#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৭ ||

সেহের বারবার খোচাচ্ছে সা’দকে সরানোর জন্য। এদিকে রিমন গেম খেলতে খেলতে সেহেরের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। বাকিরা যে যার মতো আছে। সা’দ এবার বিরক্তি নিয়ে সেহেরের দিকে তাকালো এবং বললো,

—“কী সমস্যা!”

সেহের ফিসফিস করে বললো,
—“আমার থেকে সরে বসুন, আমার অস্বস্তি হচ্ছে!”

সা’দ হেসে সেহেরের সাথে আরও লেগে বসলো। এবার সেহের নিজের চোখগুলোকে দ্বিগুণ বড় করে ফেলে। সা’দ আবারও মুচকি হেসে বলে,

—“এমন ভাবে চোখ বড়ো করেছো যেন চোখ খুলে হাতে চলে আসবে!”

এবার সেহের সা’দকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু সা’দ এক চুল পরিমাণও সরলো না। সেহের এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। সা’দ তো মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে। সেহেরকে জ্বালাতে তার ভিষণ ভালো লাগছে।

—“প্লিজ বুঝুন!”

—“কী বুঝবো?”

—“আমার সত্যিই অস্বস্তি লাগছে!”

—“তো আমি কী করতে পারি?”

—“সরে বসুন!”

—“নো ওয়ে।” বলে সা’দ আবার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেহের কী মনে করে রিমনকে আলগা করে মাঝে বসিয়ে দিয়ে জানালার পাশে চলে গেলো। রিমন ঘুমের ঘোরে কিছুটা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো। সা’দ এটা দেখে অবাক হয়ে তাকালো। সেহেরের পেটে পেটে এই ছিলো ভাবতেই সা’দের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো আর কিছু না বলেই গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। সেহের তাকিয়ে দেখলো রাগে সা’দের ফর্সা চেহারা লাল হয়ে আছে। এ দেখে কেন জানি না সেহেরের বেশ হাসি পেলো। সা’দ হঠাৎ তার সাথে এমন করে চিপকালো কেন? এই বিদেশির মতলব কী? আচ্ছা কোনোভাবে কী সা’দ এই বিয়েটা মেনে নিয়েছে? মেনে না নিলে এমন অধিকার তো দেখাতো না। ভাবতেই সেহেরের মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। পরক্ষণে আবার ভাবলো সা’দ তো একবারও মেনে নিয়েছে বলে স্বীকার করেনি! যদি তার ভাবনা ভুল হয় তো? আর সেহেরের জীবনটারই যে কোনো গ্যারান্টি নেই, তার মতো মেয়েকে সা’দ কেন মেনে নিবে? সেহেরের জীবন কাহীনি শুনে করুণা দেখাচ্ছে? নাহ সেহের আর ভাবতে চায় না তাকে নিয়ে। ভেবেই সেহের চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

প্রায় ৫০ মিনিট পর সকলে নরসিংদীর একটা শপিংমলে আসলো। রুবাই আর আসিয়া তো ধুমসে শপিং করছে, এদিক দিয়ে তপা আর জোহরাও কম না। তপা ওয়েস্টার্ন ড্রেস নিতে গেলে কবির বাঁধা দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“এইসব ছিঁড়া জামাকাপড় আমার টাকায় নিতে পারবি না ভিখারিনীর বাচ্চা!!”

কবিরের কথায় তপা মেজাজ দেখাতে গিয়েও পারলো না কারণ, কিছুটা সামনে সা’দ দাঁড়িয়ে এদিকে সেদিক তাকাচ্ছিলো। তপা সা’দকে দেখে কবিরের পাশ কাটিয়ে সরে এসে সা’দের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সা’দ সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে তপাকে একবার দেখে অন্যদিকে সেহেরের দিকে তাকালো। সে আপাতত এক কোণায় রিমনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তপা নিজে থেকে বলা শুরু করলো,

—“সা’দ দেখো আমার এই ড্রেসটা পছন্দ হিয়েছে প্লিজ কিনে দাও না।”

সা’দের মন চাচ্ছে তপাকে কয়েক ঘাঁ চড় মারতে। তার উপর কিসব ড্রেস দেখাচ্ছে যা সা’দের একদম অপছন্দ। সা’দ নিজের রাগ দমিয়ে বললো,

—“তোমার বাবা অথবা মাকে বলো!”

