বাসন্তী
পর্ব- ৩৪
লেখা-লিমু
-” তিন বছর পর…
-” আম্মু আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ক্লাসের,আমি গেলাম। তোমরা নাস্তা করে নিও। আর আজকে কলি আসবে, পরীক্ষা শেষ ওর। গতকাল রাতেই আমাকে জানিয়েছে। সকালের ট্রেনেই রওনা দিয়েছে। আমি স্টেশন থেকে ওকে নিয়েই একসাথে ফিরবো।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে,এখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করছে পুষ্প। আর সেই সাথে বছর-দুয়েক আগেই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জব হয়েছে। কলি ঢাকা মেডিকেলে পড়ছে। কবির এবার ক্লাস নাইনে। পুষ্পর মা ঘরে বসেই টেইলার্সের কাজ করে। এভাবেই চলে যাচ্ছে ওদের দিন। পুষ্প বিয়ে করেনি এখনো। ওর সামনে কেউ বিয়ের কথা উচ্চারণই করতে পারে না। ওর এক কথা,পরিবার নিয়েই ও বেশ ভালো আছে। তবে ইদানিং একজন ওকে খুব ইরিটেট করাচ্ছে। এমনকি ওর মায়ের কাছে পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু পুষ্প একবাক্যে মানা করে দিয়েছে।
কিন্তু সবসময় পুষ্পর আশেপাশে ঘুরঘুর করে সে। কারন সে আর কেউ নয়,পুষ্পর কলিগ। নাফিস ইকবাল। চট্টগ্রামেই উনাদের বাসা। এক ভাই,এক বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে,ভাইয়ের জন্য মেয়ে খুঁজা চলছে। কিন্তু তার নাকি কোন মেয়ে পছন্দ হয় না। পুষ্প যেদিন জয়েন করেছে,সেদিন থেকেই উনার তাকানো টা পুষ্পর সুবিধা লাগতো না। একটা মেয়ে সহজেই বুঝতে পারে,তার দিকে কে কোন দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। তাই সেটা বুঝতে পেরে, শুরু থেকেই পুষ্প তাকে এড়িয়ে চলে।
কিন্তু সে সহজে হাল ছাড়ার পাত্র না। নাফিস সাহেবের এমন কান্ড দেখে পুষ্পর অন্য কারো কথা মনে পড়ে গেল। যাকে তিনবছর আগে সে নিজেই ছেড়ে চলে এসেছে। জীবন আমাদেরকে কখন কোন মোড়ে নিয়ে দাঁড় করায়,সেটা আমরা কেউ জানিনা। কিন্তু যেখানেই দাঁড় করাক,আমাদেরকেই সঠিক পথ খুঁজে নিতে হয়। হয়তো সেটা কঠিন,তবে অসম্ভব না। জীবনের বাঁকে বাঁকে হোচট খেয়েই তো মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হয়। কিন্তু পুষ্প কি সেই মানুষটাকে মন থেকে সরাতে পেরেছে আজও?
