বাসন্তী
পর্ব-২৬
লিমু
-” আরে…আরে….যাচ্ছেন টা কোথায় শুনি?”
-” এটা বলেই প্রিয়মের হুডির মাথার অংশটুকু ধরে টানতে লাগলো কলি। কিন্তুু সে কি আর প্রিয়মের গায়ের জোরের সাথে পারে।
তবুও নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখলো,আর প্রিয়ম সামনের দিকে যেতে চাইছে। কলির কাজ কারবার বরাবরই প্রিয়মের কাছে উদ্ভট, আশ্চর্যজনক। অনেক্ষন টম এন্ড জেরির মতো টানাটানি করার পর প্রিয়ম সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কলির দিকে তাকালো, কিন্তুু কলি যেন সেটাকে পাত্তাই দিল না।
প্রিয়ম রাগী কন্ঠে বললো,” এই ক্রেজি গার্ল তোমার প্রবলেম টা কি হু?”
-” আপনি!”
-” হোয়াট!”
-” মানে এইমুহুর্তে আপনিই আমার প্রবলেম।”
-” প্রিয়মের মনে হয় চূড়ান্ত রাগ উঠে গেল,তাই সে আবার সামনে চলে যেতে নিল। কিন্তুু প্রিয়ম সামনে পা বাড়ানোর আগেই, আচমকা কলি প্রিয়মের সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালো। প্রিয়ম কলির সাথে প্রায় ধাক্কা লাগতে গিয়ে সরে দাঁড়ালো। আর কলি দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করে প্রিয়মের রাস্তা আটকে দাঁড়ালো। প্রিয়ম ডানে বামে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে,কলিও ঐদিকেই গিয়ে রাস্তা আটকাচ্ছে।
কলির এমন কান্ড দেখে প্রিয়ম ওর দু’হাত হুডির পকেটে গুঁজে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। আর পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলো কলিকে,কেন এমন করছে। কিন্তুু কিছুই বুঝতে পারলনা। তাই আবার কলির দিকে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাস করলো,কি সমস্যা?”
-” কলি আবার বললো,বললামি তো একবার আপনিই সমস্যা।
-” প্রিয়ম এবার রাগে কলিকে ধমক মারলো আর ওকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে গেল। হঠাৎ চলে যাওয়াতে কলি আর থামাতে পারলনা,অগত্যা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
কয়েক সেকেন্ড পরেই প্রিয়ম আবার ফিরে আসলো কলির কাছে। দেখে কলি মুখ ভার করে দাঁড়িয়েই আছে সেখানে।
প্রিয়ম কলির সামনে গিয়ে বললো,”সরি।”
-” কলির যেন মনে হচ্ছে, ও ভূতের মুখে রাম নাম শুনে ফেলেছে। ও চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকালো।
-” প্রিয়ম স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বললো,” এরকম আপনি সমস্যা,আপনি সমস্যা না করে আসল সমস্যাটা বললেই পারতে,পাগলী লাড়কী!”
-” কলির আবার রাগ উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ও তো বলতে চাইছিলোই,কিন্তু এই ব্যাটার শোনার মত সময় কই?
তবুও কলি অনেক কষ্টে রাগ সংবরণ করে বললো,” আপনি কি আমাকে বলার মতো সময় দিয়েছিলেন?” মহিষের মতো আমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলেন। বনমহিষ কোথাকার!”
-” তো তুমি সরাসরি বললেই পারতে যে ওরা দুজন বাইরে একসাথে আছে,তাহলেই তো আমি যেতে চাইতাম না ব্যাস। এতো কথা প্যাচানোর কি আছে জিলাপির মতো। নিজে ঠিক করে কথা বলতে জানোনা,আর দোষ আমার। গুছিয়ে কথা বলতে শিখো আগে ওকে। আর কিইবা বলবে,বয়সই আর কতো। ষোড়শী ক্রেজি বালিকার থেকে এরচেয়ে বেশি কি এক্সপেক্ট করা যায়,এটা বলে প্রিয়ম একটা বিদ্রুপ হাসি হাসলো। যেটা দেখে কলির গা জ্বালা করে উঠলো।
-” আর কিছু বলতে না পেরে কলি প্রিয়মের পায়ে হিল দিয়ে একটা লাথি বসিয়ে,মুখ ভেংচি কেটে রুমে চলে গেল। আর প্রিয়ম ব্যাথায় কোঁকাতে লাগলো,কি ডাইনি মেয়েরে বাবা!”
প্রিয়ম বসে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগলো,যত এই ডাইনীর কাছ থেকে সেইফ থাকতে চাই,ততই আরো সামনে এসে যায়।
পা টা বোধহয় ছিদ্র করে দিল আমার!”
★
-” পুষ্প?”
-” হুম বলুন।”
-” আবার আপনি! তুমি করে বলো না হলে এই পাহাড় থেকে ঐ খাদে লাফ দিবো।”
-” সত্যি? পুষ্প স্বাভাবিক ভাবেই বললো কথাটা। যেটা দেখে প্রণয় মুখটা হতাশার মতো করলো। ও পাহাড় থেকে লাফ দিতে চাইছে,আর এ মেয়ের এক্সপ্রেশান দেখে মনে হচ্ছে সেটা মজাদার কিছু। হায় কপাল!”