—“আরে বাবা তো কিনেই দিচ্ছে না তাইতো তোমাকে বললাম, প্লিজ সা’দ আমায় এটা কিনে দাও!”

—“কাউকে কিছু বলার আগে ম্যানারলেসটা শিখো! আমি তোমার থেকে প্রায় অনেক বড় তাও এইটুকুন একটা মেয়ে হয়ে আমার নাম ধরে ডাকছো তো ডাকছোই আবার ‘তুমি’ সম্বোধন করছো! লাজ-লজ্জা কী নেই নাকি তোমার মা বড়দের সম্মান কীভাবে দিতে হয় সেটা শিখায়নি! লজ্জা-শরম থাকলে এখুনি তোমার এই ডিজগাস্টিং ড্রেস থেকে সরে যাও নয়তো এই সা’দ কী জিনিস হারে হারে বুঝায় দিবো, ইডিয়েট!”

সা’দের ধমক তপা এই প্রথম শুনলো। সে ভয় পেয়ে অন্যদিকে চলে গেলো আর মনে মনে সেহেরকে গালি-গালাজ করতে লাগলো। সেহেরের আশেপাশে থাকলে কিছু না আবার সে কাছে গেলেই দোষ! এদিকে তপাকে দেখে সা’দের চ্যালেঞ্জের কথা মনে পরে গেলো। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সেহেরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো এবং সেহেরের হাত ধরে সেহেরকে থ্রি-পিস দেখাতে লাগলো৷ জেঠু আর কবির বাইরে আছে তাই তারা সা’দের এহেম কান্ড দেখতে পারেনি। কিন্তু এখানে উপস্থিত সকলেই সা’দের কর্মকান্ড অবাক হয়ে দেখছে একমাত্র তানজীল বাদে। রুবাই তো ভাবতেই পারেনি তার ভাই এতো চালু হবে। জুবায়ের আসিয়ার সামনে এসে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

—“তোমার ছেলের কী হলো বলো তো? তুমি এতো করেও ওরে কোনো মেয়ের সাথে লাইন করিয়ে দিতে পারলা না আর এই ছেলে কি না সেহেরের হাত ধরেছে?”

—“বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি না গো। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি!” সা’দের দিকে তাকিয়ে বললো আসিয়া!

—“বাস্তবে ফিরে আসো এটা কোনো স্বপ্ন নয়৷ তোমার ছেলের পেটে পেটে কী চলছে দেখো গিয়ে আমার তো সুগার বেড়ে যাচ্ছে!”

—“আরে ধুর। হয়তো সেহেরের সম্পর্কে জানতে পেরেছে তাই হয়তো এমন করছে। চিন্তা করো না সব ঠিক আছে।”

ওদিকে তানজীল হেসে রুবাইকে বললো,

—“জান অবাক হলে?”

—“অনেকটা!” সা’দের দিকে তাকিয়েই বললো। এদিকে জোহরা আর তপা রেগে আগুন হয়ে আছে।

—“সকলে দেখছে হাত ছাড়ুন! এ কেমন অসভ্যতামি!”

সা’দ থ্রি-পিস দেখতে দেখতে বললো,
—“আমার ইচ্ছা আমি আমার বউয়ের হাত ধরেছি তাতে তোমার কী! চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো আর আমায় ড্রেস দেখতে দাও!”

