প্রহর শেষে

পর্বঃ৬
শাড়ি পরে কাজ করতে ভীষণ অসুবিধে। গুনগুন শাড়ি পরে এককথায় দৌড়ে দৌড়েই সব কাজ করছে।

সেলিনা হক জোহরা খানম আর লায়লার শাশুড়ী আঞ্জুমান একসাথে বসে পান খাচ্ছিলেন।
বুয়া কে খুঁজতে খুঁজতে গুনগুন এখানে একবার এলো।বুয়া কে দেখেছে কিনা জিজ্ঞেস করে আবার চলে গেল। পুরোটা সময় আঞ্জুমান চুপ করে তাকে দেখলেন।
সে চলে যেতেই অতন্ত্য উৎসাহ নিয়ে তিনি বললেন –
” দেখেছেন জোহরা ভাবি, গুনগুনকে শাড়ি পরে কি সুন্দর লাগছে দেখেছেন!ওর ও এবার বিয়ে দিতে হবে।
আমাদের আহমেদের সেই ছোট্ট মেয়েটা কত বড় হয়ে গেল।”

তার কথা শুনে জোহরা হেসে ফেললেন। কিন্তু সেলিনার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। যেটা জোহরা খানমের নজর এড়ালো না।তিনি জানেন আজও আহমেদের নাম শুনলে পুরনো সেই দিনগুলোর মতো সেলিনার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।

ওয়াসিয়াত এইদিক টায় এসেছিল লাইটিং ঠিক-ঠাক ভাবে করা হচ্ছে কিনা দেখতে। আঞ্জুমানের কথা তার কানেও এলো। তারপর মনে পড়লো দুপুরের পর গুনগুনের সাথে একবারও দেখা হয় নি। এইমাত্র গুনগুন যখন বুয়াকে খুঁজতে এলো তখনো সে তাকে দেখেনি নজর লাইটিং এর দিকে ছিল বলে। ভেবেই তার মনে হলো গুনগুনকে আবার দেখার কি আছে! একবার না একবার দেখা তো হয়েই যাবে।

বিকেলের লাল সূর্য ডুবে তখন সন্ধ্যা নামছে। সারাদিন এর ওর আপ্যায়ন করতে করতে গুনগুন ক্লান্ত। একটু বসার সুযোগও তার হচ্ছে না।ক্লান্তি নিয়ে ডাইনিং এ গিয়ে চেয়ার টেনে একটু বসতেই কোথা থেকে শাহানা উড়ে এলেন। এসে বললেন ছাদ থেকে ফুলের ঝুড়িটা নিয়ে আসতে।

গুনগুন ক্লান্ত ভাবে তাকালো।তার চোখ বলছে-“আমি আর পারছি না।”
শাহানা সেই দিকে নজর দিলেন না।গুনগুন চেয়ার ছেড়ে উঠে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। দু’হাতে শাড়ি ধরে সে ছাদের দিকে ছুটলো।

দরজার খট করে একটা শব্দ হতেই ওয়াসিয়াত পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো লাল রঙা জামদানী পড়নে একটা মেয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে।
এখান থেকে শুধু তার পেছন টাই দেখা যাচ্ছে। ওয়াসিয়াত বললো -“কে? ”

-“আমি। “বলে গুনগুন পেছন ফিরে তাকালো।বললো-
“দেখ না ওয়াসি ভাই, ফুলের ঝুড়িটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ওদিকে শাহানা খালা অপেক্ষা করছেন।”

ওয়াসিয়াত চোখের ইশারায় ছাদের শেষ মাথা দেখিয়ে বললো -“ওদিকে আছে ।”
গুনগুন দ্রুত হেটে সেদিকে গেল।

ওয়াসিয়াত ঘুরে সেখান থেকে চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে তাকালো। সন্ধ্যা নেমে এসেছে । পশ্চিম আকাশে সূর্যের লাল আভাটা এখনো আছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সেখানে লাল শাড়ী পরনে একটা মেয়ে গুটি গুটি পায়ে হেটে বেড়াচ্ছে।তাকে দেখাচ্ছে লাল পরির মতোন। চারিদিকে তাজা ফুলের গন্ধ।সেই লাল পরির মতো মেয়েটিকে কোনভাবেই আজ আর ছোট বলে মনে হচ্ছে না।
হাল্কা ঘেমে যাওয়া মুখে মুক্তোর ঝিলিক। দুই গাল লাল বর্ণ ধারন করেছে।সেইসাথে লাল শাড়ীর জন্য তার পুরো মুখেই ঈষৎ লাল আভা ফুটে উঠেছে।
ওয়াসিয়াত তাকিয়ে রইল।

গুনগুন ফুলের ঝুড়ি নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।তার চেহারায় কিসের যেন মাদকতা।
সে বললো -” তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ”
ওয়াসিয়াত তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল।নিজের অসস্থি ঢাকার জন্য আশেপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললো -“এখনে লাইটিং ঠিক ভাবে করা হচ্ছে কিনা তাই দেখছি।তুমি নিচে যাও।”

গুনগুন চলে গেল। ওয়াসিয়াতের কেন যেন খারাপ লাগলো। সে কি চাইছিল গুনগুন আরও কিছুক্ষণ থাকুক?