পুষ্প আবার বললো,কি হলো আপনি লাফ
দিচ্ছেন না কেন? আমি কি ধাক্কা দিয়ে হেল্প করবো? ”
-” তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?
-” নাহ।”
-” মানে?”
-” মানে হলো মিথ্যাই ভালোবাসি, সত্যি না।
-” সেটাই মনে হচ্ছে। প্রণয় গালফুলিয়ে বসে রইলো। প্রণয়ের গাল ফুলানো দেখে পুষ্পর সেই লাগছে। প্রণয়কে আরো জ্বালানোর জন্য পুষ্প বললো,
-” এই যে শুনছেন?” গালে কি চাল ভিজিয়ে রেখেছেন,এমন ফুলে রয়েছে কেন!”
-” প্রণয় নিশ্চুপ।”
-” প্রণয়কে চুপ থাকতে দেখে পুষ্প ওর আঙ্গুল দিয়ে প্রণয়ের গালে খুঁচা দিল। হঠাৎ পুষ্পর এমন দুষ্টুমিতে প্রণয় হেসে দিল। মেয়েটার পেটে পেটে অনেক দুষ্টুবুদ্ধি,কিন্তু সেটা বাইরে থেকে বুঝা যায় না। প্রণয়ের গালে খুঁচা দিয়ে পুষ্পও হাসছিল মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে। প্রণয় সেই মুক্তঝরানো হাসি অবলোকন করছিলো। হাসলে মেয়েটাকে একদম প্রাণবন্ত লাগে। আর সেই মেয়েটা এতটা দিন কি একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে।সেটা ভাবলেই গা গুলিয়ে আসে। আর প্রণয় সেটা ভাবতেও চায় না। আর পুষ্পও যেন সেই বিভীষিকা মন থেকে একদম মুছে ফেলতে পারে তার সর্বোচ্চ চেষ্টায় থাকবে প্রণয়। প্রণয় মনে মনে বললো,তোমার ঐ হাসিটাই আমি দেখতে চায়। এই মায়াময় চেহারায়, স্নিগ্ধ হাসিটাই মানায়। আর মাঝে মাঝে তোমার ঐ রণচন্ডী রুপটা দেখতেও আমার বেশ লাগে। ঐ রুপেই যে আমার হৃদয় স্পন্দন থেমে গিয়েছিল। তারপর…..তারপর তোমার রণমায়ায় ফেঁসে গেলাম। উহু…তুমি ফাঁসাও নি, আমিই ফেঁসে গেছি। আর তুমি আমার ভালোবাসায় ফেঁসেছো,আর যে মুক্তি নেই।
ভালোবাসার মায়াজালে বাঁধা পড়েছে যে
হৃদয়,কি করে আর তা থেকে পালাবে। শূণ্য হৃদয়ে ভালোবাসার বসন্ত এনে দিয়েছো,ছেড়ে গেলে যে শীতের পত্রপুষ্পর ন্যায় রিক্ত হয়ে যাবো। তুমি যে আমার হৃদবাসন্তী, হৃদয়েরও কুঠিরে। তোমাকে হারালে যে এই হৃদয় চির রিক্ত হয়ে যাবে ঐ শীতের মলিন পত্রপল্লবের মতো।
তুমিই যে আমার মনবসন্ত, আমার বাসন্তী।
-” পুষ্প অনেক্ষন ধরে প্রণয়ের চোখের সামনে হাত নাড়াচ্ছে,কিন্তুু প্রণয় তো ধ্যানে মগ্ন। পুষ্পধ্যানে মগ্ন।
অতঃপর পুষ্প আবার বললো ,
-” আরে আপনি কি সাধুবাবা হয়ে গেলেন নাকি। কি তখন থেকে ধ্যানে পড়ছেন। পুষ্পর কথা শুনে প্রণয় শব্দ করে হেসে দিল। তারপর স্থির দৃষ্টি নিয়ে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে রইলো। যেটা দেখে পুষ্প এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। প্রণয় মুখে মুচকি হাসি রেখে পুষ্পকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলো। তারপর শান্ত স্বরে বললো,
-” পুষ্প কিছু কথা বলার ছিল, বলবো?
-” হঠাৎ প্রণয়ের ঠান্ডা স্বরটা শুনে পুষ্প একটু চমকে গেল। কি বলতে চাইছে উনি। পুষ্পর মন অজানা ভয়ে কুঁকড়ে গেল।
প্রণয় দেখলো পুষ্প হঠাৎ করেই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে, আর আনইজি ফিল করছে। সেটা দেখে প্রণয় বললো,
-” পুষ্প তুমি কি আমাকে বেশি ভালোবাস, নাকি বেশি বিশ্বাস করো?
-” পুষ্প যেন একটু অবাক হলো এমন প্রশ্ন শুনে। তাও স্বাভাবিক থেকে বললো, এটা কেমন প্রশ্ন? একটা সম্পর্কের জন্য তো দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
-” হ্যা আমি জানি সেটা। তবুও বলো।
-” তাহলে বলবো যতটুকু ভালোবাসি, ততটুকুই বিশ্বাস করি।
-” ভেবে বলছো তো?