সেহের নানানভাবে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু সা’দের শক্তির সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না। প্রতি রোজার ইদেই সেহেরের নতুন জামা কিনে দিতো কবির কিন্তু এবার কোরবানি ইদে একটা না দুইটা না একেবারে ৫টা দামী দামী থ্রি-পিস কিনে দিলো সা’দ। যদিও সা’দ গোপনে পেমেন্ট করেছে কিন্তু সকলে জানে রুবাই সেহেরকে এগুলো উপহার দিয়েছে। পাঁচটাই সা’দ নিজে পছন্দ করে দিয়েছে। নিজের পছন্দে প্রিয়জনকে উপহার দেয়াটা সত্যিই অনেক সুখ দেয়। যেমনটা সা’দ পাচ্ছে। সেহের একদমই নিতে চায়নি কিন্তু আসিয়া এবং জুবায়েরের জোরাজুরিতে সেহের এগুলা নিতে বাধ্য হলো। কিছুক্ষণ পর জেঠু এবং কবির আসলেন। তারা আসতেই সকলে বেরিয়ে গেলো। এতক্ষণ জোহরা এবং তপা সেহেরকে নিয়ে সকলের দরদ চুপচাপ দেখেছে আর লুচির মতো ফুলেছে। ভদ্রতার খাতিরে না কিছু বলতে পেরেছে আর না সহ্য করতে পেরেছে। তপার তো সেহেরকে একদম খুন করে দিতে ইচ্ছা করছিলো। যাওয়ার সময়ও সেহেরের গাঁ ঘেঁষেই সা’দ বসলো। এবার রিমন সেহেরের পাশে নেই। সে সামনে আবিদ ভাইয়ের সাথে বসেছে। এবার সেহের পরেছে বিপাকে। সেহের যতো সরে এসেছে ততোই সা’দ সেহেরের দিকে ঘেঁষে বসেছে। চাপতে চাপতে একসময় গাড়ির জানালার সাথে আটকে গেলো সেহের। পেছন সিটে সেহের এবং সা’দ ছাড়া কেউ নেই তাইতো সা’দের সাহস বেড়েছে। সেহের ফিসফিসিয়ে সা’দকে সরতে বললেই সা’দ বলে উঠে,

—“তুমি যতো তোমার থেকে সরতে বলবা আমি ততো তোমার কাছে চলে আসবো! এখনো তো দেখনি সা’দের খেল আস্তে আস্ত এসব বুঝবা!”

সেহের এবারও করুণ চোখে তাকালো সা’দের দিকে। সা’দ সেহেরের দৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে ফোনের দিকে মনোযোগী হলো। সেহের বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে গেলো। সেহেরকে ঘুমোতে দেখে সা’স ফোন রেখে সেহেরের মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে সামনে ফিরলো। গ্রামে ফিরতে ফিরতে মাগরিবের আযানও শেষ হয়ে গেলো। গ্রামে ফিরে রিকশা করে বাসাতে চলে আসলো।

—“দেখো এই সেহেরটারে আমার একদম সইয্য হইতাসে না। এই মাইয়া সবসময় ওই সা’দের লগে চিপকায় থাকে, আপনি জলদি ওরে কিছু করেন!”

—“এই মা*** চুপ করবি? এমনেই মন মেজাজ ভালা না আর তুই আসছোস আজাইরা কথা দিয়া কানের মাথা খাইতে! কয়বার কমু এইসব বালের কথা নিয়া আমার সামনে আসবি না! ওই মাইয়া জাহান্নামে যাক আমার কী! আমার এক লাখ পাইলেই হইলো! আর এই জোহইররা! আরেকবার যদি তুই বালের প্যানপ্যান করোস তইলে তোরেও ওই মাইয়ার ফকিন্নি মায়ের মতো মাইরা জবাই দিমু! আমারে চিনোস!”

বলেই হনহন করে কবির বাহিরে চলে গেলো আর জোহরা সেখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
রাতে সা’দের ঘুম আসছিলো না বিধায় রুম থেকে বেরিয়ে ক্যারিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিলো আর একটা ফিল্ম নিয়ে ফোন ঘাটছিলো তখনই চেঁচামেচি শুনতে পায় সে। রেলিংয়ের ধারে আসতেই কবির এবং জোহরার সব কথা সে শুনতে পেলো। বেশ রাত হওয়ায় এখন প্রায় সকলেই ঘুমে কাত। সা’দ সব শুনে তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ভনভন করতে লাগলো।
কবির কোন এক লাখের কথা বললো? আর কবির এও কেন বললো সে সেহেরের মাকে মেরে ফেলেছে?

—“নাহ এদের মধ্যে এখনো অনেক রহস্য লুকানো আছে।”

এইসব রহস্য ভাবতে ভাবতে সা’দের নির্ঘুম রাত কেটে গেলো, শেষরাতে গিয়ে সা’দ ঘুমিয়ে গেলো।

চলবে!!!

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here