বাসন্তী
পর্ব-২১
লিমু

_____ ” তোমাকে দেখে মনেই হচ্ছে না,এই পুঁচকে মেয়েটাই আমার সাথে এভাবে ঝগড়া করেছিল। তুমিই সেই কথার ফুলঝুরি ছড়ানো মেয়ে,সেটা মানতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

_ ” কলি তেমন কিছুই বললোনা। মনে হচ্ছে ও এখানে আছে,তবু যেন নেই। উদাস হয়ে কি ভাবছে কে জানে।

_ ” হুট করে মনে হলো প্রিয়মের বোধহয় এ কথাগুলো বলা ঠিক হয় নি এখন। কারন কথাগুলো শুনে কলির মুখটা কেমন বিষাদে ছেয়ে গেছে আরও। মনে হচ্ছে আর বেশি কিছু বললে নিশ্চিত কেঁদে দিবে। তাই প্রিয়ম প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো। ঠিক তখনি কলি বলে উঠলো,সময়,অবস্থান, পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানুষকে পাল্টে দেয়,এবং এটাই সত্য। হ্যা হয়তো তখন আপনার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল,তার জন্য সরি।

_ ” এবার প্রিয়ম চূড়ান্ত হতাশ হলো। সে সরি বলানোর জন্য কলিকে কথাগুলো বলেনি। মেয়েটা শুধু শুধু ভুল ভাবছে।
তাই বললো,” আরে ক্রেজি গার্ল আমি কি তোমাকে সরি বলতে বলেছি? ঐদিনের ঘটনাটা জাস্ট একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং,দ্যাটস ইট। তারজন্য সরি বলতে হবে নাকি,তাও আবার এখন এ সিচুয়েশনে। আমি ঐসব মনে রাখিনি,তাই তুমিও ভুলে যাও। কি হবে খারাপ সময়গুলোর কথা ভেবে ভেবে,হো নোজ,কাল হো না হো!”

_ ” কলি তবুও কিছুই বললোনা,উদাস হয়ে গাড়ির বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তাই প্রিয়ম ও আর কথা বললোনা। একবোনের একসিডেন্টে দুই বোনই একদম চুপ হয়ে গেছে। কতটা ভালোবাসে একজন আরেকজনকে বুঝাই যায়। সত্যিই খুব কষ্ট লাগছে এদের দু’বোনকে এভাবে দেখে।
হঠাৎ প্রিয়ম গাড়ি থামালো। কলি অন্যমনস্ক ছিল,তাই একটু আঁতকে উঠলো।

_ ” কি হলো গাড়ি থামালেন কেন?”

_ ” ওয়েট… আমি আসছি। এটা বলে গাড়ির দরজা লাগিয়ে প্রিয়ম কোথায় যেন গেল,কলি ঠিক বুঝতে পারলনা। আর ওর এতো মাথা ব্যাথাও নেই এটা নিয়ে।
কিছুক্ষণ পর প্রিয়ম দুটো কোণ আইসক্রিম নিয়ে এলো। বাইরে ভ্যাপসা গরম তাই। গাড়িটা সাইডেই রেখে গিয়েছিল,তাই গাড়িতে বসেই খেতে শুরু করলো। কলি একদম খেতে চাইছিলো না,যদিও কোণ তার ফেবারিট।

_ ” কিন্তুু প্রিয়মের জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে খেতে হলো।
হঠাৎ প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে কলি একটু মুচকি হাসলো। যেটা দেখে প্রিয়মের মনে প্রশ্ন জাগলো। তাই কলির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাস করলো কি হয়েছে?”

_ ” কলি কিছু না বলে প্রিয়মকে গাড়ির সামনের লুকিং গ্লাসে তাকাতে বললো ইশারায়। প্রিয়ম তাকিয়ে দেখে ওর নাকের ডগায় আইসক্রিম লেগে আছে। আর এটাই কলির মৃদু হাসির কারন।প্রিয়ম নিজেও জানেনা,কোণ আইসক্রিম খেতে গেলেই কিভাবে কিভাবে যেন ওর নাকে লেগে যায়। যাক ওর এ কাজটার জন্য কলি একটু হেসেছে তো অনেকদিন পর। এ কয়দিনে একমুহুর্তের জন্যও মেয়েটার মুখে হাসি দেখে নি প্রিয়ম।
এতটুকু একটা মেয়ে,তবুও কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে সবসময়। দেখলে মনেই হয় না,এই মেয়েটাই এভাবে তার সাথে তর্কযুদ্ধ করেছিল।
অবশ্য সিচুয়েশনেই এমন এখন,কি আর করার। এটা বলে প্রিয়ম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কলির দিকে তাকিয়ে। মেয়েটা একদম চুপসে গেছে।