গুনগুনের মেজাজ প্রচন্ড গরম হয়ে আছে।জোহরা খানম ঘণ্টাখানিক আগে তাকে ডেকে বললেন
-“গুনগুন, মা তোমার বড় আব্বু আর মামাদের জন্য মিনা কে চা বসাতে বল।পারলে তুমি নিজেও ওর সাথে একটু থাকো।”

সেই শুনে, সে রান্নাঘরে এলো। এসে দেখে মিনা সবার জন্য নাস্তা বানিয়ে কাহিল।এই অবস্থায় তাকে নতুন করে ফরমায়েশ দিতে তার মন চাইল না। তাই সে নিজেই চা করে নিয়ে এলো। তা দেখে বাকিরাও চা’ চা’করে উঠলো।সেই শুরু,তার পর থেকে এখন পর্যন্ত বসার ঘর থেকে রান্নাঘর আর রান্নাঘর থেকে বসার ঘর, তাকে দৌড়াতেই হচ্ছে। আবার প্রতিবার চায়ের সাথে টা’ও দিতে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর আর কেউ বাকি নেই ভেবে সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো তক্ষুনি কোথা থেকে ওয়াসিয়াত হুট করে সামনে এসে দাঁড়ালো।
প্রকৃত পক্ষে সে যতটা ক্লান্ত নিজেকে তার চেয়েও বেশি দুর্বল দেখিয়ে সে বললো -“তাড়াতাড়ি চা দাও গুনগুন,আমি খুব টায়ার্ড।”

সেদিকে তাকিয়ে গুনগুন ভেঙচি কাটলো। মনে মনে তার জানাই আছে এই ছেলে কি রাজকার্য করে এসেছে।
সে রান্নাঘরের দিকে ফিরে যেতেই ওয়াসিয়াত আবার বললো -“আর শোনো লেমনেডও দেবে ।”

কোমড়ে হাত রেখে গুনগুন বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে বললো -“চা,লেমনেড তুমি কি দুটোই একসাথে খাবে? ”

-“হু,প্রচন্ড গরম লাগছে। জলদি দাও।”
তাছাড়া আমি না খেলেও তোমাকে চা করতে হবে। কারণ বাইরে ছোট খালা আর একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন। তোমাকে চা নিয়ে যেতে বলা হয়েছে”।বলেই সে মিটি-মিটি হাসলো।

গুনগুন মুখে একটা বিরক্তি সূচক শব্দ করে চলে এলো।
চা বসিয়ে সে লেমনেড বানালো। শাড়ি পরে তার অভ্যাস নেই।নিজের দিকে চেয়ে দেখলো শাড়ির বেহাল দশা।মনে হলো একটানে খুলে ছুড়ে ফেলে দিতে পারলে সে যেন বাঁচে।নিজেকে সামলে কোনো মতো শাড়িটা ঠিক করে সে চা নাস্তা সাজিয়ে ট্রে হাতে নিল।

তাকে দেখে লেমনেডে চুমুক দিতে দিতে ওয়াসিয়াত বললো –
“তোমার ঢং দেখে তো মনে হচ্ছে তোমাকে দেখতে এসেছে। আর তুমি খাবার নিয়ে তাদের সামনে যাচ্ছো।”
বলেই সে হো হো করে হেসে উঠল।মিনাও সেই হাসিতে যোগ দিল।
এমন কথা শুনে গুনগুন একটু লজ্জা পেল।সে আর মুখ তুললো না, তাড়াতাড়ি হেটে চলে গেল। তার পেছন পেছন ওয়াসিয়াতও বেরিয়ে এলো। ড্রয়িং রুমের এক কোনায় চেয়ারে হেলান দিয়ে সে বসলো। তার একহাতে ফোন অন্য হাতে চা।

শাহানার পাশে বসে থাকা মহিলাটি বেশ অনেকক্ষণ ধরেই গুনগুনকে লক্ষ্য করছেন। এবার তিনি বললেন -“তোমার নাম কি মা?”

