বাসন্তী
পর্ব- ২৮
লেখা-লিমু
—–” পুষ্প নিঃশব্দে কান্না করছে ওর রুমের ব্যালকুনিতে বসে। কখনো কখনো নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হয়,কিন্তু সেটা যে মহাপাপ। তাই চাইলেও সেটা সম্ভব না,দাঁত কামড়ে সকল ব্যাথা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হবে,থাকতে হয় আমাদের। একটাই যে জীবন। আর পুষ্পর মতো একটা মেয়ে মারা গেলে এ পৃথিবীর কিছু আসে যায় না। তবু কিছু বোকা মেয়ে সামান্য কারনেও আজকাল সুইসাইড করে। বয়ফ্রেন্ড অবহেলা করলে,তারা ব্লেড দিয়ে হাত, পা কাটে। যেন বয়ফ্রেন্ডই জীবনের সব!
পরিবার,বন্ধু-বান্ধব এসব সম্পর্ক তাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে যায়,দুই দিনের বয়ফ্রেন্ডের কাছে। অথচ পৃথিবীর সবাই ত্যাগ করলেও,তোমার বাবা মা তোমাকে ত্যাগ করবেনা। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তারা সন্তানের জন্য নিজের সর্বস্ব উজার করে দেয়, চাই তার সন্তান ভালো থাকুক। আর আমরা মিথ্যে সম্পর্কে জড়িয়ে সেই বাবা মাকে কষ্ট দেয়।
হঠাৎ আকাশ-পাতাল ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল পুষ্প। ওর ভাবনার ছেদ পড়লো কারো ডাকে।
হঠাৎ প্রণয়ের মাকে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুষ্প বসা থেকে একলাফে দাঁড়িয়ে পড়লো।
পুষ্প বললো,জ্বি বলুন আন্টি।
-” ডোন্ট কল মি আন্টি,কেমন ব্যাকডেটেড লাগে।
-” কি ডাকবো তাহলে আন্টি?”
-” কিছু ডাকতে হবে না। যেটা বলতে এসেছি শুনো মন দিয়ে। শুনেছি তুমি বেশ ভালো রাঁধতে পারো। তাই রাতের জন্য বেশ কিছু দেশীয় আইটেম রান্না করবে,অনেকদিন খাই না। বিদেশে যতই দামী খাবার খাই না কেন,দেশী খাবারের স্বাদ মুখে লেগে থাকে। তুমি নাকি অনেক ভালো ভর্তার আইটেম করতে পারো,অবশ্য ঝাল নাকি বেশি দিয়ে ফেলো। ঝাল ঠিকমতো দিবে,কমও না আবার বেশিও না। ঝাল খেতে আমি ভালোবাসি,তবে অতিরিক্ত না।
-” পুষ্প একটু না, বেশ অবাকই হলো। উনি এতোকিছু কি করে জানেন? পুষ্প আবার ভাবনায় পড়ে গেল। তখন পাপড়ি মেহবুব আবার ডেকে পুষ্পর ধ্যান ভাঙালেন। এবং বললেন,জলদি কাজে লেগে পড়ো প্রণয়ের আব্বু আবার সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ে। রাতজাগা বারণ। প্রেশার কনট্রোলে থাকে না নয়তো। তাই চিন্তা অন্য পাশে রেখে কিচেনে যাও। পুষ্প আর কোন কথা না বলে চুল খোপা করতে করতে চলে গেল। কি রান্না করবে ও কিছুই বুঝতে পারছেনা। উনি তো কোন আইটেমের নামও বলেন নি। এসব সাঁত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনে পুষ্প রান্নাঘরে যাচ্ছিল। আকস্মাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে,সে হাতে ধরে ফেলে। তাকিয়ে দেখে আর কেউ না,ত্রিপলি সাহেব।
প্রণয় একটা ধমক দিয়ে বললো,” আরে এভাবে চোখে তালা মেরে কোথায় যাচ্ছিলে?”
