছুটা কমিয়ে নেয়। চিঠি বুকের সাথে লেপ্টে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়৷ খুলতে ভীষণ ভয় করছে তার। এটা তার জীবনের প্রথম চিঠি! কেউ যে তাকেও চিঠি লিখবে তা কখনো ভাবনাতেও আনেনি সে। এপাশ-ওপাশ করতে রাত একটা বেজে যায়৷ কখনো ঘরের ভেতর পায়চারি করেছে তো কখনো বিছানায় বসে পা দুলিয়ে চিঠির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে। খোলার সাহস এখনো হয়নি তার।

বুকের মধ্যে যেন নিশ্বাস আটকে আছে তার। একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে হারিকেন কাছে নিয়ে ধীরে ধীরে চিঠির ভাঁজ খুলতে লাগে। প্রথম শব্দ পড়েই চোখ আটকে যায় তার। মনে হচ্ছে এটা কোনো ছাপা লিখা। হাতের লিখা যে এত সুন্দর হিতে পারে এটা না দেখলে বুঝতো না সে।

তৃণলতা,
নামটা অদ্ভুত শোনালেও আমি তোমাকে এই নামেই ডাকবো। তুমি সেই হরিৎ সঞ্জীবনী, যে বিগতপ্রাণে সজীব প্রাণের সঞ্চার করে। আমি সেই বিগতপ্রাণ ছিলাম যে আজ ঘাসফড়িং হয়ে দেউলিয়া হতে চায়। আমি ঘাসফড়িং হয়ে তৃণলতার ভাঁজে ভাঁজে বিরাজ করতে চাই। আমি তোমার চোখে সেই স্বপ্ন হতে চাই যা তুমি রোজ দেখ। তুমি কী আমাকে তোমার হরেক রঙা স্বপ্নসঙ্গী করবে?

উত্তরের অপেক্ষায়,
বাদল… (তুমি চাইলে পরবর্তী চিঠিতে ঠিক নামের জায়গাতে তোমার ঘাসফড়িং বসিয়ে দিতে পারি)

অনামিকার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ কচলে চিঠিটা ভাঁজ করে নেয়। শরীর শিউরে ওঠে তার। শীতল এক স্নায়ুযুদ্ধ চলছে ভেতরে। অল্প শব্দের এই চিঠি পড়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। বাদলকে সে সবসময় এড়িয়ে চলতে চেয়েছে। কড়া করে কথাও বলেছে। নিজেকে দুর্বল করতে চায়নি কখনোই। কিন্তু এখন সে নিজেকে আর শক্ত করে ধরে রাখতে পারছে না৷ আজ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে। তার চোখে সে শুরুর দিকেই অন্যরকম কিছু দেখতে পেয়েছিল। তাই তো যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে ওই চোখের আড়ালে থাকার। ওই চোখজোড়া যেন ভেতরটাকে ঘায়েল করার অস্র বয়ে বেড়ায়।

মাটির কলসি থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে গটগট করে গিলে ফেলে অনামিকা। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে পানি মুখের চারপাশে উথলে পড়ে বুক ভিজে যায়। বিছানা শক্ত করে ধরে চুপচাপ বসে আছে। চিঠিটা ভেজা ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে হারিকেন নিভিয়ে দেয়। সারা রাতে আর চোখের পাতা এক করতে পারে না সে। চোখ বন্ধ করলেই বাদলের হাসি হাসি চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছিল। আর একটা কথাই মনে হচ্ছিল, বাদল তাকে ভালোবাসে…! বাদলের ভালোবাসার কাছে সে দুর্বল হতে চায় না। এই দুর্বলতা তাকে আর বাদলকে বিপদের মুখে ঠেলে নিয়ে যাবে।

৮.
সকাল থেকে কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না। চিঠির প্রতিটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ বিকেলে পড়াতে কোন সাহসে যাবে! এমনিতেও অনেক দুর্বল মনের সে। বাদল যদি সামনে এসে দাঁড়ায় তবেই তার কাঁপুনি শুরু হয়ে যাবে। যদি কিছু জিজ্ঞেস করে বসে! কী উত্তর দেবে সে! মনকে শান্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করেও সেসব বৃথা যাচ্ছে।