সেই নামটা মুছে ফেলা কি এতই সহজ,যে নামটা খুব যতনে হৃদকুঠিরের সবটা দখল করেছিল। অস্তিত্ব জুরে যার বিচরণ ছিল, তাকে ভুলতে গেলে যে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যেতে হবে। পুষ্প রাতের গভীরে একা কাঁদে,কেউ জানেনা,কেউ বুঝেনা। সে তার ব্যাথা রাতের অন্ধকারেই বিলীন করে দেয়। সকালের নতুন সূর্য উঠার আগেই,নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক করে নেয় সে। যেন তার জীবনে কিছুই ঘটেনি,সব স্বাভাবিক।
অবশ্য সবাইকে এড়াতে পারলেও,পারেনা নিজের বোনকে এড়াতে। কিন্তু কলির প্রশ্নেরও কোন জবাব দেয় না। বেশি কথা বললে,কলিকে ধমকে দেয়। কলি বেশ অবাক হয়,তার বু’র এমন আচরণে। কষ্ট পায়,কিন্তু কিছু বলে না। কারন জানে সে,তার বু এক পাহাড় সমান ব্যাথা বুকে পুষে রেখেছে। কিন্তু সেটার কারন কাউকে বলে না। সবাই শত চেষ্টা করেও ঐদিন পুষ্পর মুখ থেকে কোন কারন বের করতে পারেনি। ওর এক কথা ছিল,এ বিয়ে হবে না। বারবার যখন পুষ্প এই কথা বলছিল,তখন প্রণয় সবাইকে থেমে যেতে বলে। সবাইকে বলে যেন পুষ্পকে আর কোন প্রশ্ন না করা হয়। এবং এর পরেরদিনই পুষ্পরা সবাই ঐ বাড়ি থেকে চলে যায়। পাপড়ি পুষ্পকে বারবার অনুরোধ করছিলেন,যেন আরেকটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পুষ্প পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। এই পুষ্পকে কেউ চিনেনা। প্রণয়ও না।
প্রণয় দূর থেকে দাঁড়িয়ে পুষ্পর চলে যাওয়া দেখছিল। মনে হচ্ছিল, এটা কোন দুঃস্বপ্ন। একটু পরই ঘুম ভেঙে যাবে,আর সব ঠিক আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু কিচ্ছু ঠিক হয়নি। সব স্বপ্ন,দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। ভালোবাসলে নাকি কষ্ট পেতেই হয়,সেটা যেকোন ভাবেই হোক। আজ প্রণয় সেই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু যার জন্য কাতরাচ্ছে, যাকে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে ভালোবেসেছিল,সে কি একবারও তার কথা ভাবেনা?
এভাবে হৃদয়টা কাচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে কি সুখ সে পাচ্ছে?
মেয়ে মানেই ছলনাময়ী, এ কথা কি প্রণয়কেও মানতে হবে।
না,প্রণয়ের বাসন্তী কখনোই ছলনাময়ী হতে পারে না,কখনোই না।
অনেক বড় কোন রহস্য বা কারন লুকিয়ে আছে পুষ্পর এতোবড় সিদ্ধান্তের পিছনে। কিন্তু সেটা কি,তার যদি কোন ক্লু না পাওয়া যায়,তাহলে কিভাবে কি বুঝবে। পুষ্পর চোখে মুখে ঐদিন কেমন জানি একটা আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। একই সাথে কেমন একটা চাপা অভিমান,ক্রোধ। কিন্তু সেটা কেন,তার কোন ইয়ত্তা খুঁজে পাচ্ছিল না প্রণয়। মুহুর্তের মধ্যে এমন কি হলো,যেটা পুষ্পকে এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করলো। প্রণয় কি কোন ভুল করেছে? জানামতে করেনি সে। যদি অজান্তেও করে থাকে,তাহলে সেটা বলবে তো নাকি। না বললে তো কোন কিছু সমাধান হবে না। কিন্তু পুষ্প তো কোনকিছু সমাধান করার উপায়ই রাখলো না। সেদিনের পর প্রণয় যাতে কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে,তারজন্য সব নাম্বার বদলে দিল। কোথায় গিয়েছে, কাউকে কিছু বলেনি। কলির আইডিও ডিএক্টিভ,হয়তো অন্য আইডি চালায়। মানে একদম দূরে সরিয়ে নিতে হলে, যা যা করা দরকার তার সব ব্যবস্থা পুষ্প করেছে। এতোটা কঠিন কেউ কি করে হতে পারে,তা প্রণয়ের জানা নেই। একবারও প্রণয়ের মায়াচন্ডীর তার কথা মনে পড়ে না?
” একবারও না!”
কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে নাকি,তাকে ভুলা যায় না। তবে কি সে আমাকে ভালোই বাসে নি?”
কিন্তু তার চোখে যে আমি ভালোবাসার সমুদ্র দেখেছিলাম। তবে কি সেটা শুধুই মরিচিকা!”
