||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০২||
গুলবাহার বিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এই বৃদ্ধ বয়সেও তার চোখের আড়াল হয় না কিছুই। কোন মানুষটা কী নজরে তাকালো সেটার অর্থও তিনি ভালোই বুঝেন। সোনিয়া অনামিকাকে রেখে এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়। পরশের চাচাতো বোন সে। সেই সম্পর্কে আফিয়ার ননদ হয়। অনামিকার সাথে সই পাতিয়েছে সে। তাদের ছেলে মেয়ে হলে একে অপরের সন্তানের সাথে বিয়ে দিয়ে বেয়াইন হবে বলেও ঠিক করে নিয়েছে। কিন্তু সোনিয়া সবসময় এভাবে তাকে একা ফেলে চলে যায়। অনামিকা শব্দহীন পায়ে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াতেই গুলবাহার বিবি মুখ থেকে পানের পিক ফেলে বললেন, “বাড়ি আসার সময় হইছে? এত্তবড় ডাঙ্গর মাইয়া হইয়া গাঁও-গেরামে এমন জ্বিনের মতো ঘুইরা বেড়াইতে শরম পাওনা?”
নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কথাগুলো গিলে নেয় অনামিকা। তার তর্ক করার সাধ্য নেই এই মহিলার সাথে। আফিয়ার দিকে তাকিয়ে হলেও তাকে চুপ করে থাকতে হয়। নাহলে তার জবানও কখনো ছুরির মতো চলতো। এখন কেবল নীরবতাই সঙ্গী। ঠোঁটে যেন কুলুপ এঁটে বসে আছে নীরবতার বরফ। ঠোঁট আলগা করলেই দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে৷ ধীর পায়ে হেঁটে ঘরের ভেতরে চলে যায় সে৷ পায়ের লঘু শব্দটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তার কটুবাক্য থেকে বাঁচানোর জন্য আজ রিনিও ঘরে নেই। স্কুল থেকে এখনো ফেরেনি মেয়েটা। তার ছোটমনিকে কিছু বলে কেউ পাড় পায় না। রিনিও যে অনামিকার অনেক আদরের। সুড়কি-ঝরা ছোট্ট একতলা বাড়িতে তিনটা কামরা। এক কামরায় পরশ আর আফিয়া থাকে। তার সাথে লাগানো কামরাটায় গুলবাহার বিবি আর তার স্বামী আবুল মিয়া থাকেন। অন্য কামরায় আফিয়ার মেয়ে রিনির সাথে থাকে অনামিকা। রান্নাঘর আলাদা। শোবার ঘরের পূর্ব দিকে রান্নাঘর। শৌচাগারে যেতে হলে ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম হেঁটে যেতে হয়। ঘরের পেছনে পুকুরের পাড় ঘেঁষে তৈরি শৌচাগার।
নিজের কামরায় এসে উত্তরের জানালার পাশে দাঁড়ায় অনামিকা। এক ঝলক দমকা বাতাস এসে জানালার কপাট বন্ধ করে দিয়ে যায়। শীতল বাতাসে শাড়ির আঁচল কাঁধ থেকে কিছুটা খসে পড়ে। অন্য হাতে তা তুলে ঠিক করে নেয়। জানালা দিয়ে আকাশ দেখলে ইচ্ছে করছে মেঘেদের সাথে মিশে যেতে। ক্ষোভ হয় বিধাতার উপর। এই পৃথিবীতে যখন তিনি তার আপন বলতে কেউ দিবেনই না তখন কেনই বা পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন! কখনো সুযোগ হলে প্রশ্নটা ঠিকই করবে সে। অল্পক্ষণেই ঝিরঝির শব্দে বৃষ্টি নামে। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ বৃষ্টি ফোঁটার স্বাদ নেয়। আফিয়ার আওয়াজ পেয়ে জানালার কপাট বন্ধ করে দেয় সে।
২.