-” হ্যা।”
-” ওকে। তবে তুমি কি জানো একটা সম্পর্কে ভালোবাসার চেয়েও বিশ্বাস বেশি থাকাটা জরুরি। কারন ভালোবাসা কম হলেও একটা সম্পর্ক ঠিক রাখা যায়। কিন্তুু বিশ্বাস কম হলে সে সম্পর্ক টিকিয়া রাখা কঠিন, অনেক কঠিন। ভালোবাসা এখন কম হলেও,পরে বাড়তেও পারে। কিন্তুু বিশ্বাস কম হলে তো,সে সম্পর্কটা সামনে এগুবেই না। ঠিক থাকা তো পরের ব্যাপার। আজকাল বেশিরভাগ সম্পর্ক ভাঙার একমাত্র কারন এই বিশ্বাসের অভাব। তাদের মধ্যে ভালোবাসা আছে কিন্তুু বিশ্বাস নেই। অল্পতেই দুজন দুজনকে সন্দেহ করে। হ্যা সম্পর্কে সন্দেহ থাকবে, তবে সেটা লিমিটের মধ্যে। জানো তো বাড়াবাড়ি কোনকিছুই ভালো না।
তাই আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসার চাইতেও বেশি বিশ্বাস করো। কারন ভালোবাসা কম হলেও একছাদের নিচে থাকা যায়,কিন্তুু বিশ্বাস না থাকলে কখনোই থাকা যায় না। আর আমি তোমার বিশ্বাস অর্জনের সর্বোচ্চ চেষ্টায় থাকবো। একজন মানুষকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে পাশে নিয়ে চলার মধ্যেই জীবনের পূর্ণতা। আফসোস সবাই সেটা বুঝেনা।
-” পুষ্প মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় প্রণয়ের কথা শুনছিল। ও শুধু শুধু নার্ভাস হচ্ছিল এটা ভেবে যে প্রণয় কি না কি বলে। কিন্তুু এখন প্রণয়ের কথা শুনে ওর চোখ জলে টলমল করছে। পুষ্প প্রণয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই দিলো এবার। যেটা দেখে প্রণয় বোকা বনে গেল। কান্না করার মতো কোন কথা তো ও বলেনি,তাহলে?
-” কাঁদছো কেন আবার? ”
-” ভালোবাসায়।
-” ভালোবাসায় আবার কিভাবে কাঁদে শুনি?”
-” তুমি বুঝবেনা।
-” হু আমিতো বেকবেঞ্চার তাই বুঝবোনা।
-” প্রণয়ের কথা বলার ভঙ্গীটা দেখে পুষ্প কান্নার মাঝেই হেসে দিল। তারপর বললো,
-” শুনুন আমার বিশ্বাস,ভালোবাসা দুটোই সমান থাকবে। আর সেটা সবসময়ই থাকবে ধ্রুবকের ন্যায়।
-” আরেকটা ধ্রুবক লাগবে আমার।
-” পুষ্প ভ্রু কুচকে বললো,” কি?”
-” তুমি আমাকে তুমি করে বলবে, আপনি করে বলবেনা। এটাকেও তুমি তোমার ধ্রুবকের মধ্যে নেও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ…..
আপনি বললে আমার নিজেকে বুইড়া ব্যাটা মনে হয়।
পুষ্প এবার জোরে হেসে দিল। তারপর প্রণয়কে বললো,” ওগো আমার বুইড়া ব্যাটা শুনেন, আমি আপনাকে আপনি, তুমি সব ডাকবো। যখন যেটা মনচায়।
-” প্রণয় এবার চূড়ান্ত হতাশ হলো। তবে হাল ছাড়লে চলবেনা। এটাকে ধ্রুবকে পরিণত করতেই হবে। আপনি ডাকটা শুনলেই প্রণয়ের চোখে ভাসে একটা অষ্টাদশী মেয়ে তার ছত্রিশ বছরের স্বামীকে ডাকছে। এটা ভেবেই প্রণয়ের গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। আর বললো,পুষ্পর থেকে আমি মাত্র আটবছরের বড়,এতোটুকু ডিফারেন্স হতেই পারে। এটা বলে পুষ্পর দিকে তাকালো। পুষ্প তখনো মিটিমিটি হাসছে। আর ভোরের রোদের মিষ্টি আভা ওর সেই হাসিটাকে আরো মোহময় করে তুলেছে।
আজকের এ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দুটো মানুষ এক হওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হলো। সবকিছু ঠিক থাকলেই হলো এখন।
নতুন কোন ঝড় যেন আর না আসে ওদের জীবনে।
★
-” অনেক্ষন যাবত এয়ারপোর্টে বসে আছে পুষ্প। এই শীতের মধ্যেও টেনশনে ওর শরীর তরতর করে ঘামছে। এক অজানা ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে আসছে। ওর হাত পা কাঁপছে অনবরত।
#চলবে…..