এমন হাজারটা প্রশ্ন গত তিনটা বছর ধরে প্রণয়কে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রেখেছে,গিটার হাতে নেয় না আর। প্রণয়ের গানের সুর যে হারিয়ে গেছে,তার বাসন্তীর চলে যাওয়াতে। যাকে দেখলেই,মনে হাজারো কথা জমা হতো। আজ সেই হৃদয়,রিক্ত,শূন্য। ভাষা হারিয়েছে কথারা।
প্রণয় মাঝে মাঝেই একা একা কথা বলে। পুষ্পকে বলে,
তুমি মজা করে বলতে বিয়ে করবেনা,তোমার মজার কথাটাই তুমি সিরিয়াসলি প্রমাণ করে দিলে। কি অদ্ভুত না!
মানুষ কত দ্রুত বদলায়!”
তোমার বদলে যাওয়াটা যে আমাকে তীলে তীলে শেষ করে দিচ্ছে, তুমি কি তা একটুও অনুভব করতে পারো না। সত্যিই কি তুমি আমাকে ভুলে গেছো?
আমি কি তোমার অন্তর স্পর্শ করতে পারিনি?
তবে কি আমার ভালোবাসায় খাঁদ ছিলো?
নিজেকে আজ এতো অসহায় লাগে কেন!”
কত মানুষই তো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েও,দিব্যি ভালো আছে। আমি কেন পারছিনা।
আমার ভালো থাকার কারন হয়ে এসেছিলে,তাই বুঝি এভাবে কষ্ট দিয়ে চলে গেলে।
আচ্ছা পুষ্প…
-” তুমি ভালো আছো তো?”
-“জানো,এ প্রশ্নের উত্তরটা খুব জানতে ইচ্ছে করে,খুব।
বিকাল পাঁচটায় ট্রেন এসে স্টেশনে থামলো। ব্যাগপত্র নিয়ে কলি ট্রেন থেকে নামলো। পুষ্প প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে এসে বসে আছে। পুষ্পকে দেখে কলি হালকা দৌড়িয়ে এসে জড়িয়ে
ধরলো। তারপর রিকশা নিলো দুজনে। বাসার গলিতে ঢুকবে, এমন সময় পুষ্প হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। রিকশা থেকে একটু আগেই নেমে গেছে,কারন বাসার পাশের পথটা বেশ সংকীর্ণ।
অন্য পাশে একটা কাপল দেখে পুষ্প হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। কলি প্রায় বাসার গেটের কাছে চলে গিয়েছিল। পিছনে তাকিয়ে দেখে, পুষ্প নেই।
একটা ছেলে রাগ করে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে একটা মেয়ে কান ধরে বসে আছে। ছেলেটা চলে যাচ্ছিল,হঠাৎ আবার পিছনে ফিরে তাকায়। মেয়েটাকে এভাবে কান ধরে বসে থাকতে দেখে,মুখ গম্ভীর করে মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে। ছেলেটাও মেয়েটার সামনে বসলো চুপচাপ, কোন কথা না বলে।
ছেলেটা কি যেন বললো,সেটা শুনে এবার মেয়েটা জোরেই কেঁদে দিল। এভাবে রাস্তার মধ্যে কান্নাকাটি করার কোন মানে হয়। ছেলেটা মেয়েটাকে বকা দিচ্ছে। কিন্তু সে বকা শুনেও মেয়েটা কাঁদছে,একইসাথে হাসছে। কি অদ্ভুত লাগছে মেয়েটাকে দেখতে। ছেলেটা দুহাত বাড়ালো,মেয়েটা ছেলেটার বুকে জাপটে পড়লো। হঠাৎ কেন যেন পুষ্পর চোখ বেয়ে একফোটা অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কেন, তার কোন উত্তর পুষ্পর জানা নেই। আজকাল চোখের জলও কথা মানেনা,যখন তখন ঝরে পড়ে। পুষ্প একটা ম্লান হাসি দিয়ে পিছনে ঘুরে তাকাতেই একটু চমকে গেল। কারন কলি ঠিক ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুষ্প কলিকে কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো। কলি বললো,