বৃষ্টির গতি বেড়েছে৷ বাইরে একটানা ঝুপঝাপ শব্দ। বাদল সাইকেল টেনে বাড়ি ফিরেছে। ভিজে একদম জুবুথুবু হয়ে গেছে সে। ঘরের ভেতরে এসে কাপড় বদলে নেয়। রেহানাকে ডেকে এক কাপ চা দিয়ে যাওয়ার কথা বলে টেবিলের সামনের জানালা খুলে দেয়। একটা বই খুলে বসে। বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা টেবিলে এসে পড়ছে সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। রেহানা মাত্র একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। একমাত্র ভাইয়ের কথায় তাকে বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে হয়। চা বসিয়ে কৌটা থেকে চা-পাতা, চিনি আর গরুর দুধ ঢেলে দেয়। রুজিনা বানু বাছিদ মাস্টারের সাথে বসে খিটখিট করতে শুরু করেছেন, “পোলাডা এত্তবড় হইলো কিন্তু এহনো কোনো কামে লাগে নাই। এত পড়ালেহা করাইতেছেন এহন তো তার বোঝন উচিত। সংসারডা আর কত টানবেন আপনে!”
চিন্তায় তার দিন যায় না, রাত ফুরায় না। বাবা আর কত বসিয়ে খাওয়াবেন। তাকে কিছু বললেও সে গায়ে মাখে না। বাছিদ মাস্টার পুত্র প্রেমে কিছু বলেন না। কিন্তু রুজিনা বানু সারাক্ষণ তার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেন যাতে বাদলকে বলেন কোনো চাকরিতে ঢুকতে। অথচ ছেলের সামনে একটা কথাও বলেন না। বাদলের চাকরি-বাকরির কোনো শখ নেই। এ দেশে চাকরির বাজারে ক্রেতাদের লম্বা সারি। যেখানে বিক্রেতা কম ক্রেতাই বেশি। চাকরি বিক্রি হয় মামা-চাচার পরিচয়ে। বাদলের তো আবার কোনো মামা-চাচা নেই যার পরিচয় দিয়ে সে চাকরি করবে। সে ব্যবসা করতে চায়। সেই সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে। আন্দোলনের সমাপ্তির পর গ্রামে এসে সে হাঁসের খামার করবে। কারো গোলামী করার পক্ষপাতী ছিলো না সে কখনোই। সে নিজে কিছু করে খাবে।
বইয়ের মাঝে মনোযোগ দিতে পারছে না বাদল। সোনিয়ার সাথে মেয়েটা কে জানা হলো না তার। অসময়ে বৃষ্টিও চলে এলো। গ্রামটাও ঘোরা হলো না। মনটা কেমন জানি বিষণ্ণ হয়ে আছে। দূরে ছাতা হাতে শাড়ি উঁচিয়ে একটা মেয়েকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে দেখে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে তার। কোথায় যেন দেখেছে! কিন্তু বৃষ্টির জন্য চিনতে পারলো না। মেয়েটা দ্রুত বারান্দায় উঠে আসে। বাদল ঘর থেকে উঁকি দিতেই দেখল অনামিকা ছাতা ঝেড়ে রাখছে। চোখে চোখ পড়তেই আকাশে বিজলি চমকায়। মেঘ সজোরে শব্দ করে ওঠে। কেঁপে উঠে বুকের মাঝে একদলা থুথু ছিঁটিয়ে দেয় অনামিকা। পৃথিবীর বুকে গুলবাহার বিবির পর যদি সে কিছু ভয় পায় সেটা এই মেঘের গর্জন। সামনে তাকিয়ে বাদলকে দেখে স্তব্ধ হয়ে রয়। ক্ষণকালে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় আকাশ পানে। শাড়িটা ঠিকঠাক করে নিজেকে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ ভিজে গিয়েছে অনেকটাই। রেহানা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অনামিকাকে দেখে এক ঝলক হাসি দেয়।
