প্রহর শেষে

পর্ব:- ১৯
কথা গুলো বলার পর ওয়াসিয়াত আর সেখানে রইল না।নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। জোহরা খানম সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন।গুনগুনের কান্নার শব্দ কানে আসতে লাগলো। সেই সঙ্গে সম্মিলিত আর্তচিৎকারের তীক্ষ্ণতা তাকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দিতে লাগলো।

সেদিন আর গুনগুনকে বাইরে বেরোতে দেখা গেল না। রাতের খাবার প্রিয়া তার ঘরে রেখে এল।
সে রাতে জোহরা খানমেরও ঘুম ভালো হল না, সারারাত তিনি কেবল ছটফট করলেন।

ভোরের ট্রেনেই ওয়াসিয়াত ঢাকা চলে গেছে।
আহসানউল্লাহ সাহেব সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন।ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাকাচ্ছেন দেয়ালে টানানো কাঠের তৈরি বড় ঘড়িটার দিকে ।এখন বাজে দশটা ত্রিশ ।ঠিক দশটায় তার দোকানের উদ্দেশ্যে বেরোনোর কথা থাকলেও আজকাল প্রায় প্রতিদিনই তিনি দেরি করে যাচ্ছেন।

নতুনবাজারের ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান গুলোর মধ্যে তার দোকান টিই সবচেয়ে বড়,বেঁচা-বিক্রিও হয় বেশি।ব্যাবসা হিসেবে যদিও এটি খুবই লাভজনক তবুও আজকাল তিনি উৎসাহ পাচ্ছেন না।
ইরশাদ ব্যাবসা সামলানোর ব্যাপারে খুবই দক্ষ ছিল। যেদিন থেকে সে ব্যাবসায় হাত দিল সেদিন থেকেই ক্রমশ ব্যাবসার উন্নতি হতে লাগলো। আশেপাশের দোকানীরা রীতিমতো হিংসে করতে শুরু করল। বলতে লাগলো, ‘ মিয়া পাইছেন একটা পোলা, আপনের এই এক পোলা ব্যাবসা দাঁড় করায়া দিছে,সে আসনের পর থাইকা আপনের বেঁচা-বিক্রি খালি বাড়তেই আছে। ‘

এখন ইরশাদ নেই। কর্মচারীরা স্বতন্ত্র ভাবে চলছে। আচরণ দেখে মনে হয় যেন তারাই আজকাল মালিক বনে গেছে। ম্যানেজার আরও দু কাঠি ওপরে।আহসানউল্লাহ সাহেব পড়েছেন মহা মুসিবতে!এভাবে ব্যাবসা ধরে রাখা যায় না, আবার ডুবতে দিতেও তিনি পাড়ছেন না।এই দোকান টি তিনি একটু একটু করে তিলে তিলে গড়ে তুলে আজ এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। এখন আর যাই হোক চোখের সামনে ব্যাবসাটা এভাবে ডুবতে দিতে তিনি পাড়েন না।
শাহাদাত কাছে আছে ঠিক, তবে এসব ব্যাবসার-টেবসার ব্যাপারে সে বড়ই আনকোরা!তাছাড়া কোর্ট কাচারি নিয়েই সে পরে থাকে সারাদিন।
এদিক থেকে ওয়াসিয়াতের মধ্যে ব্যাবসার যথাযথ জ্ঞান থাকলেও তার ব্যাপারে তিনি হাত ধুয়ে ফেলেছেন। এই ছেলে ছোট থেকেই ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী।সে নিজে যা করবে তাই ঠিক।অন্যের মতামতের গুরুত্ব তার কাছে নেই।কি এক চাকরি পেয়েছে, সেই চাকরির জন্য এখন বাবা-মা, পরিবারকেই ভুলতে বসেছে।ওয়াসিয়াতের চাকরির প্রসঙ্গ মনে আসতেই আহসানউল্লাহ সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি খসখস শব্দ তুলে পত্রিকার পাতা ওল্টাতে লাগলেন,ওয়াসিয়াতের চাকরির ব্যাপার টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন।
গুনগুনের ঘরের ওদিক থেকে মিহি কলরব ভেসে আসছে। আহসানউল্লাহ সাহেব উঠে পড়লেন, সেদিকে এগিয়ে গেলেন।দোকানে না যাওয়ার জন্য একটা অজুহাত দরকার। সেটা পাওয়া গেল ভেবেই মনে মনে আহসানউল্লাহ সাহেব একটু খুশি হলেন।

জোহরা খানম বেদনাতুর দৃষ্টিতে গুনগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইরিনা ইরিজা কে কোলে নিয়ে গুনগুন দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে কিছুটা দূরে নিজের ঘরের সামনে।ভাঙা ভাঙা স্বরে জোহরা খানম ফের বললেন, ‘গুনি তুই কি সত্যি চলে যাচ্ছিস ? ‘