_ ” প্রণয় চলে যাওয়ার পর পুষ্প আরো অনেক্ষন নিঃশব্দে কাঁদলো। ও জানেনা ও কেন কাঁদছে। ও এখন কি করবে তাও জানেনা। শুধু দু’চোখ ভেঙ্গে কান্না আসছে। যেন কান্নাই ওর একমাত্র সম্বল।
কখনো কখনো আমরা এতোটা অসহায় হয়ে পড়ি,যে নিজের করার মতো কিছুই থাকে না।

_ ” কিন্তুু পুষ্প কে যে স্বাভাবিক হতেই হবে। নিজের জন্য না হলেও ওর পরিবারের জন্য। নিজেকে নিয়ে পুষ্প আর কোন স্বপ্ন দেখবে না। যেটুকু স্বপ্ন বুনেছিল মনে,তা মনেই দাফন করে দিবে। কিছু কিছু মানুষের স্বপ্ন দেখতে হয় না। এই পৃথিবীতে কত মানুষই প্রতিনিয়ত নিজেদের স্বপ্নের দাফন করে চলেছে,হয়তো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। হয়তো প্রয়োজনে, হয়তো অপ্রয়োজনে। কেউ তার খবর রাখে না।
জীবনের ছুটে চলার পথে, সবাই যার যার মত ছুটে চলছে। কারো জন্য কেউ থেমে থাকেনি, কোনদিন থাকবেও না। এটাই পৃথিবীর নির্মম সত্য গুলোর অন্যতম।
তাই পুষ্পর জন্যও কারো জীবন থেমে থাকবে না,কারো না।

_ ” পুষ্পর জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো এতোদিনে কোন বাজে স্টেপ নিতো। কিন্তুু পুষ্প নিবে না। কেন আত্নহত্যা করে সে নিজেকে মহাপাপীতে পরিণত করবে? একদম করবেনা সে। এই পৃথিবীর সাথে অভিমান করে চলে যাওয়ার কোন মানে হয় না। বড়জোড় পত্রিকার পাতায় একটা ছোট্র হেডলাইন হবে, মৃত্যুর পরদিন,এর বেশি কিছু না। কিন্তুু পুষ্প হেরে যাওয়ার মেয়ে নয়। যে পাপ করে,সে পৃথিবীতে আরো আনন্দ করে বেড়ায়। আর যে পাপের স্বীকার হয়,সে ঘৃণায়, লজ্জায় মরে। অবশ্য দোষ আমাদের সমাজ ব্যবস্থার। এখানে একটা নারীর মৃত্যু, তাদের কাছে কোন বিষয়ই না। নারী যে তাদের কাছে তুচ্ছ।
অথচ ঐ নারীর গর্ভেই তাদের জন্ম।

_ ” তাই পুষ্প সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাবে। অন্যের ওপর বোঝা হয়ে থাকতে চায় না সে। হ্যা পুষ্প বেশ বুঝতে পারছে,ওরা এখন প্রণয়ের বাসায় আছে। এতোদিন বুঝতে পারে নি,কারন প্রণয় ওর সামনে আসতো না। কিন্তুু আজকে সবটা ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল স্বচ্ছ জলের মতন।

_ ” প্রণয় বেশ বুঝতে পেরেছিল,পুষ্প বুঝতে পারলে হয়তো এখানে আসবেনা। তাই নিজেকে আড়াল করে রাখতো সবসময়। কিন্তুু প্রণয় হয়তো বুঝতে পারে নি যে,পুষ্প আজকে ওকে দেখে ফেলেছে তখন।
_ ” প্রণয়ের প্রতি পুষ্পর কোন অভিযোগ নেই,কোন অভিমান নেই। প্রণয় ছেলেটাই এমন। যে কেউ ওকে ভালোবাসতে বাধ্য।পুষ্প চাইলেও ওর ওপর অভিমান করতে পারবেনা,ঠিক ততটাই ভালোবেসে ফেলেছে পুষ্প প্রণয়কে। তাইতো সেই ভালোবাসা সযতনে বুকে পুষেই বাকীটা জীবন না হয় কাটিয়ে দিবে। কিন্তুু ওর জন্য প্রণয়ের ক্যারিয়ার,প্যাশন সেটাতে কোন আঁচ পড়তে দিবে না পুষ্প। জরুরি নয়,যাকে ভালোবাসি তার সাথেই জীবন কাটাতে হবে।