-” পুষ্প হতবাক না হয়ে পারলনা প্রণয়ের কথা শুনে। তারপর চোখ কুঁচকে বললো,
-” আমার চোখ তালা মারা,আর আপনার গুলো কি আনইন্সটল করা ছিল, যে দেখতে পাননি।
-” প্রণয় পুষ্পর হাত ছেড়ে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে একহাত প্যান্টের পকেটে,আরেকহাত গালে দিয়ে মুচকি হেসে দিল। তারপর বললো,
-” আরে বাহ,আমার কথার একেবারে কাউন্টার এট্যাক!” আই লাই ইট। আই লাইক মাই মায়াচন্ডী। অনেক মিস করছিলাম মায়াচন্ডীকে। ফাইনালি মায়াচন্ডী তার পুরোনো রুপে ফিরে এসেছে।
কিন্তু তাই বলে আবার তুমি থেকে আপনি কেন? তুমি ডেকেও তো ঝগড়া করা যায়। তাহলে মনে হবে সেটা রোমান্টিক ঝগড়া,প্রিয়জনের সাথে। আর আপনি বললে মনে হয়,উগান্ডার কোন ব্যাডার সাথে ঝগড়া করতাছো। আই অ্যাম নট এনি উগান্ডার ব্যাটা!” এটা বলে প্রণয় ওর শার্টের কলার উঁচু করলো,চুল ঠিক করলো।
-” প্রণয়ের কথা শুনে পুষ্পর পেট ফেটে হাসি আসছিল,কিন্তু সেটাকে পেটের মধ্যেই দমিয়ে রাখলো অনেক কষ্টে। তারপর পরনের ওড়না টা কোমড়ে গুঁজে একহাত কোমড়ে দিয়ে বললো,
-” হইছে?
-” হোয়াট?”
-” শেষ হইছে হিরোগিরি ভাব?
-” এইটা কোন হিরোগিরি হইলো নাকি।
-” তাই না।
-” হুম।
-” তাইলে আপনি সিংগার আছেন, সেটাই থাকেন। এদেশের হিরোদের ভাত মারার দরকার নাই।
-” তারমানে তুমি ইন্ডাইরেক্টলি বলতে চাইছো, আমি অনেক হ্যান্ডসাম। প্রণয় একটা মুড নিলো এটা বলে। আসলে সবাই বলে,আমার ফিল্মে ট্রাই করা উচিত। আমিই পাত্তা দেই না। কি দরকার বলো ঐ হিরোগুলোর কপাল পোড়ানোর।
-” চাপা মারা শেষ হইছে,না আরো বাকী রইছে।
-” চাপা মারবো কেন। সিরিয়াসলি আমি অফার পাইছি ফিল্মের জন্য।
-” ওকে থামেন। এবার আমি কিছু বলি।
-” নিশ্চয়ই বলুন রানীসাহেবা।
-” আমার জানামতে যতজন সিংগার সিংগিং থেকে হিরো হতে গিয়েছে সবাই ফ্লপ। শুধু ফ্লপ না,একেবারে সুপার ফ্লপ। সেটা বলিউড,ঢালিউড সবজায়গাতে। উদাহরণ দিব,ওকে দেই।
বলিউড থেকেই শুরু করি। হিমেশ রেশমিয়া,ইয়ো ইয়ো হানি সিং এরা সিংগার হিসেবে ফেমাস। বাট যখনি ফিল্মে গেল, সেখানে তেমন সাড়া নেই। আর আমাদের দেশে এসডি রুবেল। শাবনুরের সাথে একটা সিনেমা করেছিল,ব্যাস এতটুকুই। আর করেনি,কারন দর্শক গ্রহণ করেনি নায়ক হিসেবে। সে দেখতে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম,এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যে যেক্ষেত্রে পার্ফেক্ট,থাকে সেটাতেই মানায়। তাই সিংগিং ছেড়ে এরা ফিল্মে গেলেও,কেউই তেমন সুবিধা করতে পারেনি। শেষে আবার সিংগিং প্রফেশনেই ফিরতে হয়েছে। তাই যার যে জায়গায় আধিপত্য, সেখানেই থাকা উচিত। আর নয়তো দেখা যাবে,দুই নৌকায় পা দিতে গিয়ে কোনটাই থাকবে না শেষে। বুঝাতে পারলাম কিছু?
