#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৭ ||
তুষার একের পর এক স্টেপর্বপ ভুল করছে তো আবার কড়া রোদে শুটিংয়ের জন্য বারংবার চেঁচিয়ে উঠছে। এদিকে সা’দ হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে চুপচাপ তুষারের আজারে কান্ড দেখছে। শেষ বিকালে রোদের তাপ দেয়ার জন্য কী সূর্যমামা বসে আছে? সা’দের যে তুষারকে কী করতে মন চাচ্ছে সে নিজেও জানে না। সা’দ চুপচাপ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আর এদিকে কারীবসহ প্রডিউসার নানানভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সা’দ একবারের জন্যেও তুষারের আশেপাশে ঘেঁষছে না। এদিকে তুষার যেন আরও রেগে আছে। এতক্ষণ এতকিছু করেও সে সা’দকে নিজের আশেপাশে আনতে পারলো না। শেষে ওদের জোরাজুরিতে আবার শুটিংয়ে মনোযোগ দিলো। শুটিং শেষ হলো রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ। চা-কফির ব্রেক চলছে এখন। আটটা দশে আবার নেক্সট শিডিউল শুরু হবে। সা’দ কফিতে চুমুক দিতে দিতে গ্রামের রাতের সৌন্দর্য দেখছে তখনই তার পাশে চেয়ার নিয়ে বসলো তুষার। সা’দ তুষারের দিকে আড়চোখে তাকালেও টুশব্দও করলো না। তুষার সামনের দিকে তাকিয়েই বলতে লাগলো,
—“এতো কিসের দাপট তোমার মিয়া?”
সা’দ এবারও কিছু বললো না। সে একমনে কফি খেতেই ব্যস্ত। এবার রাগ চেপে বসলো তুষারের!
—“কী কথা কানে যায় না? হাউ ডেয়ার ইউ আমার মতো একজন সুপারস্টারকে এভোয়ড করো?”
—“সুপারস্টার বানানোর ক্রেডিট কার সেটা নাহয় আগে চেক করিও তারপর এসব কথা বলতে এসো!”
খুবই শান্ত গলায় কথাটা বললো সা’দ। সা’দের কথার মাঝে নেই কোনো রাগ আর না আছে কোনো ক্ষোভ! তুষার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—“সে যারই ক্রেডিট হোক আমি সেসব বলছি না। আমাকে এভয়েড করার মানে কী? দাপটটা একটু কম করে দেখাইয়ো!”
সা’দ কফিতে এক লম্বা চুমুক দিয়ে মৃদ্যু হেসে বলে,
—“আমি দাপট দেখাই না। যে যেমন ব্যবহার পেতে যোগ্য আমি জাস্ট তাদের সেই ব্যবহারটাই উপহার দেই। তবে হ্যাঁ এতোটা বোকাও নই যে শেষ বিকালে কড়ারোদ বলবো!”
বলেই সা’দ কফির কাপটা নিয়ে উঠে সেটের দিকে চলে গেলো। আর তুষার? সে তো হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে রাগে ফুঁসছে।
—“এই লোকটার এত বড় স্পর্ধা আমার সাথে এমন বিহেভ করছে! ড্রামাটার ডিল না করতাম, তাহলে এরে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তাম। টাকার শর্ট ছিলো তাই এই নাটকটায় আসতে রাজি হয়েছি আবার কিছু বলতেও পারছি না। তবে মিস্টার সা’দ বিন সাবরান, আমায় দুর্বল ভেবো না! আমি হেরে যাইনি!”
শিডিউল শেষ হলো রাত সাড়ে এগারোটায়। সকলেই বেশ ক্লান্ত টানা শুটিংয়ের কাজ করে। সা’দ গ্রামের এক সড়াইখানা ঠিক করে রেখেছে সেখানেই এই ১ সপ্তাহ তাদের কাটাতে হবে। সকলে থাকলেও তুষার সেই রাতেই বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা হলো। কাল তার শিডিউল দুপুরের দিকে তাই তার তেমন একটা সমস্যা হবে না। এদিকে সা’দ সড়াইখানায় পৌঁছাতেই তার মামার কল পেলো!
—“হ্যাঁ মামা বলো!”
—“বলছি তোর আশেপাশে আমি গোয়েন্দা ফিট করে রেখেছি!”
—“হোয়াট! বাট হুয়াই মামা? এসবের কী প্রয়োজন?”
—“প্রয়োজন আছে। কমিশনারের থেকে ওই লোকটার খবরা-খবর সব জেনেছি। লোকটা খুব একটা সুবিধার না আর গ্রামের মানুষ তো এদের ভরসা তো আমার একদম নেই। তুই সাবধানে থাকিস!”