“আরে অনু! কহন আইলি?” অনামিকার উত্তরের অপেক্ষা না করেই তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায় সে। বাদলের হাতে চায়ের কাপ না দিয়ে অনামিকাকে দেয়। খানিকটা অবাক ও মন খারাপ করে বাদল। এই বৃষ্টিতে ভিজে এক কাপ গরম চা সে চেয়েও পেল না! হয়তো একেই বলে রিজিক। উপরওয়ালা তার অংশের চায়ে অনামিকার নাম লিখে রেখেছিলেন। সে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চোখে দেখছে তাকে। অনামিকা চোখ না তুলেও বুঝতে পারছে বাদল তার দিকেই তাকাচ্ছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে নখ খুঁটছে। শাড়ির আঁচল টেনে দিচ্ছে বারংবার। লজ্জায় মুখটা ঈষৎ আরক্ত হলো। রেহানা তার সাথে এটা সেটা গল্প জুড়ে বসেছে। অনামিকা পড়াতে যাচ্ছিল। হঠাৎ বেগতিক বৃষ্টিতে ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যায় তার। নিজেকে কিছুটা সামলে ছাতা তুলে আনে। জলে কাকভেজা হওয়া থেকে বাঁচার জন্য তাদের বাড়িতে এসে ঢুকে। কিন্তু রেহাই সে পায়নি।
রেহানা মিনতি করে বলল, “আমার একখান শাড়ি পইরা লও। পরে দিয়া দিও। এমন থাকিলে পরে ঠান্ডা লাইগা যাইবনি।”
তার জোরাজুরিতে শাড়ি পালটে নেয় সে। ভেজা চুলগুলো খুলে দেয়। কোমর ছাড়িয়ে সোজা হয়ে পড়ে নিকষ কালো চুল। বারান্দায় রেহানার সাথে পাটির উপর বসে কথা বলছে আর চায়ে চুমুক বসাচ্ছে। রেহানা দেখল বাদল তাকে বারবার চোখের ইশারা করছে। অনামিকাকে উদ্দেশ্য করে সে উৎকণ্ঠা গলায় বলল, “আরে, তোমারে তো আমার ভাইয়ের লগে সাক্ষাৎ করাই নাই। শহর থেইক্যা আইছে সে। আমার ভাই বাদল।”
বাদল যেন এই সময়টারই অপেক্ষায় ছিল। রেহানা কথাটা বলতেই ঘর থেকে চেয়ার টেনে বারান্দায় এসে বসে। উদ্দেশ্যটাতে তো কেবল সেই অবগত৷ বাদলের সম্পর্কে সব কথা বলে একে অন্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আলাপচারিতা বাদল একাই চালিয়ে যাচ্ছে৷ অনামিকার ভ্রুক্ষেপহীন বসে। তার কপালে চিন্তার রেখা। আজকে বেতন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই বৃষ্টির মাঝে যাবেও কীভাবে! এমনিতেই এই মাসে বেতন পেতে দেরি হওয়ায় অনেক কথা শুনিয়ে ফেলেছেন গুলবাহার বিবি৷ চায়ের কাপ শেষ করতেই বৃষ্টি কিছুটা থেমে আসে। বিষয়টা এমন যেন, চা যতক্ষণ বৃষ্টি ততক্ষণ। অনামিকার বিদায়ে খানিকটা আহত হয় বাদল।
বেতন নিয়ে বাড়ির পথে ফিরছে অনামিকা। চোখে জল চিকচিক করছে। আজকে ছেলেমেয়ে দু’টো পড়েনি। বেতন দিয়ে পরিষ্কার বলে দিয়েছে তারা, আজকের পর আর তার কাছে পড়বে না। মাথার উপরের বিশাল আকাশের নীচে যেন আজ সে নিজের জন্য জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। জীবনে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করার কথা কখনো কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি সে। তবুও আনন্দ তার কাছে মরীচিকা ছাড়া কিছুই নয়। গুলবাহার বিবি যদি জানেন তার পড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে না জানি কেমন আচরণ করেন তার সাথে! আজ বাবাকে খুব মনে পড়ছে। মা কেন তাদের একা করে গেলেন। মায়ের টানেই তো বাবা এত তাড়াতাড়ি পরপারের যাত্রায় এগিয়ে গেলেন। মাথাটা ধরে এসেছে তার। উন্মুক্ত আকাশের নিচে হাঁটছে। পথের বেশ কয়েক জায়গায় কাদা হয়ে গেছে। কাদায় খালি পায়ে হাঁটতে মন্দ লাগছে না অনামিকার। পায়ের তলায় অনুষ্ণ অনুভূত হচ্ছে। বৃষ্টির গতি আবারো কিছুটা বেড়েছে। ছাতাটা রেহানাদের বাড়িতে ফেলে গেছে ভুলে। ভেজা শাড়িটাও ওখানে রয়েছে৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে মাথার উপর। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা থাকে। মধ্যপথে আসতেই কেউ একজন তার পথ আগলে দাঁড়ায়। চোখ তুলে তাকায়। শূন্যতা ভরা চোখের জল বৃষ্টির পানিতে ঢেকে যায়। কিন্তু সামনের মানুষটার চোখের আড়াল করতে পারে না।
#চলবে…
লিখা: Bornali Suhana – বর্ণালি সোহানা