-” পুষ্পর কথা শুনে প্রণয় লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নিলো। তারপর বললো,মনে হচ্ছিল বাংলা বিভাগের মেডামের লেকচার শুনছিলাম এতোক্ষণ ধরে।অবশ্য উডবি লেকচারার বলে কথা।
-” সে যাই বলুন। লেকচার শুনতে তিতা হলেও,উপকারী। আর কিছু মানুষের কাজ হচ্ছে গ্যাস বেলুনের গ্যাসের মতো আমাদের শরীরে কথার গ্যাস ঢুকিয়ে দেয়া। তারপর যখন আপনি উড়ে যাবেন,কেউ ধরতে আসবেনা। আর এটাই চরম সত্য। তাই লোকের কথায় পাত্তা দিলে ঐ বেলুনের মতোই উড়ে যাবেন। এটা বলে পুষ্প চলে গেল।
আর প্রণয় ব্যবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। পুষ্পর কথার মানে বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। এতো কঠিন কঠিন কথা বলে মেয়েটা মাঝে মাঝে , তা প্রণয়ের মাথার কয়েক ফুট উপর দিয়ে যায়। বয়সের তুলনায় অনেক বেশি ভারী ভারী কথা বলে।
প্রণয়ও মাথা চুলকিয়ে চুলকিয়ে বাইরের দিকে গেল। আর ওর হিরো হওয়ার শখ পুষ্প একেবারে ধূলিসাৎ করে দিলো। যদিও কথাগুলো পুষ্পকে এমনি বলেছিল, কিন্তু পুষ্প একেবারে সংজ্ঞা, উদাহরণ সব দিয়ে দিল ওর হিরো হওয়ার ভবিষ্যৎ এর। মেয়েটা এতো সিরিয়াস কেন সবকিছুতে। শুধু আমাকে ভালোবাসার বেলায়ই তার সিরিয়াসনেস লাপাত্তা! এটা বলে প্রণয় একটা দুখী চেহারা করলো,আর বললো সবি কপাল। কি আর করার। কপালে না থাকলে ঘি,ঠকঠকালে হবে কি!”
-” পুষ্প অনেক ভয় নিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প ওর পছন্দমত সব রান্না করলো। তাই উনাদের রিএকশান কি হতে পারে,সেটা ভেবেই পুষ্পর গলা শুকিয়ে আসছে। পুষ্পকেও ওদের সাথে বসতে বললো,তবে পুষ্প বললো পরে খাবে। পাপড়ি আরো জোর করলেন না,চুপচাপ খেতে লাগলেন। খাওয়ার সময় বাড়তি কথা বলা পছন্দ করেন না তিনি।
খাওয়া শেষে প্রণয়ের বাবা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বললেন;
অনেকদিন পর এতো তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। পুষ্পকে বললো,তোমার রান্নার প্রশংসা করতেই হচ্ছে। তোমার একটা গিফট পাওনা রইলো আমার কাছে,এতো ভালো রান্না খাওয়ানোর জন্য। তোমার কোনকিছুর শখ থাকলে আমাকে বলতে পারো,আমি চেষ্টা করবো দেওয়ার।
-” পুষ্প বললো,” আমার জন্য দোয়া করবেন শুধু আংকেল,গিফট দিতে হবে কেন। দোয়ার চেয়ে বড় গিফট কিছু হতেই পারে না।
-” রওনক সাহেব খুব খুশি হলেন পুষ্পর কথা শুনে। মেয়েটাকে যতই দেখছেন , ততই অবাক হচ্ছেন। এতটুকু সময়ের মধ্যেই উনি পুষ্পর মায়ায় পড়ে গেছেন। এতো মিষ্টি একটা মেয়ের সাথেই কেন….. রওনক সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর উনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,কি ব্যাপার তুমি কিছু বলছোনা যে?
-” কি বলবো?
-” রান্না কেমন হলো?
-” হুম ভালোই।
-” শুধু ভালো?
-” তো আর কি বলবো?
