প্রহর শেষে
পর্বঃ৪
কিছুদিন যাবৎ একটা বিষয় নিয়ে ওয়াসিয়াত খুব উসখুস করছে। কিন্তু কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।সাধারণত কোনো বিষয়ে দ্বিধায় পড়লে সবার আগে সে গুনগুন কেই জানায়।তবে এবারের ব্যপার টা একটু ভিন্ন।তাই গুনগুন কে জানাবে কিনা বুঝতে পারছে না।
অবশেষে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে সে গুনগুনের কাছেই যাবে বলে ঠিক করলো।
গুনগুন জানালার ঠিক পাশেই ছোট আরামকেদারায় বসে ছিল। রান্নাঘরে হাড়ি পাতিলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকালো। বাইরে এখন আর বৃষ্টি নেই। বৃষ্টিটা থেমেছে কিছুক্ষণ আগেই। আকাশে মেঘ সরে গেছে, সেই স্থানে এখন ঝকঝকে সূর্যের আলো।
-“চা খাবি?”
গুনগুন চমকে পেছন ফিরে তাকালো। সেলিনা হক দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।এমন আবহাওয়ার চা পেলে মন্দ হয় না। সে বললো -“দাও”।
সেলিনা আবার রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।বসে থাকতে থাকতে হটাৎ করে কিছু একটা মনে হতেই গুনগুন তাড়াতাড়ি উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল।সেলিনা সবে মগ টা হাতে নিয়েছেন চা ঢালবেন বলে।গুনগুন কাছে এসে দাঁড়ালো। ইতস্তত করে বললো –
“দাও,কাপ টা আরেকবার ধুয়ে দেই।”
কাপ টা দিয়ে সেলিনা হক কঠিন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।গুনগুন সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে বারবার কাপ টাকে ধুয়ে মনের অসস্থি দূর করলো। তারপর নিজেই চা ঢেলে নিয়ে চলে গেল। সেলিনা হক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। আজকাল আর এসব বিষয় নিয়ে তিনি চেচাঁমেচি করেন না। প্রতিনিয়ত একই বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে তার ভালো লাগে না।তিনি চিন্তায় পড়লেন , মেয়েটার এই শুচিবায়ু রোগ কিছুতেই কমছে না।বরং দিন দিন তার এই সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
কেউ একজন দরজায় কড়া নাড়ছে।সেলিনা হক এগোলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলে বাইরে ওয়াসিয়াত কে দেখেই তার মন ভালো হয়ে গেল। কোনো এক অজানা কারনে তিনি ওয়াসিয়াত কে খুব পছন্দ করেন। বাড়িতে কোনো ভালো রান্না হলেই তিনি গুনগুনের হাত দিয়ে ওয়াসিয়াতের জন্য পাঠিয়ে দেন । নিয়মিত একাজ করার ফলে গুনগুন কে এখন আর কিছু বলতে হয় না।সে নিজেই বলে -“জানি এখন তুমি কি বলবে।
বলবে -“গুনগুন, ওয়াসিয়াত তো এই পিঠা খুব পছন্দ করে।ওকে নাহয় দুটো পিঠা দিয়ে আয়”।
মেয়ের কথা শুনে তিনি তখন হেসে ফেলেন।
সেলিনা হক ওয়াসিয়াত কে ভেতরে এসে বসতে বললেন। সে ভদ্রতা সূচক হেসে বসলো ।
-“তুমি বসো। আমি চা করে আনছি।
ওয়াসিয়াত মাথা নেড়ে একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলো -“চাচী গুনগুন নেই?”