—“তোমার যেমন হুকুম। আচ্ছা এখন রাখো আমাদের রাতের খাবারের সময় হয়েছে।”
—“ও আচ্ছা। তাহলে বাই আর বেস্ট অফ লাক তোর শুটিংয়ের জন্য!”
—“হুম মামা আল্লাহ হাফেজ।”
বলেই সা’দ ফোন রেখে দিলো। সা’দ ফোন রাখতেই কারীব সা’দের দিকে আসলো। সা’দ শান্তসুরেই প্রশ্ন করলো,
—“কিছু বলবে?”
—“হ্যাঁ। খাবারটা?”
—“সকলের সাথে খাবো আসো!” ম্লান হেসে বললো সা’দ। কারীব খুশি হয়ে তার স্যারকে নিয়ে সড়াইখানার পেছনের উঠোনে গেলো। সেখানে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করা হচ্ছে আর বাকি কর্মচারীরা পাটি বিছিয়ে কথাবার্তা বলছে। অভিনেত্রী বা অভিনেতাদের দেখা যাচ্ছে না, তাদের খাবার রুমে রুমে দিয়ে আসা হবে।
সকল কর্মচারীরা সা’দ কে দেখে অত্যন্ত খুশি হলো। তাদের টিমে যে চা-কফির দায়িত্বে থাকে সা’দ তার পাশেই বসলো। সেই বেচারার তো আনন্দে চোখে জল চলে এসেছে। ছেলেটা বেশি বয়স না, কম করে হলেও তার বয়স ১৬-১৭ হবে। গরীব ঘরের ছেলেটা তবে সা’দই তার লেখাপড়া করাচ্ছে। লেখাপড়া করার মতো সামর্থ্য তার নেই। বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। মা আর বোনের জন্যই এই ছোট বয়সে যুদ্ধ করতে নেমে পরা। ছেলেটার নাম আযের। আযের ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বললো,
—“স্যার আপনি আমার পাশে বইসেন?”
–“হ্যাঁ বসলাম কেন কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
—“না সাহেব কী যে বলেন না।”
এভাবে সকলের সাথে বেশ ভালোভাবে আড্ডা হলো, খাওয়া হলো।
পরেরদিন,
মানজু আর সেহের কথা বলতে বলতে আসছিলো হঠাৎ অদূরে সেহের একটা সুন্দর বেলী ফুকের চাড়া দেখতে পায়। সেহের মানজুকে সেখানে দাঁড়াতে বলে ছুটলো সেই চাড়ার দিকে তখনই সে সে ধাক্কা খেয়ে মাটুতে পরে গেলো। হাতের কবজি এবং হাঁটুর কিছু অংশ ছিলে গেছে। ছিলে যাওয়ার জায়গায় জ্বালা করায় সেহের চোখমুখ কুচকে ফেললো। কারো কথায় ধ্যান ভাঙতেই সেহের চোখ খুলে সামনে থাকা আগন্তকের দিকে তাকালো। শ্যাম বর্ণের লম্বা, সুঠাম দেহি ছেলেটা। তবে তার চেহারায় রাগ স্পষ্ট, রাগে তার কপালে একটা রগও দেখা যাচ্ছে। তুষার কিছুটা হুংকারের সুরে বললো,
—“ম্যানারলেস বলতে কিছু নাই? দেখো না এখানে শুটিং চলে? এখন ধাক্কা দিসো ক্ষমা না চেয়ে উলটা থম মেরে বসে আছো? এতো নাটক কেমনে করো হ্যাঁ? ডিসগাস্টিং! এসব গাঁইয়া মেয়ে যে কোন ক্ষেত থেকে উঠে আসে গড নোওস!”
সেহের তুষারের কথায় কোনোরকম অভিব্যক্তি না করে উঠে দাঁড়ালো। এরপর নিজের কামিজ ঝাড়তে ঝাড়তে বলে উঠলো,
—“দেখুন আমি আপনাকে ধাক্কা দেইনি, আমি তো শুধু আমার পথ ধরে এগোচ্ছিলাম, আপনি নিজেই আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন!”
—“এই স্টুপিড মেয়ে! তুমি কী বলতে চাও আমি তোমাকে সেঁধে ধাক্কা দিয়েছি? এই ফিল্মস্টার তোমায় সেঁধে ধাক্কা দিবে হাউ ফানি! নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছো স্টুপিড মেয়ে? এই এক সেকেন্ড আই থিংক তুমি আগে থেকেই প্ল্যান করে আসছো এই ফিল্মস্টারকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে বলে রাইট? দেখো গাঁইয়া মেয়ে আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্টেড অন ইউ! জাস্ট লিভ!”