-‘হ্যাঁ বড়মা। তাতে সমস্যা তো কিছু দেখছি না, এবাড়ি-ওবাড়ি।তোমার যখন মন চাইবে তুমি ওদের দেখে আসবে, ব্যস হয়ে গেল।

জোহরা খানম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। মিনিট পাঁচেক আগেও তার মন খুশিতে ভরপুর ছিল।নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি খিচুড়ি রান্না করিয়েছেন বাচ্চাদের জন্য।সেই খিচুড়ির বাটি এখনো তার হাতে। আর গুনগুন এসব কি কথা বলছে!
সে নাকি ওবাড়ি চলে যাবে। এখন থেকে ওবাড়িতেই থাকবে। বাচ্চা দুটো কে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে একেবারে তৈরি!

আহসানউল্লাহ সাহেব এসে বললেন
-‘কি হয়েছে?
গুনগুন, তুমি ওদের নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন মামণি?
তোমার কষ্ট হচ্ছে, আমার কাছে দাও।’

-‘আপনি নিতে পারবেন না বাবা।আপনার হাতের ব্যাথা বাড়বে। আমিই নিচ্ছি।আসছি বাবা,আসসালামু আলাইকুম। ‘

আহসানউল্লাহ সাহেব চমকে তাকালেন -‘একি!তুমি কোথায় যাচ্ছো ? ‘

গুনগুন নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিলো, ‘ওবাড়ি যাচ্ছি বাবা।অনেকদিন তো এখানে থাকলাম।তাছাড়া মায়ের শরীর ভালো নেই। একা একা থাকেন,কখন কি হয়…….।’

-‘আহসানউল্লাহ সাহেব নিজের অস্থিরতা আড়াল রেখে শান্ত ভাবে বললেন, ‘এত ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে দৌড়াদৌড়ি করা তো ঠিক না গুনি।তুমি বরং এখানে থাকো।আমি তোমার মা কে আনানোর ব্যবস্থা করছি। ‘

-‘তার দরকার হবে না বাবা।আমিই যাচ্ছি।’

গুনগুন কে এত দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলতে দেখে আহসানউল্লাহ সাহেব অবাক হলেন। সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝলেন যে নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা হয়েছে।তিনি গুনগুনের কাছে এসে দাঁড়ালেন। মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্বরে বললেন
-‘কি হয়েছে গুনি? তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? আমাকে বল।দেখবে তোমার বড়বাবা তার কি হাল করে। ‘

-‘কিছু হয়নি বাবা। ‘

জোহরা খানম গুনগুনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,’আমি জানি ও কেন চলে যাচ্ছে। সব দোষ ওয়াসিয়াতের,এবার ওয়াসি আশুক ওকে আমি খুব করে বকে দেব।তবুও তুই যাস না গুনি।’

গুনগুন কে দেখে মনে হল না কথা গুলো সে শুনতে পেয়েছে।সে একবার বাচ্চাদের দিকে তাকালো।ইরিনা তার বা-কাঁধে মাথা রেখে স্থির হয়ে শুয়ে আছে, ইরিজা নিজের ডান হাতের কয়েকটা আঙুল মুখে পুড়ে দাদার দিকে তাকিয়ে হাসছে।তার হাত লালায় একেবারে মাখামাখি। সেই হাত দিয়ে মাঝে মাঝে সে তার মায়ের গাল স্পর্শ করছে।গুনগুন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আহসানউল্লাহ সাহেব কে বলল,’যাই বাবা।’
বলে সে আর পেছনে ফিরল না।দৃঢ় পায়ে হেটে চলে গেল। জোহরা খানম অসহায় দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রান্নাঘর থেকে হাড়ি পাতিলের শব্দ ভেসে আসছে,সেলিনা রাধছেন।
গুনগুন বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে আছে। ইরিনা ইরিজা দুজনেই ঘুমে বিভোর।গুনগুন তাদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল । তারও বাচ্চাদের সাথে ঘুমানোর ইচ্ছে ছিল,তাই এই অসময়ে শুয়ে থাকা,অথচ এখন আর চোখে ঘুম আসছে না।নানান চিন্তায় মন অস্থির হয়ে আছে।গুনগুন মনে করতে চেষ্টা করল ঠিক কবে সে এবাড়ি এসেছিল।মনে করতে পাড়ল না।আজকাল সে কোনো হিসাবই সঠিক রাখতে পারে না। কোনদিন কি বার?কত তারিখ? কি মাস? সব ভুলে যাচ্ছে। তবে দু সপ্তাহের বেশি কখনোই হবে না নিশ্চয়ই!
এই দু সপ্তাহে জোহরা খানম প্রতি একদিন অন্তর অন্তর এসেছেন।বাচ্চাদের সাথে খেলে, কথা বলে সময় কাটিয়ে তিনি ফিরে গেছেন। গুনগুন কেন চলে এল বা ফিরে যাচ্ছে না কেন, এ জাতীয় কোন কথাবার্তাই তিনি বলেন নি।এতো নির্বিকার থাকা জোহরা খানমের ধাঁচে নেই।তিনি যে তীব্র অভিমান থেকেই এই মাত্রাতিরিক্ত নির্লিপ্ততা দেখাচ্ছেন সেটা গুনগুনের বুঝতে দেরি হল না।