-“আছে তো,কিছুক্ষণ আগেই দেখলাম ছাদে গেল।”
বলে তিনি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। ওয়াসিয়াত আর অপেক্ষা না করে সরু লোহার সিড়ি বেয়ে সোজা ছাদে উঠে গেল।
তখন মধ্যদুপুর। সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে।রোদের তেজটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। গুনগুন ছাদের দেয়াল ঘেঁষে হাটু মুড়ে খালি পায়ে বসে আছে। এই দিক’টায় রোদ কম।ছাদ ঘেঁষেই বিশাল এক আম গাছ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কিছু ডাল- পালা ছাদেও এসে পড়েছে। মাঝে মাঝে হালকা বাতাসে ডাল গুলো তার গা ছুয়ে যাচ্ছে।সেই আম গাছের ডালে বসে একটা ইষ্টিকুটুম অনবরত ডেকে চলেছে।
-“গুনগুন “।
হুট করে ওয়াসিয়াত ডেকে ওঠায় গুনগুন একটু চমকে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। দাঁড়াতেই তীব্র আলো তার চোখে লেগে ক্রমশ তার চোখ জোড়া ছোট হয়ে এলো। সে সরু চোখে তাকালো। ওয়াসিয়াত কে কেমন যেন এলোমেলো দেখাচ্ছে । তার অস্থিরতা গুনগুনের নজর এড়ালো না।
-” কি ব্যপার, কোনো সমস্যা? ”
ওয়াসিয়াত অস্থির ভাবে ডানে-বামে মাথা নেড়ে হেসে বললো -“অনেক কাহিনি আছে। চা টা নিয়ে এসো, তারপর বলছি।”
তার কথায় কেমন যেন রহস্য। আর কিছু না বলে গুনগুন তাকে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। সূর্যের তাপে লোহার সিড়িটা প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। সে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। কি এমন কথা , জানবার জন্য গুনগুন অধির হয়ে উঠেছে।
তাদের কথার বিষয়বস্তু গুলো সবসময়ই খুব ইনট্রেসটিং হয়।আজও নিশ্চয়ই ওয়াসিয়াত খুব মজার কোনো কাহিনী বলবে। রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি বসানো দেখে গুনগুন নিজেই চা করলো।
তারপর চা নিয়ে সাবধানে সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। চা থেকে আদা,তুলসী,লেবুর সুঘ্রাণ আসছে। মন ভালো থাকলে গুনগুন এভাবে চা বানায়।
ছাদের মাঝ বরাবর থাকা ছোট টেবিলে চা রেখে মুচকি হেসে সে বললো -“এবার বলো তোমার সেই কাহিনী “।
ওয়াসিয়াত চায়ে চুমুক দিয়ে বললো-” শোনো, তোমাকেই প্রথম বলছি কিন্তু। কাউকে বলা চলবে না,ঠিক আছে? ”
গুনগুন উৎফুল্ল হয়ে বললো-
“কাউকে বলবো না।”
ওয়াসিয়াত কিছু না বলে হাসলো। তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ছবি গুনগুনের সামনে ধরলো। গুনগুন ফোন টা তার হাত থেকে নিয়ে ভালো করে ছবিটার দিকে তাকালো। সেখানে একটি মেয়ের ছবি দেখা যাচ্ছে । কাটা কাটা নাক-মুখ, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল।লম্বা চুল গুলো কাঁধের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে কাঁধটা ঢেকে রেখেছে। মাথায় গাঁদা আর গোলাপ ফুলের তৈরি ক্রাউন।সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় মেয়েটি খুব সুন্দরী।এতো পরিপাটি আর সুন্দর মেয়েকে দেখে গুনগুনের একটু ইর্ষা হলো। সে খুটিয়ে খুটিয়ে মেয়েটাকে দেখছিল। ওয়াসিয়াত চট করে ফোন টা তার হাত থেকে নিয়ে নিতেই তার হুশ হলো।
ওয়াসিয়াত রহস্য করে হেসে বললো -“কেমন?”
গুনগুন মৃদু হেসে বললো -“দেখতে তো ভারি সুন্দর, কিন্তু মেয়েটা কে?”
উত্তর না দিয়ে ওয়াসিয়াত শুধু হাসলো। তাকে দেখে মনে হলো সে লজ্জা পাচ্ছে।
তার মুখভঙ্গি দেখে সন্ধিহান হয়ে গুনগুন বললো -“আরে বাবা, বলনা মেয়েটা কে?”
ওয়াসিয়াত মাথা চুলকে খানিকটা ইতস্তত করে বললো -“ইয়ে….ওর নাম অরিন।তোমাদের স্কুল থেকেই এসএসসি দিয়েছে । তুমি চেনো ওকে? ”
-“চিনি না।তারপর ???”।
-“গুনি….সে নাকি আমাকে পছন্দ করে। ”
গুনগুন উত্তেজিত হয়ে বললো -“কি!সিরিয়াসলি?”