—“তুষার! পহোয়াট হ্যাপেন্ড? শুটিংয়ের মাঝে এভাবে অন্য একজনের সাথে ঝগড়া লাগলে কেন? সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল করেছো?”
সা’দের কথায় তুষার পিছে ফিরলো। তুষার পিছে ফেরার জন্য সা’দ এবং সেহের দুজন দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। সেহেরের চোখদুটো দেখে সা’দ যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার সময়টা যেন থমকে গেছে কোনো একজোড়া ডাগর আঁখির মায়াতে। সা’দ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে কাজল ছাড়া চোখজোড়ার দিকে। চোখদুটোতে কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই তবে সা’দের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই কাজলতা শুধু এই চোখজোড়াতেই মাধুর্যতা ফুটিয়ে তুললো, সাথে এক আকাশ মায়ার মেঘতুলো! মুখোশ বাঁধার কারণে সা’দ শুধু সেহেরের মায়াবী চোখজোড়াই দেখতে পাচ্ছে তবে তার জন্য এই চোখজোড়াই এনাফ, সা’দকে তার মায়ার মোহনজালে আবদ্ধ করে ফেলতে। নিজের অজান্তেই তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। সা’দ জানে না এ কেমন অনুভূতি! তবে বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত। হঠাৎ মেয়েটা দৌড়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো আরেকটা মেয়ে সেই মেয়েটির পিছে দৌড়ে চলছে। সেই মেয়েটির যাওয়ার পানে এখনো সা’দের দৃষ্টি স্থির। মায়ার বিষাক্ত জালে যে সে ফেঁসে গেলো তা একদমই ঠাহর করতে পারছে না। কারীবের কথায় ধ্যান ভাঙতেই সে আবার নিজের কাজে মনোযোগী হলো।
এদিকে সেহেরের বুকটা অগণিত ধুকপুক করেই চলেছে থামার নাম নেই। কয়েক মিনিটের জন্য সে সেই গাছের নিচে দাঁড়ানো পুরুষটার দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো! অত্যন্ত সুদর্শন সেই ছেলেটি। এমন সুদর্শন ছেলে সেহের এ জীবনে আগে কখনো দেখেনি। লম্বা, সুঠাম দেহি, চুল স্টাইল করে ব্রাশ করা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি যেন তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়্ব তুলেছিলো। চাঁদের গাঁয়ে যেমন দাগ আছে, তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে যেন সেই কথাটাই ফুটিয়ে তুলে। তবে দাড়ির না থাকলে ছেলেটার চেহারাটিকে পানসে পানসে লাগলো। সানগ্লাসের জন্য চোখদুটো দেখতে পারেনি সে। সেহের কিছুদূর এসে হাঁপাতে লাগলো। মাঞ্জু সেহেরের কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
—“আমালে ফেলে এভাবে দৌড়ে এলি কেন?”
—“ওখানে কী শুটিং চলছিলো?”
—“হ্যাঁ আশেপাশে তো ক্যামেরা ট্যামেরা দেখলাম!”
—“আগে কেন বলিসনি? বললে কী ওই ছেলে আমাকে অপমান করার সাহস পেতো না! আর ওরা রাস্তার মাঝে শুটিং করে কেন?”
—“আরে আরে! আমাকে কী বলতে দিয়েছিলি? নিজেই তো সেদিকে গেছিলি। তবে যাই বলিস, যে ছেলেটির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলি সে তো ইয়া বড় ফেমাস হিরো! উফফ বইন আমার তো মন চাইছিলো ওনার অটোগ্রাফ নিতে!”
—“ফেমাস না কঁচু! এর ব্যবহার তো অত্যন্ত খারাপ। এরা টাকার সাথে মানুষকে তুলনা করে। কী বিচ্ছিরি মুখের ভাষা, আমি নাকি তার জন্য ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরেছি! বড় বড় মানুষদের ব্যবহার যদি এমন নিচ স্বভাবের হয় তাহলে আমরাই বেশ আছি! এদের মতো উঠতে বসতে কাউকে কথা শুনাই না!”
—“বাহ তাহলে তো বেশ। তাহলে এতদিন যে নিজ বাড়িতে বাবা, সৎমা এবং ছোট বোনের অত্যাচার সহ্য করেছিস? সেগুলার বিষয়ে তো কোনোদিন প্রতিবাদ করিসনি?”
—“সে অন্য ব্যাপার! ওরা ঘরের মানুষ, আপনজন! আমতা আমতা করে বললো সেহের। এরপর কথা ঘুরিয়ে সেখান থেকে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
চলবে!!!