কিন্তু তার কিইবা করার আছে!
আজকাল সে অনেক কিছুই টের পায়। আড়ালে মানুষের ফিসফিস, কানাকানি। তাকে নিয়ে যে আশেপাশের মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই সেটা তার অজানা নয়।সেই কৌতূহলের বসে বা কৌতূহল মেটাতে মানুষ এখন নানান কথা বের করছে।আড়ালে আবডালে সেসব কথা শাখা প্রশাখা মেলে বিশাল মহীরুহে পরিণত হচ্ছে।
পুরো পাড়া জুড়ে শুরু থেকেই সে আলোচনার প্রধান বিষয়-বস্তু ছিল।বাপ মরা এতিম মেয়ে! সেই মেয়ে কোথায় যায়, কি করে? সেসব নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। তার ওপর এত অল্প বয়সে বিয়ে,সেটাও আবার চাচাতো ভাইয়ের সাথে! বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এখন আবার বিধবা!
কৌতুহল যেন শেষ হচ্ছে না। উনিশ কি কুড়ি বয়সেই বিধবা,তার ওপর দুটো মেয়ে রয়েছে। এই বিংশতি বিধবা কন্যার পুরোটা জীবন এখনো পড়ে রয়েছে। বাকি জীবন সে একা কিভাবে কাটাবে?

গুনগুনের সেসব ভাবনা নেই,
তার কেবলই ভয় হয়।আর কত হারাবে সে?
হারাতে হারাতে আজ সে ভীষণ ক্লান্ত।
যাকেই সে ভালোবাসে তার উপস্থিতিই ধীরে ধীরে ধূসর হতে থাকে। এভাবে মানুষ কিভাবে বাঁচে?

এসব কথা সেলিনার কানে যে আসে না তা নয়। তবে তিনি না শোনার ভান করে থাকেন। প্রতিনিয়তই মানুষ আসছে।ইনিয়ে বিনিয়ে নানান প্রস্তাব দিচ্ছে। কতরকম ইঙ্গিত দিচ্ছে ! সবার মুখ তিনি কিভাবে বন্ধ করবেন।তাছাড়া মানুষ জন তো সবসময় খারাপ কথা বলে না।সত্যিই তো! তার মেয়ের এখন ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই।তিনি আর কদিন বাঁচবেন?
গুঞ্জন থাকে চট্টগ্রাম। সে আসে মাসে-দু’মাসে একবার ।এই মেয়েকে তিনি কার কাছে রেখে যাবেন?

সূর্যের তেজ কমে এসেছে।বিষন্ন বিকেলে সূর্য তার লাল আভা দিয়ে সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে। সেই আভার মহিমায় আকাশ লাল,দিগন্ত লাল!
সেই অসীমে তাকালে মনে হয় কে যেন ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে সেখানে আগুন জ্বেলে দিয়েছে। দাও দাও করে জ্বলছে আকাশ, বাতাস আর মন।
মন! কিন্তু মনও জ্বলে পোড়ে নাকি?
কেন নয়? শ্রাবণের কালো মেঘ দেখে যদি মন বিষাদে ছেয়ে যেতে পারে তবে সূর্যের তাপে জ্বলতে দোষ কোথায়?
এইযে গুনগুনের মন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, শ্রাবণ মেঘের দিনে যেমন বিষন্নতায় ভেসে যেত।তখন এইছাদে এসে সে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো।ঘন কালো মেঘে ঢেকে থাকা আকাশের পানে চেয়ে থাকত।
আজও বসে আছে, তবে আজকের অনুভূতিগুলো পুরনো দিনের অনুভূতির মতো তীক্ষ্ণ নয়।কোথায় যেন সুর নেই।সব সুরই কি হারিয়ে গেছে?
গুনগুন আকাশের পানে তাকাল, অস্থির হয়ে কি যেন খুঁজতে লাগলো !

চলবে…………।
অদ্রিজা আহসান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here