পুকুর ঘাটে বসে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছে সোনিয়া। অনামিকা কাপড় হাতে গোসল করতে এসেছে। তাকে দেখে উলটো পথে হাঁটতে শুরু করে। সোনিয়া দৌড়ে এসে তার পথ আটকে দাঁড়ায়। হাত ধরে টেনে ঘাটে গিয়ে বসে দু’জনে। চোখ তুলে তাকাতেই যেন ভয় পাচ্ছে অনামিকা। কেমন মনমরা হয়ে আছে।

“বাদল ভাই কী লিখছে রে? আইজ তো তোর খুশি হওনের কথা আর তুই এমুন ভাব করতেছিস যেন তোর মা মইরা গেছে।”

“বাদল ভাই কবি মানুষ! সুন্দর কইরা তার মনের কথাগুলান লিইখ্যা দিছে কাগজে৷ হেয় আমার ঘাসফড়িং হইবার চায়।”

সোনিয়ার কাছে কথাগুলো অদ্ভুত শোনায়। লেখাপড়া তেমন করেনি তাই কথাগুলো তার কাছে বেশ ওজনদার মনে হয়। এত ওজন আবার তার পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। সে তার চিঠিতে কেবল লিখতে জানে,
“ওগো তুমি আমার জান
সোনার ময়না পাখি,
পান, সুপারি, চুন দিও
জর্দা রাইখো না বাকি।”

কতদিন এসব আজগুবি চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছে অনামিকা। কিন্তু তার প্রেমিক রশিদ এসব বেশ আনন্দ নিয়ে পড়ে। বুলুর হাতে পান সুপারিসহ বাকি জিনিসও দিয়ে পাঠায়। তবে তার পূর্ব প্রেমিক সেলিম কখনো তার কোনো আবদার পূরণ করেনি।

রিনি অনামিকার পেছন পেছন গোসল করতে চলে এসেছে। আফিয়া ঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বলেছে রিনির গা ভালো করে ঘষেমেজে গোসল করিয়ে দিতে। মেয়েটার চুলগুলো কেমন খসখসে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এক মাস ধরে সাবান মাখেনি।

সোনিয়া একটা ডুব দিয়ে উঠে বলল, “কী জবাব দিবি ভাবছিস?”

অনামিকা রিনির মাথায় তখন সাবান মাখছিল। তার কথায় শূন্যে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ হাতের চলন বন্ধ হয়ে যায়।

“কোনো জবাব দিমু না।”, বলেই রিনির মাথায় হাত ভরে পানি ঢেলে দেয়। সাবান পানি মাথা থেকে গড়িয়ে মুখের ভেতর ঢুকে যায়। রিনিও তা নীরবে গিলে খায়। সাবানের স্বাদটা কেমন যেন ভালো লাগে তার কাছে। আজ তার সাবান খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু খেয়ে ওঠা হয় না। তিনটা ডুব দিয়ে তাকে পুকুর থেকে তুলে দেয় অনামিকা। দৌড়ে রোদে এসে বসে। আফিয়া তার কাপড় বদলে দেয়।

অনামিকাকে সোনিয়া বোঝাচ্ছে। এই এলাকার মাঝে বাদলদের পরিবার উচ্চশিক্ষিত। বাদল কয়দিন পর ঢাকা শহরে চলে যাবে। ওখানেই চাকরি-বাকরি করবে। বিয়ে করলে বউও সাথে নিয়ে যাবে। অনামিকা অনেক সুখে থাকবে তার ঘরে। বাদলের প্রস্তাবে যেন রাজী হয়ে যায়। সব কথাই তার কানে ঢুকে, কিন্তু মগজে ঢুকায় না সে। এসব কথা তার কাছে মূল্যহীন। কেননা পরশ তার জন্য যাই সিদ্ধান্ত নেবে তাকে সেটাই মেনে নিতে হবে। পরশের কথার বাইরে গেলে আফিয়ার জীবনে কষ্ট নেমে আসবে। সে চায় না তার কোনো ভুলের কারণে বোনের সংসারটা নষ্ট হয়ে যাক। মাথার উপর যখন কোনো ছায়া ছিল না তখন এই দুলভাই ঠাঁই দিয়েছিল। কথাটা সে ভুলে গেলেও পরিস্থিতি তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here