-“কেন, মিথ্যা মনে হচ্ছে? ”
গুনগুন হেসে বললো -“না,ঠিক তা না”।।
-“তুমি চেনো ওকে? ”
-“উহু, যাইহোক আগে বলো সে তোমাকে পছন্দ করে তা তুমি কিভাবে বুজলে? “।
-” আর বলো না,সে অনেক কাহিনী। প্রথমে রাফি বললো। তারপর সে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল।মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে এক্সেপ্ট করলাম। এরপর মাঝে মাঝে কথা হতো।”
গুনগুনের মুখের হাসি আরও প্রসারিত হলো। সে বললো -“বাহ! এতো দূর।যাইহোক এখন শুধু কি সে পছন্দ করে নাকি তুমিও? ”
প্রশ্ন টা সে করতে চাইছিল না।তবুও মনের দ্বিধা দূর করতে করে ফেললো। উত্তর টা ‘হ্যাঁ’ হোক এটা সে চাইছে না।কেন চাইছে না সে জানে না।মনে মনে ‘না’ শোনার জন্য সে আকুল হয়ে আছে। মুখে তার তখনো হাসি লেগে আছে ঠিকই,তবে ভেতর ভেতর কেমন যেন ভয় হচ্ছে।
ওয়াসিয়াত বললো -“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কি করা উচিত বলো তো?এমনিতে তাকে খুব একটা খারাপ লাগে না।”
গুনগুন বিষ্মিত হয়ে ওয়াসিয়াতের দিকে তাকিয়ে রইল। আর অবাক চোখে জীবনে প্রথম বারের মতো ওয়াসিয়াত কে এতটা লজ্জা পেতে দেখলো।হুট করেই তার বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এসব জেনে তো তার খুশি হওয়ার কথা । তবু্ও কেন যেন সে খুশি হতে পাড়ছে না।সে মুখ টাকে অনেক কষ্টে হাসি-হাসি রেখে বললো-
“বাহ!এটা তো খুব ভালো কথা। এর মানে তুমিও পছন্দ করো।এতো কিছু হয়ে গেল আমার ট্রিট কই হু।কবে ট্রিট দিচ্ছ বলো?”।
ওয়াসিয়াত হাসতে হাসতে অন্য দিকে তাকালো। বললো-“তুমি কিন্তু খুব বেশিই সিরিয়াসলি নিচ্ছ।।ট্রিট দেওয়ার মতো এখনো কিছুই হয়নি। খুব বেশি কথা হয় না আমাদের। আমি আসলে এখনো ঠিক সিওর হতে পারছি না। ”
তারপর কিছুটা থেমে বললো -” কিছু একটা ঠিক লাগছে না।”
গুনগুন চুপ রইল। ওয়াসিয়াত চেয়ারটা টেনে গুনগুনের একটু কাছাকাছি এনে বসলো। বললো-
“গুনগুন,শুধু তোমাকেই জানালাম। আর কেউ যেন জানতে না পারে।”।
-” তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।তবে আমার কিন্তু সব আপডেট চাই।নইলে কেউ কেউ জেনে যেতেও পারে।” বলে সে মুচকি হাসলো।
ওয়াসিয়াত খুব সিরিয়াস হয়ে বললো -“খবরদার না।”
-“তাহলে তুমিও আমাকে জানাতে ভুল করো না। ”
ওয়াসিয়াত মাথা নেড়ে হেসে বললো -“হুম, আমি গেলাম। ”
গুনগুন এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থেকে বললো -“যাও”
ধীরে ধীরে সে পেছন ফিরে চাইলো।তারপর সিড়ির দিকে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ ওয়াসিয়াত কে দেখা যায়। ওয়াসিয়াত চলে যাওয়ার পর সে মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আগে তাদের খাওয়া এঁটো চায়ের কাপের দিকে চোখ রাখলো।
আজ তার মনটা ভীষণ ভালো ছিল। এখন আর ভালো নেই। সবকিছু ভীষণ বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন? খারাপ লাগার মতো কি কিছু ঘটেছে?
নাহ! কিছুই তো ঘটেনি। তাহলে কেন?সে কি তাহলে……
নিজের ভাবনার জন্য গুনগুন লজ্জিত হলো। দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো। সে ভাবতে পারছে না, ভাবতে চায়ও না।
চলবে…………
লেখিকাঃঅদ্রিজা আহসান