_ ” কখনোও কখনোও অপর পাশের ব্যাক্তিটার ভালোর কথা ভেবেই,নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে হয়। আর পুষ্প সেটাই করবে।
দূর থেকেও তো ভালোবাসা যায়। কিন্তুু একটাই আফসোস পুষ্পর,প্রণয় কোনদিন জানতেও পারবেনা,তার বাসন্তী থাকে ঠিক কতটা ভালোবেসেছিল। ঠিক কতটা চাইতে শুরু করেছিল এই অল্প কদিনে। পুষ্প নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল,নিজের পরিবর্তন দেখে। ওর মতো মেয়েও, প্রেমে পড়ে এভাবে বদলে যেতে পারে অবিশ্বাস্য। ও না চাইতেও মনের অন্তরালেই, প্রণয়কে ওর মনে ঠাঁই দিয়ে দিয়েছিল। হয়তো ও নিজেও বুঝতেই পারে নি। ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়। খুব গোপনে হৃদয়টা চুরি হয়ে যায়। আর যে চুরি করে,তার কথাই সারাক্ষণ মনে পড়ে। আচ্ছা এটাই কি ভালোবাসা? আমার হৃদয় তার কাছে,তার হৃদয় আমার কাছে। আর এজন্যই দুজন দুজনের কথা ভেবে ভেবে প্রেমে বিভোর হয়ে যায়। এটাই ভালোবাসা না! ”
পুষ্পর হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো,কিন্তুু কান্নাটা গলায় এসে আঁটকে যাচ্ছে। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন বুকে!”

_ ” রাতের বেলায় গিটার হাতে নিয়ে ছাদে বসেছিল প্রণয়। গত একমাস কোন কনসার্টে যাই নি ও। ওর দলের বাকী সদস্যরা খুব ক্ষেপে আছে ওর প্রতি। কিন্তুু প্রণয়ের যেন সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যখন খুব বেশি কষ্ট লাগে, তখন এভাবে একা একা ছাদে বসে টুংটাং গিটারে আওয়াজ তুলে। কিন্তুু কোন গান আসে না মনে,শুধু গিটার বাজিয়ে যায় একনাগাড়ে।
_ ” ওর মনের সব সুর যে স্তব্দ হয়ে গেছে,তার মায়াচন্ডীর স্তব্দতার সাথে। হৃদয় যে কথা হারিয়েছে,তার বাসন্তীর নিরবতায়।

_ ” হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলে। প্রণয় মনে মনে বললো,হে প্রকৃতি তোমার ঝড় তো সবাই দেখতে পায়। কিন্তুু আমার মনের ভিতর যে ঝড় বইছে গত একমাস ধরে, সে ঝড় যে কাউকে দেখাতে পারছিনা। প্রতিনিয়ত ধুঁকে মরছি আমি, এক অজানা ভয় সারাক্ষণ আমাকে গ্রাস করে রাখছে। চোখ বুজলেই মনে হয়,এই বুঝি আমি আমার মায়াচন্ডীকে হারিয়ে ফেলবো। যাকে হৃদয়ের সবটা দিয়ে ভালোবাসলাম,তাকে হারানোর ভয়, সে যে কি তীব্র ব্যাথা কেউ জানেনা।
ধীরে ধীরে বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। ঝড়বৃষ্টি হতে পারে মনে হচ্ছে।
প্রণয় গিটারটা হাতে নিল আবার মাটি থেকে,একটু আগে নিচে ফেলে দিয়েছিল। এখন আবার তুলে কয়েকটা লাইন গাইতে শুরু করলো,

সে আমার প্রথম প্রেম
প্রথম ভালোবাসা,
মায়াবী ঐ চোখে,
খুঁজে পেয়েছি আমি ভাষা।
সে যে আমার বাসন্তী,
আমার ভালোবাসা,
তার চোখে হারায় আমি,
শতবার আমার দিশা।
ও ও ও,সে যে আমার প্রথম ভালোবাসা…..

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে,কিন্তুু প্রণয়ের সেদিকে হুঁশ নেই। পাগলের মতো গিটার বাজাচ্ছে, আর গান গেয়ে যাচ্ছে।
যেন বৃষ্টির জলের সাথে সে তার ক্ষোভ, অভিমান সব ভাসিয়ে দিচ্ছে।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here