-” এই হলো আমাদের বাঙালির সমস্যা বুঝলে,প্রশংসা করতে আমাদের যত কার্পণ্য। সঠিক ক্ষেত্রে প্রশংসা করিনা,তবে অপাত্রে ঠিকই প্রশংসা করি তেল মারার জন্য।
-” পাপড়ি কিছু বললেন না,টেবিল থেকে উঠে চলে গেলেন। পুষ্প বিমর্ষ মুখ করে উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। উনাকে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা পুষ্প,কেমন যেন রহস্যময়ী।
রাত এগারটায় প্রিয়ম চুপিচুপি বাসায় ঢুকলো। যখন ওর রুমে ঢুকতে যাবে,তার আগেই ওর কানে কারো হাতের উপস্থিতির টের পেলো। চোরের মত মুখ করে তাকিয়ে দেখে ওর আম্মু। তারপর ওর মাকে পটানোর জন্য একটা মিষ্টি হাসি দিলো। কিন্তু তাতে কাজ হলো বলে মনে হয় না। ওর হাতে একটা গোলাপ ছিল,সেটা ওর মাকে দিয়ে বললো ফর মাই বিউটিফুল গর্জিয়াস লেডি,মাই ট্যালেন্টেড মাদার।
-” পাপড়ি প্রিয়মের কানটা আরেকটু জোরে চেপে বললেন,মেয়েদের এভাবেই পটানো হয় তাই না। ভুলে যাস না,তুই আমার পেট থেকে হইছোস। তাই তোর নাড়ী-নক্ষত্র সব আমার মুখস্থ। আমি অন্তত ঐ গাঁধী মেয়েদের মত না যে কোনটা মুখের কথা আর কোনটা মনের সেটার পার্থক্য বুঝতে পারবনা। কথার ধরন দেখেই বলে দিতে পারি,সেটার উৎস কোথায়, মনে নাকি মাথায়।
-” প্রিয়ম বললো,এজন্যই তো তোমাকে ট্যালেন্টেড বলি। আর আমার এমন ট্যালেন্টেড মেয়েকেই পছন্দ,এগুলো তো জাস্ট টাইমপাস।
-” টাইমপাস করতে গিয়ে বিপদে না পড়লেই হলো আব্বাজান।
-” আরে না আম্মাজান,আমি আপনার পোলা। বিপদে না পড়ার সব টেকনিক জানা আছে।
-” যখন পরবা তখন বুঝবা। তাই এসব বাদ দাও। ভাবছি এবার দুই ভাইকেই একসাথে বিয়ে করিয়ে ফেলবো। যতখুশি বউয়ের সাথে প্রেম করো।
-” বিয়ের কথা শুনে প্রিয়ম যেন লাফ মেরে উঠলো। তারপর বললো,আমার বিয়ে কি বলো আম্মাজান। আমিতো এখনো ছোট বাচ্চা,ব্রোর বয়স চলে যাচ্ছে ওকে বিয়ে দাও তাড়াতাড়ি। আমি এতো সহজে এতো তাড়াতাড়ি বউয়ের টর্চার সহ্য করতে পারবনা। কোন ডাইনি আসবে কে জানে। আমার মত অবুঝ,অসহায় বাচ্চাটাকে আঙুলের ডগায় তুলে নাচাবে। এটা ভেবেই প্রিয়মের গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। পাপড়ি প্রিয়মের নাক ধরে টেনে বললেন,এতো দুষ্টু কোথা থেকে হয়েছিস হুম।
-” প্রিয়ম ওর মায়ের পেটের দিকে ইশারা করে বললো,এইখান থেকে। যেখানে দশমাস শান্তিতে ছিলাম,এখন তো মেয়েদের জ্বালায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। পাপড়ি এবার জোরে হেসে দিলেন। প্রিয়মও হাসলো।
দূর থেকে আরো কেউ হাসলো মা ছেলের কথা শুনে।
প্রিয়মের বাবা মা আসার প্রায় সপ্তাহখানেক কেটে গেল। কিন্তু এ কয়দিনেও পাপড়িকে বুঝে উঠতে পারছেনা পুষ্প। পুষ্প ভাবলো প্রণয়ের সাথে একটু আলাদা কথা বলা দরকার,না হয় ও কিছু বুঝতে পারছেনা। প্রণয়কে রাতে ছাদে দেখা করতে বললো। প্রণয় যথারীতি রাতে ছাদে উপস্থিত হলো। কিন্তু পুষ্প কিছু বলার আগেই পাপড়ি সেখানে এসে উপস্থিত। পুষ্প একদম থতমত খেয়ে গেল উনাকে দেখে। ওড়নার আচলে আঙুল পেঁচাতে লাগলো। ওর বুক ঢিপঢিপ করছে,নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে চলেছে সমানতালে। আর ঠিক তখনি পাপড়ি প্রণয়কে এখান থেকে চলে যেতে বলেন। উনি পুষ্পর সাথে একা কথা বলবেন। এটা শুনে পুষ্প করুণ চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে,কিন্তু প্রণয় ওর দিকে না তাকিয়েই নিচে চলে গেল। টেনশন আর ভয়ে পুষ্পর হাত পা অবশ হয়ে আসছে।
#চলবে….