-” আর কত পালাবে বু? এভাবে কাউকে কিছু না বলে, আর কতদিন নিজের ভেতর যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াবা। অন্তত কাউকে বলে হালকা হও। একটা মেয়ের একা জীবন কাটানো এতো সহজ না বু। সেটা তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো। তাই সময় হারিয়ে, সময় খুঁজো না। এখনও হয়তো সময় আছে,চাইলে সব ঠিক হতে পারে।
-” কলির শেষের কথাটা শুনে পুষ্প সরু চোখে তাকালো কলির দিকে। কলির কথাগুলো যেন কিছু একটার ইঙ্গিত দিচ্ছে,কেমন আবছা কথাগুলো। পুষ্প তবুও বেশি পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে লাগলো।
-” তখন কলি আবার বললো,
-” সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি হয়,কিন্তু সেটা মারাত্মক আকার ধারণ করার আগেই ঠিক করে নিতে হয়। একটা সম্পর্ক চারাগাছের মতো,যত্ন না পেলেই নেতিয়ে পড়ে। আমি জানিনা, তোমাদের মধ্যে কি এমন হয়েছিল। তবে এটা জানি ভাইয়ার কোন দোষ নেই। তুমি একজন ভালো মানুষকে হারালে,এটাই বলবো। গত তিন বছর ধরে এটাই বলার চেষ্টা করছি তোমাকে। কিন্তু তুমি যেন কেমন হয়ে গেছো। কোন কথা তোমার গায়ে লাগে না। কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছো সবার থেকে।
বাইরে যতই দেখাও তুমি ভালো আছো,আমিতো জানি তুমি কেমন আছো।
-” বেশি পাকা পাকা কথা বলিস না।
-” সেটাতো আমি সবসময়ই বলি।
-” মানুষ বদলায়,বদলাতে হয় প্রয়োজনে।
-” নিজের স্বকীয়তা পাল্টে,আমি বদলাতে চায়না। আমি যেমন,তেমনই। জানো তো নিমপাতা তেতো হলেও,সেটাই উপকারী। সে যদি মিষ্টি হতো,তাহলে হয়তো তার এতো গুন থাকতো না।
-” খুব বড় হয়ে গেছিস না?
-” উম…তা তো একটু হয়েছিই। দেখো তোমার থেকেও লম্বা হয়ে গেছি। পুষ্পর পাশে দাঁড়িয়ে কলি হাইট মাপতে লাগলো।
-” লম্বায় বড় হয়েছিস দেখে,নিশ্চয়ই বয়সেও আমার বড় হয়ে যাস নি। তাই ছোট ছোটর মত থাকবি। সেটাই মানানসই।
-” তুমি খুব বদলে গেছো বু,খুব। অভিমানী সুরে কথাটা বললো কলি। পুষ্প কিছু বললো না। আসলেই কি পুষ্প বদলে গেছে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো খুব সন্তর্পণে,যেন কলি টের না পায়। মানুষ যেমন মরণশীল, ঠিক তেমনি পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়ত মানুষ পরিবর্তন হয়। অনেক সময় হয়তো নিজেও সেটা টের পায় না। অথবা টের পেয়েও নির্লিপ্ত থাকে।
-” হঠাৎ কলির কথায় পুষ্পর ঘোর কাটলো। কলি বলে উঠলো,
-” আর একবার কি একটু ভাবা যায় না বু?
-” যেটা ফেলে এসেছি,সেটা অতীত হয়ে গেছে। আর অতীতকে অতীতেই থাকতে দিতে হয়। আর নিজের আত্নসম্মানের চেয়ে,ভালোবাসা বড় হতে পারে না কখনো। ভালোবাসাই জীবনের সব না। ভালোবাসা ছাড়াও মানুষ বেঁচে আছে। কিন্তু আত্নসম্মান না থাকলে,সেটা বেঁচে থেকেও মরার মত। আর আমার কাছে ভালোবাসার চেয়েও, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর আমি তোদের নিয়েই বেশ ভালো আছি। এভাবেই বাকী জীবনটা কেটে যাবে দেখতে দেখতে। কতদিনই আর বাঁচবো হয়তো!”
#চলবে…..