-“জী, আমার নাম গুনগুন, মিফতাহুল মীর্জা গুনগুন। ”

-“বাহ, খুব সুন্দর নাম। ”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গুনগুন হালকা হেসে সেখান থেকে উঠে চলে এলো ।তারপর সিড়ি বেয়ে সোজা উপরে উঠে গেল।

মহিলাটি সিড়ির দিক থেকে চোখ সড়িয়ে শাহানার দিকে তাকালেন। জানতে চাইলেন মেয়েটি কে?
শাহানা বরাবরই একটু বোকা ধরনের। সে খুব উৎফুল্ল হয়ে বললো –
“আরে ওতো আপার ছোট জা’এর মেয়ে। খুব কাজের মেয়ে বুঝলেন। বয়স কম তবুও দেখুন কীভাবে সব কাজ করছে। ”

ভদ্রমহিলা খুটিয়ে খুটিয়ে আরও নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন।

ওয়াসিয়াত না দেখেও বুঝতে পেরেছিল গুনগুন ওপরে গেছে। সে সবই শুনছিল তবে পাত্তা দিচ্ছিলো না।
এবার ভদ্রমহিলা বললেন -“ওর মা কোথায়?”
শাহানা কৌতুহলি হয়ে জানতে চাইল।
-“কেন?”

-“নাহ, এমনি কথা বলতাম আরকি। ”

সেই সময় সেলিনাও সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন।শাহানা তাকে দেখে ডেকে বসালো। নানান কথা বার্তা হলো।।

একপর্যায়ে ভদ্রমহিলা বললেন -“আপনার মেয়েটা খুব মিষ্টি।ও কোথায়? এখানে আসুক। কথা বলি।”

শাহানা হুট করে বলে বসলো
-“এখানে নয়,আপনারা বরং আপার ঘরে চলুন। ”

ভদ্রমহিলা বললেন -“সেই ভালো,আপনি তাহলে ওকে সেখানেই নিয়ে আসুন। ”

ওয়াসিয়াত ফোনের দিকে তাকিয়েই কান খাড়া করে সবটা শুনলো।তার কাছে কিছু একটা ঠিক লাগছে না । সে চুপচাপ সেখান থেকে উঠে ওপরে চলে এলো। এসে গুনগুনকে খুঁজতে লাগলো।

গুনগুন মাথা নিচু করে শাড়ি ঠিক করতে করতে হেটে যাচ্ছিল।ওয়াসিয়াত গুনগুনকে দেখে কাছে গিয়ে দাড়াঁলো। বললো -“তুমি এখানে, তোমাকে সেই কখন থেকে খুঁজে চলেছি। তাড়াতাড়ি চিলেকোঠার ঘরে যাও।সেখান থেকে কাঠের চেয়ারটা নিয়ে এসো। ”

গুনগুন অবাক হয়ে বললো -“কেন? আর কেই বা বললো? ”

ওয়াসিয়াত মেঘের মতো গুরুগম্ভীর স্বরে বললো -“তুমি যাবে কিনা?
নাহয় পরে কেউ কিছু বললে আমি দায় নেব না।”

ওয়াসিয়াত পাছে আরও রেগে যায় তাই গুনগুন আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে হেটে ছাদে চিলেকোঠার ঘরে চলে গেল।

চিলেকোঠার ঘরটা ভীষণ অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর পরও ঘরটা পুরো আলো হলো না।আধার যেন এখানে জমাট বেঁধে আছে।

গুনগুন কাঠের চেয়ারটা খুঁজছিল। ঠিক সেই সময় চিলেকোঠার দরজায় অস্পষ্ট একটা শব্দ শোনা গেল। সে দৌড়ে দরজার কাছে এসে দেখলো বাইরে থেকে দরজাটা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে। গুনগুনের আত্মা ধক করে উঠল।সে জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না।

গুনগুন মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে একবার দেখলো। ঘরের ভেতর প্রচুর জিনিসপত্র রাখার ফলে কিছু কিছু জায়গা একেবারে অন্ধকার হয়ে আছে। হটাৎ করে তার খুব ভয় হতে লাগলো।
বাড়ি ভর্তি লোকজন। সকলেই ব্যস্ত। এখন যদি কেউ তাকে খুঁজতে না আসে,তাহলে কি হবে? তাকে তো এখানেই সারাজীবন থাকতে হবে।গুনগুন আবার ভাবলো সে এখানে থাকবে কি করে।দু’দিন পরই তো না খেতে পেয়ে সে মরে যাবে। এসব ভাবনা মনে আসতেই তার কান্না পেল, ভীষণ কান্না।একেবারে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কান্না।কাঁদবে না কাঁদবে না করে সে কেঁদে ফেললো। দরজার পাশেই হেলান দিয়ে বসে সে কাঁদতে লাগলো।

চলবে…………..

অদ্রিজা আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here